স্বপ্ন নিরর্থক নয় by মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার

মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে থাকে। স্বপ্ন দেখা সম্পর্কে নানা বিতর্ক থাকলেও স্বপ্নের সত্যতা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তাৎপর্যবহ। স্বপ্নে দৃশ্য কখনও স্পষ্ট বা অস্পষ্ট হয়ে থাকে। আমাদের পার্থিব জীবনের অতীত ঘটনাবলি যেমন মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, তেমনি স্বপ্নেও তার স্মৃতি মনোজগতে কিছুক্ষণের জন্য দাগ কেটে যায়।


ইসলাম স্বপ্নকে কখনও অস্বীকার করেনি, বরং ইসলামে স্বপ্নের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হজরত ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি তাঁর নয়নের মণি ইসমাইলকে কোরবানি দেওয়ার জন্য স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছেন। তিনি এই স্বপ্ন দেখাকে অলীক মনে করেননি। বরং বাস্তবে রূপ দিয়ে স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাস এবং মহান আল্লাহপাকের নির্দেশ পালন করেছিলেন। এ ঘটনাই প্রমাণ করে যে, স্বপ্ন বা খোয়াব বাস্তব সত্য। অবশ্য নবী-পয়গম্বররা যে খোয়াব দেখতেন, তা ওহির সমতুল্য। আমরা হজরত রাসূলে করীম (সা.)-এর হাদিসে তিন রকম স্বপ্নের উল্লেখ দেখতে পাই_ এক. খাবে ছালেহ বা ছাদেক :এই স্বপ্ন সরাসরি আল্লাহর তরফ থেকে সুসংবাদ বা নির্দেশ হিসেবে দৃষ্ট হয়। দুই. রুইয়ায়ে শয়তানি : শয়তানের কারসাজিতে এই স্বপ্ন অবচেতনে দৃশ্যমান হয়। তিন. অমূলক স্বপ্ন : এই স্বপ্ন মানসিক দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগের কারণে ঘুমের ভেতরে দেখা যায়।
স্বপ্ন সম্পর্কে আমাদের প্রিয় নবী করীম (সা.) বলেছেন, মুমিনদের স্বপ্ন বা খোয়াব নবুওয়াতের ছিচলি্লশ ভাগের এক ভাগ। হজরত আনাস বিন মালেক বর্ণনা করেছেন, হজরত রাসূলে পাক (সা.) ইরশাদ করেছেন, নবুওয়াত এবং রেসালাতের ধারা শেষ হয়ে গেছে। আমার পরে পৃথিবীতে আর কোনো নবী বা পয়গম্বরের আগমন ঘটবে না। কিন্তু সুসংবাদ আনয়নকারী স্বপ্ন বা খোয়াব মানুষের জন্য শুভ সংবাদ বয়ে আনবে। হজরত ইবনে ওমর আমাদের প্রিয় নবী পাক (সা.)-এর একটি স্বপ্নের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, হজরত রাসূলে মকবুল (সা.) একবার একটি কালো বর্ণের স্ত্রী লোককে মদিনা থেকে হাজফায় যাওয়ার দৃশ্য দেখেন। ওই স্ত্রী লোকটির মাথার চুল আলুথালু ছিল। হজরত নবী পাক (সা.) এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, মদিনা শরিফ থেকে মহামারী রোগ-শোক হাফসায় চলে গেল। বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক হজরত আল্লামা ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তাঁর সুবিখ্যাত কিমিয়ায়ে সায়াদাত গ্রন্থে মনোজগতের কথা আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, মনের বিপুল মাহাত্ম্য দুটি কারণে_ একটি জ্ঞান, অপরটি তার শক্তি। তিনি বলেছেন, নিদ্রিত অবস্থায় মানুষের জড় ইন্দ্রিয় যখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, তখন তার সূক্ষ্ম জগতের মনোদ্বার খুলে যায়। এই দ্বার দিয়েই সে আমলে মালাকুত অর্থাৎ সূক্ষ্ম জগৎ লওহে মাহফুজের অদৃশ্য জিনিসের জ্ঞান স্বপ্নের মাধ্যমে লাভ করে। এই অবস্থায় ভূত-ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে_ তাও সে সহজে অনুভব করতে পারে। ইমাম গাজ্জালি (রহ.)-এর এই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ খুবই তাৎপর্যবহ। স্বপ্নকে আধুনিক বিজ্ঞানীরা অবচেতন মনের চিন্তা-কল্পনার প্রতিক্রিয়া বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এ বিজ্ঞানীরা অতীন্দ্রিয় বিষয় অস্বীকার করলেও পৃথিবীর অধিকাংশ দার্শনিক, সাধক, নবী-পয়গম্বর, ওলি-আউলিয়াগণ স্বপ্ন বা খোয়াবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। এখানে থিওস ফিস্ট সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি বিশ্বাস এবং ইথার বা জ্যোতি দ্বারা গঠিত জড় দেহের কথা উল্লেখ করা যায়।
ইসলামী শাস্ত্রের অনেক পণ্ডিত, দার্শনিক, ওলি-আউলিয়া, পীর-মোহাদ্দেসগণ স্বপ্নের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য-মন্তব্য রেখেছেন, যেমন_ হজরত আলী (রা.) বলেছেন, মোমেন ব্যক্তির কোনো স্বপ্নের তাবির বা ব্যাখ্যা জানা একান্ত কর্তব্য। হজরত ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, স্বপ্নমাত্রই নিরর্থক নয়। তার কোনো না কোনো তাৎপর্য, উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই থাকে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আনাস (রা.) বলেছেন, স্বপ্ন একটি কল্যাণমূলক দর্শন, হজরত রাসূলে পাক (সা.)-এর মাধ্যমে সংবাদ লাভ করতেন। ইবনে খালদুন বলেছেন, মানুষের মন-মস্তিষ্ক যখন ইন্দ্রিয় থেকে অবসর-বিশ্রাম গ্রহণ করে, তখন সে আত্মিক জগতের দিকে অগ্রসর হয়। তখনকার স্বপ্নই সত্য খোয়াব বা স্বপ্ন বলে বিবেচিত হয়।
 

No comments

Powered by Blogger.