কল্পকথার গল্প-ঘামছি গরমে মেজাজ চরমে by আলী হাবিব

উত্তাপ বাড়ছে। বলবেন, সারা বিশ্ব যখন উত্তপ্ত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশেই বা উত্তাপ বাড়বে না কেন? বাংলাদেশ তো আর বিশ্বের বাইরে নয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধেও যখন উত্তাপ ছড়ায়, তখন এই চৈত্র মাসের দাবদাহ তো সইতে হবে, নাকি? তা সইব কেন? সেই কবে থেকে 'মানি না, মানব না', 'চুলোয় যাক নিপাত যাক' বলে রাজপথ কাঁপিয়ে বেড়িয়েছি, এখন চুপচাপ সয়ে যাব


কেন? ওসব কবিতায় হয়। চরম রোমান্টিকতায় লিখে ফেলা যায়, 'ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও।' নীরবে সব সয়ে যাওয়ার দিন শেষ। গরমে ঘাম ছুটে যাচ্ছে, সয়ে যাও! আবদার! তা, ব্যাপারটা যদি কেবলই ঋতু পরিবর্তনজনিত গরম হতো, তা না হয় উপভোগ করা যেত। এখন তো চারদিক থেকে চেপে ধরা হচ্ছে। চেপে চলা, মেপে বলার যুগ তো এটা নয়। কেউ তো এখন চেপে বসে নেই যে মেপে বলতে হবে। তাহলে? কিছু বিষয় আছে একেবারেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে যায়। যেমন, সেদিন ছিল আর্থ আওয়ার। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য বলা হয়েছিল। বলতে গেলে সারা দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পালিত হয়ে গেল আর্থ আওয়ার। ঘটা করে এটা পালন করার প্রয়োজন পড়ল না। কবি লিখেছেন, 'জীবনে যাদের হররোজ রোজা...'। যাদের ঘরে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদু্যুৎ থাকে না, তাদের আর ঘটা করে আর্থ আওয়ার পালন করার কী দরকার?
তার পরও তো বলতেই হবে, বাঙালি হচ্ছে মুক্তিপাগল জাতি। তাই বলে কি 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়' গেয়ে উঠে উদ্বাহু নৃত্য করতে পারব? না, সে উপায় নেই। বাঙালি মধ্যবিত্তের রোগের আকাল নেই। একটা গেলে আরেকটা আসে। সমস্যা ছাড়া থাকাটাও যেন বাঙালির ললাট লিখন নয়। সমস্যার সঙ্গে বাঙালিকে মানিয়ে চলতে হয়। ওই যে কী একটা গান আছে না, 'কলঙ্ক মোর গলার মালা...' - বাঙালির গলার মালা হয়ে আছে সমস্যা। একটা গেলে আরেকটা আসে। এরই ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকা। তবে, বাঙালির গুণ আছে বলতে হবে। যেকোনো সমস্যা হেলায় অবজ্ঞা করার ক্ষমতা রাখে বাঙালি। অন্য কোনো জাতি হলে টেনশনে মিইয়ে যেত। বাঙালি মাথা উঁচু করে বুক ঠুকে চলে। তাই নাকি? মাথা উঁচু করে চলে বাঙালি?
প্রশ্ন শুনে অবাক হওয়ারই কথা। মাথা উঁচু করে চলত। সে তো সেই 'ওয়ান্স আপন এ টাইম'- সে রকমই গল্প। এখন বাঙালি আশায় ভর করে চলে। হবে এবং হচ্ছে- এটাই এখনই বাঙালির মন্ত্র। এই মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে বাঙালি পথ চলছে। বাঙালির একটা অভ্যাস হচ্ছে পেয়েও হারানো। হারিয়ে ফেলে আবার অন্য জায়গায় খোঁজে। হোজ্জা নাসিরুদ্দিনের গল্পটি বোধ হয় বাঙালির ভালো জানা আছে। অন্ধকার বাগানে চাবি হারিয়ে ফেলেন নাসিরুদ্দিন। পরে সেটা খুঁজতে যান আলোকিত ল্যাম্পপোস্টের তলায়। বাগানে চাবি হারিয়ে ল্যাম্পপোস্টের তলায় খুঁজতে গেলেন কেন? কারণ, বাগানে তো অন্ধকার। ওখানে তো আলো নেই। খুঁজে কী হবে? বাঙালিরও আজ সেই দশা। একখানে হারিয়ে আরেক জায়গায় খুঁজে বেড়ায়। এ কথা শুনে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি বাঙালির কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেতে বসেছে? অস্বাভাবিক নয়। কোনো কাণ্ড না ঘটলে তো আর সেখানে জ্ঞান প্রয়োগের কার্যকারণ থাকে না। কাণ্ডই যদি না ঘটে তাহলে জ্ঞান প্রয়োগ করবে কোথায়। জ্ঞান প্রয়োগের বালাই না থাকলে কাণ্ডজ্ঞানের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? কাণ্ডজ্ঞানের প্রশ্ন না উঠলে সেটা লোপ পাচ্ছে কী করে? তার পরও আশা ছাড়তে রাজি নয় বাঙালি। 'কী আশায় বাঁধি খেলাঘর...' - গান গাইছে আর নতুন আশায় বুক বাঁধছে, এবার হবে। বাঙালি ছাড়া এভাবে আশায় আশায় বুক বাঁধতে পারার মতো লোক কমই আছে। আশায় বুক বেঁধে বাঙালি পথে বের হয়। আশায় বুক বেঁধে বাঙালি ঘরে ঢোকে।
আজকাল পথে বের হয়ে সুখ নেই। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের যে দশা, তাতে স্ত্রীর ওপর রাগ করে ঘর ছেড়ে যাওয়ার জো নেই। যাবেন কোথায়? ভাবলেন শহরের এ মাথা ও মাথা ঘুরে দিন কাটিয়ে দেবেন। উপায় নেই। একটা জ্যামে আটকে গেলে দিন কাবার হয়ে যাবে। শহরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে যেতেই তো উদ্ধারের উপায় কী? যাঁরা হেঁটে চলাচল করেন, তাঁদের একটা বাড়তি সুবিধা আছে। চলো মন পথের টানে। 'পথ যদি না শেষ হয়' গাইতে গাইতে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যেখানে ইচ্ছে চলে যান। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। তবে যাওয়ার আগে রাস্তার হিসাব নিয়ে যাওয়া ভালো। আজকাল আবার উন্নয়নের জোয়ার বইছে চারদিকে। কোথায় কোন ফুটপাত কাটা রয়েছে, কোথায় স্যুয়ারেজের কাজ চলছে, সেটা না জেনে পথে বের হলে সব জায়গায় যাওয়া যাবে না। মোটরবাইক হাঁকিয়ে যাঁরা চলেন, ফুটপাতের দখল তাঁরাও নিতে চান। উপায়ও তো নেই। সময়মতো পৌঁছাতে হলে আইন মেনে পথ চলতে গেলে হবে না। নিজেদের গাড়ি হাঁকিয়ে যাঁরা চলেন, তাঁরা আজকাল গলি-ঘুপচি চিনে গেছেন। না চিনে উপায় নেই। যেতে তো হবে। ঢাকার সব প্রধান সড়কের পাশাপাশি এসব থেকে মুক্তির পথ কী? আশা। আশায় বুক বাঁধতে হবে। বাঙালি আশায় বুক বেঁধেছিল। কর্মের মহাযজ্ঞ হবে- এমনটিই আশা করা গিয়েছিল। ঢাকা মহানগরীর এখান থেকে ওখানে যেতে বেশি সময় লাগবে না, এই আশায় থাকতে থাকতে প্রতিদিন একটু একটু করে আয়ু কমে গেল। আমাদের মেট্রোরেল এখনো দূরের স্বপ্ন। কী যেন বলে, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট হবে- হলো না আজও। পথের ক্লান্তি ভুলে কোথাও একটু থিতু হওয়ার উপায় থাকল না। আমাদের প্রতিদিনের শ্রমসময়ের অর্ধেকের বেশি খেয়ে ফেলছে পথ। তাহলে আর পথের ক্লান্তি দূর হবে কেমন করে?
তো পথে যখন এই অবস্থা, তখন পথের ক্লান্তি ভুলতে না হয় ঘরেই বসে থাকা যাক। উদাহরণ তো আমাদের হাতেই আছে। সেই যে নন্দলাল! নন্দলাল হয়ে না হয় ঘরেই বসে থাকি। সেখানেও কি শান্তিতে থাকার উপায় আছে? ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি দুই হাজার মেগাওয়াটে উঠেছে। এপ্রিল-মে মাসে এই ঘাটতি নাকি আরো বাড়বে। তখন কী উপায় হবে কে জানে। নতুন বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি। চাহিদার তুলনায় এটা এখন নিতান্তই অপ্রতুল। কোনোভাবেই আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দেশের অনেক জায়গায় এখন আর বিদ্যুৎ যায় না, আসে। কিছুক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ এসে আবার চলে যায়। একদিক সামাল দিতে গেলে অন্যদিক আলগা হয়ে পড়ে। শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। শহরে বিদ্যুৎ দিতে গেলে গ্রাম থেকে যায় অন্ধকারে। গ্রামে বিদ্যুৎ দিতে গেলে শহরকে অন্ধকারে রাখতে হয়। শহর অন্ধকারে রাখলে সেটা সহজে সবার চোখে পড়ে যায়। কাজেই যা করার তা-ই করা হচ্ছে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। নতুন একটা বাড়ি বানিয়ে যে থাকবেন, তার উপায় নেই। বিদ্যুৎ সংযোগ না পেলে থাকবেন কেমন করে? গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে না। বুঝলাম। সংযোগ যখন দেওয়া হয়েছিল, তখনই বা কী বিবেচনায় দেওয়া হয়েছিল, সে কৈফিয়ত কে দেবে?
ওদিকে বাজার আবার চড়া হতে শুরু করেছে। বাজারে নাকি এক সিন্ডিকেট আছে। সেই সিন্ডিকেট নিজেদের ইচ্ছেমতো বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। ভূত যেমন চোখে দেখা যায় না, এই বাজার সিন্ডিকেটও তেমনি চোখে দেখা যায় না। গরিবের পুষ্টি জোগাত যে ডিম, সেটাও এখন নাগালের বাইরে। মুরগির লেজে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। প্যাকেটের গুঁড়া দুধও গরম হয়ে আছে। যাবেন কোথায়? দাম বাড়ার চমৎকার যুক্তি আছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, গ্যাসের দাম বাড়ছে, পরিবহন খরচ বাড়ছে। জিনিসপত্রের দাম তো বাড়বেই। এর সঙ্গে মানুষের জীবনের দাম যদি বাড়ত।
ঘামছি গরমে। মেজাজ চরমে। তার পরও তো বলতে হচ্ছে, সহ্য ক্ষমতা বাড়ছে বাঙালির। সব সয়ে যাচ্ছে। সয়ে যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে- তার পরও আশায় আছে। স্বপ্ন দেখছে। দিন আসছে। ঋণ আসছে। বাজেট আসছে। ওদিকে ভোট আসছে সিটি করপোরেশনে। আবার নতুন নতুন আশার বাণী শুনব। দিন গুনব। নতুন দিন আসছে।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.