সড়ক যোগাযোগ-একটি জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তাব by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
১৩ আগস্ট মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ একসঙ্গে পাঁচ ব্যক্তি নিহত হওয়ার পর দেশব্যাপী নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রসঙ্গে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সংবাদপত্রের কলাম, প্রতিবেদন, টিভির প্রতিবেদন ও টক শোতে আলোচ্য বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়েছেন।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এসব পরামর্শ মনিটরিং করছে কি না, আমি জানি না।
নিরাপদ সড়ক নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা ও সমালোচনা এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় আলোচ্য বিষয় নিয়ে আলাদা করে না ভাবলে এবং জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ না নিলে মন্ত্রণালয় তথা সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বহুগুণে বেড়ে যাবে। আর এর রাজনৈতিক সুবিধা নেবে বিএনপি। আশা করি সরকার এ ব্যাপারে পূর্ণমাত্রায় সচেতন।
নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মান, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তির জন্য নতুন করে আইন প্রণয়ন, ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য (বিভিন্ন ধরনের যানবাহন) পরীক্ষা দেওয়ার আগে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ইস্যুতে সরকারের করণীয় সম্পর্কে আলোচনার জন্য আমি যোগাযোগমন্ত্রীকে একটি জাতীয় সম্মেলন আয়োজনের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। বুয়েটের ‘দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের’ সহায়তায় এই সম্মেলন আয়োজন করা যেতে পারে। সম্মেলনে নিরাপদ সড়ক ও দুর্ঘটনাসংক্রান্ত প্রতিটি ইস্যু নিয়ে পৃথক অধিবেশনে বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও সব স্টেকহোল্ডার অংশ নেবেন। প্রতিটি অধিবেশনে ব্যাপক বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বিতর্কের পর প্রতিটি ইস্যুতে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্তগুলো হতে পারে জরুরিভিত্তিক, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের প্রতিনিধিকেও সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে। প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
হাইওয়েতে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ দেখে দুর্ঘটনা হয় না। দুই বড় দল যেন এটা মনে রাখে। এই সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করতে বর্তমান সরকার ও প্রধান বিরোধী দলকে অঙ্গীকার করতে হবে। অতীত ও বর্তমানের সমালোচনায় সময় ব্যয় না করে আগামী মাস থেকে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটাই হবে আলোচনার সুর। এই সম্মেলন হবে একাডেমিক সম্মেলন, কোনো রাজনৈতিক তর্কের সম্মেলন নয়। তাই আমি অনুরোধ করব, সম্মেলনটির পরিকল্পনা, কর্মসূচি প্রণয়ন, বক্তা নির্বাচন, সম্মেলন পরিচালনা, সম্মেলন শেষে সুপারিশমালার একটি সংকলন প্রকাশের দায়িত্ব বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে যেন দেওয়া হয়। তবে সম্মেলনটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কেই আয়োজন করতে হবে।
সংবাদপত্রের লেখালেখি ও টিভির টক শোতে সময় ও স্থানস্বল্পতার জন্য কোনো বিষয় নিয়েই বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সম্ভব হয় না। অথচ নিরাপদ সড়ক প্রসঙ্গে প্রতিটি ইস্যু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডারদের প্রতিটি ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনা ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রস্তাব করার সুযোগ দিতে হবে। প্রতিটি সুপারিশ নিয়ে গঠনমূলক বিতর্ক ও আলোচনার সময় দিতে হবে, যাতে কোনো সুপারিশ চাপিয়ে দেওয়া না হয়। এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে হাইওয়ে ও সড়কগুলো এত ভাঙাচোরা হওয়ার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ই দায়ী। দায়ী যোগাযোগমন্ত্রীর উদাসীনতা। আজ নানা দুর্ঘটনার পটভূমিতে ফুঁসে ওঠা বিক্ষোভের মুখে তিনি অর্থমন্ত্রীকে দায়ী করছেন, টাকা না পাওয়ার কথা বলছেন। এ কথা সত্য হলেও তা কেউ গুরুত্ব দেবে না। কারণ যথাসময়ে তিনি এই অভিযোগ করেননি। যথাসময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই নালিশ করেননি। ১৩ আগস্টের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বাস চলাচল বন্ধ না হলে তিনি হয়তো এখনো অর্থমন্ত্রীর নামে অভিযোগ তুলতেন না। এতেই বোঝা যায় নিরাপদ সড়কের ব্যাপারে তাঁর কী রকম উদাসীনতা। অনেকে মনে করেন, মেগা প্রজেক্ট ও চীন থেকে আমদানি ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে যোগাযোগমন্ত্রীর আগ্রহ কম। কিন্তু এত ব্যর্থতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, আমাদের কার কী বলার আছে? মন্ত্রী নিয়োগ করার একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর। যোগাযোগমন্ত্রীর ওপর প্রধানমন্ত্রীর এই সীমাহীন আস্থার পেছনে বাজারে নানা কথা চালু রয়েছে। আমি বাজারের কথা নিয়ে আলোচনা করতে চাই না।
ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে গত কয়েক দিন মিডিয়ায় নানা কথা আলোচনা হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এত সহজে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায় না। এ ছাড়া রয়েছে নগদ টাকার বিনিময়ে ভুয়া লাইসেন্স। অনেকের ধারণা, বাংলাদেশে বেশির ভাগ ট্রাক ও বাসচালকের লাইসেন্সই ভুয়া। তাঁরা কোনো প্রশিক্ষণ নেন না। কোনো লিখিত, মৌখিক বা প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নেননি। অনেক চালকের লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতাই নেই। ইংল্যান্ডে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে যে পরীক্ষা দিতে হয়, তার ৮৬ শতাংশই লিখিত পরীক্ষা। খুব কম লোকই প্রথমবার এই পরীক্ষায় পাস করেন।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন (১৯ আগস্ট ২০১১) থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী যোগ্যতার পরীক্ষা ছাড়া গত ১৮ বছরে এক লাখ ৮৯ হাজার লোককে পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এখন আরও ২৮ হাজার প্রার্থীর জন্য লাইসেন্সের আবেদন করা হয়েছে। এগুলো করছেন নৌ পরিবহনমন্ত্রী। তিনি আবার সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরি পরিষদের সভাপতি।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যাপারে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটা শুধু ভবিষ্যতের লাইসেন্স নিয়ে নয়, অন্তত গত ১০ বছরে যাঁরা বাস বা ট্রাক চালানোর লাইসেন্স নিয়েছেন, তাঁদের লাইসেন্স বাতিল করে পুনরায় লিখিত, মৌখিক ও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় ডাকতে হবে। বিআরটিএর পক্ষে এত বড় কাজ করা হয়তো সম্ভব হবে না। এই কাজ আউটসোর্সিং করতে হবে। আশা করি এসব সুপারিশ জাতীয় সম্মেলনেই আসবে।
আমাদের দূষিত রাজনীতির অন্যতম উপাদান হলো দুর্নীতি। ক্ষমতা দেখিয়ে অস ৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন। বিনা পরীক্ষায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার মাধ্যমে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। এই দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রী, সচিব, সাংসদ, রাজনৈতিক নেতাসহ অনেকে যুক্ত। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে সে রকমই বলা হয়েছে। কোনো সরকারই দুর্নীতির এই চক্র বন্ধ করতে পারেনি বা চায়নি। এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াটি কঠিন হয়ে গেলে বা আন্তর্জাতিক মানের হয়ে গেলে, দুর্নীতি বন্ধ হলে, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের কাছে গেলে (আউটসোর্সিং) এই কোটি টাকার দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটা একটা বিরাট চক্র। প্রধানমন্ত্রী এটা সামাল দিতে পারবেন কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। কাজেই এটা রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর দলের অনেক সাংসদ, নেতা, কয়েকজন মন্ত্রী এতে দারুণ ক্ষুব্ধ হবেন। বিএনপির অনেক নেতাও এতে হতাশ হবেন। তাঁরা সরকারে গেলেও এই চক্র তাঁদের সঙ্গে থাকবে। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো বিআরটিএও একটি দুর্নীতির আড়ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চট্টগ্রাম বন্দর যেভাবে কাজ করেছে, রাজনৈতিক সরকারের সময় সেভাবে চলতে পারেনি। কারণ ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক অঙ্গীকার নেই। তারা দলীয় লোকদের দুর্নীতি দেখেও না দেখার ভান করে। কাজেই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াটি কঠিন করা, অর্থা ৎ লিখিত, মৌখিক ও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স না দেওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির আরেকটি আড়ত হলো সরকারের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। ব্রিজ নির্মাণ, রাস্তা নির্মাণ, মেরামত ইত্যাদি প্রকল্পে যে টাকা বরাদ্দ হয়, তার ৫০ শতাংশ এই খাতে খরচ হয় কি না সন্দেহ। বাকি ৫০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তাদের পকেটে যায়। যোগাযোগমন্ত্রী কি কখনো এই দুর্নীতি বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন? সংবাদপত্রে এত প্রতিবেদন দেখেও প্রধানমন্ত্রী কি যোগাযোগমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলেছেন? সড়ক বিভাগের সুবিধা হলো, টাকা ব্যয় না করেও ব্যয় দেখানো যায়। আর তা পরীক্ষা করার সুযোগও কম।
কাজেই উন্নত সড়ক ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। এই বিভাগের দুর্নীতি হ্রাস করতে হবে। বরাদ্দকৃত টাকা যথাযথ খাতে ব্যয় করতে হবে। ব্যয় হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করতে হবে। নির্মাণকাজের উপাদানের মান পরীক্ষা করতে হবে। এখানেই যত ভেজাল।
এখন মন্ত্রী, সচিব, প্রধান প্রকৌশলী ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা—সবাই যদি এই দুর্নীতির চক্রে যুক্ত থাকেন, তাহলে কে কাকে ধরবেন? কাজেই সড়ক বিভাগের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে।
আমি যত সহজে কথাগুলো লিখছি, অত সহজে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে দুর্নীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রধান দুটি দপ্তরের দুর্নীতি হ্রাসে দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নেবেন, সে ব্যাপারে আমার ভরসা কম। কারণ তাঁর দলের সাত হাজার নেতা ও কর্মীর দুর্নীতির মামলা ক্ষমতার দাপট দিয়ে বাতিল করা হয়েছে।
তাহলে উপায়? উপায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত না নিলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত অভিযোগগুলোর কোনো সুরাহা হবে না। কারণ এই দুর্নীতির চক্রে তাঁর মন্ত্রী, এমপি, নেতা ও নানা স্তরের আমলা জড়িত রয়েছেন বলে অনেকের ধারণা। দুর্নীতির এই চক্র বহাল রেখে ‘নিরাপদ সড়ক’ নিশ্চিত করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। কিন্তু ‘নিরাপদ সড়ক’ নিশ্চিত করা এখন গোটা দেশের মানুষের দাবি। এই দাবিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারকে এ ব্যাপারে কাজ দেখাতেই হবে।
আমি আবার ‘জাতীয় সম্মেলনের’ ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। এই সম্মেলনেই জানা যাবে নিরাপদ সড়কের জন্য প্রতিবন্ধকতা কী কী? জানা যাবে এর সমাধানের পথ কী? সরকার যদি সত্যি সত্যি নিরাপদ সড়ক ও দুর্ঘটনা হ্রাসের পথে বাধাগুলো কী তা জানতে চায় এবং এর সমাধান জানতে চায়, তাহলে একটি জাতীয় সম্মেলন ছাড়া আমি কোনো কার্যকর কর্মসূচি দেখি না। দু-একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে বা শুধু মেঠো বক্তৃতা দিয়ে এর সমাধান জানা সম্ভব নয়। আশা করি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় শিগগির প্রস্তাবিত এই ‘জাতীয় সম্মেলন’ আহ্বান করবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন কর্মী ও কলাম লেখক।নিরাপদ সড়ক নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা ও সমালোচনা এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় আলোচ্য বিষয় নিয়ে আলাদা করে না ভাবলে এবং জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ না নিলে মন্ত্রণালয় তথা সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বহুগুণে বেড়ে যাবে। আর এর রাজনৈতিক সুবিধা নেবে বিএনপি। আশা করি সরকার এ ব্যাপারে পূর্ণমাত্রায় সচেতন।
নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মান, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তির জন্য নতুন করে আইন প্রণয়ন, ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য (বিভিন্ন ধরনের যানবাহন) পরীক্ষা দেওয়ার আগে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ইস্যুতে সরকারের করণীয় সম্পর্কে আলোচনার জন্য আমি যোগাযোগমন্ত্রীকে একটি জাতীয় সম্মেলন আয়োজনের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। বুয়েটের ‘দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের’ সহায়তায় এই সম্মেলন আয়োজন করা যেতে পারে। সম্মেলনে নিরাপদ সড়ক ও দুর্ঘটনাসংক্রান্ত প্রতিটি ইস্যু নিয়ে পৃথক অধিবেশনে বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও সব স্টেকহোল্ডার অংশ নেবেন। প্রতিটি অধিবেশনে ব্যাপক বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বিতর্কের পর প্রতিটি ইস্যুতে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্তগুলো হতে পারে জরুরিভিত্তিক, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের প্রতিনিধিকেও সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে। প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
হাইওয়েতে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ দেখে দুর্ঘটনা হয় না। দুই বড় দল যেন এটা মনে রাখে। এই সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করতে বর্তমান সরকার ও প্রধান বিরোধী দলকে অঙ্গীকার করতে হবে। অতীত ও বর্তমানের সমালোচনায় সময় ব্যয় না করে আগামী মাস থেকে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটাই হবে আলোচনার সুর। এই সম্মেলন হবে একাডেমিক সম্মেলন, কোনো রাজনৈতিক তর্কের সম্মেলন নয়। তাই আমি অনুরোধ করব, সম্মেলনটির পরিকল্পনা, কর্মসূচি প্রণয়ন, বক্তা নির্বাচন, সম্মেলন পরিচালনা, সম্মেলন শেষে সুপারিশমালার একটি সংকলন প্রকাশের দায়িত্ব বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে যেন দেওয়া হয়। তবে সম্মেলনটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কেই আয়োজন করতে হবে।
সংবাদপত্রের লেখালেখি ও টিভির টক শোতে সময় ও স্থানস্বল্পতার জন্য কোনো বিষয় নিয়েই বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সম্ভব হয় না। অথচ নিরাপদ সড়ক প্রসঙ্গে প্রতিটি ইস্যু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডারদের প্রতিটি ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনা ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রস্তাব করার সুযোগ দিতে হবে। প্রতিটি সুপারিশ নিয়ে গঠনমূলক বিতর্ক ও আলোচনার সময় দিতে হবে, যাতে কোনো সুপারিশ চাপিয়ে দেওয়া না হয়। এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে হাইওয়ে ও সড়কগুলো এত ভাঙাচোরা হওয়ার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ই দায়ী। দায়ী যোগাযোগমন্ত্রীর উদাসীনতা। আজ নানা দুর্ঘটনার পটভূমিতে ফুঁসে ওঠা বিক্ষোভের মুখে তিনি অর্থমন্ত্রীকে দায়ী করছেন, টাকা না পাওয়ার কথা বলছেন। এ কথা সত্য হলেও তা কেউ গুরুত্ব দেবে না। কারণ যথাসময়ে তিনি এই অভিযোগ করেননি। যথাসময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই নালিশ করেননি। ১৩ আগস্টের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বাস চলাচল বন্ধ না হলে তিনি হয়তো এখনো অর্থমন্ত্রীর নামে অভিযোগ তুলতেন না। এতেই বোঝা যায় নিরাপদ সড়কের ব্যাপারে তাঁর কী রকম উদাসীনতা। অনেকে মনে করেন, মেগা প্রজেক্ট ও চীন থেকে আমদানি ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে যোগাযোগমন্ত্রীর আগ্রহ কম। কিন্তু এত ব্যর্থতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, আমাদের কার কী বলার আছে? মন্ত্রী নিয়োগ করার একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর। যোগাযোগমন্ত্রীর ওপর প্রধানমন্ত্রীর এই সীমাহীন আস্থার পেছনে বাজারে নানা কথা চালু রয়েছে। আমি বাজারের কথা নিয়ে আলোচনা করতে চাই না।
ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে গত কয়েক দিন মিডিয়ায় নানা কথা আলোচনা হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এত সহজে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায় না। এ ছাড়া রয়েছে নগদ টাকার বিনিময়ে ভুয়া লাইসেন্স। অনেকের ধারণা, বাংলাদেশে বেশির ভাগ ট্রাক ও বাসচালকের লাইসেন্সই ভুয়া। তাঁরা কোনো প্রশিক্ষণ নেন না। কোনো লিখিত, মৌখিক বা প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নেননি। অনেক চালকের লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতাই নেই। ইংল্যান্ডে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে যে পরীক্ষা দিতে হয়, তার ৮৬ শতাংশই লিখিত পরীক্ষা। খুব কম লোকই প্রথমবার এই পরীক্ষায় পাস করেন।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন (১৯ আগস্ট ২০১১) থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী যোগ্যতার পরীক্ষা ছাড়া গত ১৮ বছরে এক লাখ ৮৯ হাজার লোককে পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এখন আরও ২৮ হাজার প্রার্থীর জন্য লাইসেন্সের আবেদন করা হয়েছে। এগুলো করছেন নৌ পরিবহনমন্ত্রী। তিনি আবার সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরি পরিষদের সভাপতি।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যাপারে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটা শুধু ভবিষ্যতের লাইসেন্স নিয়ে নয়, অন্তত গত ১০ বছরে যাঁরা বাস বা ট্রাক চালানোর লাইসেন্স নিয়েছেন, তাঁদের লাইসেন্স বাতিল করে পুনরায় লিখিত, মৌখিক ও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় ডাকতে হবে। বিআরটিএর পক্ষে এত বড় কাজ করা হয়তো সম্ভব হবে না। এই কাজ আউটসোর্সিং করতে হবে। আশা করি এসব সুপারিশ জাতীয় সম্মেলনেই আসবে।
আমাদের দূষিত রাজনীতির অন্যতম উপাদান হলো দুর্নীতি। ক্ষমতা দেখিয়ে অস ৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন। বিনা পরীক্ষায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার মাধ্যমে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। এই দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রী, সচিব, সাংসদ, রাজনৈতিক নেতাসহ অনেকে যুক্ত। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে সে রকমই বলা হয়েছে। কোনো সরকারই দুর্নীতির এই চক্র বন্ধ করতে পারেনি বা চায়নি। এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াটি কঠিন হয়ে গেলে বা আন্তর্জাতিক মানের হয়ে গেলে, দুর্নীতি বন্ধ হলে, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের কাছে গেলে (আউটসোর্সিং) এই কোটি টাকার দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটা একটা বিরাট চক্র। প্রধানমন্ত্রী এটা সামাল দিতে পারবেন কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। কাজেই এটা রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর দলের অনেক সাংসদ, নেতা, কয়েকজন মন্ত্রী এতে দারুণ ক্ষুব্ধ হবেন। বিএনপির অনেক নেতাও এতে হতাশ হবেন। তাঁরা সরকারে গেলেও এই চক্র তাঁদের সঙ্গে থাকবে। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো বিআরটিএও একটি দুর্নীতির আড়ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চট্টগ্রাম বন্দর যেভাবে কাজ করেছে, রাজনৈতিক সরকারের সময় সেভাবে চলতে পারেনি। কারণ ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক অঙ্গীকার নেই। তারা দলীয় লোকদের দুর্নীতি দেখেও না দেখার ভান করে। কাজেই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াটি কঠিন করা, অর্থা ৎ লিখিত, মৌখিক ও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স না দেওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির আরেকটি আড়ত হলো সরকারের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। ব্রিজ নির্মাণ, রাস্তা নির্মাণ, মেরামত ইত্যাদি প্রকল্পে যে টাকা বরাদ্দ হয়, তার ৫০ শতাংশ এই খাতে খরচ হয় কি না সন্দেহ। বাকি ৫০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তাদের পকেটে যায়। যোগাযোগমন্ত্রী কি কখনো এই দুর্নীতি বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন? সংবাদপত্রে এত প্রতিবেদন দেখেও প্রধানমন্ত্রী কি যোগাযোগমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলেছেন? সড়ক বিভাগের সুবিধা হলো, টাকা ব্যয় না করেও ব্যয় দেখানো যায়। আর তা পরীক্ষা করার সুযোগও কম।
কাজেই উন্নত সড়ক ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। এই বিভাগের দুর্নীতি হ্রাস করতে হবে। বরাদ্দকৃত টাকা যথাযথ খাতে ব্যয় করতে হবে। ব্যয় হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করতে হবে। নির্মাণকাজের উপাদানের মান পরীক্ষা করতে হবে। এখানেই যত ভেজাল।
এখন মন্ত্রী, সচিব, প্রধান প্রকৌশলী ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা—সবাই যদি এই দুর্নীতির চক্রে যুক্ত থাকেন, তাহলে কে কাকে ধরবেন? কাজেই সড়ক বিভাগের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে।
আমি যত সহজে কথাগুলো লিখছি, অত সহজে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে দুর্নীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রধান দুটি দপ্তরের দুর্নীতি হ্রাসে দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নেবেন, সে ব্যাপারে আমার ভরসা কম। কারণ তাঁর দলের সাত হাজার নেতা ও কর্মীর দুর্নীতির মামলা ক্ষমতার দাপট দিয়ে বাতিল করা হয়েছে।
তাহলে উপায়? উপায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত না নিলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত অভিযোগগুলোর কোনো সুরাহা হবে না। কারণ এই দুর্নীতির চক্রে তাঁর মন্ত্রী, এমপি, নেতা ও নানা স্তরের আমলা জড়িত রয়েছেন বলে অনেকের ধারণা। দুর্নীতির এই চক্র বহাল রেখে ‘নিরাপদ সড়ক’ নিশ্চিত করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। কিন্তু ‘নিরাপদ সড়ক’ নিশ্চিত করা এখন গোটা দেশের মানুষের দাবি। এই দাবিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারকে এ ব্যাপারে কাজ দেখাতেই হবে।
আমি আবার ‘জাতীয় সম্মেলনের’ ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। এই সম্মেলনেই জানা যাবে নিরাপদ সড়কের জন্য প্রতিবন্ধকতা কী কী? জানা যাবে এর সমাধানের পথ কী? সরকার যদি সত্যি সত্যি নিরাপদ সড়ক ও দুর্ঘটনা হ্রাসের পথে বাধাগুলো কী তা জানতে চায় এবং এর সমাধান জানতে চায়, তাহলে একটি জাতীয় সম্মেলন ছাড়া আমি কোনো কার্যকর কর্মসূচি দেখি না। দু-একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে বা শুধু মেঠো বক্তৃতা দিয়ে এর সমাধান জানা সম্ভব নয়। আশা করি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় শিগগির প্রস্তাবিত এই ‘জাতীয় সম্মেলন’ আহ্বান করবে।
No comments