সময়চিত্র-ব্যর্থ মন্ত্রীদের অপসারণ কেন জরুরি by আসিফ নজরুল
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা ঘটেছে সম্প্র্রতি। কয়েকজন মন্ত্রীর বিভিন্ন ব্যর্থতায় সমালোচনামুখর হয়েছেন সরকারি দলের সাংসদেরা। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা রয়েছেন। চাইলে কেউ ভাবতে পারেন যে পদ না পেয়ে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে এসব বলেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব সমালোচনা তাঁরা আগে এত সরাসরি করেননি, এখন কেন করছেন? এর সহজ উত্তর হচ্ছে, সমালোচনা করার যথেষ্ট কারণ সৃষ্টি হয়েছে এখন।
সারা দেশে আরও বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কিছু মন্ত্রীর সমালোচনা করা হচ্ছে। তাঁদের অনেকে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীরা রয়েছেন, যাঁরা আগে কখনো প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করেননি। রয়েছেন এমনকি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও, সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে যাঁর আর কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা থাকার কথা নয়।
মাস ছয়েক আগে সংসদে সরকারি সাংসদদের ক্ষোভের প্রথম বড় ধরনের বহিঃপ্রকাশ দেখি আমরা। রাস্তাঘাট মেরামতে চরম ব্যর্থতার সমালোচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা। আমরা তখন দেখেছি, আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে তাঁদের বক্তব্যকে সমর্থন করেছিলেন। কাজেই এটি শুধু পদবঞ্চিত ব্যক্তিদের ক্ষোভ ভাবার কোনো কারণ ছিল না। সাংসদদের সবাইকে কমবেশি নিজের এলাকায় যেতে হয়। তাঁদের প্রত্যেকেই সরেজমিনে ভোগান্তির চিত্র দেখেছিলেন বলেই হয়তো যোগাযোগমন্ত্রীর সমালোচনাকে এভাবে সমর্থন করেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তারপরও যোগাযোগমন্ত্রীকে সমর্থন করেছিলেন, সমালোচনাকারীদের থামিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা তখন যোগাযোগমন্ত্রীকে ডেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নির্দেশ তাঁকে দিতে দেখিনি। এরপর সড়কের অবস্থা আরও ভয়ংকর হয়েছে, আরও বহু শিশু, নারীসহ বিভিন্ন মানুষ রাস্তায় প্রাণ হারিয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মতো দুই অমিত প্রতিভাধর মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যৌক্তিক কারণে দায়ী করা হয়েছে যোগাযোগমন্ত্রীকে, ভুয়া লাইসেন্সের তদবিরকারী হিসেবে নৌপরিবহনমন্ত্রীকে। গত এক-দেড় বছরে বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডে এমনিতেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল অনেক মানুষ। এখন তারা দাবি করছে অযোগ্য মন্ত্রীদের অপসারণের। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ‘অদক্ষ-অথর্ব মন্ত্রীদের বাদ দেওয়া হবে জনগণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঈদ উপহার’ এই বক্তব্য দিয়েছেন। বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন জরিপে প্রায় শতভাগ মানুষ তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন।
আমার ধারণা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই উপহার দিচ্ছেন না দেশের মানুষকে। সমালোচনাকারীদের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তিনি বলেছেন, তাঁর সরকার দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া সব ক্ষেত্রে সফল। তিনি উল্টো সমালোচনাকারীদের সমালোচনা করে শত্রুদের হাতে অস্ত্র তুলে না দিতে বলেছেন। তাঁর বক্তব্যে এটি অনুমান করা যায়, ঈদের উপহার মানুষকে নয়, তিনি দিচ্ছেন অযোগ্য, অথর্ব, অকর্মণ্য মন্ত্রীদের। তাঁদের মন্ত্রিত্ব হয়তো অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তাঁদের অনেকে নতুন উৎসাহ পাবেন। ব্যর্থ মন্ত্রীদের দাঁত বের করা হাসি, গরু-ছাগল তত্ত্ব, মানুষের দুর্ভোগের প্রতি নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যও হয়তো অব্যাহত থাকবে।
২.
আমাদের সংবিধান অনুসারে সরকারের সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত। দলের ভেতরও গণতন্ত্র নেই বলে তিনি এককভাবে নির্ধারণ করেন কারা হবে তাঁর সরকারের মন্ত্রী। কানাঘুষা আছে যে বিভিন্ন আমলে প্রধানমন্ত্রীরা মন্ত্রী নির্বাচনে কখনো পরিবারের কারও কারও মতামত নেন, কখনো বিদেশি মহলের অনুরোধ বা নির্দেশ গ্রহণ করেন। মন্ত্রিত্ব নির্ধারণে উন্নত গণতন্ত্রে বড় ভূমিকা রাখে সততা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। আমাদের দেশে আরও বড় ভূমিকা রাখে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নিখাদ আনুগত্য। বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা ঠিক কীভাবে বা কোন যোগ্যতায় মন্ত্রী হয়েছেন, তা নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে এটি সম্ভবত ঠিক বাংলাদেশে কোনো মন্ত্রিসভাই গঠনকালে এভাবে চমকে দেয়নি মানুষকে। এই মন্ত্রিসভায় মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আব্দুর রাজ্জাক, এ কে খন্দকার, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ প্রমুখ উজ্জ্বল ইমেজের ব্যক্তিরা ছিলেন ও আছেন। তাঁদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়া আর কেউ বড় কোনো সমালোচনার মুখে কখনো পড়েননি, অনেকেই বরং প্রশংসিত হয়েছেন সর্বমহলে। কিন্তু বাকি অনেকের যোগ্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, যাঁদের নিয়োগের কোনো বোধগম্য ব্যাখ্যা তখনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ বা সাহারা খাতুনের মতো অনুল্লেখ্য ব্যক্তি কেন অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন, অজ্ঞাত রমেশ চন্দ্র কোন বিবেচনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতো অত্যন্ত ট্যাকনিক্যাল একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেন, দীপু মনি কোন পারদর্শিতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন তা নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল কোনো কোনো মহলে। তা ছাড়া ব্যবসায়ী ফারুক খানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং শ্রমিকনেতা শাজাহান খানের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ স্বার্থসংঘাতের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) কারণে নৈতিক নয়, এমন কথাও কেউ কেউ বলেছিলেন। গত দুই বছরে বিভিন্ন ব্যর্থতা, কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য দ্বারা এই মন্ত্রীরাই সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন। সরকারের অন্য অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য এঁরাই ম্লান করে দিয়েছেন।
এঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন একঝাঁক রাজনৈতিক সংস্রবহীন উপদেষ্টা। এঁদের কেউ ভারতের কাছে ট্রানজিটের জন্য মাশুল চাওয়া হবে অসভ্যতা—এ ধরনের দেশদ্রোহি বক্তব্য রেখেছেন, কেউ প্রকাশ্যে শুধু দলের ক্যাডারদের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, অনেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে চলেছেন। তাঁদের অধিকাংশের কর্মকাণ্ডে নির্দিষ্টকৃত কোনো স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহি নেই। গোপনীয়তার কোনো শপথ গ্রহণ না করে এঁরা গোপনীয়তার শপথ নেওয়া মন্ত্রীদের সভায় যেভাবে উপস্থিত থাকেন, তা অসাংবিধানিক, অনৈতিক, নজিরবিহীন এবং দেশের স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক। গওহর রিজভীর মতো হাতেগোনা দু-একজন উপদেষ্টা বাদে বাকি সবার কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছেন এমনকি আওয়ামী লীগেরই কোনো কোনো সিনিয়র নেতা।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সমালোচিত উপদেষ্টাদের কেউই সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের জন্য মোটেও গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। সমালোচিত মন্ত্রীদেরও অধিকাংশ দলে বড়জোর দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির নেতা হিসেবে পরিচিত। এঁদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে বা কাউকে কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিলে দল হিসেবে কোনো রকম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আওয়ামী লীগের নেই। বরং দলের সঙ্গে সংস্রবহীন মন্ত্রীদের বাদ দিলে দলে সত্যিকারের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ দূর হতো, দলও শক্তিশালী হতো। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি হতো যে তাঁদের উৎকণ্ঠা, ভোগান্তি ও ক্ষোভ বিবেচনায় নেওয়ার মতো নেতৃত্ব রয়েছে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে। তাঁদের জায়গায় উপযুক্ত ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় নিয়ে এলে হয়তো সরকারের জনপ্রিয়তাও পুনরুজ্জীবিত হতো অনেকাংশে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অব্যাহত সমালোচনার মুখে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কেন তাহলে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না ব্যর্থ মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে? তাঁর কথামতো শুধু দু-এক জায়গায় ব্যর্থতা থাকলে সেখানে অন্তত কোনো পরিবর্তন কেন আনছেন না তিনি? ঈদের আগেই তাঁকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। হয়তো ঈদের পরে তিনি যোগাযোগমন্ত্রীর মতো দু-একজন প্রবল সমালোচিত মন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে পারেন। যদি না দেন তাহলে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে আমাদের এর রহস্য ও পরিণতি ভাবতে হবে।
৩.
মন্ত্রিসভায় রদবদল যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় স্বাভাবিক একটি বিষয়। সমালোচিত মন্ত্রীদের অপসারণ জনস্বার্থ, জনমত ও জনকল্যাণের প্রতি সরকারের মনোযোগ রয়েছে এই বার্তা পৌঁছে দেয়। এটি অন্য মন্ত্রীদের কাজে পারদর্শিতা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার তাগিদ সৃষ্টি করে। অতীতে মন্ত্রিসভার রদবদল শেখ হাসিনার প্রথম সরকারও করেছে। উপদেষ্টাদের সংখ্যা ও ক্ষমতা তখন সীমাবদ্ধ ছিল, এমনকি মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁদের উপস্থিতি কখনো দেখা যায়নি তাঁর প্রথম আমলে।
এই আমলে কোনো কোনো মন্ত্রী আরও বেশি সমালোচনায় বিদ্ধ হলেও তাঁদের অপসারণের কোনো উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রী এখনো নেননি। আশঙ্কা করার কারণ রয়েছে যে ব্যর্থ মন্ত্রীদের অপসারণ এবং অস্বচ্ছ ক্ষমতাধর উপদেষ্টাদের নিয়ন্ত্রণে অপারগ হলে তিনিই চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাংলাদেশের মানুষ আবুল হোসেন বা সাহারা খাতুনকে দেখে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি। ভোট দিয়েছে শেখ হাসিনাকে দেখে। জনভোগান্তি চরমে উঠলে মানুষের সবচেয়ে বেশি অভিমান বা ক্ষোভ হয় নেত্রীর প্রতিই।
এসব কঠিন সত্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরার মতো সৎ সাহস আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের আছে বলে মনে হচ্ছে না। দলের সাধারণ সম্পাদক ও প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ বরং গণমাধ্যমের সমালোচনাকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন, এটি তাঁর জীবন বিপন্নকারী হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। আমরা মনে করি, একজন সরকারপ্রধানকে বিপন্ন করতে পারে কেবল তাঁর সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও কুশাসন। পৃথিবীতে এমন নজির খুবই কম যে জনপ্রিয় ও দক্ষ একটি সরকারের পতন ঘটানো গেছে কোনো ষড়যন্ত্র করে। ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র তৈরিতে বরং ভূমিকা রাখে মন্ত্রী বা নিজ দলের প্রভাবশালী নেতাদের কুকীর্তি। বাংলাদেশে এর বহু নজির আছে।
আমরা এমন নজির আর চাই না। আমাদের প্রত্যাশা, মন্ত্রীরা বরং ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য কাজ করে এবং মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা সমাধান করে সব ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা দূর করবেন। আমরা চাই, সুশাসন দিয়ে জনকল্যাণে কাজ করে এই সরকার সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করুক। সরকার সফল হলে দেশ এগোয়, এর সুবিধা পায় প্রতিটি মানুষ।
আমরা জানি, বাংলাদেশের বহু মানুষ বিশ্বাস করে, একটি উন্নত, প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের সামর্থ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রয়েছে। তাঁর সামর্থ্য কোনো মন্ত্রী, উপদেষ্টা এমনকি তাঁর নিজের কোনো ভুলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে হবে। এটি বলার পরিবেশও বজায় রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতে সমালোচনার মুখে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেছেন। আমরা আশা করব, নিজের মন্ত্রিসভা নিয়ে পুনর্বিবেচনার গুরুত্বও তিনি আন্তরিক ও নির্মোহভাবে ভেবে দেখবেন।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সারা দেশে আরও বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কিছু মন্ত্রীর সমালোচনা করা হচ্ছে। তাঁদের অনেকে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীরা রয়েছেন, যাঁরা আগে কখনো প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করেননি। রয়েছেন এমনকি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও, সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে যাঁর আর কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা থাকার কথা নয়।
মাস ছয়েক আগে সংসদে সরকারি সাংসদদের ক্ষোভের প্রথম বড় ধরনের বহিঃপ্রকাশ দেখি আমরা। রাস্তাঘাট মেরামতে চরম ব্যর্থতার সমালোচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা। আমরা তখন দেখেছি, আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে তাঁদের বক্তব্যকে সমর্থন করেছিলেন। কাজেই এটি শুধু পদবঞ্চিত ব্যক্তিদের ক্ষোভ ভাবার কোনো কারণ ছিল না। সাংসদদের সবাইকে কমবেশি নিজের এলাকায় যেতে হয়। তাঁদের প্রত্যেকেই সরেজমিনে ভোগান্তির চিত্র দেখেছিলেন বলেই হয়তো যোগাযোগমন্ত্রীর সমালোচনাকে এভাবে সমর্থন করেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তারপরও যোগাযোগমন্ত্রীকে সমর্থন করেছিলেন, সমালোচনাকারীদের থামিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা তখন যোগাযোগমন্ত্রীকে ডেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নির্দেশ তাঁকে দিতে দেখিনি। এরপর সড়কের অবস্থা আরও ভয়ংকর হয়েছে, আরও বহু শিশু, নারীসহ বিভিন্ন মানুষ রাস্তায় প্রাণ হারিয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মতো দুই অমিত প্রতিভাধর মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যৌক্তিক কারণে দায়ী করা হয়েছে যোগাযোগমন্ত্রীকে, ভুয়া লাইসেন্সের তদবিরকারী হিসেবে নৌপরিবহনমন্ত্রীকে। গত এক-দেড় বছরে বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডে এমনিতেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল অনেক মানুষ। এখন তারা দাবি করছে অযোগ্য মন্ত্রীদের অপসারণের। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ‘অদক্ষ-অথর্ব মন্ত্রীদের বাদ দেওয়া হবে জনগণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঈদ উপহার’ এই বক্তব্য দিয়েছেন। বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন জরিপে প্রায় শতভাগ মানুষ তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন।
আমার ধারণা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই উপহার দিচ্ছেন না দেশের মানুষকে। সমালোচনাকারীদের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তিনি বলেছেন, তাঁর সরকার দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া সব ক্ষেত্রে সফল। তিনি উল্টো সমালোচনাকারীদের সমালোচনা করে শত্রুদের হাতে অস্ত্র তুলে না দিতে বলেছেন। তাঁর বক্তব্যে এটি অনুমান করা যায়, ঈদের উপহার মানুষকে নয়, তিনি দিচ্ছেন অযোগ্য, অথর্ব, অকর্মণ্য মন্ত্রীদের। তাঁদের মন্ত্রিত্ব হয়তো অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তাঁদের অনেকে নতুন উৎসাহ পাবেন। ব্যর্থ মন্ত্রীদের দাঁত বের করা হাসি, গরু-ছাগল তত্ত্ব, মানুষের দুর্ভোগের প্রতি নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যও হয়তো অব্যাহত থাকবে।
২.
