সমকালীন প্রসঙ্গ-সমাজের অন্ধকারে বিপন্ন মানুষ by নাদির জুনাইদ

যারা শীর্ণ দেহের এক কিশোরকে গাড়ি থেকে ঠেলে নামিয়ে দেয় একদল হিংস্র মানুষের সামনে, তারপর সেই জনতার পাশবিক আক্রমণে দুর্বল-অসহায় কিশোরের প্রচণ্ড কষ্টের রক্তাক্ত মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে অবলীলায়_ সেই পুলিশ সদস্যরা আর পুলিশ থাকে না; সেই মানুষও আর কেবলই মানুষ নয়।


তারা সবাই দয়ামায়াহীন দুর্বৃত্ত এবং দানব। তাদের মনের অন্ধকার দিকগুলোই দ্বিধাহীনভাবে বীভৎস আচরণ করার মানসিকতা আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে


নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ১৬ বছরের কিশোর মিলনকে পুলিশের উপস্থিতিতে নারকীয় নৃশংসতার সঙ্গে পিটিয়ে মেরে ফেলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই সাভারের আমিনবাজারে শবেবরাতের রাতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ছয় ছাত্রকে, জুন মাসের শেষে পটুয়াখালীর গলাচিপায় শত শত লোকের সামনে গাছে ঝুলিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে আরেক যুবককে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে পুলিশি হেফাজতে সইতে হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। তিনি অভিযোগ করেছেন, থানার ওসি চাপাতি দিয়ে তার পায়ে আঘাত করেছেন। গত ৩১ জুলাই দয়াগঞ্জ থেকে 'ডিবি পুলিশ' পরিচয়ধারী একদল সশস্ত্র লোক তিন যুবককে ধরে নিয়ে যায় আর ক'দিন পরই পাওয়া যায় সেই যুবকদের হাত-পা বাঁধা মৃতদেহ। এরকম ভয়ঙ্কর নৃশংস ঘটনা যে সমাজে নিয়মিতভাবে ঘটতে থাকে সে সমাজকে কোনোভাবেই কি আর সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজ বলে গণ্য করা সম্ভব? কোনো সুস্থ এবং সভ্য সমাজে জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের সরকারি গাড়ি থেকে এক কিশোরকে ঠেলে নামিয়ে দেওয়া হয় উন্মত্ত, হিংস্র মানুষের সামনে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্য? লাঠি-ইট হাতে একদল হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, খুনের নেশায় মত্ত, উন্মাদ লোক অবিশ্বাস্য-নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আঘাতের পর আঘাতে হত্যা করে সেই অসহায়, হতভাগ্য কিশোরকে। পরে তার সেই রক্তাক্ত মৃতদেহ আবার তুলে নেওয়া হয় পুলিশের সরকারি গাড়িতেই। এই পৈশাচিকতা, এই পাশবিকতা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই ২০১১ সালেও বিভিন্ন দিকে এত উন্নয়নের কথা শোনা যাওয়ার এ আধুনিক সময়ে আদিম বর্বরতা কীভাবে টিকে আছে আমাদের দেশে?
এ ঘটনার ভিডিওচিত্র পাওয়া না গেলে হয়তো এ নির্মম হত্যাকাণ্ডে পুলিশের সহায়তার কথা মানুষ জানতেও পারত না। মানুষের জীবন আজ কতটা মূল্যহীন আমাদের সমাজে; আর কিছু মানুষ এ সমাজে আজ কতটা হিংস্র, কতটা নিষ্ঠুর আর অনুভূতিহীন! অথচ এমন সব ভয়ঙ্কর অপরাধ নিয়মিতভাবে ঘটতে দেখার পরও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বলতে বাধে না যে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। দেশের কতজন মানুষ আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন? এসব অমানুষিক আর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুরতা, আর যে মা অল্পবয়সী সন্তানের ফোন পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখেন তার সন্তানকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, যে মা-বাবা তাদের কম বয়সী নিখোঁজ সন্তানদের মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে থাকার খবর পান তাদের তীব্র দুঃখ অনুধাবন করতে পারলে কী আর কারও পক্ষে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খুশি হওয়া সম্ভব? আমাদের অস্থির আর আতঙ্কিত হয়ে উঠতে হয় এ কারণে যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের আরও বেপরোয়া করে তুলবে।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, মিলন নামে এ ছেলেটি কেবল এক জায়গায় বসে অপেক্ষা করছিল তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য, আর তারপরই তার টাকা আর ফোন ছিনিয়ে নিয়ে সেই এলাকার কিছু লোক তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়, আর পুলিশ তাকে পরে ঠেলে দেয় রক্তলোলুপ কিছু মানুষের দিকে। ভিডিওচিত্র ধারণকৃত মানুষের চিৎকার থেকে জানা যায়, পুলিশ তাদের নির্দেশও দিয়েছে ছেলেটিকে মেরে ফেলার জন্য। ডাকাতির সঙ্গে মিলনের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, আর ডাকাত হলেই কি আইন অগ্রাহ্য করে পুলিশ জনতার হাতে তাকে তুলে দিতে পারে মেরে ফেলার জন্য? সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখি (সমকাল, ৯ আগস্ট-২০১১) নোয়াখালীর পুলিশ সুপারের সামনেই এক যুবক প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে, প্রশাসনের সহযোগিতায়ই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে এতগুলো ডাকাতকে পিটিয়ে মারা। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এমন স্বীকারোক্তির পরও তো পুলিশ সে যুবককে গ্রেফতার করেনি; ভিডিওচিত্র দেখে মিলনকে যারা হত্যা করল তাদের গ্রেফতার করার কোনো উদ্যোগও তো নেওয়া হয়নি। সেদিন সেই হিংস্র হত্যাকারীদের হাতে মিলনকে তুলে দেওয়ার জন্য দায়ী ঘটনাস্থলে উপস্থিত সেই পুলিশদের কেবল সাময়িক বরখাস্ত করাই কি যথেষ্ট? এই পুলিশ সদস্যদের শুধু দায়িত্বে অবহেলার গতানুগতিক অভিযোগে দোষী করলে চলে না; নিজেদের হেফাজতে থাকা এক অসহায় কিশোরকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করার জন্য জনতাকে সুযোগ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে পুলিশের সদস্যরাও এ হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা রেখেছে। আইনের রক্ষক হিসেবে তাদের এ অপরাধ অচিন্তনীয় এবং অমার্জনীয়।
দেশের অনেক মানুষ এবং কিছু পুলিশ সদস্যের এমন অমানুষোচিত, হিংস্র আচরণ আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে দীর্ঘদিন ধরে যে অস্বাভাবিকতা টিকে আছে, সেই অসুস্থ পরিবেশের প্রভাবেরই ফল। রাজনৈতিক কারণে আমাদের দেশে সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে দিনের পর দিন; সন্ত্রাসের অভিযোগ থাকার পরও অনেক ব্যক্তির দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকতে সমস্যা হয় না। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা অস্ত্র হাতে সন্ত্রাসী কাজে যুক্ত হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে। এ কথা মেনে নেওয়া যায় না যে, রাজনৈতিক দলগুলো এ অবস্থায় পরিবর্তন করতে অক্ষম। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকৃত আন্তরিকতা থাকলে সন্ত্রাস, সহিংসতা টিকিয়ে রাখার এ জঘন্য সংস্কৃতি নির্মূল করা কঠিন কোনো কাজ নয়। দশকের পর দশক ধরে এমন ঘৃণ্য সংস্কৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ পুরো সমাজকে কলুষিত করে যেতে পারে না।
সুশিক্ষার আশীর্বাদ এই দরিদ্র দেশের বহু মানুষকেই স্পর্শ করেনি। বিচক্ষণতার সঙ্গে ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করা তাই এ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সহজ নয়। এ মানুষ যখন দেখে সন্ত্রাস এবং বিভিন্ন ধরনের সহিংস আচরণ এ সমাজে প্রায়ই রাজনৈতিক এবং ক্ষমতার দাপট হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তখন সেই নিন্দনীয়, ক্ষতিকর সংস্কৃতি এ সমাজের বহু মানুষকেও সহিংস কাজ করতে প্রলুব্ধ করে তোলে সহিংসতাকে ব্যবহার করে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এক ধরনের বিকৃত দাপট অনুভব করার জন্য। মানুষ তো একটি সমাজের পরিবেশ দ্বারাই প্রভাবিত হয়; বিভিন্ন সময় যারা দেশের ক্ষমতায় থেকেছেন তারা নিজ স্বার্থে দিনের পর দিন সমাজে সহিংসতা আর নিষ্ঠুরতার যে অসুস্থ পরিবেশ টিকিয়ে রেখেছেন তার অশুভ প্রভাবেই অনেক মানুষ আজ অনুভূতিহীন দানবীয় কাজে অংশ নেয় অবলীলায়। অন্যায়কারী এ সমাজে অন্যায় করতে ভীত নয়, কারণ দল-মত উপেক্ষা করে অপরাধীর প্রতি দ্রুততার সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত এখানে দুর্লভ। যে দেশে রাজনৈতিক প্রভাব অপরাধীদের জন্য ভরসা হয়ে দাঁড়ায় সেখানে ভয়ঙ্কর অপরাধ করতেই অপরাধীরা আর দ্বিধা করবে কেন? এ দেশে অতীতে আইন করে খুনিদের নিরাপদে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, আবার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্ষমা পেয়ে যাচ্ছে বর্তমান সময়েও। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কি ভেবে দেখে যে, তাদের বিভিন্ন আচরণ এবং সিদ্ধান্ত কোন ধরনের মানুষকে উৎসাহিত এবং আশ্বস্ত করছে?
যারা শীর্ণ দেহের এক কিশোরকে গাড়ি থেকে ঠেলে নামিয়ে দেয় একদল হিংস্র মানুষের সামনে, তারপর সেই জনতার পাশবিক আক্রমণে দুর্বল-অসহায় কিশোরের প্রচণ্ড কষ্টের রক্তাক্ত মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে অবলীলায়_ সেই পুলিশ সদস্যরা আর পুলিশ থাকে না; সেই মানুষও আর কেবলই মানুষ নয়। তারা সবাই দয়ামায়াহীন দুর্বৃত্ত এবং দানব। তাদের মনের অন্ধকার দিকগুলোই দ্বিধাহীনভাবে বীভৎস আচরণ করার মানসিকতা আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। সহিংসতা-অন্যায়কে সততা আর আন্তরিকতার সঙ্গে প্রতিহত না করা এক অসুস্থ প্রবণতা সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে। আমরা দেখছি কত সহজে সমাজে হত্যা করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, বিনা অপরাধে কাউকে সহ্য করতে হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। তারপর কোম্পানীগঞ্জে এ কিশোরের এমন করুণ, মর্মান্তিক মৃত্যু দেখার পর কোনো অনুভূতিশীল মানুষের পক্ষে কি সুস্থির থাকা সম্ভব? আমাদের সমাজে এ অন্ধকার টিকিয়ে রাখার প্রবণতা আগামী দিনগুলোতে আরও কত সাধারণ মানুষের জীবনে চরম অনিষ্টকর ফল বয়ে আনবে কে জানে!

নাদির জুনাইদ : শিক্ষক
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.