চালচিত্র-সংসদ ও নির্বাচন থাকলেই গণতন্ত্র হয় না by শুভ রহমান
কালো পতাকা আর বৈরিতার রাজনীতি পাল্টে দিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। কাজটা খুব সহজ নয়, দুরূহ। অনেক দিন ধরেই চলে আসছে এমন বিরূপ রাজনীতি; কিন্তু আমরা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করছি না। অনেকটা আত্মতৃপ্তই থাকছি একটা নির্বাচন আর সংসদ গঠিত হলেই। ব্যস, এতেই গণতন্ত্র হয়ে গেল।
এত সহজ নয় গণতন্ত্র! পেটের গণতন্ত্রের কথা বাদই দিলাম, পেটের গণতন্ত্রকে যা নিশ্চিত করবে, তার হদিস কে করছে! নির্বাচন একটা যেনতেন রকম হয়ে তার মধ্য দিয়ে যাঁরাই ক্ষমতায় গেলেন, সংসদ গঠিত হলো, অমনি শুরু হয়ে গেল অহেতুক বৈরিতা, সংসদ বর্জন। বিরোধী দলের জন্মই যেন ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতা করার জন্য, সংসদে না যাওয়ার জন্য। এর আর ব্যত্যয় ঘটছে না। ৪০ বছর হয়ে গেল স্বাধীনতার, কবে আমাদের চৈতন্যোদয় ঘটবে স্বাধীনতাকে, গণতন্ত্রকে, সংসদকে, নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থবহ করার জন্য? আমরা কী ভাবছি, একবারও ভেবেছি তার জন্য? মনে হয় অনেক দেরিতে হলেও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কথাটা ভেবেছেন এবং রীতিমতো ভাবনাটাকে এখন কাজে লাগাতে শুরু করেছেন।
ঘটনাটি ছোট। নতুন কিছুও নয়, কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ঘটনাস্থল কানাডার টরন্টো শহর। শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা জানাবেন সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা; কিন্তু বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী সে অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করতে বিক্ষোভ দেখাতে এসেছেন। অর্থাৎ সচরাচর এতকাল যা ঘটে আসছে, তারই পুনরাবৃত্তি। সঙ্গে নিশ্চয়ই কালো পতাকাও ছিল। সেদিনই এর আগে স্থানীয় বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী একদফা কালো পতাকা দেখিয়েছেন। আবার বিকেলে সংবর্ধনাস্থলে বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছে।
নিরাপত্তাকর্মীরা লাঠিপেটা করে, বিক্ষোভকারীদের মেরে, হটিয়ে দিয়ে অনুষ্ঠান পণ্ড করার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হাতাহাতি-মারামারিও হলো। অর্থাৎ যা হয়ে আসছে_তা-ই।
না, আসলে সেটা এবার ঘটেনি। ঘটতে পারত। এবার কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা এবং অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সামরিক সচিবকে দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ডাকিয়ে আনলেন। নিজেও হোটেল কক্ষের বাইরে চলে এলেন। তাঁদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে শুনলেন তাঁদের সব কথা। প্রবাসজীবনে তাঁদের নানা সমস্যার কথা। শুধু সেখানেই শেষ নয়; প্রধানমন্ত্রী তাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বললেন_হোটেলের লবিতে ওই বিক্ষোভকারীদের চা-পানের যথাযোগ্য আপ্যায়ন করতে। বিক্ষোভকারীরা অবশ্য তাতে রাজি হননি। এক অভাবিত কাণ্ড কিন্তু ঘটে গেল এতে, বিক্ষোভকারীদের কাছে যা ছিল ধারণাতীত।
এ যদি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে মোড় পরিবর্তনের সূচনা হয়, আমরা তাকে আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানাই এবং এ সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানাই। বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর এ কার্যক্রম প্রশংসিতও হয়েছে।
