গোধূলির ছায়াপথে-গুলমেহের, না কৃষ্ণচূড়া by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
‘কেন যে আমার কৃষ্ণচূড়ার বনে’—ফেরদৌসীর গাওয়া আধুনিক গান। গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সুর আবদুল আহাদের। একটি গানেই বাংলাদেশের আধুনিক গানের দিকনির্দেশ হয়ে গিয়েছিল। এর পরও অনেক গানে কৃষ্ণচূড়ার আগুন বাংলা গানের শরীরে এনেছে দুর্বার যৌবন। সমাসবদ্ধ শব্দটি, কৃষ্ণ চূড়ায় যাহার—কৃষ্ণচূড়া, এর প্রথম নাম রক্তচূড়া, ব্যবহূত মঙ্গলকাব্যের গানে।
কক্সবাজারে যাওয়ার সময় গিন্নি বললেন: কৃষ্ণচূড়ার একটি ডাল নিয়ে এসো তো। ওখানকার কৃষ্ণচূড়া আমার ভালো লাগে। লাগবেই বা না কেন? বিয়ের ছয় দিন পর, ১৯৬৩ সালের ২৬ জানুয়ারি ‘লাবণী রেস্ট হাউসে’ হাজির। রমজান মাস, জনমানুষশূন্য। রেস্ট হাউস ও সমুদ্রতটের বালুকাবেলা দুজনের জন্য, আর সমুদ্রতটসীমার দিকে দৃষ্টি দিলেই কৃষ্ণচূড়া। হানিমুনের বাকি অংশটি শেষে।
হোস্টকে জিজ্ঞেস করলাম, বৃক্ষের কলম পাওয়া যাবে কি না। হোস্টের মা—যাঁর বয়স আশি—বললেন: ও, গুলমেহেরের কথা বলছেন? ‘গুল’ হিন্দি বা উর্দুতে অর্থ ফুল। ‘মেহের’-এর অর্থ ময়ূর। এটাকে মোহরও বলা হয়। ময়ূরের অপভ্রংশ মোহর বা মো’র, যে ফুল তার ডাল ও সবুজ পাতাগুলোকে ময়ূরের পুচ্ছের মতো লালিমা দিয়ে ভরিয়ে দেয়, সেটাই ‘গুলমেহের’। ভাষাবিচ্ছেদের ফলে ওটা যে ‘গুলমেহের’, আমরা জানতে পারিনি। ‘গুলমেহের’ ফুলাচ্ছাদিত, রোমান্টিক ও অর্থবহ।
পিতার গাওয়া ‘বিচ্ছেদী’ গানে কৃষ্ণ বসতেন কদম্বডালে, ‘প্রাণ সখী রে, ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে’ অথবা ‘বাঁশিটি বাজাইয়ারে কালা থুইলেন কদম তলে/ ওরে নিরলা বাতাসে বাঁশি রাধা রাধা বলে রে’। ওখানে বসেই বাঁশি বাজালে সব ভুলে রাধা হাজির।
অথচ গুলমেহেরের আবির্ভাব মাদাগাস্কার থেকে। ভিয়েতনামে এর নাম ফিনিক্সের পুচ্ছ। ফিলিপাইনে এর নাম ছিল পয়েনসিয়ানা, শাসক ফিলিপ ডি লংভিলিয়ার্স ডি পয়েন্সির নামে। ফিলিপাইনের সপ্তদশ শতকের গভর্নর সেন্ট ক্রিস্টোফার এই বৃক্ষরাজি আমেরিকায় পাঠালেন উপহার হিসেবে। আমি যখন ফিলিপাইনে প্রথম যাই, দেখলাম, পয়েনসিয়ানায় ভরে গেছে পুরো দ্বীপপুঞ্জ। যেন এ ফুল না ফুটলে ফিলিপাইনের মানুষের মুখে হাসি ফুটবে না। এখন ট্রপিক্যাল ফ্লোরিডায় যেখানেই যাই, খুঁজে পাব এই বৃক্ষ। যাঁরা ছোটবেলা থেকে এই বৃক্ষতলে মানুষ হয়েছেন, তাঁদের কেউ ফ্লোরিডার বোকারাটনে মেয়ের বাসায় গিয়েও মনে করেন, বাংলাদেশেই বাস করছি। এমনই এ বৃক্ষের গুণ।
