বিদ্যুৎ খাতের সংকট ও তার মোকাবিলা by আইয়ুব আলী

বিদ্যুৎ সংকট কী ও কেন বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং চাহিদার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। ফলে লোডশেডিং একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই লোডশেডিংয়ের ফলে কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে, জনজীবনে বিভিন্ন দুর্ভোগ দেখা দিচ্ছে।


প্রথমে দেখা যাক, বাংলাদেশের বিদ্যুতের চাহিদা কতটুকু। প্রতিদিনের বিদ্যুতের চাহিদা এবং উৎপাদন সমান থাকে না, কিন্তু লোডশেডিং প্রতিদিনই থাকছে। সে ক্ষেত্রে যেকোনো একটি দিনের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এ বছরেরই কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে দেশে সম্ভাব্য বিদ্যুতের চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ১২০ মেগাওয়াট এবং উৎপাদন কেন্দ্রগুলোয় সেদিনের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল চার হাজার ২৪০ মেগাওয়াট। ফলে ওই দিন প্রায় মোট ৭৯৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। ওই একই দিনে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কয়েকটি জেনারেটিং সেট বন্ধ ছিল। যেমন_কাপ্তাই ৩ ও ৪, শিকলবাহা ৬০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ সিসিপিপি স্টিম, ঘোড়াশাল-২, খুলনা ১১০ মেগাওয়াট ও ৬০ মেগাওয়াট, হরিপুর এসবিইউ জিটি-৩ এবং হরিপুর পাওয়ার লি. (স্টিম ইউনিট) এবং গ্যাস স্বল্পতার কারণে বন্ধ ছিল হরিপুর এসবিউ-২।
বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে একটি অলিখিত নিয়ম হচ্ছে, যে পরিমাণ বিদ্যুৎ চাহিদা থাকবে, সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ সংরক্ষিত থাকবে এবং সেই একই পরিমাণ ইউনিট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ থাকবে। আমাদের ক্ষেত্রে এ নিয়মটি পালন করা সম্ভব হচ্ছে না, যেহেতু আমাদের জেনারেটিং সেটের অভাব রয়েছে। তাই সহজেই বোঝা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বল্পতাই বর্তমানের এই বিদ্যুৎ সংকটের মূল কারণ।
বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহার একটি চলমান প্রক্রিয়া। একটি উন্নয়নশীল দেশে প্রতিনিয়তই চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সব সময় চালু রাখতে হবে। একটি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ শতাংশ হারে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে বলে ধরা হয়। সেই ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে সে অনুযায়ী উৎপাদনব্যবস্থার জন্য নতুন জেনারেটর স্থাপন করতে হবে। গত পাঁচ-সাত বছরের রেকর্ড অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে দেশে উল্লেখযোগ্যভাবে কোনো জেনারেটিং প্লান্ট আমাদের বিদ্যুৎব্যবস্থায় সংযোজিত হয়নি।
নতুন জেনারেটিং সেট স্থাপনের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য মান্ধাতা আমলের ঔপনিবেশিক নিয়মকানুন বাদ দিয়ে দেশপ্রেমের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় নির্বাহীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে সরবরাহকারী বা স্থাপনকারীকে বাছাই করে ওয়ার্ক অর্ডার দিতে হবে। কিভাবে তা করা যেতে পারে? সহজ করে বললে, প্রধানমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ এবং সব বিষয়ের বিশেষজ্ঞসহ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেকে সামনাসামনি একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে রেডটেপিজম অস্বচ্ছতার কোনো সুযোগ থাকবে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দেশবাসীর পূর্ণ আস্থা আছে বলেই আমার দৃঢ়বিশ্বাস। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে জ্বালানির প্রয়োজন অত্যাবশ্যকীয়। কারণ জ্বালানি ছাড়া বিদ্যুতের মেশিন চলবে না। অবশ্য জলবিদ্যুৎ এবং উইন্ডমেশিনের দ্বারা উৎপাদিত বিদ্যুতের কথা আলাদা। আমাদের কাপ্তাই বিদ্যুৎ ছাড়া অন্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের এখনো কোনো ব্যবস্থা নেই।
জ্বালানি হিসেবে গ্যাস, কয়লা এবং বিভিন্ন ধরনের তেলের প্রয়োজন, যা সংগ্রহ করা প্রাথমিক কর্তব্য। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা, গ্যাস এবং তেল ব্যবহার করা হচ্ছে। কয়লা এবং গ্যাস আমাদের নিজস্ব সম্পদ। অতএব গ্যাস এবং কয়লা দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রাথমিকভাবে আমাদের চিন্তায় রাখা প্রয়োজন। কারণ হিসেবে দেখা যায়, গ্যাস দ্বারা উৎপাদিত ইউনিটের গড় ১.০৪২, ৭২৬.০৯৩ ইস্ট জোনে এবং তৈল উৎপাদন ইউনিট গড়ে ১২.৯৪০, ১৮.৯৭৫, ৯৫৫,৯.৬১৪ এবং কয়লা দ্বারা উৎপাদিত ইউনিট গড়ে ১.৯২২, এটা ওয়েস্ট জোনের হিসাবে। এই পরিসংখ্যান ২০০৯ সালের হিসাব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্যাস এবং কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা সহজলভ্য এবং খরচ কম, যেহেতু গ্যাস এবং কয়লা এ দেশের মাটিতেই মজুদ আছে। এখন পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের কয়লা প্রচুর পরিমাণে মজুদ আছে বলে আমাদের ধারণা। সে অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক পাওয়ার স্টেশন উত্তরবঙ্গে স্থাপন করলে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ স্বনির্ভরতা অর্জন করবে এবং অনেক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হবে। বর্তমানে উৎপাদিত কয়লাভিত্তিক পাওয়ার স্টেশন দ্বারা উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ চাহিদা পুরোপুরি মেটানো যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদনের অতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর জন্য ইস্ট জোন থেকে ইস্ট-ওয়েস্ট ইন্টার কানেকটর দ্বারা বাকি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। তার পরও চাহিদা মেটাতে তেল দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, যার উৎপাদন খরচ বেশি। যদি কোনো সময় কোনো দুর্ঘটনাজনিত কারণে ইস্ট-ওয়েস্ট ইন্টার কানেকটর অচল হয়ে যায়, তাহলে উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ চাহিদা সম্পূরকভাবে সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। জ্বালানি সংগ্রহ এবং বিদ্যুৎব্যবস্থার উন্নতিকল্পে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকার এবং দেশের জনসাধারণকে একে অন্যের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে হবে।
স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা : ১. বর্তমানে এই জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে কিছু বার্জ মাউন্টেড জেনারেটর স্থাপন করা যেতে পারে। ২. আপাতত কোনো নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যাবে না।
জরুরি শিল্প-কারখানা ছাড়া গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্য সংযোগ আগামী এক বছরের জন্য বন্ধ রাখতে হবে। কারণ, মাইলের পর মাইল সংযোগ স্থাপন করে ও দু-একটা লাইনে ধান ভাঙার কল ছাড়া আর কোনো ইন্ডাস্ট্রি থাকে না, এ রকম লাইন বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। এর পরিবর্তে আবাসিক এলাকায় সোলার এনার্জির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
আমাদের জ্বালানি আছে বলে এখনো আমরা মনে করি। জ্বালানি সংগ্রহে আশু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের মতো গরিব দেশের স্থানীয় জ্বালানি, গ্যাস এবং কয়লা দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
বিদ্যুৎ ম্যানেজমেন্ট : শুরু থেকেই বিদ্যুৎব্যবস্থার উন্নতিকল্পে কিছু কিছু দাতা সংস্থা যেমন_ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ বিভিন্ন ধরনের প্রেসক্রিপশন আমাদের ওপর জারি করে চলেছে। যেমন_বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে বিভক্ত করে বিভিন্ন সংস্থায় রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, এতে নাকি ম্যানেজমেন্টের সুবিধা হয়। যদি একটি মন্ত্রণালয় তার অধীনদের নিয়ে চলতে পারে, তাহলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিদ্যুৎব্যবস্থার উন্নয়ন করতে অপারগ হওয়ার মতো কোনো কিছু আছে বলে আমরা মনে করি না। প্রায়ই দেখা যায়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মচারী, কর্মকর্তারাই ওই সব নবসৃষ্ট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। বর্তমানে দেশে একই বিদ্যুৎব্যবস্থাকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করার ফলে বিভিন্ন বিভক্তিকৃত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ_বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ডেসা, ডেসকো, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন লিমিটেড প্রভৃতি। উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা, বিতরণ করা এবং রেভিনিউ সংগ্রহ করা। একই ধরনের কাজ হওয়ায় এবং সমন্বয়হীনতার ফলে জনগণ লোডশেডিংজনিত দুর্ভোগের শিকার হয়। বিভিন্ন সংস্থা সৃষ্টি করার ফলে ওভারহেড খরচও অনেক বেশি পড়ে। তাই আমাদের দেশের বিদ্যুৎব্যবস্থা সচল রাখার জন্য বাইরের প্রতিষ্ঠানের প্রেসক্রিপশন গ্রহণ না করাই বাঞ্ছনীয়। কারণ এসব প্রেসক্রিপশনের ফলে ঘটে যাওয়া লোকসানের বোঝা দেশের জনগণকেই বহন করতে হয়।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড

No comments

Powered by Blogger.