একসময় মুক্তিযুদ্ধের এই দেশের মানুষ বলে, বঙ্গবন্ধুর দেশের মানুষ বলে পরিচয় পেলে বিশ্বের যেকোনো সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশেই আবেগ আর আপ্যায়নের ঘটনা দেখে, উচ্ছ্বাস দেখে, আমরা আশ্চর্যান্বিত হতাম, মুগ্ধ হতাম, গর্বে, আনন্দে আপ্লুত হতাম। কোথায়, কখন হারিয়ে গেছে সে সোনালি দিনগুলো! আমরা সেই হৃত দিনগুলো ফিরে পেতে চাই। প্রধানমন্ত্রী মনে হয় সেই সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার একটা অনুকরণীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলেন! তাঁকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে অভিনন্দন জানাই।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে বলেছেন : Real reform does not come at the ballot box alone. reform মানে তো সামরিক মদদপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের লোকদেখানো সংস্কার নয়, 'উইচ হান্টিং' নয়_রিফর্ম হচ্ছে আচার-আচরণ, রাজনৈতিক শিষ্টাচার, ভব্যতা_সব কিছু মিলিয়েই একটা আমূল পরিবর্তন।
বেশি দূরে দেখতে হবে না। পাশের দেশের ছোট একটি রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালেই আমরা সে সংস্কার, সে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের দেখা পাব। এখানে আর নির্বাচনে কী তেমন জয়-পরাজয় হয়! গেলবারই শুধু, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ একটা ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছে। বিজয়ের পর আওয়ামী লীগও নেতা-কর্মীদের সংযত থাকার, বিজয় মিছিল না করার নির্দেশ দিয়ে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছিল; কিন্তু সেটা পরে আর ধরে রাখতে পারেনি। জয়-পরাজয় তো ছোট-বড় তার আগেও হয়েছে_কই নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সন্ধান তো এ দেশের মানুষ তেমন পায়নি। সেই তো এক পক্ষ জিতে শপথ নিতে গেলে বিজিত প্রতিপক্ষ শপথ অনুষ্ঠান বর্জন করে বসে; কিন্তু আমাদের নাকের ডগায় ছোট যে রাজ্যটি, বাংলাভাষীদেরই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এবার কী দেখলাম! ৩৪ বছরের সুদীর্ঘ শাসনের পরও ভোটার সাধারণ যখন শাসক বামফ্রন্টকে ব্যালটের লড়াইয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস আর রাজ্য কংগ্রেস জোটকে ক্ষমতায় বসাল, চমৎকার ভব্যতা ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের উজ্জ্বলতম নজির দেখিয়ে দুই পক্ষই রাজভবনে শপথ অনুষ্ঠানে পরম সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতি দেখিয়ে অংশগ্রহণ করল। যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে দুই পক্ষই রাজ্য পরিচালনায় সক্রিয় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিল। দেখিয়ে দিল, শুধু ব্যালটই গণতন্ত্র নয়, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা শুধু ব্যালটের জয়-পরাজয় নয়। মানুষের প্রত্যাশা আরো অনেক কিছু। মিলেমিশে দেশ গড়বে সবাই, মানুষ সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এ সংস্কৃতিই চায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে স্বর্ণোজ্জ্বল সংস্কৃতির পতাকা সবেগে দৃঢ়হাতেই পশ্চিমবঙ্গে সমুন্নত রাখলেন। গোটা উপমহাদেশ, গোটা বিশ্ব তাঁর জয়গানে মুখরিত হবে।
একটু পেছনে গেলেও দেখব, সত্যিকার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অধিকারী যাঁরা, যেমন_আফ্রিকার মুক্তিদূত নেলসন ম্যান্ডেলা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাপারে অভাবিতভাবেই অনেক দূর এগিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর তাঁর ঘোর প্রতিপক্ষ বর্ণবাদী নেতা এফ ডাবি্লউ ডি ক্লার্ককে পর্যন্ত অপজিশন বেঞ্চ থেকে তুলে এনে সাময়িকভাবে নিজ মন্ত্রিসভার ভাইস প্রেসিডেন্ট করেছিলেন। দেশ তাঁর দূরদর্শিতায় অগ্রসর হয়েছিল বহু দূর। যৌথভাবে তিনি ক্লার্কের সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণেও দ্বিধা করেননি। একটা দেশের নবজাগরণ, সব ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন এমনি-এমনি হয় না, শুধু ভোট আর সংসদই দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ গণতন্ত্রায়নের নিয়ামক নয়।
শেখ হাসিনাও ১৯৯৬ সালে দলীয় সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে অন্য দল থেকে ক্যাবিনেটে মন্ত্রী গ্রহণ করে গণতান্ত্রিক ঐক্য সরকার গঠন করে রাষ্ট্র ও সমাজের গণতন্ত্রায়ন ব্যাপকতর করেছিলেন। তাঁর আজকের বিক্ষোভকারী বিরোধী নেতা-কর্মীদের ভেতরে ডেকে এনে তাঁদের সমস্যা জানা ও চা-পানে আপ্যায়িত করার পেছনেও এ রকম সত্যিকার গণতন্ত্রমনা-সংস্কৃতিমনা এক রাজনৈতিক সত্তাই নিহিত রয়েছে। অবশ্য বঙ্গবন্ধুই এ দেশে সে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সূচনা করে গেছেন।
অতীতে অনেক দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাই ঘটে গেছে। ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে একটি বেসামরিক চ্যারিটি সংস্থার উদ্যোগে 'বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল-৯৯' উদ্যাপিত হয়েছিল। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সে ফেস্টিভ্যাল উদ্বোধন করার কথা ছিল। তাঁর সঙ্গে থাকার কথা তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তখন যুক্তরাজ্যের বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সমন্বয়ে গঠিত বিরোধী জোট কালো পতাকা হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের আয়োজন করে।
শুধু বিদেশের মাটিতেই নয়, দেশের অভ্যন্তরেও কালো পতাকা প্রদর্শনের সংস্কৃতি দেশের ভাবমূর্তিকে বারবার কলঙ্কিত করেছে। ২০০১ সালে বাংলা একাডেমীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমনের প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কালো পতাকা প্রদর্শনের আয়োজন করেছিল। শুধু সে বছরই নয়, শেখ হাসিনার আমলে ফি বছরই ছাত্রদল বাংলা একাডেমীতে প্রধানমন্ত্রীর আগমনের প্রতিবাদ জানিয়ে অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কুসংস্কৃতি দুই দলকেই কর্মীস্তর পর্যন্ত কিভাবে কলুষিত করে ফেলে, তার সাম্প্রতিক নজির দেখা গেছে দেশের দুই প্রধান নেত্রীর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরকালে। গত ২৩ মে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য হচ্ছে : গত ১৪ মে বিএনপি চেয়ারপারসন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্য সফরে গেলে হিথ্রো বিমানবন্দরের বাইরে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ কালো পতাকা-বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। খালেদা জিয়া বিক্ষোভকারীদের এড়িয়ে বিশেষ পথ দিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। তবে বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে বিক্ষোভ নিয়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।
দেখা গেছে, বিগত বছরগুলোয় দেশে কিংবা বিদেশে এক পক্ষের কালো পতাকা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের মুখে অপর পক্ষের নেত্রীকে বিমানবন্দর ত্যাগ করতে ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হয়েছে। এ ধারাই চলে আসছে কতকাল ধরে!
এই প্রথম জননেত্রী শেখ হাসিনা সোজাসুজি বিক্ষোভকারীদের মোকাবিলা করে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়, তাদের সমস্যা জানতে আগ্রহী হওয়া এবং এমনকি হোটেলের লবিতে নিয়ে তাদের চা-পানে আপ্যায়িত করতে চাওয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। শুধু বিদেশের সর্বত্রই নয়, দেশের অভ্যন্তরেও যে সময় বিরোধী দলের সংসদ বর্জন চলছে, বাস-লঞ্চ টার্মিনালের মতো বিএনপি সংসদ সদস্যদের সংসদে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকাডাকি চলছে_তখন শেখ হাসিনার ঔদার্য ও দূরদর্শিতা দেশের অভ্যন্তরেও সচেতন মহল কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।
আমরা আশা করব, এর কল্যাণময় ফল দেশের চলমান সংসদের বাজেট অধিবেশনকে দুই পক্ষের সক্রিয় উপস্থিতির মাধ্যমে প্রাণবন্ত ও ফলপ্রসূ করতে সহায়ক হবে। এ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার আর পাশের পশ্চিমবঙ্গ-প্রদর্শিত গণতান্ত্রিক সুসংস্কৃতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে না। আমরা নিজেরাই এরপর দৃঢ়ভাবে গণতন্ত্র চর্চা, গণতান্ত্রিক সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক সুসংস্কৃতির পথ অবলম্বন করে আগামী দিনের সংসদ, গণতন্ত্র ও আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে জনগণের জন্য সর্বতোভাবে অর্থবহ ও কল্যাণকর করে তুলতে সক্ষম হব।
২৪.৫.২০১১
ঘটনাটি ছোট। নতুন কিছুও নয়, কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ঘটনাস্থল কানাডার টরন্টো শহর। শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা জানাবেন সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা; কিন্তু বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী সে অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করতে বিক্ষোভ দেখাতে এসেছেন। অর্থাৎ সচরাচর এতকাল যা ঘটে আসছে, তারই পুনরাবৃত্তি। সঙ্গে নিশ্চয়ই কালো পতাকাও ছিল। সেদিনই এর আগে স্থানীয় বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী একদফা কালো পতাকা দেখিয়েছেন। আবার বিকেলে সংবর্ধনাস্থলে বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছে।
নিরাপত্তাকর্মীরা লাঠিপেটা করে, বিক্ষোভকারীদের মেরে, হটিয়ে দিয়ে অনুষ্ঠান পণ্ড করার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হাতাহাতি-মারামারিও হলো। অর্থাৎ যা হয়ে আসছে_তা-ই।
না, আসলে সেটা এবার ঘটেনি। ঘটতে পারত। এবার কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা এবং অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সামরিক সচিবকে দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ডাকিয়ে আনলেন। নিজেও হোটেল কক্ষের বাইরে চলে এলেন। তাঁদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে শুনলেন তাঁদের সব কথা। প্রবাসজীবনে তাঁদের নানা সমস্যার কথা। শুধু সেখানেই শেষ নয়; প্রধানমন্ত্রী তাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বললেন_হোটেলের লবিতে ওই বিক্ষোভকারীদের চা-পানের যথাযোগ্য আপ্যায়ন করতে। বিক্ষোভকারীরা অবশ্য তাতে রাজি হননি। এক অভাবিত কাণ্ড কিন্তু ঘটে গেল এতে, বিক্ষোভকারীদের কাছে যা ছিল ধারণাতীত।
এ যদি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে মোড় পরিবর্তনের সূচনা হয়, আমরা তাকে আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানাই এবং এ সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানাই। বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর এ কার্যক্রম প্রশংসিতও হয়েছে।
একসময় মুক্তিযুদ্ধের এই দেশের মানুষ বলে, বঙ্গবন্ধুর দেশের মানুষ বলে পরিচয় পেলে বিশ্বের যেকোনো সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশেই আবেগ আর আপ্যায়নের ঘটনা দেখে, উচ্ছ্বাস দেখে, আমরা আশ্চর্যান্বিত হতাম, মুগ্ধ হতাম, গর্বে, আনন্দে আপ্লুত হতাম। কোথায়, কখন হারিয়ে গেছে সে সোনালি দিনগুলো! আমরা সেই হৃত দিনগুলো ফিরে পেতে চাই। প্রধানমন্ত্রী মনে হয় সেই সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার একটা অনুকরণীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলেন! তাঁকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে অভিনন্দন জানাই।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে বলেছেন : Real reform does not come at the ballot box alone. reform মানে তো সামরিক মদদপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের লোকদেখানো সংস্কার নয়, 'উইচ হান্টিং' নয়_রিফর্ম হচ্ছে আচার-আচরণ, রাজনৈতিক শিষ্টাচার, ভব্যতা_সব কিছু মিলিয়েই একটা আমূল পরিবর্তন।
বেশি দূরে দেখতে হবে না। পাশের দেশের ছোট একটি রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালেই আমরা সে সংস্কার, সে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের দেখা পাব। এখানে আর নির্বাচনে কী তেমন জয়-পরাজয় হয়! গেলবারই শুধু, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ একটা ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছে। বিজয়ের পর আওয়ামী লীগও নেতা-কর্মীদের সংযত থাকার, বিজয় মিছিল না করার নির্দেশ দিয়ে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছিল; কিন্তু সেটা পরে আর ধরে রাখতে পারেনি। জয়-পরাজয় তো ছোট-বড় তার আগেও হয়েছে_কই নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সন্ধান তো এ দেশের মানুষ তেমন পায়নি। সেই তো এক পক্ষ জিতে শপথ নিতে গেলে বিজিত প্রতিপক্ষ শপথ অনুষ্ঠান বর্জন করে বসে; কিন্তু আমাদের নাকের ডগায় ছোট যে রাজ্যটি, বাংলাভাষীদেরই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এবার কী দেখলাম! ৩৪ বছরের সুদীর্ঘ শাসনের পরও ভোটার সাধারণ যখন শাসক বামফ্রন্টকে ব্যালটের লড়াইয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস আর রাজ্য কংগ্রেস জোটকে ক্ষমতায় বসাল, চমৎকার ভব্যতা ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের উজ্জ্বলতম নজির দেখিয়ে দুই পক্ষই রাজভবনে শপথ অনুষ্ঠানে পরম সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতি দেখিয়ে অংশগ্রহণ করল। যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে দুই পক্ষই রাজ্য পরিচালনায় সক্রিয় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিল। দেখিয়ে দিল, শুধু ব্যালটই গণতন্ত্র নয়, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা শুধু ব্যালটের জয়-পরাজয় নয়। মানুষের প্রত্যাশা আরো অনেক কিছু। মিলেমিশে দেশ গড়বে সবাই, মানুষ সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এ সংস্কৃতিই চায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে স্বর্ণোজ্জ্বল সংস্কৃতির পতাকা সবেগে দৃঢ়হাতেই পশ্চিমবঙ্গে সমুন্নত রাখলেন। গোটা উপমহাদেশ, গোটা বিশ্ব তাঁর জয়গানে মুখরিত হবে।
একটু পেছনে গেলেও দেখব, সত্যিকার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অধিকারী যাঁরা, যেমন_আফ্রিকার মুক্তিদূত নেলসন ম্যান্ডেলা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাপারে অভাবিতভাবেই অনেক দূর এগিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর তাঁর ঘোর প্রতিপক্ষ বর্ণবাদী নেতা এফ ডাবি্লউ ডি ক্লার্ককে পর্যন্ত অপজিশন বেঞ্চ থেকে তুলে এনে সাময়িকভাবে নিজ মন্ত্রিসভার ভাইস প্রেসিডেন্ট করেছিলেন। দেশ তাঁর দূরদর্শিতায় অগ্রসর হয়েছিল বহু দূর। যৌথভাবে তিনি ক্লার্কের সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণেও দ্বিধা করেননি। একটা দেশের নবজাগরণ, সব ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন এমনি-এমনি হয় না, শুধু ভোট আর সংসদই দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ গণতন্ত্রায়নের নিয়ামক নয়।
শেখ হাসিনাও ১৯৯৬ সালে দলীয় সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে অন্য দল থেকে ক্যাবিনেটে মন্ত্রী গ্রহণ করে গণতান্ত্রিক ঐক্য সরকার গঠন করে রাষ্ট্র ও সমাজের গণতন্ত্রায়ন ব্যাপকতর করেছিলেন। তাঁর আজকের বিক্ষোভকারী বিরোধী নেতা-কর্মীদের ভেতরে ডেকে এনে তাঁদের সমস্যা জানা ও চা-পানে আপ্যায়িত করার পেছনেও এ রকম সত্যিকার গণতন্ত্রমনা-সংস্কৃতিমনা এক রাজনৈতিক সত্তাই নিহিত রয়েছে। অবশ্য বঙ্গবন্ধুই এ দেশে সে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সূচনা করে গেছেন।
অতীতে অনেক দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাই ঘটে গেছে। ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে একটি বেসামরিক চ্যারিটি সংস্থার উদ্যোগে 'বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল-৯৯' উদ্যাপিত হয়েছিল। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সে ফেস্টিভ্যাল উদ্বোধন করার কথা ছিল। তাঁর সঙ্গে থাকার কথা তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তখন যুক্তরাজ্যের বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সমন্বয়ে গঠিত বিরোধী জোট কালো পতাকা হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের আয়োজন করে।
শুধু বিদেশের মাটিতেই নয়, দেশের অভ্যন্তরেও কালো পতাকা প্রদর্শনের সংস্কৃতি দেশের ভাবমূর্তিকে বারবার কলঙ্কিত করেছে। ২০০১ সালে বাংলা একাডেমীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমনের প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কালো পতাকা প্রদর্শনের আয়োজন করেছিল। শুধু সে বছরই নয়, শেখ হাসিনার আমলে ফি বছরই ছাত্রদল বাংলা একাডেমীতে প্রধানমন্ত্রীর আগমনের প্রতিবাদ জানিয়ে অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কুসংস্কৃতি দুই দলকেই কর্মীস্তর পর্যন্ত কিভাবে কলুষিত করে ফেলে, তার সাম্প্রতিক নজির দেখা গেছে দেশের দুই প্রধান নেত্রীর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরকালে। গত ২৩ মে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য হচ্ছে : গত ১৪ মে বিএনপি চেয়ারপারসন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্য সফরে গেলে হিথ্রো বিমানবন্দরের বাইরে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ কালো পতাকা-বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। খালেদা জিয়া বিক্ষোভকারীদের এড়িয়ে বিশেষ পথ দিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। তবে বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে বিক্ষোভ নিয়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।
দেখা গেছে, বিগত বছরগুলোয় দেশে কিংবা বিদেশে এক পক্ষের কালো পতাকা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের মুখে অপর পক্ষের নেত্রীকে বিমানবন্দর ত্যাগ করতে ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হয়েছে। এ ধারাই চলে আসছে কতকাল ধরে!
এই প্রথম জননেত্রী শেখ হাসিনা সোজাসুজি বিক্ষোভকারীদের মোকাবিলা করে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়, তাদের সমস্যা জানতে আগ্রহী হওয়া এবং এমনকি হোটেলের লবিতে নিয়ে তাদের চা-পানে আপ্যায়িত করতে চাওয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। শুধু বিদেশের সর্বত্রই নয়, দেশের অভ্যন্তরেও যে সময় বিরোধী দলের সংসদ বর্জন চলছে, বাস-লঞ্চ টার্মিনালের মতো বিএনপি সংসদ সদস্যদের সংসদে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকাডাকি চলছে_তখন শেখ হাসিনার ঔদার্য ও দূরদর্শিতা দেশের অভ্যন্তরেও সচেতন মহল কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।
আমরা আশা করব, এর কল্যাণময় ফল দেশের চলমান সংসদের বাজেট অধিবেশনকে দুই পক্ষের সক্রিয় উপস্থিতির মাধ্যমে প্রাণবন্ত ও ফলপ্রসূ করতে সহায়ক হবে। এ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার আর পাশের পশ্চিমবঙ্গ-প্রদর্শিত গণতান্ত্রিক সুসংস্কৃতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে না। আমরা নিজেরাই এরপর দৃঢ়ভাবে গণতন্ত্র চর্চা, গণতান্ত্রিক সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক সুসংস্কৃতির পথ অবলম্বন করে আগামী দিনের সংসদ, গণতন্ত্র ও আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে জনগণের জন্য সর্বতোভাবে অর্থবহ ও কল্যাণকর করে তুলতে সক্ষম হব।
২৪.৫.২০১১
No comments