আমাদের সংবিধান অনুসারে সরকারের সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত। দলের ভেতরও গণতন্ত্র নেই বলে তিনি এককভাবে নির্ধারণ করেন কারা হবে তাঁর সরকারের মন্ত্রী। কানাঘুষা আছে যে বিভিন্ন আমলে প্রধানমন্ত্রীরা মন্ত্রী নির্বাচনে কখনো পরিবারের কারও কারও মতামত নেন, কখনো বিদেশি মহলের অনুরোধ বা নির্দেশ গ্রহণ করেন। মন্ত্রিত্ব নির্ধারণে উন্নত গণতন্ত্রে বড় ভূমিকা রাখে সততা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। আমাদের দেশে আরও বড় ভূমিকা রাখে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নিখাদ আনুগত্য। বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা ঠিক কীভাবে বা কোন যোগ্যতায় মন্ত্রী হয়েছেন, তা নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে এটি সম্ভবত ঠিক বাংলাদেশে কোনো মন্ত্রিসভাই গঠনকালে এভাবে চমকে দেয়নি মানুষকে। এই মন্ত্রিসভায় মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আব্দুর রাজ্জাক, এ কে খন্দকার, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ প্রমুখ উজ্জ্বল ইমেজের ব্যক্তিরা ছিলেন ও আছেন। তাঁদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়া আর কেউ বড় কোনো সমালোচনার মুখে কখনো পড়েননি, অনেকেই বরং প্রশংসিত হয়েছেন সর্বমহলে। কিন্তু বাকি অনেকের যোগ্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, যাঁদের নিয়োগের কোনো বোধগম্য ব্যাখ্যা তখনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ বা সাহারা খাতুনের মতো অনুল্লেখ্য ব্যক্তি কেন অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন, অজ্ঞাত রমেশ চন্দ্র কোন বিবেচনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতো অত্যন্ত ট্যাকনিক্যাল একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেন, দীপু মনি কোন পারদর্শিতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন তা নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল কোনো কোনো মহলে। তা ছাড়া ব্যবসায়ী ফারুক খানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং শ্রমিকনেতা শাজাহান খানের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ স্বার্থসংঘাতের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) কারণে নৈতিক নয়, এমন কথাও কেউ কেউ বলেছিলেন। গত দুই বছরে বিভিন্ন ব্যর্থতা, কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য দ্বারা এই মন্ত্রীরাই সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন। সরকারের অন্য অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য এঁরাই ম্লান করে দিয়েছেন।
এঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন একঝাঁক রাজনৈতিক সংস্রবহীন উপদেষ্টা। এঁদের কেউ ভারতের কাছে ট্রানজিটের জন্য মাশুল চাওয়া হবে অসভ্যতা—এ ধরনের দেশদ্রোহি বক্তব্য রেখেছেন, কেউ প্রকাশ্যে শুধু দলের ক্যাডারদের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, অনেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে চলেছেন। তাঁদের অধিকাংশের কর্মকাণ্ডে নির্দিষ্টকৃত কোনো স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহি নেই। গোপনীয়তার কোনো শপথ গ্রহণ না করে এঁরা গোপনীয়তার শপথ নেওয়া মন্ত্রীদের সভায় যেভাবে উপস্থিত থাকেন, তা অসাংবিধানিক, অনৈতিক, নজিরবিহীন এবং দেশের স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক। গওহর রিজভীর মতো হাতেগোনা দু-একজন উপদেষ্টা বাদে বাকি সবার কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছেন এমনকি আওয়ামী লীগেরই কোনো কোনো সিনিয়র নেতা।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সমালোচিত উপদেষ্টাদের কেউই সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের জন্য মোটেও গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। সমালোচিত মন্ত্রীদেরও অধিকাংশ দলে বড়জোর দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির নেতা হিসেবে পরিচিত। এঁদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে বা কাউকে কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিলে দল হিসেবে কোনো রকম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আওয়ামী লীগের নেই। বরং দলের সঙ্গে সংস্রবহীন মন্ত্রীদের বাদ দিলে দলে সত্যিকারের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ দূর হতো, দলও শক্তিশালী হতো। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি হতো যে তাঁদের উৎকণ্ঠা, ভোগান্তি ও ক্ষোভ বিবেচনায় নেওয়ার মতো নেতৃত্ব রয়েছে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে। তাঁদের জায়গায় উপযুক্ত ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় নিয়ে এলে হয়তো সরকারের জনপ্রিয়তাও পুনরুজ্জীবিত হতো অনেকাংশে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অব্যাহত সমালোচনার মুখে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কেন তাহলে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না ব্যর্থ মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে? তাঁর কথামতো শুধু দু-এক জায়গায় ব্যর্থতা থাকলে সেখানে অন্তত কোনো পরিবর্তন কেন আনছেন না তিনি? ঈদের আগেই তাঁকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। হয়তো ঈদের পরে তিনি যোগাযোগমন্ত্রীর মতো দু-একজন প্রবল সমালোচিত মন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে পারেন। যদি না দেন তাহলে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে আমাদের এর রহস্য ও পরিণতি ভাবতে হবে।
৩.
মন্ত্রিসভায় রদবদল যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় স্বাভাবিক একটি বিষয়। সমালোচিত মন্ত্রীদের অপসারণ জনস্বার্থ, জনমত ও জনকল্যাণের প্রতি সরকারের মনোযোগ রয়েছে এই বার্তা পৌঁছে দেয়। এটি অন্য মন্ত্রীদের কাজে পারদর্শিতা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার তাগিদ সৃষ্টি করে। অতীতে মন্ত্রিসভার রদবদল শেখ হাসিনার প্রথম সরকারও করেছে। উপদেষ্টাদের সংখ্যা ও ক্ষমতা তখন সীমাবদ্ধ ছিল, এমনকি মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁদের উপস্থিতি কখনো দেখা যায়নি তাঁর প্রথম আমলে।
এই আমলে কোনো কোনো মন্ত্রী আরও বেশি সমালোচনায় বিদ্ধ হলেও তাঁদের অপসারণের কোনো উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রী এখনো নেননি। আশঙ্কা করার কারণ রয়েছে যে ব্যর্থ মন্ত্রীদের অপসারণ এবং অস্বচ্ছ ক্ষমতাধর উপদেষ্টাদের নিয়ন্ত্রণে অপারগ হলে তিনিই চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাংলাদেশের মানুষ আবুল হোসেন বা সাহারা খাতুনকে দেখে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি। ভোট দিয়েছে শেখ হাসিনাকে দেখে। জনভোগান্তি চরমে উঠলে মানুষের সবচেয়ে বেশি অভিমান বা ক্ষোভ হয় নেত্রীর প্রতিই।
এসব কঠিন সত্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরার মতো সৎ সাহস আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের আছে বলে মনে হচ্ছে না। দলের সাধারণ সম্পাদক ও প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ বরং গণমাধ্যমের সমালোচনাকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন, এটি তাঁর জীবন বিপন্নকারী হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। আমরা মনে করি, একজন সরকারপ্রধানকে বিপন্ন করতে পারে কেবল তাঁর সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও কুশাসন। পৃথিবীতে এমন নজির খুবই কম যে জনপ্রিয় ও দক্ষ একটি সরকারের পতন ঘটানো গেছে কোনো ষড়যন্ত্র করে। ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র তৈরিতে বরং ভূমিকা রাখে মন্ত্রী বা নিজ দলের প্রভাবশালী নেতাদের কুকীর্তি। বাংলাদেশে এর বহু নজির আছে।
আমরা এমন নজির আর চাই না। আমাদের প্রত্যাশা, মন্ত্রীরা বরং ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য কাজ করে এবং মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা সমাধান করে সব ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা দূর করবেন। আমরা চাই, সুশাসন দিয়ে জনকল্যাণে কাজ করে এই সরকার সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করুক। সরকার সফল হলে দেশ এগোয়, এর সুবিধা পায় প্রতিটি মানুষ।
আমরা জানি, বাংলাদেশের বহু মানুষ বিশ্বাস করে, একটি উন্নত, প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের সামর্থ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রয়েছে। তাঁর সামর্থ্য কোনো মন্ত্রী, উপদেষ্টা এমনকি তাঁর নিজের কোনো ভুলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে হবে। এটি বলার পরিবেশও বজায় রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতে সমালোচনার মুখে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেছেন। আমরা আশা করব, নিজের মন্ত্রিসভা নিয়ে পুনর্বিবেচনার গুরুত্বও তিনি আন্তরিক ও নির্মোহভাবে ভেবে দেখবেন।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments