চারদিক-‘হামরা বাড়্যাল, আম-লিচির ব্যবোসা করি’ by সালেক খোকন

হর্ন দিয়ে ঢুকতে যাব ডানের রাস্তায়, অমনি থেমে যায় আমাদের মোটরসাইকেলটি। ধানের খড়ে আকীর্ণ রাস্তা। তিল পরিমাণ মাটির দেখা নেই। দু-একজন রাস্তার পাশেই ধান মাড়াই করছেন। বোরো ধান ঘরে উঠছে। কষ্টের মধ্যেও কৃষকের মুখে আনন্দের হাসি। মাধববাটির কথা বলতেই দেখিয়ে দেন একটি মেঠোপথ।


রাস্তার দুই পাশে ছনে ছাওয়া মাটির ঘরগুলো পেছনে ফেলে এগোতেই যেন পাল্টে যায় দৃশ্য। দুই পাশে সার সার লিচুগাছ। শত থেকে হাজারে। সবুজের মধ্যে যেন সিঁদুরের ফোঁটা।
সঙ্গে আসা বন্ধু কাজিমের বাড়ি দিনাজপুর। তিনি জানান, লিচুর আধিক্যের কারণে মাধববাটিকে অনেকেই জানেন লিচুগ্রাম হিসেবে। আমরাও ঘুরে দেখি লিচুগ্রামের বাগানগুলো।
একটি বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ শুনি, গানের সুর। ‘হে নানা লবগঞ্জ থেকে হামরা আসছি বিরলেরই লিচু বাগানে...।’ তার পরই অট্টহাসি। চাঁপাইয়ের গম্ভীরা গানের সুর দিনাজপুরে! খানিকটা অবাক হই। বাগানের ভেতর ঢুকতে দেখি, গাছের নিচে ছোট্ট একটি পলিথিনের ছাপরা ঘর। সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন চল্লিশোর্ধ্ব দুজন। একজন গলায় সুর তুলছেন, অন্যজন রান্নার পাতিলে শব্দ করে তাল দিচ্ছেন। আমাদের পায়ের শব্দে তাঁরা থামিয়ে দেন সব সুর।
ছাপরা ঘরে বসে আমরা আলাপ জমাই তাঁদের সঙ্গে। এনামুল ও মমিন দুজনেরই বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। মাধববাটিতে এসেছেন বৈশাখের ঠিক আগে। প্রতিবছর যখন লিচুগাছে মুকুল দেখা দেয়, তখন তাঁরা বাগান ঘুরে মুকুল দেখেন আর অনুমান করেন লিচুর ফলনের। যদি কাঙ্ক্ষিত গাছ মিলে যায়, তখন বাগানির কাছ থেকে বাগান কিনে লিচুর পরিচর্যা করতে থাকেন। অতঃপর লিচু পাকলে বিক্রি করে দেন ঢাকার পাইকারের কাছে।
এনামুল জানান, তাঁদের বাগানে লিচুগাছ আছে ৩৮টি। নয়জন মিলে তাঁরা বাগানটি কিনেছেন চার লাখ ১৩ হাজার টাকায়। ১৩ বছর আগে একবার নিজ গ্রামে ৩৫০ টাকায় তিনটি গাছ কিনে এনামুল লাভ করেন এক হাজার টাকা। সেই থেকেই তিনি আগ্রহী হন এ ব্যবসায়। এই ব্যবসার নাম কী?
পাশ থেকে মমিন বলেন, ‘হামরা বাড়্যাল, আম-লিচির ব্যবোসা করি।’
এনামুল জানান, বাগান কেনার পর চলে স্প্রে করা। লিচু একটু বড় হলেই শুরু হয় বাদুড় তাড়ানো আর চোর পাহারা। কথা থামিয়ে ছাপরা ঘরের পাশ থেকে বাঁশের তৈরি যন্ত্রে তিনি হাত দিয়ে চেপে ধরেন। অমনি ফট ফট শব্দ। এটি ফটফটিয়া। এনামুল একটি দড়ি ধরে দেন টান। অমনি গাছে বাঁধা টিনের ঝাড়ে লাঠিপেটার শব্দ। এটি টিনবাঁধ। টিনের শব্দে দু-একটা বাদুড়ও উড়ে যায় একটি গাছ থেকে।
বাদুড়কে তাড়াতে হয় কেন? এমন প্রশ্নে এনামুলের চোখ কপালে ওঠে। তিনি বলেন, ‘বাদুড় আইস্যা লিচুর খিতি করে খুব। খাবে পাঁচটা, নষ্ট করবে এক-দুই হাজার। খালি চিবায়ে ফালাইয়া দেয়।’ বাদুড় ছাড়া লিচুর ব্যবসায় ভয় শুধুই ঝড়-বাদলে। গত বছর এক রাতের ঝড়ের কথা বলেন এনামুল। রাতভর কষ্ট নিয়ে ছাপরা ঘরে বসে তিনি দেখেছেন ঝড়ের তাণ্ডব। চোখের সামনে ভেঙে পড়েছে যত্নের লিচুসহ ডালগুলো।
ঝড়ের সময় কী করেন? এনামুল বলেন, ‘শুধুই আল্লাহকে ডাকি, সবই তাঁর ওপর নির্ভর।’ বাগানের মধ্যে কীভাবে খাওয়াদাওয়া চলে? মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘হামরা দুই বেলা রাঁধি, তিন বেলা খাই।’
মা, বাবা, স্ত্রী আর সন্তানদের স্মৃতি নিয়ে বাড়্যালরা বাগানে কাটান বছরের তিনটি মাস। ঝড়-বৃষ্টিকে মাথায় রেখে লাভের আশায় জীবন কাটান লিচুবাগানে। তিন ঘণ্টা পালা করে কাজ। আর অবসরে লুডু খেলতে খেলতে গলা ছেড়ে গান ধরা। মমিন বলেন, ‘আগে মন খারাপ বেশি হতো। এহন মোবাইলে যোগাযোগ করি, মেয়ের সঙ্গে কথা বলি।’
এনামুল বলেন, ‘ঘুম না আইসলে মোবাইলেই মমতাজের গান শুনি, বুকটা ফাইট্টা যায়...।’ আপনারা লিচু খান না?
এনামুল বলেন, ‘যত দিন লিচু না ভাঙব তত দিন হামরা লিচু মুখে করি না।’
কোন কোন জাতের লিচু আছে বাগানে? প্রশ্ন করতেই মমিন হড়হড় করে বলতে থাকেন নামগুলো—মুম্বাই, মাদরাজি, বেদেনা আর চায়না থ্রি। তিনি জানান, মাদরাজি লিচুর হাজারের দাম এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৮০০-র মতো হলেও চায়না থ্রি লিচুর দাম সব সময় থাকে আকাশচুম্বী। কখনো কখনো এ জাতের প্রতিটি লিচুর দাম পড়ে ৮ থেকে ১০ টাকা। এ জাতের লিচুর দেখা মেলে না কোনো বাজারে। বাগান থেকেই বিশেষ ব্যবস্থায় লিচুগুলো চলে যায় দেশের প্রভাবশালীদের বাড়িতে। মমিনের কথায় আমাদের দীর্ঘশ্বাস ওঠে।
এনামুল জানান, তাঁরা লিচু বিক্রি করেন এক হাজার ১০০টিতে হাজার ধরে। লিচু বিক্রির সময় তাঁরা লিচু ভেঙে আঁটি বেঁধে দেন। মমিনের ভাষায়, ‘হামরা শুধু ভাইঙ্গা গুনতি দেই।’ লিচু বিক্রির সময় মনে মনে একধরনের কষ্ট টের পান এনামুল, মমিনসহ সব বাড়্যালরা। অতঃপর বাগানের মায়া ভুলে তাঁরা ফিরে যান আপন সংসারে।
ফেরার পথে মাধববাটির বাগানে থেমে থেমেই শব্দ করছিল ফটফটিয়াগুলো। কয়েক দিন পরই লিচু ভাঙার হিড়িক পড়বে মাধববাটিতে। লিচু ভাঙার পর আপন ঘরে ফিরবেন বাড়্যালরা। এভাবেই কেটে যায় বাড়্যালদের এক একটি বছর। এক বাগানের মায়া ভুলতেই পরের বছর মেলে অন্য কোনো বাগান। কিন্তু বাড়্যালদের জীবন থেকে কখনো হারায় না ফটফটিয়ার শব্দ আর লিচু ভাঙার কষ্টগুলো।’
সালেক খোকন

No comments

Powered by Blogger.