বৃক্ষের চার রং: সুগভীর লাল, ভারমেলিয়ান, কমলা ও হলুদ। ঘন সবুজ ফার্নের পাতা ফুলগুলোকে সাজিয়েছে লাল-সবুজের ছোপ দিয়ে, যেন বাংলাদেশের পতাকা। গুলমেহেরের মতো এমন আর কোনো বৃক্ষ নেই, যা একই সঙ্গে ছড়ায় ফাগুনের সৌন্দর্য বছরজুড়ে, কাঙাল পথিককে দেয় সুশীতল ছায়া। কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, কোচবিহার ও ঢাকা একদিন ছিল গুলমেহেরের শহর। এখন নয়। নির্মমভাবে কেটে পথ করেছি প্রশস্ত, সংকীর্ণ করেছি মনের গলি। লন্ডনে যাঁরা বড় বড় বাগানে সময় কাটিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতির সুরভিতে নিশ্চয়ই আছে রাজকীয় গুলমেহের। ডেলুনিক্স রেজিয়া নামের এই বৃক্ষটির পিতৃপুরুষের নাম ফ্যাবাসিই, ইংরেজিতে এর নাম রাজকীয় পয়েনসিনিয়া অথবা ফ্ল্যামবয়েন্ট।
গুলমেহের থেকে খানিকটা আলাদা আরেকটি বৃক্ষ, তার নাম ময়ূর বৃক্ষ। ভারতের সব প্রদেশেই আছে এই বৃক্ষ, এর ভিন্ন ভিন্ন নাম। হিন্দিতে কুনিশচুরিন, তামিলে কুমরি। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এই বৃক্ষের ওপরে শিব অবস্থান করতেন। তাই এর প্রতিটি পাতা-ফুল তাঁদের কাছে পবিত্রতার উপাদান দিয়ে প্রস্তুত, ওষুধের চেয়েও বেশি কাজ করে। কেটে গেলে, হজমের গন্ডগোল হলে, অল্প করে টনিকের মতো ব্যবহার করেন তাঁরা। এর গাছের ছাল থেকে তৈরি, কালি। যে কালির লেখা সবচেয়ে উত্তম।
কয়েকজন বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁদের অপছন্দনীয় শব্দাবলির জঞ্জাল সাফ করার। হাতে খবরের কাগজ ও টেলিভিশন থাকলেই হলো। শতাব্দী ব্যবহূত আরবি-ফারসি-তুর্কি-উর্দু শব্দ। জনগণ ব্যবহার করেছে। অভিধান বের করেছে বাংলা একাডেমী, ব্যবহার শিখিয়েছেন কাজী নজরুল। আমার মৃতদেহটি লাশ। ‘শব’ অন্য জিনিস। আমার ‘ইন্তেকাল’ এক জগৎ থেকে অন্য জগতে যাত্রা, শব্দই নয় শুধু, এটি আমার বিশ্বাস-সম্পর্কিত। ‘প্রয়াত’ কিছুই বোঝায় না। ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ অজান্তেই ঘটে গেছে। যার যারটা সে ব্যবহার করলেই চলবে। ভালো করে লেখাপড়া শেখা, ভাষাকে জানা, পৃথিবীর সব ভাষার শ্রেষ্ঠ সম্পদের সঙ্গে যোগাযোগ, সেটাই ‘ভাষা-যোগ’।
কবির সুমন সমঝদার ব্যক্তি। তাঁর গানের একটি লাইন: ‘যাহা জল, তাহা পানি’। আমার কাছে কৃষ্ণচূড়ার মতোই সুন্দর গুলমেহের। দুটোই আমার, সমৃদ্ধতর আমি দুটোকে পেয়েই। কোনোটিই বাদ দেব না।
হানিমুনে ফিরে আসি। গার্ডকে বলে কোনোভাবে আলুসিদ্ধ ও ডালভাতের ব্যবস্থা হলো। পরম ভোজন। আমরা দুজনে দুজনার। আর কিছুরই প্রয়োজন নেই। গার্ডকে বললাম, ‘ভাই, এদিকটায় তো কোনো মানুষজন দেখছি না। রাতের বেলা নিরাপদ তো?’ গার্ড বলল, ‘স্যার, কোনো ভয় করবেন না, সব নিরাপদ। তবে...।’
‘তবে কী?’
‘তবে...’ গার্ড আবার ইতস্তত করছে। পরে বলল, ‘স্যার, একটি মেয়েকে দু-তিন দিন আগে বিচ থেকে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে। আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।’
পূর্ণিমা চাঁদ আলো দিচ্ছে স্কাই লাইট দিয়ে। ভয়ে নববধূর শরীরে দিচ্ছে কাঁটা, আর তাঁর বীরপুরুষ বর পায়চারি করছে একটি হাঙরের দাঁত ও কৃষ্ণচূড়ার ভাঙা ডাল নিয়ে। বলা তো যায় না...।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
হোস্টকে জিজ্ঞেস করলাম, বৃক্ষের কলম পাওয়া যাবে কি না। হোস্টের মা—যাঁর বয়স আশি—বললেন: ও, গুলমেহেরের কথা বলছেন? ‘গুল’ হিন্দি বা উর্দুতে অর্থ ফুল। ‘মেহের’-এর অর্থ ময়ূর। এটাকে মোহরও বলা হয়। ময়ূরের অপভ্রংশ মোহর বা মো’র, যে ফুল তার ডাল ও সবুজ পাতাগুলোকে ময়ূরের পুচ্ছের মতো লালিমা দিয়ে ভরিয়ে দেয়, সেটাই ‘গুলমেহের’। ভাষাবিচ্ছেদের ফলে ওটা যে ‘গুলমেহের’, আমরা জানতে পারিনি। ‘গুলমেহের’ ফুলাচ্ছাদিত, রোমান্টিক ও অর্থবহ।
পিতার গাওয়া ‘বিচ্ছেদী’ গানে কৃষ্ণ বসতেন কদম্বডালে, ‘প্রাণ সখী রে, ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে’ অথবা ‘বাঁশিটি বাজাইয়ারে কালা থুইলেন কদম তলে/ ওরে নিরলা বাতাসে বাঁশি রাধা রাধা বলে রে’। ওখানে বসেই বাঁশি বাজালে সব ভুলে রাধা হাজির।
অথচ গুলমেহেরের আবির্ভাব মাদাগাস্কার থেকে। ভিয়েতনামে এর নাম ফিনিক্সের পুচ্ছ। ফিলিপাইনে এর নাম ছিল পয়েনসিয়ানা, শাসক ফিলিপ ডি লংভিলিয়ার্স ডি পয়েন্সির নামে। ফিলিপাইনের সপ্তদশ শতকের গভর্নর সেন্ট ক্রিস্টোফার এই বৃক্ষরাজি আমেরিকায় পাঠালেন উপহার হিসেবে। আমি যখন ফিলিপাইনে প্রথম যাই, দেখলাম, পয়েনসিয়ানায় ভরে গেছে পুরো দ্বীপপুঞ্জ। যেন এ ফুল না ফুটলে ফিলিপাইনের মানুষের মুখে হাসি ফুটবে না। এখন ট্রপিক্যাল ফ্লোরিডায় যেখানেই যাই, খুঁজে পাব এই বৃক্ষ। যাঁরা ছোটবেলা থেকে এই বৃক্ষতলে মানুষ হয়েছেন, তাঁদের কেউ ফ্লোরিডার বোকারাটনে মেয়ের বাসায় গিয়েও মনে করেন, বাংলাদেশেই বাস করছি। এমনই এ বৃক্ষের গুণ।
বৃক্ষের চার রং: সুগভীর লাল, ভারমেলিয়ান, কমলা ও হলুদ। ঘন সবুজ ফার্নের পাতা ফুলগুলোকে সাজিয়েছে লাল-সবুজের ছোপ দিয়ে, যেন বাংলাদেশের পতাকা। গুলমেহেরের মতো এমন আর কোনো বৃক্ষ নেই, যা একই সঙ্গে ছড়ায় ফাগুনের সৌন্দর্য বছরজুড়ে, কাঙাল পথিককে দেয় সুশীতল ছায়া। কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, কোচবিহার ও ঢাকা একদিন ছিল গুলমেহেরের শহর। এখন নয়। নির্মমভাবে কেটে পথ করেছি প্রশস্ত, সংকীর্ণ করেছি মনের গলি। লন্ডনে যাঁরা বড় বড় বাগানে সময় কাটিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতির সুরভিতে নিশ্চয়ই আছে রাজকীয় গুলমেহের। ডেলুনিক্স রেজিয়া নামের এই বৃক্ষটির পিতৃপুরুষের নাম ফ্যাবাসিই, ইংরেজিতে এর নাম রাজকীয় পয়েনসিনিয়া অথবা ফ্ল্যামবয়েন্ট।
গুলমেহের থেকে খানিকটা আলাদা আরেকটি বৃক্ষ, তার নাম ময়ূর বৃক্ষ। ভারতের সব প্রদেশেই আছে এই বৃক্ষ, এর ভিন্ন ভিন্ন নাম। হিন্দিতে কুনিশচুরিন, তামিলে কুমরি। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এই বৃক্ষের ওপরে শিব অবস্থান করতেন। তাই এর প্রতিটি পাতা-ফুল তাঁদের কাছে পবিত্রতার উপাদান দিয়ে প্রস্তুত, ওষুধের চেয়েও বেশি কাজ করে। কেটে গেলে, হজমের গন্ডগোল হলে, অল্প করে টনিকের মতো ব্যবহার করেন তাঁরা। এর গাছের ছাল থেকে তৈরি, কালি। যে কালির লেখা সবচেয়ে উত্তম।
কয়েকজন বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁদের অপছন্দনীয় শব্দাবলির জঞ্জাল সাফ করার। হাতে খবরের কাগজ ও টেলিভিশন থাকলেই হলো। শতাব্দী ব্যবহূত আরবি-ফারসি-তুর্কি-উর্দু শব্দ। জনগণ ব্যবহার করেছে। অভিধান বের করেছে বাংলা একাডেমী, ব্যবহার শিখিয়েছেন কাজী নজরুল। আমার মৃতদেহটি লাশ। ‘শব’ অন্য জিনিস। আমার ‘ইন্তেকাল’ এক জগৎ থেকে অন্য জগতে যাত্রা, শব্দই নয় শুধু, এটি আমার বিশ্বাস-সম্পর্কিত। ‘প্রয়াত’ কিছুই বোঝায় না। ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ অজান্তেই ঘটে গেছে। যার যারটা সে ব্যবহার করলেই চলবে। ভালো করে লেখাপড়া শেখা, ভাষাকে জানা, পৃথিবীর সব ভাষার শ্রেষ্ঠ সম্পদের সঙ্গে যোগাযোগ, সেটাই ‘ভাষা-যোগ’।
কবির সুমন সমঝদার ব্যক্তি। তাঁর গানের একটি লাইন: ‘যাহা জল, তাহা পানি’। আমার কাছে কৃষ্ণচূড়ার মতোই সুন্দর গুলমেহের। দুটোই আমার, সমৃদ্ধতর আমি দুটোকে পেয়েই। কোনোটিই বাদ দেব না।
হানিমুনে ফিরে আসি। গার্ডকে বলে কোনোভাবে আলুসিদ্ধ ও ডালভাতের ব্যবস্থা হলো। পরম ভোজন। আমরা দুজনে দুজনার। আর কিছুরই প্রয়োজন নেই। গার্ডকে বললাম, ‘ভাই, এদিকটায় তো কোনো মানুষজন দেখছি না। রাতের বেলা নিরাপদ তো?’ গার্ড বলল, ‘স্যার, কোনো ভয় করবেন না, সব নিরাপদ। তবে...।’
‘তবে কী?’
‘তবে...’ গার্ড আবার ইতস্তত করছে। পরে বলল, ‘স্যার, একটি মেয়েকে দু-তিন দিন আগে বিচ থেকে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে। আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।’
পূর্ণিমা চাঁদ আলো দিচ্ছে স্কাই লাইট দিয়ে। ভয়ে নববধূর শরীরে দিচ্ছে কাঁটা, আর তাঁর বীরপুরুষ বর পায়চারি করছে একটি হাঙরের দাঁত ও কৃষ্ণচূড়ার ভাঙা ডাল নিয়ে। বলা তো যায় না...।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments