ধর নির্ভয় গান-নিকষ কালো যামিনীর শেষেই আছে প্রত্যাশার প্রভাত by আলী যাকের
মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ। অপকর্মের বিরুদ্ধে কেবল প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রয়োজনে জনসভার মাধ্যমেও যদি এ ধরনের অপকর্ম সম্বন্ধে গণমানুষকে অবহিত করা যায়, তাহলেই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের সেই পথই দেখিয়েছিলেন। তিনি কখনোই জনগণের ওপর আস্থা হারাননি।
সে জন্যই তাঁর আহ্বানে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল
'সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা/অন্ধ বিভাবরী, সঙ্গ পরশহারা'
ঝরে পড়ে শ্রাবণ রাতের আকাশভাঙা জল। কখনও শিপশিপ শব্দে, আবার কখনও ঝমঝমিয়ে। আমি আমার অন্ধকার পড়ার ঘরের জানালার ধারে বসে রাত্রির তৃতীয় প্রহরে গাঢ় তমসাচ্ছন্ন রাত্রির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। কানে ভেসে আসে আমার প্রিয় শিল্পী প্রয়াত কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে 'সঘন গহন রাত্রি ...'। এই পরিবেশে সবকিছু ভুলে যেতে ইচ্ছা হয়। মনে হয় মনটা যেন উড়ে যায় শান্তিনিকেতনে কিংবা শিলাইদহ বা পতিসরে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ উত্তরায়ণের কোনো একটি বাড়িতে বসে শ্রাবণ দেখতেন। অথবা পদ্মার বুকে বোটের মাঝে বসে বর্ষার গান রচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথই আসলে আমাদের জীবনের প্রায় সবরকম বৈচিত্র্য নিয়ে প্রগাঢ় উপলব্ধির কথা বলেছেন। এর সূচনা বোধকরি তাঁর গানগুলোর মধ্যে স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে গানের সুরে সুরে মনে এক ধরনের দোলা লাগে। হঠাৎই মনে হয় যে, আমার এই সমাজ, এই দেশ, এর মানুষ কিংবা গোটা পৃথিবীই যেন তুচ্ছ হয়ে যায় এক শিহরণ লাগা বোধের কাছে। কিন্তু এমন এক প্রজন্মের মানুষ আমি, দেখেছি জীবনে এত কিছু, মানুষের ভালোবাসা, মানুষের হিংস্রতা, মানুষের সীমাহীন যন্ত্রণা কিংবা মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে সংঘাত যে, এমন একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত, বৃষ্টির অবিরাম শব্দ, কণিকার কণ্ঠে 'সঘন গহন রাত্রি'_ এই সবকিছুকে ছাপিয়ে কোথায় যেন একটা যন্ত্রণার ঢেউ তোলে। আমি সজাগ হয়ে উঠি রূঢ় বাস্তবতার শান্তি হরণকারী আক্রমণে।
আমাদের বাল্যকালটা কেটেছে বড় আনন্দে। আম-কাঁঠালের বনে ছুটোছুটি, ছোট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে বালুকাবেলায় গড়াগড়ি, কিংবা ক্ষীণস্রোতা জলে সারাদিন ধরে দাপাদাপি_ এই তো বাল্যকালের স্মৃতি আমার। যান্ত্রিকতার স্বাদ পেতাম কেবল যখন দু'ঘণ্টা কি তিন ঘণ্টা পরপর ওই ছোট শহরের পাশ ঘেঁষে রেলগাড়ি চলে যেত কলকাতার দিকে। আমরা দুটি ভাইবোন দৌড়ে যেতাম কাশবন পেরিয়ে রেললাইনের ধারে। আমাদের স্বপ্ন হতো সেই রেলের যাত্রী এবং সেই স্বপ্নকে বুকে বয়ে নিয়ে আলোকোজ্জ্বল এক বিরাট স্বপ্নের নগরী কলকাতায় চলে যেত বাল্যকালের ট্রেন। এমনকি আমাদের যৌবনে উন্মাতাল রাজনীতি, ভাষা আন্দোলনের সময় ক্ষমতাসীনদের হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি উত্তরাধিকার নিয়েও কী এক অনাবিল সুখে কেটেছে জীবন। হ্যাঁ, ছাত্ররাজনীতি ছিল, প্রতিবাদ ছিল, প্রতিবাদী সাহিত্য-সংস্কৃতি ছিল। দলে দলে বৈরিতা ছিল আবার দিন শেষে গলাগলি ভাবও ছিল। মধুদার ক্যান্টিনের শিঙ্গাড়া ছিল। আর ছিল কাপের পর কাপ চা। সেখান থেকে হঠাৎ করেই দুর্বিনীত শাসকগোষ্ঠীর অকস্মাৎ আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম আমরা। এই আক্রমণ একটিতেই ক্ষান্ত হলো না। চলতে লাগল একের পর এক। যে ভাষা, যে সংস্কৃতি, যে জীবন, যে শান্তি ছিল আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী, তাও ওরা করে দিল ধ্বংস। কিন্তু মানুষ তো আর নির্বীর্য জড় পদার্থ নয়? ঘুরে দাঁড়াল তারা। যুদ্ধ হলো মরণপণ। স্বাধীন হলো দেশ। কিন্তু যে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হলাম আমরা, সেই শত্রু তো হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়? তারা একের পর এক চক্রান্ত করতে লাগল এই দেশকে, এই দেশের আদর্শকে বিধ্বস্ত করে দিতে। কত রকম, কত রূপে যে চক্রান্তের ফাঁদ পাতা হলো, তার হিসাব রাখে কার সাধ্য? শুরু হলো আমাদের জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। তারপর চার প্রধান নেতাকে হত্যা করা হলো জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এরপর শুরু হলো যেখানেই যা কিছু আমাদের মুক্তবুদ্ধির পরিচয়বাহী, তাকে ধ্বংস করার জন্য একের পর এক আক্রমণ। ছায়ানটের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা আক্রমণ, ২১ আগস্ট ২০০৪-এ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল যে দলের দ্বারা, সেই আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা আক্রমণ এবং অসংখ্য মানুষ হত্যা। এসবই বাংলাদেশের চেতনাকে নস্যাৎ করার একটা সুপরিকল্পিত চক্রান্তের ফল। অথচ এসব যখন ঘটছে, তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ হচ্ছে। হয়তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার এই চক্রান্তের তথ্য আহরণের জন্য তদন্তও শুরু করেছে। তারপর সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু আবার শীতল প্রকোষ্ঠে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। একটি দেশকে স্থবির করে দেওয়ার জন্য কত কিছুই না করা হয়েছে, কত কিছুই করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে পাকিস্তানি শত্রুর বিরুদ্ধে জীবনপণ যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি আমরা, তারাই ক্ষমতায় বসিয়েছে এমন সরকার যারা তাদের প্রতি অনুগত সর্বাংশে। পত্রিকায় পড়ি একটি বিশেষ সরকার আমাদের দেশে ক্ষমতায় থাকার সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হয় উত্তর-পূর্ব ভারতে অস্ত্র চালান দিতে। এই সংবাদ ফাঁস করে দেয় ভারতেরই সন্ত্রাসী কোনো নেতা। ট্রাকের পর ট্রাক বিদেশি অস্ত্র ধরা পড়ে এই বাংলাদেশের মাটিতেই। জানতে পাই এর সঙ্গে যুক্ত কেবল পাকিস্তানপন্থি ওই সরকারের মন্ত্রী-আমলারাই নয়, এমনকি আমাদের সবচেয়ে গৌরবের যে সেনাবাহিনী, তার কতিপয় ক্ষমতাবান সদস্য। কী এক ভয়াবহ সময় অতিবাহিত করছি আমরা। কী এক অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে আমাদের চারপাশে। আজ এসব ষড়যন্ত্রের তথ্য একে একে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে কেননা ক্ষমতাসীন সরকার এই দেশকে ভিনদেশি ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের ঘাঁটি করার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে চলেছে। কিন্তু কেবল এই কারণেই ক্ষমতাসীন সরকারকেই হয়তো ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে কোনো এক চক্রান্তের মাধ্যমে। এসব দেখি আর শুনি, কিন্তু এখন আর চমকে উঠি না। সব সম্ভবের এই দেশে এই চরম অনভিপ্রেত এবং দুর্বিনীত কাজ অবলীলায় করা সম্ভব, এ তো প্রায় অবধারিত সত্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
মাঝে মধ্যে গালে হাত দিয়ে ভাবি তাহলে কি আর আমাদের '৭১-এ স্বপ্নে দেখা সোনার বাংলাকে তার স্বীয় গরিমায় প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাব না আমরা? আমি নিরাশাবাদী নই। চরম বিপদেও অসীম সাহস নিয়ে এগিয়ে গেছি সামনের দিকে নির্ভয়ে। আমি নিরাশাবাদী নই এখনও। যদিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বাংলাদেশের আদর্শে উদ্বুদ্ধ যে সরকার আজকে ক্ষমতায় আছে তারা কিন্তু তাদের দায়িত্বটি পরিপূর্ণভাবে সম্পাদন করছেন এই কথাটি বলতে পারব না। যখন একটি দেশের সংস্কৃতি, আদর্শ, মূল্যবোধ এবং দেশটির নিয়ন্ত্রক সংবিধান হুমকির সম্মুখীন হয়, তখন কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। সকলই সম্ভব হয় যদি দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে সব অপকর্মকে রুখে দাঁড়ান। সাধারণ মানুষ এখনও আসল তথ্যগুলো জানে না। জানলে তারাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে দেশপ্রেমিকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এর সামান্য নিদর্শন আমরা দেখেছি যখন মৌলবাদীরা সম্প্রতি একটি হরতাল আহ্বান করেছিল। সাধারণ মুটে-মজুর, রিকশাচালকরা বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় হরতাল আহ্বানকারীদের ধরে উত্তম-মধ্যম দিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ অত বোকা নয়। তার চেয়েও বড় কথা, মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ। অপকর্মের বিরুদ্ধে কেবল প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রয়োজনে জনসভার মাধ্যমেও যদি এ ধরনের অপকর্ম সম্বন্ধে গণমানুষকে অবহিত করা যায়, তাহলেই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের সেই পথই দেখিয়েছিলেন। তিনি কখনোই জনগণের ওপর আস্থা হারাননি। সে জন্যই তাঁর আহ্বানে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে পূর্ব দিগন্ত ফর্সা হয়ে এসেছে, তা খেয়ালও করিনি। বৃষ্টি কেটে গেছে। মেঘও অপসৃয়মান। রোদের ঝিলিকও যেন দেখা যায় পূর্ব দিগন্তে। আমি আশায় উদ্দীপিত হই আবার। নিকষ কালো যামিনীর শেষেই আছে প্রত্যাশার প্রভাত।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
'সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা/অন্ধ বিভাবরী, সঙ্গ পরশহারা'
ঝরে পড়ে শ্রাবণ রাতের আকাশভাঙা জল। কখনও শিপশিপ শব্দে, আবার কখনও ঝমঝমিয়ে। আমি আমার অন্ধকার পড়ার ঘরের জানালার ধারে বসে রাত্রির তৃতীয় প্রহরে গাঢ় তমসাচ্ছন্ন রাত্রির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। কানে ভেসে আসে আমার প্রিয় শিল্পী প্রয়াত কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে 'সঘন গহন রাত্রি ...'। এই পরিবেশে সবকিছু ভুলে যেতে ইচ্ছা হয়। মনে হয় মনটা যেন উড়ে যায় শান্তিনিকেতনে কিংবা শিলাইদহ বা পতিসরে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ উত্তরায়ণের কোনো একটি বাড়িতে বসে শ্রাবণ দেখতেন। অথবা পদ্মার বুকে বোটের মাঝে বসে বর্ষার গান রচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথই আসলে আমাদের জীবনের প্রায় সবরকম বৈচিত্র্য নিয়ে প্রগাঢ় উপলব্ধির কথা বলেছেন। এর সূচনা বোধকরি তাঁর গানগুলোর মধ্যে স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে গানের সুরে সুরে মনে এক ধরনের দোলা লাগে। হঠাৎই মনে হয় যে, আমার এই সমাজ, এই দেশ, এর মানুষ কিংবা গোটা পৃথিবীই যেন তুচ্ছ হয়ে যায় এক শিহরণ লাগা বোধের কাছে। কিন্তু এমন এক প্রজন্মের মানুষ আমি, দেখেছি জীবনে এত কিছু, মানুষের ভালোবাসা, মানুষের হিংস্রতা, মানুষের সীমাহীন যন্ত্রণা কিংবা মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে সংঘাত যে, এমন একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত, বৃষ্টির অবিরাম শব্দ, কণিকার কণ্ঠে 'সঘন গহন রাত্রি'_ এই সবকিছুকে ছাপিয়ে কোথায় যেন একটা যন্ত্রণার ঢেউ তোলে। আমি সজাগ হয়ে উঠি রূঢ় বাস্তবতার শান্তি হরণকারী আক্রমণে।
আমাদের বাল্যকালটা কেটেছে বড় আনন্দে। আম-কাঁঠালের বনে ছুটোছুটি, ছোট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে বালুকাবেলায় গড়াগড়ি, কিংবা ক্ষীণস্রোতা জলে সারাদিন ধরে দাপাদাপি_ এই তো বাল্যকালের স্মৃতি আমার। যান্ত্রিকতার স্বাদ পেতাম কেবল যখন দু'ঘণ্টা কি তিন ঘণ্টা পরপর ওই ছোট শহরের পাশ ঘেঁষে রেলগাড়ি চলে যেত কলকাতার দিকে। আমরা দুটি ভাইবোন দৌড়ে যেতাম কাশবন পেরিয়ে রেললাইনের ধারে। আমাদের স্বপ্ন হতো সেই রেলের যাত্রী এবং সেই স্বপ্নকে বুকে বয়ে নিয়ে আলোকোজ্জ্বল এক বিরাট স্বপ্নের নগরী কলকাতায় চলে যেত বাল্যকালের ট্রেন। এমনকি আমাদের যৌবনে উন্মাতাল রাজনীতি, ভাষা আন্দোলনের সময় ক্ষমতাসীনদের হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি উত্তরাধিকার নিয়েও কী এক অনাবিল সুখে কেটেছে জীবন। হ্যাঁ, ছাত্ররাজনীতি ছিল, প্রতিবাদ ছিল, প্রতিবাদী সাহিত্য-সংস্কৃতি ছিল। দলে দলে বৈরিতা ছিল আবার দিন শেষে গলাগলি ভাবও ছিল। মধুদার ক্যান্টিনের শিঙ্গাড়া ছিল। আর ছিল কাপের পর কাপ চা। সেখান থেকে হঠাৎ করেই দুর্বিনীত শাসকগোষ্ঠীর অকস্মাৎ আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম আমরা। এই আক্রমণ একটিতেই ক্ষান্ত হলো না। চলতে লাগল একের পর এক। যে ভাষা, যে সংস্কৃতি, যে জীবন, যে শান্তি ছিল আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী, তাও ওরা করে দিল ধ্বংস। কিন্তু মানুষ তো আর নির্বীর্য জড় পদার্থ নয়? ঘুরে দাঁড়াল তারা। যুদ্ধ হলো মরণপণ। স্বাধীন হলো দেশ। কিন্তু যে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হলাম আমরা, সেই শত্রু তো হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়? তারা একের পর এক চক্রান্ত করতে লাগল এই দেশকে, এই দেশের আদর্শকে বিধ্বস্ত করে দিতে। কত রকম, কত রূপে যে চক্রান্তের ফাঁদ পাতা হলো, তার হিসাব রাখে কার সাধ্য? শুরু হলো আমাদের জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। তারপর চার প্রধান নেতাকে হত্যা করা হলো জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এরপর শুরু হলো যেখানেই যা কিছু আমাদের মুক্তবুদ্ধির পরিচয়বাহী, তাকে ধ্বংস করার জন্য একের পর এক আক্রমণ। ছায়ানটের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা আক্রমণ, ২১ আগস্ট ২০০৪-এ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল যে দলের দ্বারা, সেই আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা আক্রমণ এবং অসংখ্য মানুষ হত্যা। এসবই বাংলাদেশের চেতনাকে নস্যাৎ করার একটা সুপরিকল্পিত চক্রান্তের ফল। অথচ এসব যখন ঘটছে, তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ হচ্ছে। হয়তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার এই চক্রান্তের তথ্য আহরণের জন্য তদন্তও শুরু করেছে। তারপর সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু আবার শীতল প্রকোষ্ঠে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। একটি দেশকে স্থবির করে দেওয়ার জন্য কত কিছুই না করা হয়েছে, কত কিছুই করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে পাকিস্তানি শত্রুর বিরুদ্ধে জীবনপণ যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি আমরা, তারাই ক্ষমতায় বসিয়েছে এমন সরকার যারা তাদের প্রতি অনুগত সর্বাংশে। পত্রিকায় পড়ি একটি বিশেষ সরকার আমাদের দেশে ক্ষমতায় থাকার সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হয় উত্তর-পূর্ব ভারতে অস্ত্র চালান দিতে। এই সংবাদ ফাঁস করে দেয় ভারতেরই সন্ত্রাসী কোনো নেতা। ট্রাকের পর ট্রাক বিদেশি অস্ত্র ধরা পড়ে এই বাংলাদেশের মাটিতেই। জানতে পাই এর সঙ্গে যুক্ত কেবল পাকিস্তানপন্থি ওই সরকারের মন্ত্রী-আমলারাই নয়, এমনকি আমাদের সবচেয়ে গৌরবের যে সেনাবাহিনী, তার কতিপয় ক্ষমতাবান সদস্য। কী এক ভয়াবহ সময় অতিবাহিত করছি আমরা। কী এক অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে আমাদের চারপাশে। আজ এসব ষড়যন্ত্রের তথ্য একে একে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে কেননা ক্ষমতাসীন সরকার এই দেশকে ভিনদেশি ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের ঘাঁটি করার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে চলেছে। কিন্তু কেবল এই কারণেই ক্ষমতাসীন সরকারকেই হয়তো ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে কোনো এক চক্রান্তের মাধ্যমে। এসব দেখি আর শুনি, কিন্তু এখন আর চমকে উঠি না। সব সম্ভবের এই দেশে এই চরম অনভিপ্রেত এবং দুর্বিনীত কাজ অবলীলায় করা সম্ভব, এ তো প্রায় অবধারিত সত্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
মাঝে মধ্যে গালে হাত দিয়ে ভাবি তাহলে কি আর আমাদের '৭১-এ স্বপ্নে দেখা সোনার বাংলাকে তার স্বীয় গরিমায় প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাব না আমরা? আমি নিরাশাবাদী নই। চরম বিপদেও অসীম সাহস নিয়ে এগিয়ে গেছি সামনের দিকে নির্ভয়ে। আমি নিরাশাবাদী নই এখনও। যদিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বাংলাদেশের আদর্শে উদ্বুদ্ধ যে সরকার আজকে ক্ষমতায় আছে তারা কিন্তু তাদের দায়িত্বটি পরিপূর্ণভাবে সম্পাদন করছেন এই কথাটি বলতে পারব না। যখন একটি দেশের সংস্কৃতি, আদর্শ, মূল্যবোধ এবং দেশটির নিয়ন্ত্রক সংবিধান হুমকির সম্মুখীন হয়, তখন কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। সকলই সম্ভব হয় যদি দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে সব অপকর্মকে রুখে দাঁড়ান। সাধারণ মানুষ এখনও আসল তথ্যগুলো জানে না। জানলে তারাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে দেশপ্রেমিকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এর সামান্য নিদর্শন আমরা দেখেছি যখন মৌলবাদীরা সম্প্রতি একটি হরতাল আহ্বান করেছিল। সাধারণ মুটে-মজুর, রিকশাচালকরা বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় হরতাল আহ্বানকারীদের ধরে উত্তম-মধ্যম দিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ অত বোকা নয়। তার চেয়েও বড় কথা, মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ। অপকর্মের বিরুদ্ধে কেবল প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রয়োজনে জনসভার মাধ্যমেও যদি এ ধরনের অপকর্ম সম্বন্ধে গণমানুষকে অবহিত করা যায়, তাহলেই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের সেই পথই দেখিয়েছিলেন। তিনি কখনোই জনগণের ওপর আস্থা হারাননি। সে জন্যই তাঁর আহ্বানে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে পূর্ব দিগন্ত ফর্সা হয়ে এসেছে, তা খেয়ালও করিনি। বৃষ্টি কেটে গেছে। মেঘও অপসৃয়মান। রোদের ঝিলিকও যেন দেখা যায় পূর্ব দিগন্তে। আমি আশায় উদ্দীপিত হই আবার। নিকষ কালো যামিনীর শেষেই আছে প্রত্যাশার প্রভাত।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments