এই দিনে-শিলচর ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর by ফিরোজ আহমেদ
১৯৬১ সালের ১৯ মে। দুপুর দুইটা ৩৫ মিনিট। আসাম পুলিশের গুলি। রক্তে ভেসে গেল শিলচর রেলস্টেশন। ঘটনাস্থলেই শহীদ সাতজন। পরে হাসপাতালে আরও চারজন। মোট ১১ জনের জীবন বলি হয় এ আন্দোলনে।’ এভাবেই ৫০ বছর আগের স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন গণসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক (শিলচর) পরিতোষ পাল চৌধুরী।
সম্প্রতি ঢাকা সফরে এলে আমরা মুখোমুখি হই এই ভাষাসৈনিকের। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। কিন্তু তারুণ্যের দীপ্তি চোখেমুখে। কেমন লাগছে বাংলাদেশ? তিনি বলেন, ‘ভালো। দারুণ! বাঙালির সত্যিকারের ঠিকানা এই বাংলাদেশ।’
আলাপের শুরুতেই এলাকার ভৌগোলিক পরিচয় তুলে ধরেন ভাষাসৈনিক পরিতোষ, ‘বাংলাদেশের সিলেট সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলটির নাম কাছাড়। প্রায় ৫০ লাখ বাঙালির বাস এখানে। এখনো এটি আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। কাছাড় জেলা ভেঙে তিনটি জেলা হয়েছে—কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি। তিন জেলাকে আমরা এক নামে বলি বরাক উপত্যকা। কাছাড়ের প্রধান শহর শিলচর।’
জানতে চাই, কেন আপনাদের ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন করতে হলো? ‘কাছাড় জেলা ঐতিহাসিকভাবে কখনোই আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। উনিশ শতকের শেষের দিকে কাছাড়কে আসামের অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকে আমাদের বঞ্চনার সূত্রপাত। দেশ স্বাধীনের পরও তা অব্যাহত থাকে। আসামের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে শুধু অহমিয়াকে (অসমিয়া) স্বীকৃতি দিয়ে বিল পাস হয় ১৯৬০ সালের ২৪ অক্টোবর। আমরা দাবি তুলি, আসাম রাজ্যের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষারও স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হলে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমরা আন্দোলনের পথ বেছে নিই। গঠন করা হয় কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ। হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জেও গঠিত হয় গণসংগ্রাম পরিষদ।’
সংগ্রাম পরিষদের (শিলচর শাখা) আহ্বায়ক পরিতোষ পাল চৌধুরীর চোখে ফিরে আসে ৫০ বছর আগের স্মৃতি, ‘আমরা সংগঠিত করতে থাকি ছাত্র-জনতাকে। শুরু হয় গ্রামে গ্রামে পদযাত্রা। চলতে থাকে আসাম সরকারের ভাষা বিলের প্রতিবাদ। ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯ মে তিন জেলায় হাজার হাজার মানুষ এই অহিংস আন্দোলনে অংশ নেয়। শিলচর রেলস্টেশনে সেদিনের রেল অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেয় পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। কিন্তু পুলিশ অতর্কিতে লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে আর নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে ১১ জন শহীদ হন।’
১৯ মের ভাষাশহীদেরা হলেন—কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, কানাই লাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, তরণী দেবনাথ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সুনীল সরকার, কুমুদরঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্র দেব ও বীরেন্দ্র সূত্রধর। (সূত্র: ভারতের বাংলা ভাষা সংগ্রাম, কানু আইচ)
বাংলাদেশের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন কি তখন আপনাদের আন্দোলনে কোনো প্রেরণা জুগিয়েছিল? ত্বরিত জবাব পরিতোষের, ‘অবশ্যই। আন্দোলনের বিষয় তো একই। ভাষার আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। আপনাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর আমাদের ওপর অহমিয়া। আপনাদের মতো আমরাও চেয়েছিলাম “অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা” হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। সে সময় আমাদের মতো তরুণদের মধ্যে বায়ান্নর একুশ আদর্শ হিসেবে কাজ করত।’
৫০ বছর পর ১৯ মের তাৎপর্য আসলে কী? জবাবে পরিতোষ, ‘১৯ মের আন্দোলনের ফলে আসামের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বরাক উপত্যকার বৈষম্য দূর হয়নি। এটি দূর করতে হলে কাছাড়ের তিন জেলা নিয়ে ভাষাভিত্তিক নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই এবং অবশ্যই তা হতে হবে ভারতীয় সংবিধানের আলোকে। ভারতে বেশ কিছু কেন্দ্রশাসিত রাজ্য রয়েছে। বরাকও কেন্দ্রশাসিত রাজ্য হতে পারে। আমরা ভৌগোলিকভাবেও আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন। আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে আমাদের শিলচরের দূরত্ব ৩৫০ কিলোমিটারের মতো, যার মধ্যে ৩০০ কিলোমিটারই মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি এলাকা। সড়কপথে এই সামান্য পথ যেতে আমাদের ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা সময় লাগে। সুতরাং ভৌগোলিক কারণেও কাছাড়ের পৃথক সত্তা প্রয়োজন।’
এত ছোট রাজ্য গঠনের প্রয়োজন আছে কি? উত্তরে পরিতোষ, ‘বরাক উপত্যকা মোটেও ছোট নয়। এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার জনসংখ্যা বরাক উপত্যকার চেয়ে কম বা কাছাকাছি। এখানে উল্লেখ করা দরকার, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর “রাজ্য পুনর্গঠন” প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ১৯৪৮ সালে এ অঞ্চলে আলাদা রাজ্যের প্রস্তাব সরকারের বিবেচনাধীন ছিল। মণিপুর, মিজোরাম, কাছাড় ও ত্রিপুরা—এই চার এলাকার সমন্বয়ে “পূর্বাচল” রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ছিল। মণিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরা—ভারত সরকার সবাইকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছে, শুধু আমরা বাদ পড়ে গেছি। বরাকবাসীর জন্য আমরা কি একই মাপকাঠি প্রত্যাশা করতে পারি না?’
৫০ বছর পর এসে কী মনে হয়, যে স্বপ্ন নিয়ে আপনারা বাংলা ভাষার আন্দোলন করেছিলেন, তা কি সফল হয়েছে? পরিতোষের দৃঢ় জবাব, ‘আমাদের দুটি দাবি ছিল। ভাষার দাবি পূরণ হয়েছে। আশা করি, নতুন রাজ্যের বাস্তবতাও সরকার একদিন উপলব্ধি করতে পারবে। তখনই কেবল আমরা সত্যিকার অর্থে ভাষা আন্দোলনের সুফল পাব।’
ফিরোজ আহমেদ
আলাপের শুরুতেই এলাকার ভৌগোলিক পরিচয় তুলে ধরেন ভাষাসৈনিক পরিতোষ, ‘বাংলাদেশের সিলেট সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলটির নাম কাছাড়। প্রায় ৫০ লাখ বাঙালির বাস এখানে। এখনো এটি আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। কাছাড় জেলা ভেঙে তিনটি জেলা হয়েছে—কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি। তিন জেলাকে আমরা এক নামে বলি বরাক উপত্যকা। কাছাড়ের প্রধান শহর শিলচর।’
জানতে চাই, কেন আপনাদের ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন করতে হলো? ‘কাছাড় জেলা ঐতিহাসিকভাবে কখনোই আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। উনিশ শতকের শেষের দিকে কাছাড়কে আসামের অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকে আমাদের বঞ্চনার সূত্রপাত। দেশ স্বাধীনের পরও তা অব্যাহত থাকে। আসামের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে শুধু অহমিয়াকে (অসমিয়া) স্বীকৃতি দিয়ে বিল পাস হয় ১৯৬০ সালের ২৪ অক্টোবর। আমরা দাবি তুলি, আসাম রাজ্যের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষারও স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হলে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমরা আন্দোলনের পথ বেছে নিই। গঠন করা হয় কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ। হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জেও গঠিত হয় গণসংগ্রাম পরিষদ।’
সংগ্রাম পরিষদের (শিলচর শাখা) আহ্বায়ক পরিতোষ পাল চৌধুরীর চোখে ফিরে আসে ৫০ বছর আগের স্মৃতি, ‘আমরা সংগঠিত করতে থাকি ছাত্র-জনতাকে। শুরু হয় গ্রামে গ্রামে পদযাত্রা। চলতে থাকে আসাম সরকারের ভাষা বিলের প্রতিবাদ। ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯ মে তিন জেলায় হাজার হাজার মানুষ এই অহিংস আন্দোলনে অংশ নেয়। শিলচর রেলস্টেশনে সেদিনের রেল অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেয় পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। কিন্তু পুলিশ অতর্কিতে লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে আর নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে ১১ জন শহীদ হন।’
১৯ মের ভাষাশহীদেরা হলেন—কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, কানাই লাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, তরণী দেবনাথ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সুনীল সরকার, কুমুদরঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্র দেব ও বীরেন্দ্র সূত্রধর। (সূত্র: ভারতের বাংলা ভাষা সংগ্রাম, কানু আইচ)
বাংলাদেশের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন কি তখন আপনাদের আন্দোলনে কোনো প্রেরণা জুগিয়েছিল? ত্বরিত জবাব পরিতোষের, ‘অবশ্যই। আন্দোলনের বিষয় তো একই। ভাষার আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। আপনাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর আমাদের ওপর অহমিয়া। আপনাদের মতো আমরাও চেয়েছিলাম “অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা” হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। সে সময় আমাদের মতো তরুণদের মধ্যে বায়ান্নর একুশ আদর্শ হিসেবে কাজ করত।’
৫০ বছর পর ১৯ মের তাৎপর্য আসলে কী? জবাবে পরিতোষ, ‘১৯ মের আন্দোলনের ফলে আসামের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বরাক উপত্যকার বৈষম্য দূর হয়নি। এটি দূর করতে হলে কাছাড়ের তিন জেলা নিয়ে ভাষাভিত্তিক নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই এবং অবশ্যই তা হতে হবে ভারতীয় সংবিধানের আলোকে। ভারতে বেশ কিছু কেন্দ্রশাসিত রাজ্য রয়েছে। বরাকও কেন্দ্রশাসিত রাজ্য হতে পারে। আমরা ভৌগোলিকভাবেও আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন। আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে আমাদের শিলচরের দূরত্ব ৩৫০ কিলোমিটারের মতো, যার মধ্যে ৩০০ কিলোমিটারই মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি এলাকা। সড়কপথে এই সামান্য পথ যেতে আমাদের ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা সময় লাগে। সুতরাং ভৌগোলিক কারণেও কাছাড়ের পৃথক সত্তা প্রয়োজন।’
এত ছোট রাজ্য গঠনের প্রয়োজন আছে কি? উত্তরে পরিতোষ, ‘বরাক উপত্যকা মোটেও ছোট নয়। এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার জনসংখ্যা বরাক উপত্যকার চেয়ে কম বা কাছাকাছি। এখানে উল্লেখ করা দরকার, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর “রাজ্য পুনর্গঠন” প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ১৯৪৮ সালে এ অঞ্চলে আলাদা রাজ্যের প্রস্তাব সরকারের বিবেচনাধীন ছিল। মণিপুর, মিজোরাম, কাছাড় ও ত্রিপুরা—এই চার এলাকার সমন্বয়ে “পূর্বাচল” রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ছিল। মণিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরা—ভারত সরকার সবাইকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছে, শুধু আমরা বাদ পড়ে গেছি। বরাকবাসীর জন্য আমরা কি একই মাপকাঠি প্রত্যাশা করতে পারি না?’
৫০ বছর পর এসে কী মনে হয়, যে স্বপ্ন নিয়ে আপনারা বাংলা ভাষার আন্দোলন করেছিলেন, তা কি সফল হয়েছে? পরিতোষের দৃঢ় জবাব, ‘আমাদের দুটি দাবি ছিল। ভাষার দাবি পূরণ হয়েছে। আশা করি, নতুন রাজ্যের বাস্তবতাও সরকার একদিন উপলব্ধি করতে পারবে। তখনই কেবল আমরা সত্যিকার অর্থে ভাষা আন্দোলনের সুফল পাব।’
ফিরোজ আহমেদ
No comments