প্রবীণ পালক ও তারুণ্যের আসমান by পাভেল পার্থ

জনগণের প্রজ্ঞা, শ্রম আর প্রাণসম্পদের এক মজবুত ঐতিহাসিকতার ভেতর বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু চলমান রুগ্ণ ও রক্তাক্ত বাংলাদেশের দিকে তাকালে অতীতের সেই মজবুত ধারাবাহিকতাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসবই চলি্লশ বছরের রাষ্ট্রপক্ষের সুবিধাপ্রাপ্ত কিছু মানুষের অন্যায় ভোগ, দুর্নীতি ও লুটতরাজের ফল।


রাষ্ট্র আজ পণ্য বিশ্বায়নের তথাকথিত মুক্তবাজারে দেশের সম্পদ ও মগজ অনিবার্য কায়দায় ডাকসাইটে সব দোকানে তুলে দিয়ে বসে আছে। রাষ্ট্র আজ জনগণ নয়, নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার করপোরেট ফেরিওয়ালাতে পরিণত হয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু, ভাষা, সংস্কৃতি, বোধ ও ভূগোল কি যাপিতজীবন_ সবকিছু নিয়েই রাষ্ট্র আজ নয়া ঔপনিবেশিকতার 'জয়পতাকা' সমুন্নত রেখেছে

জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পাড়ি দিয়েছে দুর্বিনীত চলি্লশ। এদেশের বাঙালি কি আদিবাসী সব নিম্নবর্গের যাপিতজীবনে টানটান হয়ে আছে নিরন্তর 'দেশ' নামে এক স্বপ্নআখ্যান ও জাদুবাস্তবতা। রাজধানীতে বাস করে যখন কেউ তার গ্রামে যায়, বলে 'দেশে' যাই। চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো বা গাজিনি শালবনের কোনো মান্দি যখন শহরে আসে, বলে 'দেশ' থেকে এলাম। সিলেট অঞ্চলের চা বাগানের শ্রমিকরা ব্রিটিশের জুলুম ও অন্যায়ের প্রতিবাদে শুরু করেছিল 'মুল্লুকযাত্রা'। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের গহিনে উসখুস করে 'দেশ' নামক এক চৈতন্য ও আকাঙ্ক্ষার ময়দান। 'দেশ' মানে জন্মমাটি, দেশ মানে যেখানে কেউ কোনোদিন 'নিরুদ্দেশ' হয় না। 'দেশ' মানে যেখানে বিকশিত হয় দশের সংসার। 'দেশ' মানে যেখানে একের বিষাদের চূর্ণ ভাগ করে নেয় সবাই, একের উচ্ছলতায় গড়ে সবাই অহংকারী বৈভব। 'দেশে' সবাই বাস করে। দেশ কাউকে পরবাসী করে না। 'দেশ' কখনও লুট করা যায় না, ভেঙেচুরে খান খান করা যায় না। 'দেশ' কখনও দখল কি 'বিদেশ' হয়ে যায় না। কিন্তু নিদারুণভাবে গত চলি্লশ বছরে দেশের মানুষের কাছ থেকে 'দেশকে' ছিনতাই ও লুট করেছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখনও জনগণের কাছে 'দেশ' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। 'দেশে' থাকে মানুষ, কিন্তু রাষ্ট্র তার নানা কায়দা ও খবরদারির কানুনে মানুষকে বানাতে চেয়েছে 'নাগরিক'। বন্দুক, বারুদ, বাণিজ্য আর বাহাদুরির জোরে রাষ্ট্র অনিবার্য হতে চেয়েছে। আর তাই রাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে মানুষের; তৈরি হয়েছে ঐতিহাসিক বিচ্ছিন্নতা। রাষ্ট্রের উচিত মানুষের কাছে তার 'দেশকে' ফিরিয়ে দেওয়া।
আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা জন্ম নিয়েছি এক অবিস্মরণীয় আখ্যান ও ভূগোলের কুঙ্কুমে। আমরা রচনা করেছি ক্ষুধাজয়ী অনবদ্য পুঁথি 'প্রজ্ঞাপারমিতা'। মান্দি সমাজের শেরানজিংপালা কি দিগ্গিবান্দি, চাকমাদের উবোগীত কি রাধামণধনপুদি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের রাসপালা, হাওর জনপদের ধামাইল, মৈমনসিংহ গীতিকা কি সুন্দরবনের গাজীর গান দুনিয়ার আর কোথায় সৃষ্টি হয়েছে? মসলিন ও জামদানির মতো মিহি বস্ত্র বুননের কারিগর আমরা। আমাদের বাঙালি কৃষক ও আদিবাসী জুমিয়া নারীরা উদ্ভাবন করেছেন বিশ হাজার ধানের জাত। আমাদের হাজং আদিবাসীরা যখন সুসং রাজার হাতিবাণিজ্যের বিরোধিতা করে 'হাতিখেদা বিদ্রোহ' শুরু করেন তখনও দুনিয়ায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কোনো নাগরিক আওয়াজই শুরু হয়নি। হাওরাঞ্চলে ভাসান পানির আন্দোলনের মাধ্যমে আমরাই দুনিয়ায় প্রথম মুক্ত পানিতে সবার অধিকারের দাবি তুলেছি। উয়ারী-বটেশ্বরে আমরা যেমন নগর-সভ্যতা নির্মাণ করেছি, আদিবাসী জনগণও দেখিয়েছে অরণ্য-সভ্যতার বিস্ময়। নীলগাছ থেকে নীল রঙ প্রস্তুতির অনন্য কৌশল আমরা দুনিয়াকে শিখিয়েছি। 'গাছেরও প্রাণ আছে'_ আমরাই বলেছি প্রথম। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তথাকথিত উন্নয়ন-মারদাঙ্গার সমালোচনা করেছি আমরা। কান্তজিউর মন্দিরের গায়ে মাটির ফলকে পৌরাণিক গাথা নির্মাণের কারিগর আমরা। তেভাগা-টংক-নানকার মতো অন্যায্য খাজনাপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস করেছি আমরা। মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতির জন্য দুনিয়ায় প্রথম জান দিয়েছি আমরা। বয়স কি লিঙ্গ, জাতি কি বর্গ সবাই মিলে লড়েছি আমরা একটি স্বাধীন দেশের জন্য। আমাদের রয়েছে এক রক্তক্ষয়ী অহংকারের অতীত অগি্নটিকা। হয়তো দুনিয়ার খুব কম দেশেই, খুব কম মানুষের ভেতরেই এমন বৈচিত্র্য বৈভবের সাহসী সময়ের ইতিহাস আছে। কিন্তু আমাদের দুঃখ ও ক্ষোভ_ চলি্লশ বছরের এই স্বাধীন রাষ্ট্র জনগণের এই অবিস্মরণীয় কালস্রোতকে শ্রদ্ধা ও বিবেচনা করেনি।
জনগণের প্রজ্ঞা, শ্রম আর প্রাণসম্পদের এক মজবুত ঐতিহাসিকতার ভেতর বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু চলমান রুগ্ণ ও রক্তাক্ত বাংলাদেশের দিকে তাকালে অতীতের সেই মজবুত ধারাবাহিকতাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসবই চলি্লশ বছরের রাষ্ট্রপক্ষের সুবিধাপ্রাপ্ত কিছু মানুষের অন্যায় ভোগ, দুর্নীতি ও লুটতরাজের ফল। রাষ্ট্র আজ পণ্য বিশ্বায়নের তথাকথিত মুক্তবাজারে দেশের সম্পদ ও মগজ অনিবার্য কায়দায় ডাকসাইটে সব দোকানে তুলে দিয়ে বসে আছে। রাষ্ট্র আজ জনগণ নয়, নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার করপোরেট ফেরিওয়ালাতে পরিণত হয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু, ভাষা, সংস্কৃতি, বোধ ও ভূগোল কি যাপিতজীবন_ সবকিছু নিয়েই রাষ্ট্র আজ নয়া ঔপনিবেশিকতার 'জয়পতাকা' সমুন্নত রেখেছে। চলি্লশ বছরের এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমস্যাটাই এখানে_ জনগণের যাপিতজীবন ও ভূগোলের সীমানাকে আঁচ না করে বারবার ধাক্কা মেরে সরিয়ে রাখা। জনগণের প্রবীণ পালকের সাহসিকতাকে গুরুত্ব না দিয়ে রাষ্ট্র পেশি আর দলিলের জোরে তৈরি করে রেখেছে এক 'কাঁটাতার ঘেরা মিথ্যা, নকল আসমানের হাতছানি। এ আসমানে ওড়ার জোরদার সামর্থ্য কি খেদ কোনোটাই অর্জন করা হয়ে ওঠেনি বাংলাদেশের নিম্নবর্গের। যারা নিজের রক্ত ও সংসারের মায়া সবকিছু রক্তাক্ত করে স্বাধীন করেছিল এক ছোট্ট তুলতুলে বাংলাদেশ চলি্লশ বছর আগে। কথা ছিল আঁতুড়ঘর থেকে শুরু করে শৈশব, কৈশোর কি তারুণ্য সবখানেই স্বজনের আঙুল ধরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। স্বপ্ন দেখি, চলি্লশ বছর পর এই অন্যায় আখ্যানের অনিবার্যতাকে প্রশ্ন করে ঘুরে দাঁড়াবে তারুণ্যের বাংলাদেশ। যারা তার অনর্গল শৈশব, কৈশোর ও তরুণবেলা নিয়ে ছলচাতুরী করেছে তাদের দাঁড় করাবে জনগণের ঐতিহাসিক সালিশের ময়দানে।
তার বাদেও দীর্ঘ চলি্লশ বছরে কিছুটা অদলবদল ঘটেছে। তরুণ নেতৃত্ব নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। বিভিন্ন সরকারের দুর্নীতি ও অন্যায় কিছুটা হলেও জনসমক্ষে আসছে। গণমাধ্যমের এক ধরনের 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতা' তৈরি হয়েছে। লেখালেখি, চারুকলা, চলচ্চিত্র, মঞ্চনাটক, আলোকচিত্র ও বিদ্যায়তনিক পরিসরে বেশ ইতিবাচক গতিময়তা তৈরি হয়েছে। কিছুটা হলেও মানুষ ন্যায়বিচারের দাবি তুলতে পারছে। পাটের জিন-মানচিত্র তৈরি থেকে শুরু করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে 'পরিবেশ বিষয়ক' ধারা সংযোজিত হয়েছে। গ্রামীণ লোকায়ত সংস্কৃতি বিষয়ে কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয় বিবেচনা তৈরি হয়েছে। দেশের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ানোর সচলতা তৈরি হয়েছে। কৃষিতে ভর্তুকি ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিলেও তা বারবার চাপা পড়ে যাচ্ছে। দেশের নদ-নদী-জলাধার ও পাহাড় রক্ষায় এক ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা তৈরি হয়েছে। নারী ও আদিবাসী জনগণের ওপর অনিবার্য বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন বাদে বন বিভাগ তার পূর্বতন বৈরী আচরণ ও বিবাদের জন্য ভুল স্বীকার করছে। দেশজ তাঁত ও বস্ত্রশিল্পের বিকাশে নাগরিক প্রণোদনা তৈরি হয়েছে। গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে এক উদ্যমী তরুণ সমাজ। কিন্তু দেশকে দুনিয়ায় আপন মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াতে দরকার এক সাহসী গণজাগরণ ও সামাজিক রূপান্তর। কিন্তু পূর্বজনদের স্মৃতি, প্রজ্ঞা ও নির্দেশনাকে গুরুত্ব না দিলে আবারও আমরা এক মুমূর্ষু রক্তাক্ত বাংলাদেশকেই চোখের সামনে হাঁপাতে দেখব। বুদ্ধিদীপ্ত আজকের তরুণ সমাজ নিশ্চয় রাষ্ট্রের মতো বৈরী আচরণ করে দেশের জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে দিনবদলের কোনো সাফাই তৈরি করবে না।
জনগণই দেশের মানচিত্র ও ভূগোলের কারিগর। চলি্লশ বছরের বাংলাদেশকে এ সত্য বুঝতে, মানতে ও জানতে হবে। দেশের জনগণের উৎপাদন সম্পর্ক, শ্রেণীপরিসর ও সাংস্কৃতিক গতিময়তাকে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। জনগণের সিদ্ধান্ত ও অংশগ্রহণে তৈরি হবে রাষ্ট্রের নথি, দলিল ও কর্মকৌশল। বৈশ্বিক দেনদরবার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোও দেশের মানুষের আধার ও আধেয়কে সামনে রেখেই করতে হবে। বাজার অর্থনীতির শিকলে হাত-পা বেঁধে গ্রামের মানুষকে আলোঝলমল করপোরেট দোকানের সামনে টেনে আনা বন্ধ করতে হবে। মানুষ জাগবে মানুষের মতো, ঠিক যেমন জাগবে জলধারা কি বৃক্ষলতা বা পাখিদের সংসার। মানুষ বাঁচবে মানুষের মতো। হুকুমদার রাষ্ট্র নয়, দিনবদলের নিজের দেশে। নিজের ছায়া ও রোদের জগঝম্পে। অতীত আখ্যানের প্রবীণ পালকগুলো জুড়ে জুড়ে আজকের তারুণ্যই রচনা করবে আগামীর বাংলাদেশের সত্যিকারের সাহসী আসমান। যেখানে উড়বার দায় ও দায়িত্ব বিস্তৃত হবে দেশের সবার মাঝে; সমানভাবে। মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয়তায়।

পাভেল পার্থ :গবেষক
animistbangla@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.