সুশাসন-পুলিশের জবাবদিহি by শেখ হাফিজুর রহমান ও ফারহানা হেলাল মেহতাব
পুলিশ কি সেবক, নাকি দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমগ্ন ও নির্যাতক বাহিনীর সদস্য? কিছুদিন একটি রাজশাহীতে একটি পরিবারের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে এক লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে এখন আটজন শ্রীঘরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবদুল কাদেরকে ছিনতাইকারী সাজিয়ে তাঁর ওপর পুলিশের নির্যাতনের
ঘটনায় খবরে শিউরে উঠেছেন লাখ লাখ সংবেদনশীল মানুষ। প্রশ্ন উঠেছে, আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় সরকার যে পুলিশ বাহিনী পুষছে, তারা কী করছে? কী করে পুলিশের উপস্থিতিতে ছয়জন কলেজছাত্রকে গ্রামবাসী এক ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উর্দি পরা মাস্তানের ভূমিকায় কেউ দেখতে চায় না। কনস্টেবল থেকে থানার ওসি পর্যন্ত পুলিশের যে নিচু স্তর, তাদের আচরণ খুবই ভয়ংকর। পুলিশের এই নিচু স্তরকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে জনবান্ধব করতে না পারলে পুলিশের কাছ থেকে কী করে জনগণ সেবা পাবে? থানার ওসি পর্যায়ে বিসিএস উত্তীর্ণ কর্মকর্তাদের নিয়োগ করতে সমস্যা কোথায়? বর্তমান সরকার এমন একটি উদ্যোগ নিয়েও বাস্তবায়ন করতে পারল না কেন?
কত কত প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে সারা দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী ছেলে ও মেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন। তাঁদের পড়াশোনা ও থাকা-খাওয়ার জন্য যে টাকা ব্যয় হয়, কত কষ্ট করে বাবা-মা তার জোগান দেন। যাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল নন, তাঁদের টিউশনি করে বা খণ্ডকালীন কাজ করে পড়াশোনার খরচ মেটাতে হয়। কত কত ছাত্র টিউশনি করেন, পরিবারে টাকা দিয়ে, নিজের পড়াশোনার খরচ মিটিয়ে তারপর প্রথম শ্রেণী পান! এমন নানা সমস্যা ও প্রতিকূলতার মধ্যে সংগ্রাম করে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকে থাকতে হয়, বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রে নিজের অবস্থান করে নিতে হয়। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় পুলিশের মিথ্যা মামলায় ডাকাত বা ছিনতাইকারীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর ভয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাবেন কোথায়?
পুলিশের যে ইমেজ-সংকট, সেটি কিন্তু দু-এক বছরের ঘটনা নয়। সেটি শত বছরের পুরোনো একটি রাষ্ট্রীয় সমস্যা। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার এমন এক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়, যে বাহিনী সব আন্দোলন ও বিপ্লব দমন করে ব্রিটিশরাজকে নিরাপদ রাখবে। একটি শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য ব্রিটিশরাজ পুলিশের একটি কাঠামো এবং ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন তৈরি করে। ব্রিটিশরাজ কর্তৃক গড়ে তোলা কাঠামো ও পুলিশ আইন তৈরির পর দেড় শ বছর অতিক্রান্ত হলেও ওই কাঠামো ও আইন অনুযায়ী এখনো বাংলাদেশের পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের প্রধান সমালোচনা হচ্ছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশরাজকে বিপ্লব ও আন্দোলন থেকে নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্য নিয়েই ওই আইনটি করা হয়েছিল। ভারত উপমহাদেশের (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বা এই অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টিকে এ আইনে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ, ব্রিটিশ কাঠামো ও ব্রিটিশরাজ প্রণীত আইনে পুলিশের ভূমিকা ছিল Pro-ruler বা শাসকবান্ধব। বিপ্লবী, আন্দোলনকারী ও জনগণকে নির্যাতন করাই ছিল ব্রিটিশ আইনে নির্ধারিত পুলিশের ভূমিকা।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, পুলিশের ওই নির্যাতক চরিত্রটিকেই আমরা রেখে দিয়েছি। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়েছে ১৯৪৭ সালে, পাকিস্তানি শাসনের অবসান হয়েছে ১৯৭১ সালে, এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা সামরিক, তত্ত্বাবধায়ক ও গণতান্ত্রিক শাসন দেখেছি। কিন্তু যে গণবিরোধী পুলিশ বাহিনী ব্রিটিশরাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেই গণবিরোধী ও নির্যাতক পুলিশের কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ঔপনিবেশিক শাসনের সহায়ক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার পর ব্রিটিশরাজ বুঝতে পারে যে তারা এক ফ্রাংকেনস্টাইন গড়ে তুলেছে। নানা অভিযোগ আসতে থাকে পুলিশের বিরুদ্ধে। অভিযোগ তদন্ত করার জন্য ১৯০২ সালে ফ্রেজার কমিশন গঠিত হয়। কমিশন তার রিপোর্টে সুস্পষ্ট করেই বলল যে পুলিশ অদক্ষ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। ১৯০২ সালে ফ্রেজার কমিশন যে কথাগুলো বলেছিল, আজ ১০৯ বছর পর বাংলাদেশের পুলিশ সম্পর্কেও কি সেই কথাগুলো প্রযোজ্য নয়?
বাংলাদেশের পুলিশের চরিত্র আমরা জানি। পুলিশের সমস্যাগুলোও বারবার চিহ্নিত হয়েছে। এখন দরকার গণমুখী ও সার্ভিস ওরিয়েন্টেড পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া। ইয়াসমীন যখন পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগে পুলিশ যখন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের পরিধেয় খুলে তাঁকে নির্যাতন করল, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। যে পুলিশ বাহিনী ডাকাতি ও ছিনতাই করে, যে পুলিশ ছাত্রকে চাপাতি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে, যে পুলিশ বাহিনী নারী নির্যাতন করে, সেই পুলিশ বাহিনী আমাদের দরকার নেই। আমাদের দরকার এমন এক পুলিশ বাহিনী, যারা আমাদের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতিকেও রাখবে শান্ত ও সুস্থির। এই উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে আমাদের এমন একটি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পুলিশ বাহিনী প্রয়োজন হবে, যারা জনগণের সেবা নিশ্চিত করবে। সেই লক্ষ্যে সরকার ও বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে কাজ করবে বলে প্রত্যাশা রইল।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ফারহানা হেলাল মেহতাব: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়।
কত কত প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে সারা দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী ছেলে ও মেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন। তাঁদের পড়াশোনা ও থাকা-খাওয়ার জন্য যে টাকা ব্যয় হয়, কত কষ্ট করে বাবা-মা তার জোগান দেন। যাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল নন, তাঁদের টিউশনি করে বা খণ্ডকালীন কাজ করে পড়াশোনার খরচ মেটাতে হয়। কত কত ছাত্র টিউশনি করেন, পরিবারে টাকা দিয়ে, নিজের পড়াশোনার খরচ মিটিয়ে তারপর প্রথম শ্রেণী পান! এমন নানা সমস্যা ও প্রতিকূলতার মধ্যে সংগ্রাম করে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকে থাকতে হয়, বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রে নিজের অবস্থান করে নিতে হয়। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় পুলিশের মিথ্যা মামলায় ডাকাত বা ছিনতাইকারীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর ভয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাবেন কোথায়?
পুলিশের যে ইমেজ-সংকট, সেটি কিন্তু দু-এক বছরের ঘটনা নয়। সেটি শত বছরের পুরোনো একটি রাষ্ট্রীয় সমস্যা। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার এমন এক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়, যে বাহিনী সব আন্দোলন ও বিপ্লব দমন করে ব্রিটিশরাজকে নিরাপদ রাখবে। একটি শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য ব্রিটিশরাজ পুলিশের একটি কাঠামো এবং ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন তৈরি করে। ব্রিটিশরাজ কর্তৃক গড়ে তোলা কাঠামো ও পুলিশ আইন তৈরির পর দেড় শ বছর অতিক্রান্ত হলেও ওই কাঠামো ও আইন অনুযায়ী এখনো বাংলাদেশের পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের প্রধান সমালোচনা হচ্ছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশরাজকে বিপ্লব ও আন্দোলন থেকে নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্য নিয়েই ওই আইনটি করা হয়েছিল। ভারত উপমহাদেশের (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বা এই অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টিকে এ আইনে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ, ব্রিটিশ কাঠামো ও ব্রিটিশরাজ প্রণীত আইনে পুলিশের ভূমিকা ছিল Pro-ruler বা শাসকবান্ধব। বিপ্লবী, আন্দোলনকারী ও জনগণকে নির্যাতন করাই ছিল ব্রিটিশ আইনে নির্ধারিত পুলিশের ভূমিকা।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, পুলিশের ওই নির্যাতক চরিত্রটিকেই আমরা রেখে দিয়েছি। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়েছে ১৯৪৭ সালে, পাকিস্তানি শাসনের অবসান হয়েছে ১৯৭১ সালে, এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা সামরিক, তত্ত্বাবধায়ক ও গণতান্ত্রিক শাসন দেখেছি। কিন্তু যে গণবিরোধী পুলিশ বাহিনী ব্রিটিশরাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেই গণবিরোধী ও নির্যাতক পুলিশের কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ঔপনিবেশিক শাসনের সহায়ক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার পর ব্রিটিশরাজ বুঝতে পারে যে তারা এক ফ্রাংকেনস্টাইন গড়ে তুলেছে। নানা অভিযোগ আসতে থাকে পুলিশের বিরুদ্ধে। অভিযোগ তদন্ত করার জন্য ১৯০২ সালে ফ্রেজার কমিশন গঠিত হয়। কমিশন তার রিপোর্টে সুস্পষ্ট করেই বলল যে পুলিশ অদক্ষ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। ১৯০২ সালে ফ্রেজার কমিশন যে কথাগুলো বলেছিল, আজ ১০৯ বছর পর বাংলাদেশের পুলিশ সম্পর্কেও কি সেই কথাগুলো প্রযোজ্য নয়?
বাংলাদেশের পুলিশের চরিত্র আমরা জানি। পুলিশের সমস্যাগুলোও বারবার চিহ্নিত হয়েছে। এখন দরকার গণমুখী ও সার্ভিস ওরিয়েন্টেড পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া। ইয়াসমীন যখন পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগে পুলিশ যখন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের পরিধেয় খুলে তাঁকে নির্যাতন করল, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। যে পুলিশ বাহিনী ডাকাতি ও ছিনতাই করে, যে পুলিশ ছাত্রকে চাপাতি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে, যে পুলিশ বাহিনী নারী নির্যাতন করে, সেই পুলিশ বাহিনী আমাদের দরকার নেই। আমাদের দরকার এমন এক পুলিশ বাহিনী, যারা আমাদের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতিকেও রাখবে শান্ত ও সুস্থির। এই উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে আমাদের এমন একটি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পুলিশ বাহিনী প্রয়োজন হবে, যারা জনগণের সেবা নিশ্চিত করবে। সেই লক্ষ্যে সরকার ও বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে কাজ করবে বলে প্রত্যাশা রইল।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ফারহানা হেলাল মেহতাব: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments