রাজনীতি-অলি বারবার ফিরে আসে... by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
রবীন্দ্রনাথের একটি বহুল শ্রুত গানের কলি, ‘অলি বারবার ফিরে আসে, অলি বারবার ফিরে যায়।’ না, কবিগুরুর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নয়, এই গানের বাণী স্মরণে এল বাংলাদেশের রাজনীতির দ্রুত বাঁক পরিবর্তন ও রাজনীতিবিদদের চরিত্রের রং বদলের প্রসঙ্গে।
কয়েক বছর ধরে চালু হয়েছে ‘ইফতারের রাজনীতি’র সংস্কৃতি। এই রাজনীতি এসেছে সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে। নির্বাচনের দুই-আড়াই বছর আগেই শত্রু-মিত্র নির্ধারণ করে চলছে জোট গঠন-প্রক্রিয়া। ইফতারের রাজনীতিতে এবারে মুখ্য হয়ে ওঠে কাকে কাছে টানা যাবে, নির্বাচনী জোটকে কীভাবে শক্তিশালী করা যাবে, সেই বিষয়টি। তাই ছোট ছোট দলের দর বেড়েছে—একেকজন রাজনীতিককে গণনা করা হচ্ছে একেকটি আসনের হিসাবে। কাদের সিদ্দিকী গামছা পরিয়ে দিচ্ছেন বড় দুই দলের নীতিনির্ধারকদের, বদরুদ্দোজা চৌধুরী গিয়ে বসছেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর পাশে, হাসিমুখে বেগম জিয়ার পাশে দেখা যাচ্ছে কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে। ছোট দলের বড় নেতারা দুই পক্ষকেই বাজিয়ে দেখছেন। এখনো নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে খোলাসা করে কিছু বলছেন না। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন অলি আহমদ। ইফতারের টেবিল শুধু নয়, সস্ত্রীক বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবনে গিয়ে দেড়-দুই ঘণ্টা আলাপ করে এসেছেন তিনি। সেই আলাপের সারমর্ম আমরা জানি না। তবে তাঁর কথায় এখন যে সুর বাজছে, তাতে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, নিজের নির্বাচনী আসনটির ব্যাপারে আশ্বস্ত হয়ে এসেছেন তিনি। সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সরব হওয়ার, আন্দোলনে বিএনপির শরিক হওয়ার যে কথা তিনি এখন বলছেন, তা কতটা জনগণের অধিকার রক্ষায় আর কতটা নিজের নির্বাচনী আসন রক্ষায়, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে যে বিরোধ ছিল তা পারিবারিক, আদর্শগত বিরোধ নয়।’ স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হলো কেন? এই দলের (এলডিপি) নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তো বেগম খালেদা জিয়ার পারিবারিক সম্পর্কও ছিল না, বিরোধও ছিল না। তাঁদের কেন আপনাদের পারিবারিক বিরোধের পুতুলনাচে শরিক করলেন?
বিএনপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার ব্যাপারে কাদের সিদ্দিকীর আপত্তির জায়গাটা হচ্ছে জামায়াত। বিএনপি এই সঙ্গীকে না ছাড়লে তাঁর পক্ষে ওই জোটে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। বদরুদ্দোজা চৌধুরীরও ইতস্তত ভাব একই ব্যাপারে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমদ বীর বিক্রমের এ ব্যাপারে বিশেষ আপত্তি আছে বলে মনে হলো না। জামায়াতের ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘জামায়াত যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করে, তাহলে পাক, আমার সঙ্গে কাজ করলে নাপাক, এটা হতে পারে না। জামায়াতের সব লোক তো আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি। ৪০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, ওদের অনেকের বয়স ৫০ বছরের নিচে, তা হলে তারা রাজাকার হলো কীভাবে?’ তাঁর এই যুক্তির বিপক্ষে অনেক কথাই তোলা যায়, যেমন—আওয়ামী লীগ নাপাক কাজ করলে অলি আহমদকেও তা করতে হবে কেন? কিংবা ৫০ বছরের নিচে যাদের বয়স, তাঁরাই বা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সংগঠনটিকেই তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন কেন ইত্যাদি। কিন্তু আমরা সেসব প্রশ্নে না গিয়ে বরং অলি আহমদের অতীতের বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাই। চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে জামায়াতের সঙ্গে সখ্যের জন্য বিএনপি নেতৃত্বের সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, ‘এদের পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত-শিবির আশ্রিত ক্যাডাররা সারা দেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলার সুযোগ পেয়েছে।’
আসলে অলির জামায়াত-বিরোধিতা যতটা না আদর্শিক, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিগত লাভালাভের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চন্দনাইশ-সাতকানিয়া এবং সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন দুটিতে নির্বাচন করে আসছেন অলি আহমদ। দুটি আসনে জিতে একটিতে উপনির্বাচনে তাঁর স্ত্রী মমতাজ অলিকে প্রার্থীও করেছেন আগে। কিন্তু সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে তাঁর বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে জামায়াত। চারদলীয় জোটের শরিক হিসেবে এই আসনটির দাবি জানিয়েছে তারা। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির হাইকমান্ড আসনটি জামায়াতকে ছেড়ে দিলেও অলি সেই সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে জোটের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন এবং হারেন। বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে অলির বিরোধ সেখান থেকেই শুরু।
হতাশা ও ক্ষোভ থেকে নতুন রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) গঠন করেছিলেন বিএনপিতে অবমূল্যায়িত আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে মিলে। কিন্তু বিএনপির প্রাক্তন দুই নেতার এই ঐক্য নতুন কোনো ধারা তৈরি করতে তো পারলই না, বরং শুরুতেই রেষারেষির কারণে ‘বিকল্প ধারা’র সন্ধান করতে হলো ডা. চৌধুরীকে। যা-ই হোক, সে অন্য প্রসঙ্গ।
অলি আহমদ বলেছেন, বেগম জিয়ার সঙ্গে তাঁর বিরোধটি ছিল পারিবারিক। কিন্তু সেই পারিবারিক বিরোধকে প্রকাশ্যে এনে যেসব কথা তখন তিনি বলেছিলেন, সেসব কথা কি শুধু পারিবারিক গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল? ‘বিএনপির জন্মের পর মুসলিম লীগের মৃত্যু হয়েছিল, এলডিপির জন্মের কারণে বিএনপির মৃত্যু হবে’ কিংবা ‘দুই হা অর্থাৎ হাওয়া ভবন ও হারিছ চৌধুরীর কারণে খালেদা জিয়া হাওয়া হয়ে যাবেন’ প্রভৃতি উক্তি শুধুই পারিবারিক? সেই সময়কার রাজনৈতিক বাস্তবতার কোনো প্রতিফলন এতে ছিল না? এমনকি বাংলাদেশে উগ্র জঙ্গিবাদীদের উত্থানের জন্যও তো তিনি দায়ী করেছিলেন তাঁর ‘পারিবারিক ঘনিষ্ঠদের’ই, বলেছিলেন ‘বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ উত্থানের জন্য খালেদা ও তাঁর পুত্র তারেক দায়ী।’
বলেছি, কর্নেল অলি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভে মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবদান সম্পর্কে তিনি যেভাবে লিখেছেন, তাতে মনে হয় তাঁর মতো দু-একজন সেনা কর্মকর্তা না থাকলে মুক্তিযুদ্ধই হতো না। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস, সেই সংগ্রামের নেতৃত্বে থাকা রাজনীতিবিদদের ত্যাগ-তিতিক্ষার জীবন, পাকিস্তানি শাসকদের জেল-জুলুম-হুলিয়া-নির্যাতনের সামনেও অনমনীয় মনোবল এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার দীর্ঘ ধারাবাহিক ইতিহাস সেখানে তুচ্ছ হয়ে যায়। জিয়াউর রহমান ও তিনি সুপরিকল্পিতভাবে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করেছেন, অতঃপর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলে যে তথ্য তিনি পরিবেশন করেছেন, তাঁর অভিসন্দর্ভে, তাতে মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাজনীতিকদের ভূমিকা যেমন অকথিত থেকে যায়, তেমনি উপেক্ষা করা হয় আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, বেলাল মোহাম্মদসহ তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের সেই শব্দসৈনিকদেরও, যাঁরা জীবন বাজি রেখে নানা কারিগরি সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই কেন্দ্রটি চালু করেছিলেন। অলি আহমদদের হাতে ইতিহাস সময়-সুযোগমতো বদলে যায়, তাই বিএনপিতে অবহেলিত হয়ে নতুন দল গঠন করার পর বলতে পেরেছিলেন, ‘জিয়াকে রাস্তা থেকে ডেকে এনে যুদ্ধে নামিয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করিয়েছি।’
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তাই রাজনীতিবিদদের লাগামছাড়া কথারও শেষ নেই। একটিমাত্র আসনের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়ে, মন্ত্রিত্ব না পেয়ে, দলে গুরুত্ব হারিয়ে ক্ষুব্ধ অলি ২০০৬ সালে বলেছিলেন, ‘আমিই বেগম জিয়াকে রান্নাঘর থেকে রাজনীতিতে এনেছি, আবারও তাঁকে রান্নাঘরে ফিরে যেতে হবে।’ বেগম খালেদা জিয়া রান্নাঘরে ফিরে যাননি, বরং পাঁচ বছর পর অলি ফিরে এসেছেন। তাঁদের ‘পারিবারিক সম্পর্ক’ উত্তরোত্তর মধুর হোক।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
বিএনপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার ব্যাপারে কাদের সিদ্দিকীর আপত্তির জায়গাটা হচ্ছে জামায়াত। বিএনপি এই সঙ্গীকে না ছাড়লে তাঁর পক্ষে ওই জোটে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। বদরুদ্দোজা চৌধুরীরও ইতস্তত ভাব একই ব্যাপারে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমদ বীর বিক্রমের এ ব্যাপারে বিশেষ আপত্তি আছে বলে মনে হলো না। জামায়াতের ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘জামায়াত যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করে, তাহলে পাক, আমার সঙ্গে কাজ করলে নাপাক, এটা হতে পারে না। জামায়াতের সব লোক তো আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি। ৪০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, ওদের অনেকের বয়স ৫০ বছরের নিচে, তা হলে তারা রাজাকার হলো কীভাবে?’ তাঁর এই যুক্তির বিপক্ষে অনেক কথাই তোলা যায়, যেমন—আওয়ামী লীগ নাপাক কাজ করলে অলি আহমদকেও তা করতে হবে কেন? কিংবা ৫০ বছরের নিচে যাদের বয়স, তাঁরাই বা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সংগঠনটিকেই তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন কেন ইত্যাদি। কিন্তু আমরা সেসব প্রশ্নে না গিয়ে বরং অলি আহমদের অতীতের বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাই। চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে জামায়াতের সঙ্গে সখ্যের জন্য বিএনপি নেতৃত্বের সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, ‘এদের পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত-শিবির আশ্রিত ক্যাডাররা সারা দেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলার সুযোগ পেয়েছে।’
আসলে অলির জামায়াত-বিরোধিতা যতটা না আদর্শিক, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিগত লাভালাভের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চন্দনাইশ-সাতকানিয়া এবং সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন দুটিতে নির্বাচন করে আসছেন অলি আহমদ। দুটি আসনে জিতে একটিতে উপনির্বাচনে তাঁর স্ত্রী মমতাজ অলিকে প্রার্থীও করেছেন আগে। কিন্তু সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে তাঁর বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে জামায়াত। চারদলীয় জোটের শরিক হিসেবে এই আসনটির দাবি জানিয়েছে তারা। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির হাইকমান্ড আসনটি জামায়াতকে ছেড়ে দিলেও অলি সেই সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে জোটের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন এবং হারেন। বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে অলির বিরোধ সেখান থেকেই শুরু।
হতাশা ও ক্ষোভ থেকে নতুন রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) গঠন করেছিলেন বিএনপিতে অবমূল্যায়িত আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে মিলে। কিন্তু বিএনপির প্রাক্তন দুই নেতার এই ঐক্য নতুন কোনো ধারা তৈরি করতে তো পারলই না, বরং শুরুতেই রেষারেষির কারণে ‘বিকল্প ধারা’র সন্ধান করতে হলো ডা. চৌধুরীকে। যা-ই হোক, সে অন্য প্রসঙ্গ।
অলি আহমদ বলেছেন, বেগম জিয়ার সঙ্গে তাঁর বিরোধটি ছিল পারিবারিক। কিন্তু সেই পারিবারিক বিরোধকে প্রকাশ্যে এনে যেসব কথা তখন তিনি বলেছিলেন, সেসব কথা কি শুধু পারিবারিক গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল? ‘বিএনপির জন্মের পর মুসলিম লীগের মৃত্যু হয়েছিল, এলডিপির জন্মের কারণে বিএনপির মৃত্যু হবে’ কিংবা ‘দুই হা অর্থাৎ হাওয়া ভবন ও হারিছ চৌধুরীর কারণে খালেদা জিয়া হাওয়া হয়ে যাবেন’ প্রভৃতি উক্তি শুধুই পারিবারিক? সেই সময়কার রাজনৈতিক বাস্তবতার কোনো প্রতিফলন এতে ছিল না? এমনকি বাংলাদেশে উগ্র জঙ্গিবাদীদের উত্থানের জন্যও তো তিনি দায়ী করেছিলেন তাঁর ‘পারিবারিক ঘনিষ্ঠদের’ই, বলেছিলেন ‘বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ উত্থানের জন্য খালেদা ও তাঁর পুত্র তারেক দায়ী।’
বলেছি, কর্নেল অলি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভে মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবদান সম্পর্কে তিনি যেভাবে লিখেছেন, তাতে মনে হয় তাঁর মতো দু-একজন সেনা কর্মকর্তা না থাকলে মুক্তিযুদ্ধই হতো না। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস, সেই সংগ্রামের নেতৃত্বে থাকা রাজনীতিবিদদের ত্যাগ-তিতিক্ষার জীবন, পাকিস্তানি শাসকদের জেল-জুলুম-হুলিয়া-নির্যাতনের সামনেও অনমনীয় মনোবল এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার দীর্ঘ ধারাবাহিক ইতিহাস সেখানে তুচ্ছ হয়ে যায়। জিয়াউর রহমান ও তিনি সুপরিকল্পিতভাবে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করেছেন, অতঃপর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলে যে তথ্য তিনি পরিবেশন করেছেন, তাঁর অভিসন্দর্ভে, তাতে মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাজনীতিকদের ভূমিকা যেমন অকথিত থেকে যায়, তেমনি উপেক্ষা করা হয় আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, বেলাল মোহাম্মদসহ তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের সেই শব্দসৈনিকদেরও, যাঁরা জীবন বাজি রেখে নানা কারিগরি সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই কেন্দ্রটি চালু করেছিলেন। অলি আহমদদের হাতে ইতিহাস সময়-সুযোগমতো বদলে যায়, তাই বিএনপিতে অবহেলিত হয়ে নতুন দল গঠন করার পর বলতে পেরেছিলেন, ‘জিয়াকে রাস্তা থেকে ডেকে এনে যুদ্ধে নামিয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করিয়েছি।’
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তাই রাজনীতিবিদদের লাগামছাড়া কথারও শেষ নেই। একটিমাত্র আসনের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়ে, মন্ত্রিত্ব না পেয়ে, দলে গুরুত্ব হারিয়ে ক্ষুব্ধ অলি ২০০৬ সালে বলেছিলেন, ‘আমিই বেগম জিয়াকে রান্নাঘর থেকে রাজনীতিতে এনেছি, আবারও তাঁকে রান্নাঘরে ফিরে যেতে হবে।’ বেগম খালেদা জিয়া রান্নাঘরে ফিরে যাননি, বরং পাঁচ বছর পর অলি ফিরে এসেছেন। তাঁদের ‘পারিবারিক সম্পর্ক’ উত্তরোত্তর মধুর হোক।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments