রম্য-বৈধ উৎকোচ by সাইফুল আলম
সরকারি অফিসে ফাইলের অগ্রগতিতে, আকাঙ্ক্ষিত কেন্দ্রে পোস্টিং ও বদলিতে, টেন্ডারবাজিতে, নতুন চাকরি লাভে, বাড়িতে অত্যাবশ্যকীয় নানা সংযোগ পেতে, আইন-শৃঙ্খলার সহায়তা পেতে, যানবাহনের মালপত্র বহন_ সবখানেই উৎকোচের মহাধুম।
শুধু তাই নয়। অবুঝ শিশুদের শিক্ষাঙ্গনে পাঠানোর প্রয়াসেও অনেক সময় অভিভাবকদের উৎকোচের কালো হাতের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে হচ্ছে
বেশ ক'টা দিন ধরে আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু কিসমিস আলীর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বা যোগাযোগ নেই। মোবাইল ফোনটা বন্ধ, আর ল্যান্ড ফোনটাও যে মাসখানেক যাবৎ গোঁ ধরে নীরব হয়ে আছে, তা আমার জ্ঞাত। অথচ ওর সঙ্গে বেশি দিনের বিচ্ছিন্নতা যে আমার আহার-নিদ্রায় বদহজম ঘটায়, সেটা ওর অজানা নয়। তাই ব্যস্ততাকে ফাঁকি দিয়ে আর সময়কে পোষ মানিয়ে একদিন ওর জিগাতলার বাসার সামনে উপস্থিত হলাম। হাতঘড়ির ঘণ্টার কাঁটাটা তখন সকাল ৯টাকে ধরি ধরি করছে। সদর দরজার কলিং বেলটাতে চাপ দিতেই গৃহপরিচারক কালাম বিলম্বকে ঝেড়ে ফেলে দরজাটা খুলে মুখদর্শন দিল। মনে হলো, সে যেন ওপাশে আমার জন্যই এতক্ষণ সময় গুনছিল। যাহোক, ঘরে ঢুকে কিসমিসের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ও মুখে কিছু না বলে ইশারায় ওর প্রভুর শোবার ঘরটা দেখিয়ে সামনের রান্নাঘরে মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল।
আমি নিঃশব্দ পদচারণা করে কিসমিসের ঘরটায় ঢুকে দেখি, পা থেকে মাথা অবধি একটা সাদা চাদরে ঢেকে ও বিছানায় শুয়ে আছে। আমি নরম হাতে ওর গায়ে ছোঁয়া দিতেই ও মাথার চাদরের সামান্য অংশ সরিয়ে শুধু চোখ দুটি বের করল। অপ্রত্যাশিতভাবে আমার মুখ দর্শনে ও এমন ভাবে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল যে, আমি যেন ওর অনেক দিনের অচেনা। কণ্ঠে খানিকটা বিস্ময়ের বাটা মসলা মাখিয়ে বললাম, 'কী বিষয় দোস্ত, ক'টা দিন নিজেকে নির্বাসনে রেখেছ কেন?'
আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ও ধীরে ধীরে মাথার বালিশটাকে পিঠের মাঝখানে স্থাপন করে চোখের ইশারায় ওর পাশে বসতে বলল। আমিও রোবটের মতো ওর প্রতি আনুগত্য দেখালাম। আমাদের দু'জনের নীরবতাকে নিয়ে সময় যেন কিছুটা খেলা করতে লাগল। সে খেলা ভঙ্গ করে আমি শুধালাম, 'ল্যান্ড ফোনটা খারাপ, মোবাইল বন্ধ। এ প্রতীকী ধর্মঘটের কারণ কী?'
_মোবাইল ইচ্ছা করেই বন্ধ, আর ল্যান্ড ফোনটার কেবল চুরি।
কিসমিস তার শুকনো ঠোঁট দুটোয় আধাছটাক হাসি মাখিয়ে জবাব দিল।
_তা ফোন অফিসে কমপ্লেন করলেই তো সমস্যা চুকে যায়।
_তা যায়। কিন্তু চুরিটা তো ধারাবাহিক নাটকের মতো মঞ্চস্থ হচ্ছে।
_ও! আমার কণ্ঠে এবার হতাশা।
_তাছাড়া_
_তাছাড়া?
_তাছাড়া! নাঃ বাকিটা আর নাইবা প্রকাশ করলাম।
কিসমিস এবার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর আমার ডান হাতটা ধরে লিভিং রুমের একটা সোফাতে নিয়ে বসাল। আমি বললাম, 'দোস্ত, এ যুগে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা সনাতনি যুগের শামিল।' আমার এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ও বলল, 'দোস্ত, একটু অপেক্ষা কর, কালামকে চা-নাশতার ব্যবস্থা করতে বলি। পরে না হয় আলাপের ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষা যাবে।'
_সে কী! এত বেলা অবধি মুখে কিছু দাওনি?
_না, তবে চায়ের পিপাসাটাকে বেশ কিছুক্ষণ আদর করে থামিয়ে রাখলেও ক্ষুধাটা এখন যেন পাকস্থলীর দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। কথাগুলো ইথারের বুকে ছড়িয়ে দিতে দিতে কিসমিস রান্নাঘরে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে বলল, 'শোনো দোস্ত, ক'টা দিন ধরে ভাবছি কোনো একটা দৈনিক পত্রিকায় চিঠিপত্র কলামে আমাদের জাতীয় একটা সমস্যা নিয়ে কিছু পরামর্শ লিখব।'
ভাবলাম, কিসমিসের পরামর্শ বলে কথা। তাও আবার লিখিতভাবে! বিষয়টা আমার মস্তিষ্কের অনুভূতির কোষগুলোয় খোঁচা দিতেই আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে ওর পানে তাকালাম। এ এবার বলল, 'দোস্ত, দেশের বিভিন্ন সেক্টরে উৎকোচ আদান-প্রদানকে বৈধ ঘোষণা করলে কেমন হয়?'
_সে কী! এ যে সমাজে জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়ার শামিল! আমি চমকে উঠে বললাম।
_না দোস্ত, এটাই জীবাণু ধ্বংসের ধারালো ব্যবস্থা। কিসমিসের দৃঢ় উত্তর। আমি ওর কথার জবাবের সন্ধানের মাঝে কালাম একটা ট্রেতে চা আর নাশতা দিয়ে গেল। আমি শুধু চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিতেই কিসমিসের জোরালো অনুরোধে নাশতাতেও হস্ত নিক্ষেপ করতে হলো। কিসমিস তার উদর পূর্তি করে এবার একটু নড়েচড়ে বসে বলল, 'তুমি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ যে, সরকারি অফিসে ফাইলের অগ্রগতিতে, আকাঙ্ক্ষিত কেন্দ্রে পোস্টিং ও বদলিতে, টেন্ডারবাজিতে, নতুন চাকরি লাভে, বাড়িতে অত্যাবশ্যকীয় নানা সংযোগ পেতে, আইন-শৃঙ্খলার সহায়তা পেতে, যানবাহনের মালপত্র বহন_ সবখানেই উৎকোচের মহাধুম।'
কিসমিসের অভিমানি কথামালা আমার বিবেককে তাড়িত করে যেন আবেগের সরোবরে স্নান করাতে লাগল। আমি সি্নগ্ধ কণ্ঠে বললাম, 'শুধু তাই নয়। অবুঝ শিশুদের শিক্ষাঙ্গনে পাঠানোর প্রয়াসেও অনেক সময় অভিভাবকদের উৎকোচের কালো হাতের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে হচ্ছে।'
আমার কথা শেষ হতেই কিসমিস তার দু'হাতের তালু দিয়ে মুখমণ্ডলটা ঢেকে তার শীর্ণ শরীরটায় যেন দু'তিনটি ৬ রিখটার মাপের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি দিল। আমি উপলব্ধি করলাম, ও তার বুক থেকে উঠে আসা হাসিটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমি তড়িৎ কণ্ঠে শুধালাম, 'কী হলো? আমার কথায় এত পুলকিত হওয়ার কারণ কী?' ও এবার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল, 'সত্যি, তুমি এবার জাতীয় সমস্যাটার একেবারে তৃণমূলে দৃষ্টি ফেলেছ। ব্র্যাভো ব্র্যাভো! ওর মন্তব্যটা আমার মনের ইঞ্জিনের ট্যাঙ্কারে যেন দশ লিটার অকটেন ঢেলে দিল। আমি এবার ঊর্ধ্বর্গতিতে বাক্য চালনা করে বললাম, দোস্ত, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, উৎকোচ দেওয়া আর নেওয়া সমান অপরাধ।
_সেটা তো নীতিবাক্য। সমস্যাটার নাড়ি কাটতে হবে আঁতুড়ঘরে। অথবা উৎকোচকে বৈধ ঘোষণা করতে হবে।
_সেটা কেমন?
_কোনো লুকোচুরি খেলা না খেলে খোলামেলা দেওয়া-নেওয়া আর কি!
কিসমিস কথাগুলোতে ব্যঙ্গ মিশিয়ে ছেড়ে দিল। আমি বললাম, 'দোস্ত তোমার এ সংলাপগুলো অভিমান আর দুঃখের উত্তাপে ঝলসানো বার বি-কিউ-র মতো। কোনো সমাধানমূলক পরামর্শ আছে কিনা বর্ণনা কর।'
_দেখ, বাংলায় একটা কথা আছে_ অভাবে স্বভাব নষ্ট।
_তা আছে। কিন্তু এখানে এ বেদবাক্যের অবতারণা কেন?
_জীবন-সংগ্রামে অনেক সময় সৎচরিত্রের লাগামকে ধরে রাখা যায় না। অভাব ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকলে সততা জানালা দিয়ে পালাতে চায়। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা_ এ ক'টি নূ্যনতম প্রয়োজনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
_এ দুরূহ কাজ কীভাবে সম্ভব?
_অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সরকার আর জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত সংগ্রাম।
আমি কিসমিসের পরামর্শটাকে আদর করেই যেন কোলে তুলে নিয়ে বললাম, 'উন্নত বিশ্বে এসবের নিশ্চয়তা আছে জানি। তবে একটা বিষয়ে আলোকপাত না করলে বুকের বেদনাটা বড্ডা হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে দোস্ত।'
_'তা বিষয়টা ম্যাচিউরড্ হলে ডেলিভারিটা করেই ফেল না।' আমি এবার কিসমিসের তীক্ষষ্ট চোখের মণি দুটিকে নিরিখ করে বললাম, 'বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক সময় জানতে পারি বিশ্বখ্যাত অনেক মনীষী বা কোম্পানি উৎকোচের লোভনীয় হাতছানির প্রেমে বন্দি হয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।' আমার কথাটার যবনিকাপাতের সঙ্গে সঙ্গে কিসমিস আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল, 'দোস্ত, বাইরের দিকে নজর না দিয়ে একটু নিজের ঘরের দিকে দৃষ্টি ফেল। আন্তর্জাতিক রঙ-তুলি দিয়ে বিষয়টাকে হোলিখেলার রঙে রঞ্জিত কর না।'
ওর কথায় আমি যেন আমার অন্তঃচক্ষুকে উন্মোচিত করলাম। নিভৃত মনের কোণে আমাদের সামাজিক ক্ষতগুলোর দুর্গন্ধ অনুভব করলাম। লক্ষ্য করলাম কিসমিস যেন নিঃশব্দে আমার অনুভূতির নিকুঞ্জটাকে হাতড়াচ্ছে। আমি প্রশংসাস্নাত কণ্ঠে বললাম, 'তুমি তো সবসময়ই সমস্যাগুলোর মূল শিকড়েই অস্ত্রোপচারের ভাবনা কর।'
_'হ্যাঁ, তা করি। তবে মূল শিকড়ে অস্ত্রোপচার করতে হলে ধারালো ছুরি আর সাহসী পদক্ষেপ প্রয়োজন।'
বললাম, 'দোস্তস্ন, অনেকক্ষণ তো হলো, এখন উঠি। তবে এবার তোমার মোবাইল ফোনটা অন কর, আর ল্যান্ড ফোনটাকেও সঞ্জীবনী সুধা পান করানোর ব্যবস্থা কর।
_'বেশ!' আমাকে সম্মতি জানালো কিসমিস।
ডা. সাইফুল আলম :ডেন্টাল সার্জন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
বেশ ক'টা দিন ধরে আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু কিসমিস আলীর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বা যোগাযোগ নেই। মোবাইল ফোনটা বন্ধ, আর ল্যান্ড ফোনটাও যে মাসখানেক যাবৎ গোঁ ধরে নীরব হয়ে আছে, তা আমার জ্ঞাত। অথচ ওর সঙ্গে বেশি দিনের বিচ্ছিন্নতা যে আমার আহার-নিদ্রায় বদহজম ঘটায়, সেটা ওর অজানা নয়। তাই ব্যস্ততাকে ফাঁকি দিয়ে আর সময়কে পোষ মানিয়ে একদিন ওর জিগাতলার বাসার সামনে উপস্থিত হলাম। হাতঘড়ির ঘণ্টার কাঁটাটা তখন সকাল ৯টাকে ধরি ধরি করছে। সদর দরজার কলিং বেলটাতে চাপ দিতেই গৃহপরিচারক কালাম বিলম্বকে ঝেড়ে ফেলে দরজাটা খুলে মুখদর্শন দিল। মনে হলো, সে যেন ওপাশে আমার জন্যই এতক্ষণ সময় গুনছিল। যাহোক, ঘরে ঢুকে কিসমিসের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ও মুখে কিছু না বলে ইশারায় ওর প্রভুর শোবার ঘরটা দেখিয়ে সামনের রান্নাঘরে মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল।
আমি নিঃশব্দ পদচারণা করে কিসমিসের ঘরটায় ঢুকে দেখি, পা থেকে মাথা অবধি একটা সাদা চাদরে ঢেকে ও বিছানায় শুয়ে আছে। আমি নরম হাতে ওর গায়ে ছোঁয়া দিতেই ও মাথার চাদরের সামান্য অংশ সরিয়ে শুধু চোখ দুটি বের করল। অপ্রত্যাশিতভাবে আমার মুখ দর্শনে ও এমন ভাবে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল যে, আমি যেন ওর অনেক দিনের অচেনা। কণ্ঠে খানিকটা বিস্ময়ের বাটা মসলা মাখিয়ে বললাম, 'কী বিষয় দোস্ত, ক'টা দিন নিজেকে নির্বাসনে রেখেছ কেন?'
আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ও ধীরে ধীরে মাথার বালিশটাকে পিঠের মাঝখানে স্থাপন করে চোখের ইশারায় ওর পাশে বসতে বলল। আমিও রোবটের মতো ওর প্রতি আনুগত্য দেখালাম। আমাদের দু'জনের নীরবতাকে নিয়ে সময় যেন কিছুটা খেলা করতে লাগল। সে খেলা ভঙ্গ করে আমি শুধালাম, 'ল্যান্ড ফোনটা খারাপ, মোবাইল বন্ধ। এ প্রতীকী ধর্মঘটের কারণ কী?'
_মোবাইল ইচ্ছা করেই বন্ধ, আর ল্যান্ড ফোনটার কেবল চুরি।
কিসমিস তার শুকনো ঠোঁট দুটোয় আধাছটাক হাসি মাখিয়ে জবাব দিল।
_তা ফোন অফিসে কমপ্লেন করলেই তো সমস্যা চুকে যায়।
_তা যায়। কিন্তু চুরিটা তো ধারাবাহিক নাটকের মতো মঞ্চস্থ হচ্ছে।
_ও! আমার কণ্ঠে এবার হতাশা।
_তাছাড়া_
_তাছাড়া?
_তাছাড়া! নাঃ বাকিটা আর নাইবা প্রকাশ করলাম।
কিসমিস এবার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর আমার ডান হাতটা ধরে লিভিং রুমের একটা সোফাতে নিয়ে বসাল। আমি বললাম, 'দোস্ত, এ যুগে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা সনাতনি যুগের শামিল।' আমার এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ও বলল, 'দোস্ত, একটু অপেক্ষা কর, কালামকে চা-নাশতার ব্যবস্থা করতে বলি। পরে না হয় আলাপের ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষা যাবে।'
_সে কী! এত বেলা অবধি মুখে কিছু দাওনি?
_না, তবে চায়ের পিপাসাটাকে বেশ কিছুক্ষণ আদর করে থামিয়ে রাখলেও ক্ষুধাটা এখন যেন পাকস্থলীর দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। কথাগুলো ইথারের বুকে ছড়িয়ে দিতে দিতে কিসমিস রান্নাঘরে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে বলল, 'শোনো দোস্ত, ক'টা দিন ধরে ভাবছি কোনো একটা দৈনিক পত্রিকায় চিঠিপত্র কলামে আমাদের জাতীয় একটা সমস্যা নিয়ে কিছু পরামর্শ লিখব।'
ভাবলাম, কিসমিসের পরামর্শ বলে কথা। তাও আবার লিখিতভাবে! বিষয়টা আমার মস্তিষ্কের অনুভূতির কোষগুলোয় খোঁচা দিতেই আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে ওর পানে তাকালাম। এ এবার বলল, 'দোস্ত, দেশের বিভিন্ন সেক্টরে উৎকোচ আদান-প্রদানকে বৈধ ঘোষণা করলে কেমন হয়?'
_সে কী! এ যে সমাজে জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়ার শামিল! আমি চমকে উঠে বললাম।
_না দোস্ত, এটাই জীবাণু ধ্বংসের ধারালো ব্যবস্থা। কিসমিসের দৃঢ় উত্তর। আমি ওর কথার জবাবের সন্ধানের মাঝে কালাম একটা ট্রেতে চা আর নাশতা দিয়ে গেল। আমি শুধু চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিতেই কিসমিসের জোরালো অনুরোধে নাশতাতেও হস্ত নিক্ষেপ করতে হলো। কিসমিস তার উদর পূর্তি করে এবার একটু নড়েচড়ে বসে বলল, 'তুমি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ যে, সরকারি অফিসে ফাইলের অগ্রগতিতে, আকাঙ্ক্ষিত কেন্দ্রে পোস্টিং ও বদলিতে, টেন্ডারবাজিতে, নতুন চাকরি লাভে, বাড়িতে অত্যাবশ্যকীয় নানা সংযোগ পেতে, আইন-শৃঙ্খলার সহায়তা পেতে, যানবাহনের মালপত্র বহন_ সবখানেই উৎকোচের মহাধুম।'
কিসমিসের অভিমানি কথামালা আমার বিবেককে তাড়িত করে যেন আবেগের সরোবরে স্নান করাতে লাগল। আমি সি্নগ্ধ কণ্ঠে বললাম, 'শুধু তাই নয়। অবুঝ শিশুদের শিক্ষাঙ্গনে পাঠানোর প্রয়াসেও অনেক সময় অভিভাবকদের উৎকোচের কালো হাতের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে হচ্ছে।'
আমার কথা শেষ হতেই কিসমিস তার দু'হাতের তালু দিয়ে মুখমণ্ডলটা ঢেকে তার শীর্ণ শরীরটায় যেন দু'তিনটি ৬ রিখটার মাপের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি দিল। আমি উপলব্ধি করলাম, ও তার বুক থেকে উঠে আসা হাসিটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমি তড়িৎ কণ্ঠে শুধালাম, 'কী হলো? আমার কথায় এত পুলকিত হওয়ার কারণ কী?' ও এবার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল, 'সত্যি, তুমি এবার জাতীয় সমস্যাটার একেবারে তৃণমূলে দৃষ্টি ফেলেছ। ব্র্যাভো ব্র্যাভো! ওর মন্তব্যটা আমার মনের ইঞ্জিনের ট্যাঙ্কারে যেন দশ লিটার অকটেন ঢেলে দিল। আমি এবার ঊর্ধ্বর্গতিতে বাক্য চালনা করে বললাম, দোস্ত, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, উৎকোচ দেওয়া আর নেওয়া সমান অপরাধ।
_সেটা তো নীতিবাক্য। সমস্যাটার নাড়ি কাটতে হবে আঁতুড়ঘরে। অথবা উৎকোচকে বৈধ ঘোষণা করতে হবে।
_সেটা কেমন?
_কোনো লুকোচুরি খেলা না খেলে খোলামেলা দেওয়া-নেওয়া আর কি!
কিসমিস কথাগুলোতে ব্যঙ্গ মিশিয়ে ছেড়ে দিল। আমি বললাম, 'দোস্ত তোমার এ সংলাপগুলো অভিমান আর দুঃখের উত্তাপে ঝলসানো বার বি-কিউ-র মতো। কোনো সমাধানমূলক পরামর্শ আছে কিনা বর্ণনা কর।'
_দেখ, বাংলায় একটা কথা আছে_ অভাবে স্বভাব নষ্ট।
_তা আছে। কিন্তু এখানে এ বেদবাক্যের অবতারণা কেন?
_জীবন-সংগ্রামে অনেক সময় সৎচরিত্রের লাগামকে ধরে রাখা যায় না। অভাব ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকলে সততা জানালা দিয়ে পালাতে চায়। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা_ এ ক'টি নূ্যনতম প্রয়োজনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
_এ দুরূহ কাজ কীভাবে সম্ভব?
_অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সরকার আর জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত সংগ্রাম।
আমি কিসমিসের পরামর্শটাকে আদর করেই যেন কোলে তুলে নিয়ে বললাম, 'উন্নত বিশ্বে এসবের নিশ্চয়তা আছে জানি। তবে একটা বিষয়ে আলোকপাত না করলে বুকের বেদনাটা বড্ডা হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে দোস্ত।'
_'তা বিষয়টা ম্যাচিউরড্ হলে ডেলিভারিটা করেই ফেল না।' আমি এবার কিসমিসের তীক্ষষ্ট চোখের মণি দুটিকে নিরিখ করে বললাম, 'বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক সময় জানতে পারি বিশ্বখ্যাত অনেক মনীষী বা কোম্পানি উৎকোচের লোভনীয় হাতছানির প্রেমে বন্দি হয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।' আমার কথাটার যবনিকাপাতের সঙ্গে সঙ্গে কিসমিস আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল, 'দোস্ত, বাইরের দিকে নজর না দিয়ে একটু নিজের ঘরের দিকে দৃষ্টি ফেল। আন্তর্জাতিক রঙ-তুলি দিয়ে বিষয়টাকে হোলিখেলার রঙে রঞ্জিত কর না।'
ওর কথায় আমি যেন আমার অন্তঃচক্ষুকে উন্মোচিত করলাম। নিভৃত মনের কোণে আমাদের সামাজিক ক্ষতগুলোর দুর্গন্ধ অনুভব করলাম। লক্ষ্য করলাম কিসমিস যেন নিঃশব্দে আমার অনুভূতির নিকুঞ্জটাকে হাতড়াচ্ছে। আমি প্রশংসাস্নাত কণ্ঠে বললাম, 'তুমি তো সবসময়ই সমস্যাগুলোর মূল শিকড়েই অস্ত্রোপচারের ভাবনা কর।'
_'হ্যাঁ, তা করি। তবে মূল শিকড়ে অস্ত্রোপচার করতে হলে ধারালো ছুরি আর সাহসী পদক্ষেপ প্রয়োজন।'
বললাম, 'দোস্তস্ন, অনেকক্ষণ তো হলো, এখন উঠি। তবে এবার তোমার মোবাইল ফোনটা অন কর, আর ল্যান্ড ফোনটাকেও সঞ্জীবনী সুধা পান করানোর ব্যবস্থা কর।
_'বেশ!' আমাকে সম্মতি জানালো কিসমিস।
ডা. সাইফুল আলম :ডেন্টাল সার্জন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
No comments