মাননীয় মেয়র, গন্ধ লাগছে by জাহিদ হায়দার

যতদূর জানি, 'বু' ফারসি শব্দ, 'বা'-ও; আমার ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থনা করি। 'বু' শব্দের অর্থ_সুগন্ধ (এ প্রসঙ্গে 'খোশবু' মনে আসতে পারে) এবং 'বা' মানে 'সহিত'। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার উঠতি ধনপতিরা মনোনীত নারীর নাচ দেখতে, গান শুনতে আর তরঙ্গময় আহ্লাদ করতে সুগন্ধিসহ (এখানে মেখে) সন্ধ্যাকালে ঘোড়াটানা গাড়িতে চড়ে বিশেষ পাড়ায় যেতেন।


তখন তাঁদের শরীর থেকে সুগন্ধ বের হতো। সাধারণ পথচারীরা তাঁদের বলতেন, 'বাবু যাচ্ছেন।' অনেকের মতে, 'বাবু' শব্দটির প্রচলন তখন থেকে। বাবু নবীন চন্দ্র সেন অসুস্থতার কারণে এক সন্ধ্যায় বাইজির আনন্দগৃহে যেতে পারেননি। তখন বাড়ির গৃহকর্ত্রী এবং পরিচারিকারা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন_বাবুর কী হলো? বাবুর অসুস্থতা বিশেষ গুরুত্ব পায়নি।
ঢাকা শহরে আমরা যারা বিশ্বায়নের মধ্যে পড়ে নাভিশ্বাস প্রতিযোগিতায় নাগরিক হওয়ার লোভে উদয়াস্ত রাস্তাঘাটে চলাচল করছি, তারা প্রতিনিয়তই পড়ছি অপরিকল্পিত নগরায়ণের 'বর্বরায়নে'। 'তিলোত্তমা' ঢাকা করার দায়দায়িত্ব নগরকর্তা মেয়রের, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এবং এই নগরের নাগরিকদেরও। তবে মেয়রের দায় ও কর্তব্য নাগরিকদের চেয়ে দশ আনা বেশি। মনে রাখা প্রয়োজন, যাঁরা ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেছেন বা করছেন, তাঁদের নগরবিষয়ক ধারণা, বড় সড়কের ব্যবহারবিষয়ক ধারণা প্রায় গ্রাম্য। দেখবেন, স্যুট/টাই পরা অনেক মানুষও ফুটপাত ও ওভারব্রিজ ব্যবহার করছেন না, কাশি-থুতু সশব্দে ফেলছেন। মরহুম হানিফ সাহেব ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় প্রথম বড় বড় কনটেইনার বসিয়েছিলেন। কাগজে, টেলিভিশনে সচেতনতামূলক সহৃদয় অনুরোধপূর্ণ বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, যেন বড় বড় ডাস্টবিনে আমরা ময়লা ফেলি। কোনো কোনো নাগরিক ঘরের ময়লা বিনে ফেললেন, কিন্তু বেশির ভাগ নাগরিক বিনের পাশে রাস্তায় ফেললেন। আমি দেখেছি, সকালে অফিসে যাওয়ার সময় কেতাদুরস্ত কাপড় পরা বাবু পলিব্যাগে ভরা ময়লা রাস্তার ওপর ফেলে অফিসের বাসে উঠলেন। ব্যাগ পতনের শব্দে নিকটস্থ ডাস্টবিনে ব্যস্ত কাক ভয়ে একটু উড়াল দিল।
ময়লা-আবর্জনা ভরা কনটেইনার কি ডিসিসির কর্মীদের প্রতিদিন সরানোর কথা নয়? কিংবা প্রতিদিন পরিষ্কার করে রাখার কথা নয়? কনটেইনার উপচে ময়লা পড়ছে, আশপাশের বাতাস উৎকট-তেতো-বিশ্রী গন্ধে বু হতে পারছে না। মনে হয়, বেশির ভাগ পথচারীর নাক কাকের নাকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই নাক ধরছে না। যাঁরা নাকে রুমাল দিচ্ছেন, তাঁরা মনে হয় হঠাৎ এই নরকে এসে পড়েছেন। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কয়েকজন তরুণ কথা বলছে। তাদের কিছু আলাপ আমার কানে এল। মনে হয়, ওরা বর্তমান সরকারের দল করে। তা করুক। আমরা জানি, ঢাকার মেয়র সাহেব বর্তমান বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কিন্তু তিনি তো এই নগরে বসবাসকারী সব নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা (সুযোগ-কুবিধা নয়) দেখভাল করার দায়দায়িত্ব পেয়েছেন। তরুণরা বলছিল, বর্তমান সরকারকে 'অকার্যকর' সরকার প্রমাণ করার জন্য এই মেয়র আবর্জনা সরাতে তাঁর লোকজনকে দিয়ে যথাযথভাবে কাজ করাচ্ছেন না। আমি এসব তরুণের কথা বিশ্বাস করতে চাই না। কারণ মেয়র সাহেবের নাক সুগন্ধ আর দুর্গন্ধের পার্থক্য অন্য সব নাগরিকের চেয়ে ত্বরিত করতে পারেন বলেই আমি মনে করি। শুনেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তান আমলের ঢাকার নগরকর্তা নাকি কোনো কোনো সকালে বেরিয়ে দেখতেন, তাঁর নিয়োজিত লোকজন সকালে রাস্তাঘাট ঠিকমতো ঝাড়ু দিচ্ছে কি না। আমি জানি না, বর্তমান মেয়র সকালে তাঁর কর্মীদের কাজকর্ম দেখতে বের হন কি না।
ডিসিসির লোকজনকে মাঝে মাঝে দেখি, সকাল ৮-৯টার দিকে ফুটপাত ঝাড়ু দিচ্ছে, ফুটপাতসংলগ্ন রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে এবং ময়লাগুলো জড়ো করে রাখছে ফুটপাতের পাশেই। তারা ময়লাগুলো কাছের কনটেইনারে ফেলছে না। পথচারীদের পায়ের গুঁতায় ময়লাগুলো আবার আনন্দে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
দেখতে পাচ্ছি, কোনো কোনো রাস্তায় স্যুয়ারেজ পরিষ্কার করা হচ্ছে। মনে হয়, বর্ষার সময় পানি যেন দ্রুত নিষ্কাশিত হয়, সে জন্যই এ কাজ। খুবই ভালো। কিন্তু স্যুয়ারেজ থেকে যেসব ময়লা তুলে রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে, তা তখনই সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না কেন? আমার অবাধ্য কৌতূহল আমাকে তাড়ায়। যাঁরা ময়লা তুলে ফুটপাতের পাশে রাখছেন, জিজ্ঞেস করি তাঁদের একজনকে, এসব ময়লা গাড়িতে করে কখন নিয়ে যাবে? উত্তর আসে, জানি না। পরদিন আমি আবার সেখানে যাই। দেখি, ময়লাগুলো সরানো হয়নি। মনে মনে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ, আজ বৃষ্টি দিয়ো না। যদি বৃষ্টি দাও, তাহলে ময়লাগুলো আবার চলে যাবে আগের জায়গায়। তাতে অবশ্য একটা লাভ হবে, পথচারীর নাকে গন্ধ লাগবে না। আর আমাদের মেয়র সাহেব যদি এই পথে যান, তাঁর নাকও গন্ধে সিটকাবে না।
লেখক : কবি

No comments

Powered by Blogger.