দিল্লির রাজনীতি-দুর্নীতি, ভূমি ও মাওবাদী আন্দোলন by সোহরাব হাসান
এই মুহূর্তে ভারতের সামনে তিনটি প্রধান সমস্যা হলো—দুর্নীতি, ভূমি ও মাওবাদী আন্দোলন। আপাতদৃষ্টিতে তিনটি পৃথক সমস্যা হলেও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। দুর্নীতি বৈষম্য বাড়ায় আর সেই বৈষম্যের বঞ্চনা নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করে। উন্নয়নের নামে গরিবের ভূমি জবরদখল হয়ে যায়।
দিল্লির রাজদরবারে এখন রাজনৈতিক দুর্নীতির বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্য হলো, এখানে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের কেউ দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন না। অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। ভারতে দুর্নীতিবাজদের হাতেনাতে ধরা হচ্ছে, দুর্নীতির দায়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জেল খাটছেন, ক্ষমতাসীন দলের সাংসদকে গুরুত্বপূর্ণ পদ হারাতে হচ্ছে। দুর্নীতি নিয়ে লোকসভায় বিতর্ক হচ্ছে, বিরোধী দল বেশ কিছুদিনের জন্য সংসদ অচল করে রেখেছিল। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও অকপটে ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন। দুর্নীতির কথা স্বীকার করলেই এর বিরুদ্ধে লড়াই করার তাগিদ অনুভূত হয়।
ভারতে দুর্নীতির চালচিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাবেক আমলা এবং দেশটির তিন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে মন্ত্রিপরিষদ-সচিবের দায়িত্ব পালনকারী টি এস আর সুব্রামনিয়াম বলেছেন, ‘দুর্নীতির রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা প্রশাসনে শিকড় গেড়েছে। তিন দশক আগে নিম্নপর্যায়ে ছোটখাটো দুর্নীতি ছিল। এখন তা সহজেই উচ্চপর্যায়ে চোখে পড়বে। একইভাবে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন জানে কীভাবে চুক্তি ভাগিয়ে নিতে হয়।’
কথাগুলো বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি সত্য।
ভারতে রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে যে মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি হয়, তার প্রমাণ কমনওয়েলথ ভিলেজ নির্মাণ, টেলিকম খাত কিংবা মহারাষ্ট্রের আবাসন প্রকল্প। তবে দিল্লির একজন প্রবীণ কূটনীতিক এ লেখককে বলেছেন, ‘ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং উন্নয়নের অনিবার্য উপসর্গ হয়ে আসে দুর্নীতি। প্রশ্ন হলো এর মাত্রা নিয়ে। যদি সহনীয় মাত্রায় থাকে, এ নিয়ে হইচই হয় না। কিন্তু যখন প্রকল্পের পুরো টাকাই হজম করার চেষ্টা হয়, তখনই গোলমাল দেখা দেয়।’
প্রধান বিরোধী দল বিজেপি বা এনডিএ জোট এখন দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হলেও তাদের আমলে দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে—জানালেন আরেক কূটনীতিক। সে ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন বিশ্বাসযোগ্যতা পায় না। এখনো যেসব রাজ্যে বিজেপি সরকার আছে, সেসব রাজ্যে দুর্নীতি বেশি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সম্প্রতি গান্ধীবাদী নেতা ও সমাজসেবক আন্না হাজারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরকার দাবি মেনে নেওয়ায় তিনি অনশন ভঙ্গ করেছেন। তাঁর দাবি, দুর্নীতি বন্ধে স্বাধীন ন্যায়পাল গঠন করতে হবে, যার কাছে সবাই জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন।
২.
দিল্লিতে এখন কারা ক্ষমতায় আছে, তা দলীয় অফিসে লোকসমাগম এবং গাড়ির সংখ্যা দেখে আন্দাজ করা কঠিন নয়। আকবর রোডে কংগ্রেস অফিস। ১০ মে বিকেল চারটায় পৌঁছে দেখি, ফুটপাতে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালজুড়ে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধীর ছবি। পাশে হকার বিক্রি করছেন দলীয় ঘোষণাপত্র, প্রতীক ও নেতা-নেত্রীদের ছবি। আগেই কথা হয়েছিল দলের অন্যতম মুখপাত্র মনীষ তেওয়ারির সঙ্গে। অভ্যর্থনাকক্ষে তাঁর নাম বললাম। এরপর দর্শনার্থী বইতে নাম-ঠিকানা লিখে মনীষ তেওয়ারির কক্ষে গিয়ে জানলাম, তিনি কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছেন। তাঁকে টেলিফোন করতেই পরদিন আসতে বললেন। পরদিন অবশ্য ঝুঁকি না নিয়ে দৈনিক মিরর টুডের সাংবাদিক কে বেনেডিক্টকে সঙ্গে নিলাম। কংগ্রেসের বিট করেন বলে নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে। চারটায় দলের সংবাদ সম্মেলন।
সেদিন দলের আরেক মুখপাত্র ও রাজ্যসভার সদস্য জয়ন্তী নটরাজন সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন বিজেপির নেতা মুরালি মনোহর যোশীর একটি বিবৃতি নিয়ে। তিনি সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি। কমনওয়েলথ ভিলেজের দুর্নীতি নিয়ে গঠিত কমিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিলেও তা ১১-১০ ভোটে নাকচ হয়ে যায়। যোশীর অভিযোগ, মন্ত্রী ও কংগ্রেসের ক্ষমতাধর নেতারা সদস্যদের প্রভাবিত করেছেন। কংগ্রেসের মুখপাত্র যোশীর বিবৃতির নিন্দা করে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামত অগ্রাহ্য করে তিনি মনগড়া কোনো বিবৃতি দিতে পারেন না। এটি সংসদীয় রীতির বরখেলাপ।
সংবাদ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে আমরা দলের অন্যতম সম্পাদক টম ভেডাক্কানের কক্ষে গেলাম। কথা হলো দিল্লির রাজনীতি নিয়ে। তিনি মনে করেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দলের অবস্থান শক্ত। ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি বা এনডিএ জোটের যে বিপর্যয় ঘটে, এখনো তারা তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
আগের দিন বিজেপির মুখপাত্র নির্মলা সীতারাম অবশ্য এই অভিযোগ স্বীকার করলেন না। তাঁর মতে, ‘গত দুই বছরে দল অনেক গুছিয়ে নিয়েছে। সাংগঠনিক শক্তি সুদৃঢ় হয়েছে। সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্বলতাগুলো আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরছি। একসময় যাঁরা দল ছেড়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আবার ফিরে আসছেন—যশবন্ত সিং, উমা ভারতী প্রমুখ।’ কিন্তু বিজেপির যে দুর্বলতার কথাটি নির্মলা বলেননি তা হলো, তরুণ প্রজন্মকে কাছে টানতে না পারা।
৯ মে লোদি স্ট্রিটে সিডিএনএসের কার্যালয়ে কথা হয় বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার মুচকুন্দ দুবের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘এই মুহূর্তে ভারতের প্রধান সমস্যা মাওবাদী বা নকশাল আন্দোলন। সরকারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাতের বেলা দেশের এক-তৃতীয়াংশ নকশালদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে সমস্যাটি রাজনৈতিক। যেসব কারণে এসব এলাকার মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, সেসব কারণ দূর করতে না পারলে কেবল অস্ত্র দিয়ে মাওবাদীদের দমন করা যাবে না। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটিকে দেখছেন আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে।’ ভারতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও তার সুবিধা গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ পাচ্ছে না। সরকার কৃষির প্রতি নজর না দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কেবল শিল্পকারখানা গড়ে তুলছে। ফলে কৃষিজমির ওপর আগ্রাসন বাড়ছে। ব্যাংকঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে, খাদ্যের জোগান না দিতে পেরে কৃষক আত্মহত্যা করছেন। এটি সুস্থ অর্থনীতির লক্ষণ নয়।
দিল্লিতে ভারতীয় মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সিপিএমের অফিসটি বেশ সাজানো-গোছানো। কথা হলো সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নীলোৎপল বসুর সঙ্গে। ইউপিএ সরকার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, তারা প্রায় সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। সিপিএম যখন কংগ্রেসের সঙ্গে ছিল, দুর্নীতি এতটা বাড়তে পারেনি। ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে বামদের সমর্থন প্রত্যাহার কি সঠিক হয়েছে? তিনি বললেন, ‘সরকার সবকিছু করছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে। আমরা তো যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশমতো চলতে পারি না।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। অন্তত বামদের স্বার্থেই ইউপিএ সরকারের সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর এখন বামদের অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
৩.
আমরা যখন দিল্লিতে, তখনই বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষিত হয়। আলতাফ আলম ও আর এম লোথার বেঞ্চ এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় স্থগিত ঘোষণা করেন। তাঁরা বিস্ময় প্রকাশ করেন, হাইকোর্টের কাছে কোনো পক্ষ ভূমির মালিকানা দাবি না করলেও তাঁরা কী করে তিন পক্ষকে ভাগ করে দিলেন? একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট সেখানে স্থিতাবস্থা রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। বিজেপিসহ হিন্দুবাদী দলগুলো রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। কংগ্রেস ও সিপিআইএম কোনো মন্তব্য করেনি। হাইকোর্টের রায় রাজনৈতিক হলেও বিবদমান তিন পক্ষই তাতে সন্তুষ্ট ছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায় নতুন করে অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ভূমি পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্টকে ডুবিয়েছে। মায়াবতী উত্তর প্রদেশে উন্নয়নের নামে একই কাজ করেছেন। নডায় শিল্পায়নের নামে কয়েকটি গ্রাম অধিগ্রহণ করা হলে কৃষকেরা আন্দোলনে নামেন। তাঁদের দাবি, ভূমির ন্যায্য দাম ও উন্নয়নের হিস্যা দিতে হবে। সেই আন্দোলনে বিরোধী দল অংশ নিলে পুলিশ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে। সংঘর্ষে দুই পুলিশ ও একজন কৃষক মারা যান। এর পরদিন রাহুল গান্ধী এক দলীয় কর্মীর মোটরসাইকেলে চড়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে ঘটনাস্থলে গিয়ে আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। পরে উত্তর রাজ্য পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখে। রাহুল গান্ধী ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক ও লোকসভার সদস্য।
বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আগুন জ্বলে যেত। উত্তর প্রদেশ সরকার বরখাস্ত হতো এবং মুখ্যমন্ত্রীকে জেল খাটতে হতো। কংগ্রেস রাহুলের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করলেও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর বিরুদ্ধে কিছু বলেনি; বরং মায়াবতী কংগ্রেসের এ তৎপরতাকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে প্রচার চালাচ্ছেন।
রাহুল গান্ধীর গণমুখী রাজনীতির এটাই একমাত্র উদাহরণ নয়। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের আমন্ত্রণে যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখনো সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের সঙ্গে খেয়েছেন। বনেদি পরিবারের সন্তান রাহুল জনগণের কাতারে চলে এলেও আমাদের দেশে প্রথম প্রজন্মে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা রাজনীতিকেরা সব সময় স্যুটেট-বুটেট থাকতে পছন্দ করেন। একজন সাবেক স্পিকারকে দেখলাম, মে মাসের প্রচণ্ড গরমে বিমানবন্দরে ঠা-ঠা রোদে দলীয় নেত্রীকে বিদায় জানাচ্ছেন থ্রিপিস ও টাই পরে। এটাই হলো ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতিকদের পার্থক্য।
৪.
ভারতের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী দল কংগ্রেস একক কারও নেতৃত্বে পরিচালিত হয় না। সরকার ও দলে আছেন তিন সুপ্রিমো। সরকার চালান ড. মনমোহন সিং। দল ও ইউপিএ জোটের নেতৃত্ব দেন সোনিয়া গান্ধী। কিন্তু ভেতরে ও বাইরের রাজনীতিটা সামাল দেন প্রণব মুখার্জি। দিল্লির দরবারে তিনি ক্রাইসিস ম্যানেজার বা সংকট মোচনকারী হিসেবে পরিচিত। বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র হয়ে এখন তিনি ১২০ কোটি মানুষের দেশটির অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। দিল্লির রাজনৈতিক মহলে তাঁকে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী ভাবা হয়। মনমোহন সিং প্রশাসনের বাইরে কিছু দেখেন না। তাঁর আনুগত্য সোনিয়া গান্ধীর প্রতি, যিনি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। বাঙালি নেতা জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি সিপিআইএমের গোঁয়ার্তুমির জন্য। আর প্রণব মুখার্জির ভাগ্যে প্রধানমন্ত্রীর শিকা ছিঁড়ছে না—সম্ভবত দলীয় সভানেত্রীর আস্থার অভাবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
ভারতে দুর্নীতির চালচিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাবেক আমলা এবং দেশটির তিন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে মন্ত্রিপরিষদ-সচিবের দায়িত্ব পালনকারী টি এস আর সুব্রামনিয়াম বলেছেন, ‘দুর্নীতির রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা প্রশাসনে শিকড় গেড়েছে। তিন দশক আগে নিম্নপর্যায়ে ছোটখাটো দুর্নীতি ছিল। এখন তা সহজেই উচ্চপর্যায়ে চোখে পড়বে। একইভাবে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন জানে কীভাবে চুক্তি ভাগিয়ে নিতে হয়।’
কথাগুলো বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি সত্য।
ভারতে রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে যে মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি হয়, তার প্রমাণ কমনওয়েলথ ভিলেজ নির্মাণ, টেলিকম খাত কিংবা মহারাষ্ট্রের আবাসন প্রকল্প। তবে দিল্লির একজন প্রবীণ কূটনীতিক এ লেখককে বলেছেন, ‘ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং উন্নয়নের অনিবার্য উপসর্গ হয়ে আসে দুর্নীতি। প্রশ্ন হলো এর মাত্রা নিয়ে। যদি সহনীয় মাত্রায় থাকে, এ নিয়ে হইচই হয় না। কিন্তু যখন প্রকল্পের পুরো টাকাই হজম করার চেষ্টা হয়, তখনই গোলমাল দেখা দেয়।’
প্রধান বিরোধী দল বিজেপি বা এনডিএ জোট এখন দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হলেও তাদের আমলে দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে—জানালেন আরেক কূটনীতিক। সে ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন বিশ্বাসযোগ্যতা পায় না। এখনো যেসব রাজ্যে বিজেপি সরকার আছে, সেসব রাজ্যে দুর্নীতি বেশি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সম্প্রতি গান্ধীবাদী নেতা ও সমাজসেবক আন্না হাজারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরকার দাবি মেনে নেওয়ায় তিনি অনশন ভঙ্গ করেছেন। তাঁর দাবি, দুর্নীতি বন্ধে স্বাধীন ন্যায়পাল গঠন করতে হবে, যার কাছে সবাই জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন।
২.
দিল্লিতে এখন কারা ক্ষমতায় আছে, তা দলীয় অফিসে লোকসমাগম এবং গাড়ির সংখ্যা দেখে আন্দাজ করা কঠিন নয়। আকবর রোডে কংগ্রেস অফিস। ১০ মে বিকেল চারটায় পৌঁছে দেখি, ফুটপাতে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালজুড়ে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধীর ছবি। পাশে হকার বিক্রি করছেন দলীয় ঘোষণাপত্র, প্রতীক ও নেতা-নেত্রীদের ছবি। আগেই কথা হয়েছিল দলের অন্যতম মুখপাত্র মনীষ তেওয়ারির সঙ্গে। অভ্যর্থনাকক্ষে তাঁর নাম বললাম। এরপর দর্শনার্থী বইতে নাম-ঠিকানা লিখে মনীষ তেওয়ারির কক্ষে গিয়ে জানলাম, তিনি কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছেন। তাঁকে টেলিফোন করতেই পরদিন আসতে বললেন। পরদিন অবশ্য ঝুঁকি না নিয়ে দৈনিক মিরর টুডের সাংবাদিক কে বেনেডিক্টকে সঙ্গে নিলাম। কংগ্রেসের বিট করেন বলে নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে। চারটায় দলের সংবাদ সম্মেলন।
সেদিন দলের আরেক মুখপাত্র ও রাজ্যসভার সদস্য জয়ন্তী নটরাজন সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন বিজেপির নেতা মুরালি মনোহর যোশীর একটি বিবৃতি নিয়ে। তিনি সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি। কমনওয়েলথ ভিলেজের দুর্নীতি নিয়ে গঠিত কমিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিলেও তা ১১-১০ ভোটে নাকচ হয়ে যায়। যোশীর অভিযোগ, মন্ত্রী ও কংগ্রেসের ক্ষমতাধর নেতারা সদস্যদের প্রভাবিত করেছেন। কংগ্রেসের মুখপাত্র যোশীর বিবৃতির নিন্দা করে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামত অগ্রাহ্য করে তিনি মনগড়া কোনো বিবৃতি দিতে পারেন না। এটি সংসদীয় রীতির বরখেলাপ।
সংবাদ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে আমরা দলের অন্যতম সম্পাদক টম ভেডাক্কানের কক্ষে গেলাম। কথা হলো দিল্লির রাজনীতি নিয়ে। তিনি মনে করেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দলের অবস্থান শক্ত। ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি বা এনডিএ জোটের যে বিপর্যয় ঘটে, এখনো তারা তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
আগের দিন বিজেপির মুখপাত্র নির্মলা সীতারাম অবশ্য এই অভিযোগ স্বীকার করলেন না। তাঁর মতে, ‘গত দুই বছরে দল অনেক গুছিয়ে নিয়েছে। সাংগঠনিক শক্তি সুদৃঢ় হয়েছে। সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্বলতাগুলো আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরছি। একসময় যাঁরা দল ছেড়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আবার ফিরে আসছেন—যশবন্ত সিং, উমা ভারতী প্রমুখ।’ কিন্তু বিজেপির যে দুর্বলতার কথাটি নির্মলা বলেননি তা হলো, তরুণ প্রজন্মকে কাছে টানতে না পারা।
৯ মে লোদি স্ট্রিটে সিডিএনএসের কার্যালয়ে কথা হয় বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার মুচকুন্দ দুবের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘এই মুহূর্তে ভারতের প্রধান সমস্যা মাওবাদী বা নকশাল আন্দোলন। সরকারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাতের বেলা দেশের এক-তৃতীয়াংশ নকশালদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে সমস্যাটি রাজনৈতিক। যেসব কারণে এসব এলাকার মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, সেসব কারণ দূর করতে না পারলে কেবল অস্ত্র দিয়ে মাওবাদীদের দমন করা যাবে না। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটিকে দেখছেন আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে।’ ভারতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও তার সুবিধা গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ পাচ্ছে না। সরকার কৃষির প্রতি নজর না দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কেবল শিল্পকারখানা গড়ে তুলছে। ফলে কৃষিজমির ওপর আগ্রাসন বাড়ছে। ব্যাংকঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে, খাদ্যের জোগান না দিতে পেরে কৃষক আত্মহত্যা করছেন। এটি সুস্থ অর্থনীতির লক্ষণ নয়।
দিল্লিতে ভারতীয় মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সিপিএমের অফিসটি বেশ সাজানো-গোছানো। কথা হলো সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নীলোৎপল বসুর সঙ্গে। ইউপিএ সরকার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, তারা প্রায় সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। সিপিএম যখন কংগ্রেসের সঙ্গে ছিল, দুর্নীতি এতটা বাড়তে পারেনি। ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে বামদের সমর্থন প্রত্যাহার কি সঠিক হয়েছে? তিনি বললেন, ‘সরকার সবকিছু করছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে। আমরা তো যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশমতো চলতে পারি না।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। অন্তত বামদের স্বার্থেই ইউপিএ সরকারের সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর এখন বামদের অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
৩.
আমরা যখন দিল্লিতে, তখনই বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষিত হয়। আলতাফ আলম ও আর এম লোথার বেঞ্চ এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় স্থগিত ঘোষণা করেন। তাঁরা বিস্ময় প্রকাশ করেন, হাইকোর্টের কাছে কোনো পক্ষ ভূমির মালিকানা দাবি না করলেও তাঁরা কী করে তিন পক্ষকে ভাগ করে দিলেন? একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট সেখানে স্থিতাবস্থা রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। বিজেপিসহ হিন্দুবাদী দলগুলো রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। কংগ্রেস ও সিপিআইএম কোনো মন্তব্য করেনি। হাইকোর্টের রায় রাজনৈতিক হলেও বিবদমান তিন পক্ষই তাতে সন্তুষ্ট ছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায় নতুন করে অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ভূমি পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্টকে ডুবিয়েছে। মায়াবতী উত্তর প্রদেশে উন্নয়নের নামে একই কাজ করেছেন। নডায় শিল্পায়নের নামে কয়েকটি গ্রাম অধিগ্রহণ করা হলে কৃষকেরা আন্দোলনে নামেন। তাঁদের দাবি, ভূমির ন্যায্য দাম ও উন্নয়নের হিস্যা দিতে হবে। সেই আন্দোলনে বিরোধী দল অংশ নিলে পুলিশ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে। সংঘর্ষে দুই পুলিশ ও একজন কৃষক মারা যান। এর পরদিন রাহুল গান্ধী এক দলীয় কর্মীর মোটরসাইকেলে চড়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে ঘটনাস্থলে গিয়ে আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। পরে উত্তর রাজ্য পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখে। রাহুল গান্ধী ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক ও লোকসভার সদস্য।
বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আগুন জ্বলে যেত। উত্তর প্রদেশ সরকার বরখাস্ত হতো এবং মুখ্যমন্ত্রীকে জেল খাটতে হতো। কংগ্রেস রাহুলের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করলেও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর বিরুদ্ধে কিছু বলেনি; বরং মায়াবতী কংগ্রেসের এ তৎপরতাকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে প্রচার চালাচ্ছেন।
রাহুল গান্ধীর গণমুখী রাজনীতির এটাই একমাত্র উদাহরণ নয়। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের আমন্ত্রণে যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখনো সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের সঙ্গে খেয়েছেন। বনেদি পরিবারের সন্তান রাহুল জনগণের কাতারে চলে এলেও আমাদের দেশে প্রথম প্রজন্মে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা রাজনীতিকেরা সব সময় স্যুটেট-বুটেট থাকতে পছন্দ করেন। একজন সাবেক স্পিকারকে দেখলাম, মে মাসের প্রচণ্ড গরমে বিমানবন্দরে ঠা-ঠা রোদে দলীয় নেত্রীকে বিদায় জানাচ্ছেন থ্রিপিস ও টাই পরে। এটাই হলো ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতিকদের পার্থক্য।
৪.
ভারতের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী দল কংগ্রেস একক কারও নেতৃত্বে পরিচালিত হয় না। সরকার ও দলে আছেন তিন সুপ্রিমো। সরকার চালান ড. মনমোহন সিং। দল ও ইউপিএ জোটের নেতৃত্ব দেন সোনিয়া গান্ধী। কিন্তু ভেতরে ও বাইরের রাজনীতিটা সামাল দেন প্রণব মুখার্জি। দিল্লির দরবারে তিনি ক্রাইসিস ম্যানেজার বা সংকট মোচনকারী হিসেবে পরিচিত। বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র হয়ে এখন তিনি ১২০ কোটি মানুষের দেশটির অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। দিল্লির রাজনৈতিক মহলে তাঁকে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী ভাবা হয়। মনমোহন সিং প্রশাসনের বাইরে কিছু দেখেন না। তাঁর আনুগত্য সোনিয়া গান্ধীর প্রতি, যিনি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। বাঙালি নেতা জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি সিপিআইএমের গোঁয়ার্তুমির জন্য। আর প্রণব মুখার্জির ভাগ্যে প্রধানমন্ত্রীর শিকা ছিঁড়ছে না—সম্ভবত দলীয় সভানেত্রীর আস্থার অভাবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments