মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি by ড. মুহাম্মদ ইউনূস
গত ২২ ফেব্রুয়ারি সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টারি ডেলিগেটদের সঙ্গে আলাপকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার ব্যাপারে তাঁদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব করেন। তিনি প্রস্তাব রাখেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বব্যাংকের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগের জন্য যেন আমার নাম প্রস্তাব করে।
তিনি এ পদে আমার যোগ্যতার ব্যাপারেও ডেলিগেটদের কাছে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন। এর পর থেকে সংবাদমাধ্যমে প্রস্তাবটি নিয়ে অনেক উৎসাহব্যঞ্জক আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এই প্রস্তাবটি আমার জন্য ছিল একটি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত সুসংবাদ। বিশ্বের সুপরিচিত এবং বিপুল প্রভাবশালী একটি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে আমার নাম প্রস্তাব করার অনুরোধ জানিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সহূদয়তার পরিচয় দিয়েছেন, তার জন্য আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
এই সংবাদে আনন্দিত হওয়ার আমার আরেকটি কারণ হলো, প্রস্তাবটি এবং তার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার যোগ্যতার যে উদার তালিকা দিয়েছেন তার মাধ্যমে পরিষ্কার হলো যে আমার সম্বন্ধে এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্বন্ধে তাঁর যে পূর্ববর্তী ধারণাগুলো ছিল, সেগুলোর অবসান হয়েছে। এতে আশান্বিত হয়েছি যে এখন থেকে আমার প্রতি এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ অবস্থানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। এর ফলে আমার এবং আমার মতো অনেক দেশবাসীর মাথার ওপর থেকে দুঃখ ও দুশ্চিন্তার একটা বিরাট বোঝা নেমে যাবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে অনেকে এই প্রস্তাবের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন; যুক্তরাষ্ট্রের মাননীয় রাষ্ট্রদূত আশ্বাস দিয়েছেন যে আমি আগ্রহী হলে তাঁর দেশ এই প্রস্তাবের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেবে। আমি মাননীয় রাষ্ট্রদূত এবং অন্য সবার প্রতি আমার ওপর তাঁদের আস্থার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আমি নিজে অবশ্য কখনো বিশ্বব্যাংকের প্রধান বা ওই রকমের বড় কোনো দায়িত্ব নেওয়ার কথা চিন্তা করিনি। দীর্ঘকালব্যাপী বিশ্বব্যাংকের একজন নিয়মিত সমালোচক হিসেবে আমি তার নীতি ও কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করে এসেছি। এই ব্যাংকের সর্বোচ্চ পদটি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ করে রাখার বিষয়টিও আমার সমালোচনার বিষয়বস্তু ছিল। কিন্তু তাই বলে যে কাজে নিজেকে সঁপে দিয়েছি তার বাইরে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের সর্বোচ্চ দায়িত্ব গ্রহণ করার ব্যাপারে আমার মনে কোনো আগ্রহ জন্মেনি। এখনো এ রকম কোনো আগ্রহ আমার নেই।
অতীতেও আরেকবার আমি এ রকম আলোচনার মধ্যে এসে গিয়েছিলাম। ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন আমাকে ওভাল অফিসে আমন্ত্রণ জানান। নানা বিষয়ের মধ্যে তিনি বিশ্বব্যাংকের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির ব্যাপারে আলাপ করেন এবং আমার পরামর্শ চান। তিনি জানতে চান, বিশ্বব্যাংকের জন্য নতুন একজন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করতে হবে, এ পদে আমার কোনো আগ্রহ হবে কি না। আমি সবিনয়ে তাঁকে অনুরোধ করেছি আমার কাজের মধ্যে আমাকে নিবিষ্ট থাকার সুযোগ দেওয়ার জন্য। এরপর পত্রপত্রিকায় বিশ্বব্যাংকের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাব্য ব্যক্তি হিসেবে আমার নাম প্রকাশিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একজন বিরক্ত মার্কিন সাংবাদিক আমার যে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন, তার একটা কৌতুকময় বর্ণনা আমার আত্মজীবনী ব্যাংকার টু দি পুওর বইটিতে আমি উল্লেখ করেছি। সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমি কী কী পদক্ষেপ নেব। সংবাদটির প্রতি সাংবাদিক মহোদয়ের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অনুভব করে আমি বলেছিলাম যে আমার প্রথম পদক্ষেপ হবে বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয়টি ওয়াশিংটন থেকে সরিয়ে বাংলাদেশে স্থানান্তর করা। আমার জবাবে সাংবাদিক খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন জিম উলফেনসনকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ দেন। তিনি জানতেন না, আমার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল।
তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়ার কিছুদিন পর আমাকে বিশ্বব্যাংকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ, অন্যতম ম্যানেজিং ডিরেক্টর হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। একই কারণে আমি তাঁর অনুরোধও রাখতে পারিনি।
২০০৫ সালের শেষের দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব খালেদা জিয়া আমাকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল পদে মনোনয়ন দানের প্রস্তুতি নেন এবং আমার সম্মতি চান। জাতিসংঘের নিয়ম অনুসারে সেবার পদটি একজন এশিয়াবাসীর প্রাপ্য ছিল। আগে থেকে কয়েকটি ইউরোপীয় এবং এশিয়ান দেশ আমাকে আগ্রহী হওয়ার জন্য উৎসাহিত করছিলেন। আমি তাদের আমার অপারগতার কথা জানিয়ে যাচ্ছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও তাঁর সহূদয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার নিজের কাজে নিয়োজিত থাকার ব্যাপারে সুযোগ প্রার্থনা করেছিলাম। তিনি কয়েকবার অনুরোধ করার পরও আমি আমার মন পাল্টাতে পারিনি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান প্রস্তাবে যাঁরা উৎসাহিত বোধ করছেন, তাঁরা হয়তো আমার ওপর নারাজ হবেন এই ভেবে যে দেশের জন্য এত বড় সুযোগের প্রতি আমি গুরুত্ব দিচ্ছি না। আমার দিকটার কথাও তাঁদের বিবেচনার জন্য নিবেদন করছি। সারা জীবন আমি যে কাজ আমার মতো করে করতে পারি, এবং আমার কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, সেটাই করে গেছি। সামাজিক ব্যবসাকে সবার কাছে পরিচিত করা, সেটার সফল বাস্তবায়ন করা, পৃথিবীর তরুণদের মানুষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশাবাদী করে তোলা এবং নতুন পৃথিবী সৃষ্টিতে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণে আগ্রহী করে তোলার কাজেই আমি নিয়োজিত। এ কাজে আমি পরিপূর্ণভাবে নিয়োজিত থাকতে চাই। আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে ‘বিশ্ব সামাজিক ব্যবসা ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বিশ্বের মৌলিক অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশসংক্রান্ত সমস্যার দ্রুত সমাধানে এই ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যদি কেউ আমাকে অনুরোধ করে, তবে সানন্দে সে দায়িত্ব নিতে আমি এগিয়ে আসব—তত দিনে আমার বয়স যতই হোক।
No comments