চারদিক-সাটিয়াচড়া-গোড়ান গণহত্যা by শফিউদ্দিন তালুকদার
টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে পাকুল্লা বাসস্ট্যান্ড থেকে ২০০ গজ দূরে ঢাকা-টাঙ্গাইল পাকা রাস্তার দুই পাশেই সাটিয়াচড়া গ্রাম। আর সাটিয়াচড়ার উত্তর-পূর্ব পাশের গ্রামটির নাম গোড়ান। দুটি গ্রামই মির্জাপুর উপজেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালায় সাটিয়াচড়া ও গোড়ান গ্রামে।
১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল ময়মনসিংহ থেকে এসে মুক্তিকামী ইপিআর সদস্যরা বিকেল চারটা থেকেই সাটিয়াচড়ার রাস্তার দুই পাশে অবস্থান নেন। তাঁরা ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তার দুই পাশে বাংকার খুঁড়ে পাকিস্তানি হানাদারদের আগমন প্রতিহত করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ইপিআরদের সব কাজে সহযোগিতা করেন সাটিয়াচড়ার জুমারত আলী দেওয়ান, জাহাঙ্গীর হোসেন মানিক, গোড়ানের নূর উদ্দিন, হাসি মিঞাসহ ৩০-৪০ জন ছাত্র-যুবক ও সুধীজন। টাঙ্গাইল জেলা সংগ্রাম কমিটির নেতারা, বিশেষ করে বদিউজ্জামান খান, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, খন্দকার আসাদুজ্জামান, ফজলুর রহমান খান ফারুক প্রমুখ ইপিআর বাহিনীর এ প্রতিরোধ অভিযান সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত ছিলেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম এ বিষয়ে সার্বক্ষণিকই তৎপর ছিলেন।
২৬ মার্চের পর থেকেই জুমারত আলী দেওয়ানের নেতৃত্বে সাটিয়াচড়া-গোড়ানের ছাত্র-যুবকেরা দেওয়ান জয়নাল আবেদিন শামসুল, এখলাস উদ্দিন তারা খলিফা, এস এম আমান উল্লাহ শুকুর, হাবিবুর রহমান মধু, সাদেক হোসেন তালুকদার, আবদুল হামিদ চৌধুরী, চান মিঞা প্রমুখের লাইসেন্সধারী বন্দুক সংগ্রহ করে রাতের বেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগমন প্রতিরোধ করার জন্য রাস্তা পাহারা দিতেন। দিনের বেলায় চলত অস্ত্র প্রশিক্ষণের মহড়া।
ইপিআর বাহিনীর সেনারা পাঁচটি ট্রেঞ্চ কেটে তার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পথের দুই ধারে ঝোপঝাড়ের আড়ালে রাইফেলধারী ছাত্র ও যুবকেরা পজিশন নিয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার সেনারা এর আভাসটুকুও টের পায়নি। তারা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসছিল। এখানে যে কোনো ভয়ের কারণ আছে, তা তারা ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীকে চমকে দিয়ে কতগুলো এলএমজি ও রাইফেল গর্জে ওঠে। বৃষ্টির মতো গুলির আঘাতে অপ্রস্তুত পাকিস্তানি সেনারা ধরাশায়ী হতে থাকে।
বাংকারগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জেনে নেওয়া দরকার। সাটিয়াচড়া গ্রামের বুক চিরে যাওয়া ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তার দক্ষিণ পাশে করিম বখশের বাড়ির পূর্বকোনা ঘেঁষে তালগাছের আড়ালে ছয়টি বাংকার। (বাংকারের স্থানে বর্তমানে আলম, বাবা শুকুর মাহমুদের বসতবাড়ি) শণক্ষেতের মাঝে দুটি বাংকার খুঁড়ে ইপিআর জওয়ানেরা অবস্থান নেন। (বর্তমানে নায়েব আলী, শফিউদ্দিন ও আক্কেল আলীর বংশধরদের ভোগদখল করা আবাদি জমি)
ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তার উত্তরে জঙ্গলের পাশে চারটি। সেখান থেকে প্রায় ১৫০ গজ উত্তর দিকে পরিত্যক্ত বাড়ি নারকেল গাছের আড়ালে চারটি (বর্তমানে শামসুল হকের বসতবাড়ি)। সেখান থেকে আরও ২০০ গজ উত্তর দিকে ভিটাবাড়িতে দুটি বাংকার (বর্তমানে আবদুল আলীমের বসতবাড়ি) খুঁড়ে ইপিআর যোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান সুদৃঢ় করেন।
ইপিআর যোদ্ধাদের অস্ত্রের মধ্যে ছিল রাইফেল ৬০টি, এলএমজি ছয়টি, রকেট লঞ্চার তিনটি, টু ইঞ্চি মর্টার তিনটি এবং গ্রামবাসীর দেওয়া সাতটি রাইফেল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী দল ঢাকা থেকে ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল ভোর ছয়টার দিকে সাটিয়াচড়া অতিক্রম করার সময়ই বাংকার ও আশপাশে পজিশনরত ইপিআর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার, এলএমজি ও রাইফেল থেকে হানাদার বাহিনীর কনভয় লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা গুলি চালায়। প্রায় ছয় থেকে সাত ঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর ইপিআর মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হটেন। যুদ্ধে ফরিদপুরের ইপিআর সদস্য আবদুল গফুর, বগুড়ার ইপিআর হাবিলদার আবদুল খালেক, সাটিয়াচড়ার ছাত্রনেতা জুমারত আলী দেওয়ানসহ প্রায় ৩৫ জন শহীদ হন। পক্ষান্তরে শতাধিক পাকিস্তানি হানাদার নিহত হয়। ইপিআর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলে হানাদার সাটিয়াচাড়া-গোড়ান গ্রামে ঢুকে বর্বরোচিত গণহত্যা চালায়। অগ্নিসংযোগ করে, ধর্ষণ করে অগণিত মা-বোনকে। সেদিন পাকিস্তানি হানাদারদের বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে নিস্তেজ হয়ে যায় অগণিত নিষ্পাপ নিরপরাধ স্বাধীনতাকামী মানুষ। মৃত্যুপুরীর মতো স্তব্ধ হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী সাটিয়াচড়া ও গোড়ান গ্রাম। সাটিয়াচড়া ও গোড়ান গ্রামে গণহত্যায় শহীদ হন ৫০ জনের বেশি মানুষ।
শফিউদ্দিন তালুকদার
২৬ মার্চের পর থেকেই জুমারত আলী দেওয়ানের নেতৃত্বে সাটিয়াচড়া-গোড়ানের ছাত্র-যুবকেরা দেওয়ান জয়নাল আবেদিন শামসুল, এখলাস উদ্দিন তারা খলিফা, এস এম আমান উল্লাহ শুকুর, হাবিবুর রহমান মধু, সাদেক হোসেন তালুকদার, আবদুল হামিদ চৌধুরী, চান মিঞা প্রমুখের লাইসেন্সধারী বন্দুক সংগ্রহ করে রাতের বেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগমন প্রতিরোধ করার জন্য রাস্তা পাহারা দিতেন। দিনের বেলায় চলত অস্ত্র প্রশিক্ষণের মহড়া।
ইপিআর বাহিনীর সেনারা পাঁচটি ট্রেঞ্চ কেটে তার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পথের দুই ধারে ঝোপঝাড়ের আড়ালে রাইফেলধারী ছাত্র ও যুবকেরা পজিশন নিয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার সেনারা এর আভাসটুকুও টের পায়নি। তারা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসছিল। এখানে যে কোনো ভয়ের কারণ আছে, তা তারা ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীকে চমকে দিয়ে কতগুলো এলএমজি ও রাইফেল গর্জে ওঠে। বৃষ্টির মতো গুলির আঘাতে অপ্রস্তুত পাকিস্তানি সেনারা ধরাশায়ী হতে থাকে।
বাংকারগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জেনে নেওয়া দরকার। সাটিয়াচড়া গ্রামের বুক চিরে যাওয়া ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তার দক্ষিণ পাশে করিম বখশের বাড়ির পূর্বকোনা ঘেঁষে তালগাছের আড়ালে ছয়টি বাংকার। (বাংকারের স্থানে বর্তমানে আলম, বাবা শুকুর মাহমুদের বসতবাড়ি) শণক্ষেতের মাঝে দুটি বাংকার খুঁড়ে ইপিআর জওয়ানেরা অবস্থান নেন। (বর্তমানে নায়েব আলী, শফিউদ্দিন ও আক্কেল আলীর বংশধরদের ভোগদখল করা আবাদি জমি)
ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তার উত্তরে জঙ্গলের পাশে চারটি। সেখান থেকে প্রায় ১৫০ গজ উত্তর দিকে পরিত্যক্ত বাড়ি নারকেল গাছের আড়ালে চারটি (বর্তমানে শামসুল হকের বসতবাড়ি)। সেখান থেকে আরও ২০০ গজ উত্তর দিকে ভিটাবাড়িতে দুটি বাংকার (বর্তমানে আবদুল আলীমের বসতবাড়ি) খুঁড়ে ইপিআর যোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান সুদৃঢ় করেন।
ইপিআর যোদ্ধাদের অস্ত্রের মধ্যে ছিল রাইফেল ৬০টি, এলএমজি ছয়টি, রকেট লঞ্চার তিনটি, টু ইঞ্চি মর্টার তিনটি এবং গ্রামবাসীর দেওয়া সাতটি রাইফেল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী দল ঢাকা থেকে ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল ভোর ছয়টার দিকে সাটিয়াচড়া অতিক্রম করার সময়ই বাংকার ও আশপাশে পজিশনরত ইপিআর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার, এলএমজি ও রাইফেল থেকে হানাদার বাহিনীর কনভয় লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা গুলি চালায়। প্রায় ছয় থেকে সাত ঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর ইপিআর মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হটেন। যুদ্ধে ফরিদপুরের ইপিআর সদস্য আবদুল গফুর, বগুড়ার ইপিআর হাবিলদার আবদুল খালেক, সাটিয়াচড়ার ছাত্রনেতা জুমারত আলী দেওয়ানসহ প্রায় ৩৫ জন শহীদ হন। পক্ষান্তরে শতাধিক পাকিস্তানি হানাদার নিহত হয়। ইপিআর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলে হানাদার সাটিয়াচাড়া-গোড়ান গ্রামে ঢুকে বর্বরোচিত গণহত্যা চালায়। অগ্নিসংযোগ করে, ধর্ষণ করে অগণিত মা-বোনকে। সেদিন পাকিস্তানি হানাদারদের বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে নিস্তেজ হয়ে যায় অগণিত নিষ্পাপ নিরপরাধ স্বাধীনতাকামী মানুষ। মৃত্যুপুরীর মতো স্তব্ধ হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী সাটিয়াচড়া ও গোড়ান গ্রাম। সাটিয়াচড়া ও গোড়ান গ্রামে গণহত্যায় শহীদ হন ৫০ জনের বেশি মানুষ।
শফিউদ্দিন তালুকদার
No comments