চারদিক-সোনালি শৈশব শুধুই স্বপ্ন by এম জসীম উদ্দীন
ছবির এই শিশুটির দিকে চোখ রাখুন। এই বয়সে ওর কচি হাত দুটোয় বইখাতা বুকে আগলে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। সহপাঠীদের সঙ্গে মাঠে খেলা করবে, কাদাজলে লুটোপুটি খাবে, ঘাসফড়িং ধরবে, ঘুড়ি ওড়াবে, আরও কত কী করবে! মায়ের বকুনি, শিক্ষকদের শাসন, আদর, প্রশংসা কত কী পাওয়ার কথা! কিন্তু এ সবই যেন স্বপ্ন শিশু রাব্বির জীবনে। এখন তার কচি হাতের শক্ত মুঠোয় রিকশার হ্যান্ডেল, বাড়ন্ত পায়ে প্যাডল।
তবু রাব্বির স্বপ্নগুলো মরে যায়নি। পড়াশোনা করে বড় হবে, মায়ের চিকিৎসা, পরিবারের দুমুঠো আহার জোটানো—কত স্বপ্ন ওকে তাড়া করছে প্রতিনিয়ত। যে স্বপ্ন ওর মনে, তা কি জীবনের কঠিন ঘানি টানতে টানতে মরে যাবে?
রিকশা চালাতে দেখে ওর সঙ্গে কথা বলার তাড়না অনুভব করি।
‘কী নাম তোমার?’
‘বেলাল হোসেন। ডাক নাম রাব্বি। আমি শুধু রিকশা চালাই না, পড়াশোনাও করি।’
‘কোন স্কুলে পড়ো?’
‘আমি বরগুনার বাঁশবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র।’
‘এই বয়সে রিকশা চালাচ্ছ কেন?’
এমন প্রশ্ন শুনে সহজ-সরল জবাব ১০ বছরের রাব্বির, ‘কাম না করলে খামু কী, মায়রে চিকিৎসা করামু কেমেন? বেয়ানবেলা স্কুলে যাই, ছুটির পর রিকশা চালাই। এই দিয়া সংসার ও মায়ের চিকিৎসা খরচ চলে।’
রাব্বি থাকে বরগুনা শহরের বাঁশবুনিয়া গ্রামে। দ্বিতীয় বিয়ে করে বাবা নিরুদ্দেশ প্রায় দুই বছর। মা রেহেনা আক্তার বছর খানেক ধরে অ্যাপেন্ডিক্সের জটিল রোগে ভুগছেন। এ অবস্থায় মায়ের চিকিৎসা ও সংসারের ভরণপোষণের খরচ মেটাতে রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছে ছেলেটি। স্কুল ছুটির পর বিকেলে সে রিকশা নিয়ে বেরোয় শহরে। গভীর রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা আয় করে। এ দিয়েই চলে ছোট ভাই রবিউল ও তার মাকে নিয়ে তিনজনের সংসার।
ঈদ সামনে রেখে বরগুনা শহরের বিপণিবিতানগুলোয় রাতে যখন বাড়তি আলোর ঝলক, নারী-শিশুসহ সব বয়সের ক্রেতাদের গভীর রাত অবধি কেনাকাটার ভিড়, নতুন জামা-কাপড়ের গন্ধে যখন ছড়িয়ে পড়েছে ঈদের আমেজ, তখন কি দোকানগুলোর ঝলমলে আলোকচ্ছটা দেখে কোমল চেহারার শিশু রাব্বির মনটা অতৃপ্তির বেদনায় ভরে ওঠে? রিকশার সিটের ওপর বসে এই রঙিন আলোয় ওর বিবর্ণ জীবন কি বৈপরীত্যের তীব্র আঘাতে ভেঙে পড়ে না?
তখন তারও নিশ্চয় ইচ্ছে হয় ঈদের নতুন জামার ঘ্রাণ নিতে, পরিবারের সঙ্গে আনন্দে ঈদ উদ্যাপন করতে। কিন্তু দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে সেসব ইচ্ছে চাপা পড়ে যায় মনের গভীরে। কারণ, ওর মা অসুস্থ, পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ সে একাই। তার ওপর লেখাপড়া করে বড় হওয়ার অদম্য স্বপ্ন তার বুকজুড়ে দুলছে। তাই বিদ্যালয় ছুটির পরই তাকে রিকশা নিয়ে পথে নামতে হয় জীবিকার তাগিদে।
আমরা রাব্বির বাড়িতে গিয়ে ওর মা রেহেনা আক্তারের সঙ্গে কথা বলি। বাঁশবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে খালপাড়ের সরকারি জমিতে তাদের একটি ঝুপড়ি ঘর। ঘরটির একপাশে চা-বিস্কুটের দোকান। রাব্বির বাবা দুই বছর আগে নিরুদ্দেশ হওয়ার পর ওই দোকানটি দিয়ে দুই ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার চলছিল। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে অসুখে পড়লে দোকানের পুঁজির সবটাই চলে যায় চিকিৎসায়। আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনন্যোপায় হয়ে একটি এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছেলেকে একটি রিকশা কিনে দেন। এরপর প্রায় এক বছর ধরে রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ, মায়ের চিকিৎসা ও এনজিওর ২৫০ টাকা সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করছে রাব্বি।
ছেলের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে রেহেনা আক্তারের চোখ ভিজে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘কত কষ্টে পইর্যা এতটুক পোলারে হ্যার মায় রিকশা চালাইতে পাডায়? আমি কি মা না অন্য কিছু! আল্লায় এমন ভাইগ্য দেছে আমাগো যে এই ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। রিকশা চালাইয়্যা রাইতে ঘরে আইয়্যা যহন আয় করা টাকাগুলা আমার হাতে দেয়, হেই সময় পোলাডার মোহের দিকে চাইতে পারি না। চোহের পানি সামলাইয়্যা মনে মনে কই, আল্লায় মোরে লইয়্যা যায় না ক্যান। মোর ইচ্ছা, রাব্বি ল্যাহাপড়া কইর্যা অনেক বড় অইবে। জানি না হেই ইচ্ছা আল্লায় পূরণ করবে কি না।’
বাঁশবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মালা বেগমের কাছে যাই। তিনি বলেন, ‘রাব্বি পড়াশোনার প্রতি খুব মনোযোগী এবং ক্লাসেও ভালো। কিন্তু কয়েক মাস ধরে সে বিদ্যালয়ে একটু অনিয়মিত। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওর মা অসুস্থ। চিকিৎসায় অনেক টাকা লাগবে বলে নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসতে পারে না। এতটুকু শিশু এত কষ্ট করে—এটা শুনে আমাদেরও মন খারাপ হয়।’
আর দশটি শিশুর মতো রাব্বিরও ইচ্ছে করে লেখাপড়া করে পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে। ইচ্ছে করে ঘুরে বেড়াতে, বন্ধুদের সঙ্গে নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদের আনন্দে শামিল হতে। কিন্তু সেসব ইচ্ছে পূরণের সংগতি ওর নেই। তাই শিশু রাব্বির ‘সোনালি শৈশব’ শুধুই স্বপ্ন।
এম জসীম উদ্দীন
রিকশা চালাতে দেখে ওর সঙ্গে কথা বলার তাড়না অনুভব করি।
‘কী নাম তোমার?’
‘বেলাল হোসেন। ডাক নাম রাব্বি। আমি শুধু রিকশা চালাই না, পড়াশোনাও করি।’
‘কোন স্কুলে পড়ো?’
‘আমি বরগুনার বাঁশবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র।’
‘এই বয়সে রিকশা চালাচ্ছ কেন?’
এমন প্রশ্ন শুনে সহজ-সরল জবাব ১০ বছরের রাব্বির, ‘কাম না করলে খামু কী, মায়রে চিকিৎসা করামু কেমেন? বেয়ানবেলা স্কুলে যাই, ছুটির পর রিকশা চালাই। এই দিয়া সংসার ও মায়ের চিকিৎসা খরচ চলে।’
রাব্বি থাকে বরগুনা শহরের বাঁশবুনিয়া গ্রামে। দ্বিতীয় বিয়ে করে বাবা নিরুদ্দেশ প্রায় দুই বছর। মা রেহেনা আক্তার বছর খানেক ধরে অ্যাপেন্ডিক্সের জটিল রোগে ভুগছেন। এ অবস্থায় মায়ের চিকিৎসা ও সংসারের ভরণপোষণের খরচ মেটাতে রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছে ছেলেটি। স্কুল ছুটির পর বিকেলে সে রিকশা নিয়ে বেরোয় শহরে। গভীর রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা আয় করে। এ দিয়েই চলে ছোট ভাই রবিউল ও তার মাকে নিয়ে তিনজনের সংসার।
ঈদ সামনে রেখে বরগুনা শহরের বিপণিবিতানগুলোয় রাতে যখন বাড়তি আলোর ঝলক, নারী-শিশুসহ সব বয়সের ক্রেতাদের গভীর রাত অবধি কেনাকাটার ভিড়, নতুন জামা-কাপড়ের গন্ধে যখন ছড়িয়ে পড়েছে ঈদের আমেজ, তখন কি দোকানগুলোর ঝলমলে আলোকচ্ছটা দেখে কোমল চেহারার শিশু রাব্বির মনটা অতৃপ্তির বেদনায় ভরে ওঠে? রিকশার সিটের ওপর বসে এই রঙিন আলোয় ওর বিবর্ণ জীবন কি বৈপরীত্যের তীব্র আঘাতে ভেঙে পড়ে না?
তখন তারও নিশ্চয় ইচ্ছে হয় ঈদের নতুন জামার ঘ্রাণ নিতে, পরিবারের সঙ্গে আনন্দে ঈদ উদ্যাপন করতে। কিন্তু দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে সেসব ইচ্ছে চাপা পড়ে যায় মনের গভীরে। কারণ, ওর মা অসুস্থ, পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ সে একাই। তার ওপর লেখাপড়া করে বড় হওয়ার অদম্য স্বপ্ন তার বুকজুড়ে দুলছে। তাই বিদ্যালয় ছুটির পরই তাকে রিকশা নিয়ে পথে নামতে হয় জীবিকার তাগিদে।
আমরা রাব্বির বাড়িতে গিয়ে ওর মা রেহেনা আক্তারের সঙ্গে কথা বলি। বাঁশবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে খালপাড়ের সরকারি জমিতে তাদের একটি ঝুপড়ি ঘর। ঘরটির একপাশে চা-বিস্কুটের দোকান। রাব্বির বাবা দুই বছর আগে নিরুদ্দেশ হওয়ার পর ওই দোকানটি দিয়ে দুই ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার চলছিল। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে অসুখে পড়লে দোকানের পুঁজির সবটাই চলে যায় চিকিৎসায়। আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনন্যোপায় হয়ে একটি এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছেলেকে একটি রিকশা কিনে দেন। এরপর প্রায় এক বছর ধরে রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ, মায়ের চিকিৎসা ও এনজিওর ২৫০ টাকা সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করছে রাব্বি।
ছেলের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে রেহেনা আক্তারের চোখ ভিজে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘কত কষ্টে পইর্যা এতটুক পোলারে হ্যার মায় রিকশা চালাইতে পাডায়? আমি কি মা না অন্য কিছু! আল্লায় এমন ভাইগ্য দেছে আমাগো যে এই ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। রিকশা চালাইয়্যা রাইতে ঘরে আইয়্যা যহন আয় করা টাকাগুলা আমার হাতে দেয়, হেই সময় পোলাডার মোহের দিকে চাইতে পারি না। চোহের পানি সামলাইয়্যা মনে মনে কই, আল্লায় মোরে লইয়্যা যায় না ক্যান। মোর ইচ্ছা, রাব্বি ল্যাহাপড়া কইর্যা অনেক বড় অইবে। জানি না হেই ইচ্ছা আল্লায় পূরণ করবে কি না।’
বাঁশবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মালা বেগমের কাছে যাই। তিনি বলেন, ‘রাব্বি পড়াশোনার প্রতি খুব মনোযোগী এবং ক্লাসেও ভালো। কিন্তু কয়েক মাস ধরে সে বিদ্যালয়ে একটু অনিয়মিত। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওর মা অসুস্থ। চিকিৎসায় অনেক টাকা লাগবে বলে নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসতে পারে না। এতটুকু শিশু এত কষ্ট করে—এটা শুনে আমাদেরও মন খারাপ হয়।’
আর দশটি শিশুর মতো রাব্বিরও ইচ্ছে করে লেখাপড়া করে পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে। ইচ্ছে করে ঘুরে বেড়াতে, বন্ধুদের সঙ্গে নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদের আনন্দে শামিল হতে। কিন্তু সেসব ইচ্ছে পূরণের সংগতি ওর নেই। তাই শিশু রাব্বির ‘সোনালি শৈশব’ শুধুই স্বপ্ন।
এম জসীম উদ্দীন
No comments