বিচার বিভাগ-প্রধান বিচারপতি-আইনমন্ত্রী দ্বৈরথ by শেখ হাফিজুর রহমান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বিচার বিভাগ নিয়ে বিতর্কে অবতীর্ণ হন। ১৫ মে কাকরাইলে বিচারপতিদের জন্য বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আইনমন্ত্রী বিচার বিভাগের কঠোর সমালোচনা করলে প্রধান বিচারপতিও তার কড়া
জবাব দেন। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মামলার জটসহ বিচার বিভাগের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে বিচারপতিদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরও এতটুকু অগ্রগতি হয়নি। আইনমন্ত্রী বলেন, জনগণের দুর্ভোগ নিরসনে বিচার বিভাগ আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে আমার জানা নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিচার বিভাগের অচিরেই ভেঙে পড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা আছে।
আইনমন্ত্রীর সমালোচনার জবাবে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, বিচার বিভাগ হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটার মতো স্বাধীনতা পেয়েছে। তিনি বলেন, পুরো বিচার বিভাগ অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক সমর্থন ছাড়াই চলছে। তিনি বলেন, বিচার বিভাগে মামলার যে পাহাড় জমেছে, তা নিরসনের জন্য বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকের সংখ্যা না বাড়িয়ে, অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুয়োগ-সুবিধা না দিয়ে শুধু বিচারকদের দোষারোপ করে সমস্যার সমাধান হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বিতর্ককে আমি গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে মনে করি। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নানা বিষয়ে বিতর্ক হবে, বিতর্কের মাধ্যমে প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত হলে সরকার তা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। এতে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে, সুশাসন অর্থবহ হয়ে উঠবে। প্রধান বিচারপতি-আইনমন্ত্রী দ্বৈরথে আমাদের তরফে যে লাভ হলো তা হচ্ছে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারপতি এবং আইন ও বিচারিক বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী স্বীকার করে নিলেন, বিচার বিভাগের অবস্থা ভালো নয়। আইনমন্ত্রী আক্রমণ করলেন বিচার বিভাগ তথা বিচারকদের, আর প্রধান বিচারপতি বললেন, বিচারকস্বল্পতা এবং অবকাঠামো ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অপর্যাপ্ততার কথা। তাহলে নির্ধারিত সময়ে, কম খরচে ও কম ঝামেলায় মামলা নিষ্পত্তি, চূড়ান্ত অর্থে জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের কী অবস্থা? নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক! শুধু বিচার বিভাগ নয়, গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিভাগের অবস্থাই হতাশাব্যঞ্জক। বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার—কোনো বিভাগই কেন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াচ্ছে না? তাহলে গণতন্ত্র কীভাবে শক্তিশালী হবে, সুশাসন কী করে অর্থবহ হবে? ৪০ বছর বয়সী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনগণ কী পেয়েছে জানি না, তবে রাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী-কাম-রাজনীতিবিদ ও কনসালট্যান্টরা তাঁদের ষোলোআনা সুবিধাই আদায় করে নিয়েছেন।
বিচার বিভাগের কথায় ফিরে আসি আবার। সাপ্তাহিক ২০০০-এর ২০১০ সালের ৫ নভেম্বর সংখ্যায় বিচার বিভাগের ওপর যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, সেখান থেকে কিছু তথ্য উদ্ধৃত করছি। ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত এক হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা ও সেশনস আদালতে এক হাজার ৭০০ জন বিচারক বিচারিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ যখন নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়, তখন বাংলাদেশের আদালতগুলোতে নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষারত বা ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ। নতুন কোনো মামলা যদি দায়ের করা নাও হয়, তাহলেও কর্মরত বিচারকদের ১৮ লাখ মামলা নিষ্পত্তি করতে ১৬ বছর লেগে যাবে। সাপ্তাহিক ২০০০-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের একজন বিচারককে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওই পরিমাণ কাজ করেন ১০ জন বিচারক। এ ছাড়া বিচারকদের এজলাস, পরিবহন, থাকার ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও অপর্যাপ্ত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা। অনিবার্য ফলাফল হচ্ছে ঝুলে থাকা ১৮ লাখ মামলা। যে মামলা দু-তিন বছরে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেই মামলা নিষ্পত্তি করতে ১০ থেকে ১৫ বছর চলে যাচ্ছে। কখনো কখনো কয়েক প্রজন্ম চলে যাচ্ছে একটি মামলা নিষ্পত্তি করতে। এ যেন রিলে রেসের মতো! এক প্রজন্ম মৃত্যুর সময় আরেক প্রজন্মের কাছে মামলার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস যে কান্ট্রি কমার্শিয়াল গাইড তৈরি করেছে, তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি মামলা শুরু হওয়ার পর রায় দেওয়া পর্যন্ত ১০ বছর চলে যায় এবং এই দীর্ঘসূত্রতার জন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যেখানে দু-এক বছরের মধ্যে কোনো দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেখানে তা নিষ্পত্তি হতে ১০-১৫ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। যখন মামলার রায় দেওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তখন ওই রায়ের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। এটা বলা হয় যে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বলাই সংগত।
মামলার দীর্ঘসূত্রতার জন্য আইনমন্ত্রী শুধু বিচারকদের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইনজীবীদের অসততার কথা কেন তিনি বললেন না? অনেক আইনজীবী অর্থ উপার্জনের জন্য মামলা নিষ্পত্তি না করে বছরের পর বছর তা হাতে রেখে দেন। আইনজীবীরা নানাভাবে মক্কেলকে সর্বস্বান্ত করেন, বিশেষ করে ফৌজদারি মামলায় তালিকাবদ্ধ সন্ত্রাসীদের ‘জামিন পাইয়ে দেওয়া’ তো এক জমজমাট ব্যবসায় পরিণত হয়েছে! অভিযুক্ত আসামি (মূলত সন্ত্রাসী) চুক্তি করে আইনজীবীর সঙ্গে। আর ‘জামিন পাইয়ে’ দেওয়ার এই ব্যবসা শুধু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেই সীমাবদ্ধ নেই।
নানা রকম তথ্য-উপাত্ত ও প্রতিবেদন দ্বারা উকিলদের (সৎ আইনজীবীদের কথা আমি বলছি না) অসততা স্বীকৃত। ট্রাইব্যুনাল করে অসৎ আইনজীবীদের শাস্তির বিধান থাকলেও বার কাউন্সিলের তৎপরতা এ ব্যাপারে নেই বললেই চলে। একসময় বিচারকদের সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ খুব একটা ছিল না। কিন্তু বিচারকদের সততা ও নিষ্ঠাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। টিআইবির খানা জরিপ ২০১০-এ দুর্নীতির শীর্ষে বিচার বিভাগের অবস্থান এ কথাকেই সমর্থন করে।
একটা রাষ্ট্রের মধ্যে নানা বিভাগ থাকে, যেমন—শ্রম বিভাগ, পুুলিশ বিভাগ, যোগাযোগ বিভাগ, পানিসম্পদ বিভাগ, বন বিভাগ ইত্যাদি। ওই সব বিভাগের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্নীতি অনেক সময় সহনীয়। ওই বিচ্যুতিতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়, জনগণ কষ্ট পায়, কিন্তু ওই ক্ষতি ও কষ্ট সামলে নেওয়া যায়। কিন্তু বিচার বিভাগের ওপর আস্থা নষ্ট হলে, পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। কেননা, বিচার বিভাগ যেমন সংবিধানের অভিভাবক, তেমনি মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর বিতর্কের সুবাদে বিচার বিভাগের সমস্যা যেহেতু চিহ্নিত হলো, এবার আমরা চাইব, সরকার বিচার বিভাগের সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। বিচারক ও আইনজীবীরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন বলেও প্রত্যাশা রইল।
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com
আইনমন্ত্রীর সমালোচনার জবাবে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, বিচার বিভাগ হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটার মতো স্বাধীনতা পেয়েছে। তিনি বলেন, পুরো বিচার বিভাগ অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক সমর্থন ছাড়াই চলছে। তিনি বলেন, বিচার বিভাগে মামলার যে পাহাড় জমেছে, তা নিরসনের জন্য বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকের সংখ্যা না বাড়িয়ে, অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুয়োগ-সুবিধা না দিয়ে শুধু বিচারকদের দোষারোপ করে সমস্যার সমাধান হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বিতর্ককে আমি গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে মনে করি। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নানা বিষয়ে বিতর্ক হবে, বিতর্কের মাধ্যমে প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত হলে সরকার তা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। এতে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে, সুশাসন অর্থবহ হয়ে উঠবে। প্রধান বিচারপতি-আইনমন্ত্রী দ্বৈরথে আমাদের তরফে যে লাভ হলো তা হচ্ছে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারপতি এবং আইন ও বিচারিক বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী স্বীকার করে নিলেন, বিচার বিভাগের অবস্থা ভালো নয়। আইনমন্ত্রী আক্রমণ করলেন বিচার বিভাগ তথা বিচারকদের, আর প্রধান বিচারপতি বললেন, বিচারকস্বল্পতা এবং অবকাঠামো ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অপর্যাপ্ততার কথা। তাহলে নির্ধারিত সময়ে, কম খরচে ও কম ঝামেলায় মামলা নিষ্পত্তি, চূড়ান্ত অর্থে জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের কী অবস্থা? নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক! শুধু বিচার বিভাগ নয়, গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিভাগের অবস্থাই হতাশাব্যঞ্জক। বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার—কোনো বিভাগই কেন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াচ্ছে না? তাহলে গণতন্ত্র কীভাবে শক্তিশালী হবে, সুশাসন কী করে অর্থবহ হবে? ৪০ বছর বয়সী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনগণ কী পেয়েছে জানি না, তবে রাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী-কাম-রাজনীতিবিদ ও কনসালট্যান্টরা তাঁদের ষোলোআনা সুবিধাই আদায় করে নিয়েছেন।
বিচার বিভাগের কথায় ফিরে আসি আবার। সাপ্তাহিক ২০০০-এর ২০১০ সালের ৫ নভেম্বর সংখ্যায় বিচার বিভাগের ওপর যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, সেখান থেকে কিছু তথ্য উদ্ধৃত করছি। ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত এক হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা ও সেশনস আদালতে এক হাজার ৭০০ জন বিচারক বিচারিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ যখন নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়, তখন বাংলাদেশের আদালতগুলোতে নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষারত বা ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ। নতুন কোনো মামলা যদি দায়ের করা নাও হয়, তাহলেও কর্মরত বিচারকদের ১৮ লাখ মামলা নিষ্পত্তি করতে ১৬ বছর লেগে যাবে। সাপ্তাহিক ২০০০-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের একজন বিচারককে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওই পরিমাণ কাজ করেন ১০ জন বিচারক। এ ছাড়া বিচারকদের এজলাস, পরিবহন, থাকার ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও অপর্যাপ্ত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা। অনিবার্য ফলাফল হচ্ছে ঝুলে থাকা ১৮ লাখ মামলা। যে মামলা দু-তিন বছরে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেই মামলা নিষ্পত্তি করতে ১০ থেকে ১৫ বছর চলে যাচ্ছে। কখনো কখনো কয়েক প্রজন্ম চলে যাচ্ছে একটি মামলা নিষ্পত্তি করতে। এ যেন রিলে রেসের মতো! এক প্রজন্ম মৃত্যুর সময় আরেক প্রজন্মের কাছে মামলার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস যে কান্ট্রি কমার্শিয়াল গাইড তৈরি করেছে, তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি মামলা শুরু হওয়ার পর রায় দেওয়া পর্যন্ত ১০ বছর চলে যায় এবং এই দীর্ঘসূত্রতার জন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যেখানে দু-এক বছরের মধ্যে কোনো দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেখানে তা নিষ্পত্তি হতে ১০-১৫ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। যখন মামলার রায় দেওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তখন ওই রায়ের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। এটা বলা হয় যে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বলাই সংগত।
মামলার দীর্ঘসূত্রতার জন্য আইনমন্ত্রী শুধু বিচারকদের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইনজীবীদের অসততার কথা কেন তিনি বললেন না? অনেক আইনজীবী অর্থ উপার্জনের জন্য মামলা নিষ্পত্তি না করে বছরের পর বছর তা হাতে রেখে দেন। আইনজীবীরা নানাভাবে মক্কেলকে সর্বস্বান্ত করেন, বিশেষ করে ফৌজদারি মামলায় তালিকাবদ্ধ সন্ত্রাসীদের ‘জামিন পাইয়ে দেওয়া’ তো এক জমজমাট ব্যবসায় পরিণত হয়েছে! অভিযুক্ত আসামি (মূলত সন্ত্রাসী) চুক্তি করে আইনজীবীর সঙ্গে। আর ‘জামিন পাইয়ে’ দেওয়ার এই ব্যবসা শুধু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেই সীমাবদ্ধ নেই।
নানা রকম তথ্য-উপাত্ত ও প্রতিবেদন দ্বারা উকিলদের (সৎ আইনজীবীদের কথা আমি বলছি না) অসততা স্বীকৃত। ট্রাইব্যুনাল করে অসৎ আইনজীবীদের শাস্তির বিধান থাকলেও বার কাউন্সিলের তৎপরতা এ ব্যাপারে নেই বললেই চলে। একসময় বিচারকদের সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ খুব একটা ছিল না। কিন্তু বিচারকদের সততা ও নিষ্ঠাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। টিআইবির খানা জরিপ ২০১০-এ দুর্নীতির শীর্ষে বিচার বিভাগের অবস্থান এ কথাকেই সমর্থন করে।
একটা রাষ্ট্রের মধ্যে নানা বিভাগ থাকে, যেমন—শ্রম বিভাগ, পুুলিশ বিভাগ, যোগাযোগ বিভাগ, পানিসম্পদ বিভাগ, বন বিভাগ ইত্যাদি। ওই সব বিভাগের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্নীতি অনেক সময় সহনীয়। ওই বিচ্যুতিতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়, জনগণ কষ্ট পায়, কিন্তু ওই ক্ষতি ও কষ্ট সামলে নেওয়া যায়। কিন্তু বিচার বিভাগের ওপর আস্থা নষ্ট হলে, পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। কেননা, বিচার বিভাগ যেমন সংবিধানের অভিভাবক, তেমনি মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর বিতর্কের সুবাদে বিচার বিভাগের সমস্যা যেহেতু চিহ্নিত হলো, এবার আমরা চাইব, সরকার বিচার বিভাগের সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। বিচারক ও আইনজীবীরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন বলেও প্রত্যাশা রইল।
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com
No comments