তথ্যপ্রযুক্তি-বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগিতার গুরুত্ব by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
যখন মানুষ বন্য প্রাণীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতেও সক্ষম হয়নি, সেই প্রাগৈতিহাসিক গুহার সভ্যতা থেকে বর্তমান সভ্যতা তৈরিতে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও অন্য নিবেদিত জ্ঞানকর্মীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার পরও মনে হয় না আমাদের সমাজ এখনো এই নিবেদিতপ্রাণ কর্মবীরদের যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত।
এর পরও জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখাকে তারা সমৃদ্ধ করেছে, সম্প্রসারিত করেছে এর দিগন্তকে। এখন আমাদের আগের তুলনায় অনেক বেশি নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর প্রয়োজন জ্ঞানের অগণিত শাখায় এবং তাদের পরিচ্ছেদনে কাজ করার জন্য।
আমাদের দেশে মেধাবী ছাত্ররা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, জীববিজ্ঞান, গণিতসহ বিজ্ঞানের নানা শাখায় তাদের বুৎপত্তি প্রমাণ করেছে। তারপর তারা সেই বিষয়ে তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, যে বিষয় তারা পড়েনি একমাত্র এই কারণে যে ওই বিষয়ে সুযোগ-সুবিধা এতই বেশি যে তার থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভবত সমাজ এখন তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, তাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। তবে আমাদের সমাজের অস্তিত্বের এই ভঙ্গুর অবস্থার জন্য শুধু সমাজপতিদের দোষারোপ করলে চলবে না, সভ্যতায় টিকে থাকার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রকৌশলের গুরুত্ব অনুধাবন করাতে জ্ঞানকর্মীদেরও ব্যর্থতা রয়েছে।
আমরা জানি, সমাজে ক্রীড়া ও বিনোদন অত্যন্ত জনপ্রিয়, এমনকি ভয়ানক মুষ্টিযুদ্ধ, ষাড়ের লড়াই পর্যন্ত, অথচ আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব হলো আমাদের বুদ্ধিতে এবং পাশবশক্তিতে নয়। ক্রীড়ার সুপারস্টার যেমন ফুটবলার ফিগোকে আমাদের সমাজ নানাভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং ৩০ বছর বয়সেই হয়তো ১০ কোটি ইউরোর মালিক করছে, যদিও পাকা চুলওয়ালা একজন আইনস্টাইনকে জীবনের মধ্য বয়স পার হওয়ার পর আর বেশির ভাগ বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ১০ লাখ ডলার দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, এমন সময়ে যখন হয়তো ওই অর্থ ব্যবহার করার মতো মানসিক ও শারীরিক অবস্থাও তার নেই। মূল্যায়নের এই ব্যবধান কি যুক্তিসংগত?
অন্যপক্ষে শিক্ষাবিদ, গবেষকেরাও বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে সমাজের বিকাশে জ্ঞানকর্মীদের কাজের গুরুত্ব কতখানি। আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারব কি, বিজ্ঞানের ছাত্র ও বিজ্ঞানকর্মীদের কাছে বিজ্ঞান কতটা জনপ্রিয়? একজন পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ও শাহরুখ খান উভয়েই যদি একই সময়ে ঢাকা বিমানবন্দরে আসে, তবে আমরা কি নিশ্চিত পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি প্রয়োজনে নোবেল বিজয়ীকে ধাক্কা দিয়ে শাহরুখ খানকে এক নজর দেখবে না? পদার্থবিজ্ঞান ও নোবেল পুরস্কার শব্দযুগলের পরিবর্তে ক্রীড়া বা বিনোদনের অনুরূপ শব্দ ব্যবহার করলে ক্রীড়াবিদ কিংবা বিনোদনকর্মীদের আচরণ কি একই রকম হবে? সুতরাং, বিজ্ঞানের ছাত্র কিংবা বিজ্ঞানকর্মীদের মধ্যে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
তুলনামূলকভাবে কম নিশ্চয়তার সাফল্যকে আমাদের সমাজ উদারভাবে পুরস্কৃত করে থাকে এবং সাধারণ মানুষ অসাধারণ সাফল্যকে বুঝতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে। ক্রীড়ার সাফল্যগুলোকে ইন্টারনেটে রাখা হয়, বিশ্লেষণ করা হয় এবং নানাভাবে শ্রেণীকরণ করে সাধারণ মানুষের অনুসন্ধিৎসা মেটানো হয়। পুরস্কারের মাত্রা এমনই বড় হয় যে মুহূর্তের মধ্যে তারা সাধারণ মানুষের হিরো হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অধিকতর নিশ্চয়তার শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সাফল্যকে আমাদের সমাজ তার ক্ষুদ্রাংশ দিয়েও স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। উইম্বলডনের বিজয়ীকে তার ১৫ দিনের খেলার জন্য যদি দুই লাখ ডলার পুরস্কার দেওয়া হতো, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে দেখার জন্য এত বড় ভিড় হতো না। পক্ষান্তরে কোনো অলিম্পিয়াডের চ্যাম্পিয়নকে অথবা আইসিপিসির চ্যাম্পিয়নকে যদি ১০ লাখ ডলার পুরস্কার দেওয়া হতো, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে দেখার জন্য ছোট-বড় সবার মধ্যে একটি আগ্রহ তৈরি হতো।
তবে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটিকে সস্তা জনপ্রিয়তার দাঁড়িপাল্লায় তুলে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না মানব সভ্যতার বিকাশে এর অবদান কতখানি। এ ছাড়া ক্রীড়াসংক্রান্ত অসংখ্য চিত্তাকর্ষক পরিসংখ্যান বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীদের তৈরি ইন্টারনেটে রেখে তরুণ প্রবীণ সবার মধ্যে এমন জনপ্রিয় হচ্ছে, বিজ্ঞানের যেকোনো ভালো ছাত্র তার বিষয়ের তথ্য না রাখলেও এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রশংসনীয় পরিমাণে মুখস্থ রাখছে, এবং যেকোনো জনপ্রিয় কুইজ শোতে তার প্রমাণ রাখছে। অবশ্য বিজ্ঞানের স্কুল-কলেজে ও কুইজ শোতে বিজ্ঞানসংক্রান্ত প্রশ্ন করা হয় যৎসামান্যই। তাই ছাত্ররা কেনই বা এসব তথ্য মুখস্থ রাখবে?
বাংলাদেশে প্রায় ৪০ বছর ধরে প্রতি বিষয়ে ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে কত বিষয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে লাখ লাখ ছাত্রের অংশগ্রহণে পাবলিক পরীক্ষা হয়ে গেল। কত ধরনের পরিসংখ্যানই না সম্ভব ছিল তৈরি করে জ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগিতায় শুধু ছাত্র কেন, সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে। হয়েছে কি? আমরা কি জানি, কোন ছাত্রটি মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় লাখ লাখ ছাত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে? উভয় পরীক্ষায় মিলে সর্বোচ্চ নম্বরটি কার? প্রতিটি বিষয়ে কে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে অথবা শুধু বিজ্ঞানের বিষয়ে কিংবা মানবিক বিষয়গুলোতে অথবা ভাষা শিক্ষায়? এই অর্জনগুলো কিন্তু হেলাফেলা করার নয়। ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যান এক ইনিংসে সেঞ্চুরি কিংবা ডাবল সেঞ্চুরি করার পরের ইনিংসেই শূন্য পেতে পারে কিন্তু আমাদের এই মেধাবী ছাত্রদের পারফরম্যান্সের একটি ধারাবাহিকতা আছে, যা বিশ্বাস করা যায় অনেক বেশি। এমন ছাত্রের সংখ্যা কম নেই, যারা প্রতিটি পরীক্ষায়ই প্রথম হয়েছে, যদিও কত ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষক তাদের খাতা দেখেছেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা এবং জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় মিলে কে বেশি পেয়েছে, তারও একটি মেধাতালিকা করা হয় এবং তাতে সমাজের যথেষ্ট উৎসাহ রয়েছে। অথচ আমাদের দেশে গ্রেডিং সিস্টেমের দুষ্টুচক্রে পরে শিক্ষার উৎকর্ষ প্রায় তিরোহিত। আগে বোর্ডের মেধাস্থান দখলকারীদের গর্বিত পিতা-মাতা, শিক্ষকসহ টেলিভিশনে মাত্র দেড় সেকেন্ডের জন্য দেখালেও তাতে সবাই উদ্বুদ্ধ হতো, এখন আর সে সুযোগ নেই। একই কথা প্রযোজ্য সারা দেশের সব স্কুল-কলেজের জন্য। পড়ালেখা আর কখনো সমাজে হিরো তৈরি করতে পারবে না। সুতরাং, পড়ালেখায় আর উৎকর্ষ অর্জনের সম্ভাবনা নেই।
একসময় ভাবাই যেত না, দাবার মতো এমন একটি চিন্তাসর্বস্ব খেলা যেখানে দেহের অবস্থান পরিবর্তন হয় সর্বনিম্ন, তাও টেলিভিশনের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছে। অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার জন্য গণমাধ্যম একটু এগিয়ে এলেই হবে। যে দেশ পৃথিবীর ভূখণ্ডের এক-সহস্রাংশ ভূমিতে ২৪ সহস্রাংশ মানুষের আহার জোগাচ্ছে, বাসস্থান, চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে, তা-ও আবার উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবেই, সে দেশে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে প্রতিটি ক্ষেত্রে কী মাত্রার উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করা দরকার, তা বলাই বাহুল্য।
একটি পরিসংখ্যান মতে, প্রাথমিক শিক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরে মাথাপিছু বিনিয়োগ করে পাঁচ হাজার ৪০০ ডলার, ভারত ও নেপাল করে ১৩ ডলার, আমরা করি তারও কম। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভৌত অবকাঠামো উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনীয় নয়, না তুলনীয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার পরিমাণ। একমাত্র যে বিষয়ে আমরা সমকক্ষ হতে পারি, তা হলো আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রাণশক্তি। তবে এই প্রাণশক্তিকে কীভাবে উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতির প্রভাবে দেশ গড়ার কাজে ব্যবহার করতে পারি, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আমাদের তরুণ-তরুণীদের শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত হতে হবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানে বলিয়ান হতে হবে। যেকোনো বিষয়ে উৎকর্ষ অর্জনের সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী পদ্ধতি হচ্ছে সুস্থ প্রতিযোগিতা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তথা শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনের জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা হয়তো আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হবে না। শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে সুস্থ প্রতিযোগিতা সূচনা করে, গণমাধ্যমে তার বহুল প্রচার নিশ্চিত করে আমরা তরুণদের অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দক্ষতায় উৎকর্ষ সাধনে উৎসাহিত করতে পারি। ইদানীং বাংলাদেশে গণিত, ইনফরমেটিক্স, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নসহ নানা বিষয়ে অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সাফল্য নির্ভর করছে এই প্রতিযোগিতাগুলোকে আমরা সমাজে কত দ্রুত জনপ্রিয় করতে পারছি তার ওপর।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি।
আমাদের দেশে মেধাবী ছাত্ররা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, জীববিজ্ঞান, গণিতসহ বিজ্ঞানের নানা শাখায় তাদের বুৎপত্তি প্রমাণ করেছে। তারপর তারা সেই বিষয়ে তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, যে বিষয় তারা পড়েনি একমাত্র এই কারণে যে ওই বিষয়ে সুযোগ-সুবিধা এতই বেশি যে তার থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভবত সমাজ এখন তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, তাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। তবে আমাদের সমাজের অস্তিত্বের এই ভঙ্গুর অবস্থার জন্য শুধু সমাজপতিদের দোষারোপ করলে চলবে না, সভ্যতায় টিকে থাকার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রকৌশলের গুরুত্ব অনুধাবন করাতে জ্ঞানকর্মীদেরও ব্যর্থতা রয়েছে।
আমরা জানি, সমাজে ক্রীড়া ও বিনোদন অত্যন্ত জনপ্রিয়, এমনকি ভয়ানক মুষ্টিযুদ্ধ, ষাড়ের লড়াই পর্যন্ত, অথচ আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব হলো আমাদের বুদ্ধিতে এবং পাশবশক্তিতে নয়। ক্রীড়ার সুপারস্টার যেমন ফুটবলার ফিগোকে আমাদের সমাজ নানাভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং ৩০ বছর বয়সেই হয়তো ১০ কোটি ইউরোর মালিক করছে, যদিও পাকা চুলওয়ালা একজন আইনস্টাইনকে জীবনের মধ্য বয়স পার হওয়ার পর আর বেশির ভাগ বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ১০ লাখ ডলার দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, এমন সময়ে যখন হয়তো ওই অর্থ ব্যবহার করার মতো মানসিক ও শারীরিক অবস্থাও তার নেই। মূল্যায়নের এই ব্যবধান কি যুক্তিসংগত?
অন্যপক্ষে শিক্ষাবিদ, গবেষকেরাও বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে সমাজের বিকাশে জ্ঞানকর্মীদের কাজের গুরুত্ব কতখানি। আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারব কি, বিজ্ঞানের ছাত্র ও বিজ্ঞানকর্মীদের কাছে বিজ্ঞান কতটা জনপ্রিয়? একজন পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ও শাহরুখ খান উভয়েই যদি একই সময়ে ঢাকা বিমানবন্দরে আসে, তবে আমরা কি নিশ্চিত পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি প্রয়োজনে নোবেল বিজয়ীকে ধাক্কা দিয়ে শাহরুখ খানকে এক নজর দেখবে না? পদার্থবিজ্ঞান ও নোবেল পুরস্কার শব্দযুগলের পরিবর্তে ক্রীড়া বা বিনোদনের অনুরূপ শব্দ ব্যবহার করলে ক্রীড়াবিদ কিংবা বিনোদনকর্মীদের আচরণ কি একই রকম হবে? সুতরাং, বিজ্ঞানের ছাত্র কিংবা বিজ্ঞানকর্মীদের মধ্যে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
তুলনামূলকভাবে কম নিশ্চয়তার সাফল্যকে আমাদের সমাজ উদারভাবে পুরস্কৃত করে থাকে এবং সাধারণ মানুষ অসাধারণ সাফল্যকে বুঝতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে। ক্রীড়ার সাফল্যগুলোকে ইন্টারনেটে রাখা হয়, বিশ্লেষণ করা হয় এবং নানাভাবে শ্রেণীকরণ করে সাধারণ মানুষের অনুসন্ধিৎসা মেটানো হয়। পুরস্কারের মাত্রা এমনই বড় হয় যে মুহূর্তের মধ্যে তারা সাধারণ মানুষের হিরো হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অধিকতর নিশ্চয়তার শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সাফল্যকে আমাদের সমাজ তার ক্ষুদ্রাংশ দিয়েও স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। উইম্বলডনের বিজয়ীকে তার ১৫ দিনের খেলার জন্য যদি দুই লাখ ডলার পুরস্কার দেওয়া হতো, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে দেখার জন্য এত বড় ভিড় হতো না। পক্ষান্তরে কোনো অলিম্পিয়াডের চ্যাম্পিয়নকে অথবা আইসিপিসির চ্যাম্পিয়নকে যদি ১০ লাখ ডলার পুরস্কার দেওয়া হতো, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে দেখার জন্য ছোট-বড় সবার মধ্যে একটি আগ্রহ তৈরি হতো।
তবে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটিকে সস্তা জনপ্রিয়তার দাঁড়িপাল্লায় তুলে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না মানব সভ্যতার বিকাশে এর অবদান কতখানি। এ ছাড়া ক্রীড়াসংক্রান্ত অসংখ্য চিত্তাকর্ষক পরিসংখ্যান বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীদের তৈরি ইন্টারনেটে রেখে তরুণ প্রবীণ সবার মধ্যে এমন জনপ্রিয় হচ্ছে, বিজ্ঞানের যেকোনো ভালো ছাত্র তার বিষয়ের তথ্য না রাখলেও এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রশংসনীয় পরিমাণে মুখস্থ রাখছে, এবং যেকোনো জনপ্রিয় কুইজ শোতে তার প্রমাণ রাখছে। অবশ্য বিজ্ঞানের স্কুল-কলেজে ও কুইজ শোতে বিজ্ঞানসংক্রান্ত প্রশ্ন করা হয় যৎসামান্যই। তাই ছাত্ররা কেনই বা এসব তথ্য মুখস্থ রাখবে?
বাংলাদেশে প্রায় ৪০ বছর ধরে প্রতি বিষয়ে ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে কত বিষয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে লাখ লাখ ছাত্রের অংশগ্রহণে পাবলিক পরীক্ষা হয়ে গেল। কত ধরনের পরিসংখ্যানই না সম্ভব ছিল তৈরি করে জ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগিতায় শুধু ছাত্র কেন, সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে। হয়েছে কি? আমরা কি জানি, কোন ছাত্রটি মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় লাখ লাখ ছাত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে? উভয় পরীক্ষায় মিলে সর্বোচ্চ নম্বরটি কার? প্রতিটি বিষয়ে কে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে অথবা শুধু বিজ্ঞানের বিষয়ে কিংবা মানবিক বিষয়গুলোতে অথবা ভাষা শিক্ষায়? এই অর্জনগুলো কিন্তু হেলাফেলা করার নয়। ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যান এক ইনিংসে সেঞ্চুরি কিংবা ডাবল সেঞ্চুরি করার পরের ইনিংসেই শূন্য পেতে পারে কিন্তু আমাদের এই মেধাবী ছাত্রদের পারফরম্যান্সের একটি ধারাবাহিকতা আছে, যা বিশ্বাস করা যায় অনেক বেশি। এমন ছাত্রের সংখ্যা কম নেই, যারা প্রতিটি পরীক্ষায়ই প্রথম হয়েছে, যদিও কত ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষক তাদের খাতা দেখেছেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা এবং জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় মিলে কে বেশি পেয়েছে, তারও একটি মেধাতালিকা করা হয় এবং তাতে সমাজের যথেষ্ট উৎসাহ রয়েছে। অথচ আমাদের দেশে গ্রেডিং সিস্টেমের দুষ্টুচক্রে পরে শিক্ষার উৎকর্ষ প্রায় তিরোহিত। আগে বোর্ডের মেধাস্থান দখলকারীদের গর্বিত পিতা-মাতা, শিক্ষকসহ টেলিভিশনে মাত্র দেড় সেকেন্ডের জন্য দেখালেও তাতে সবাই উদ্বুদ্ধ হতো, এখন আর সে সুযোগ নেই। একই কথা প্রযোজ্য সারা দেশের সব স্কুল-কলেজের জন্য। পড়ালেখা আর কখনো সমাজে হিরো তৈরি করতে পারবে না। সুতরাং, পড়ালেখায় আর উৎকর্ষ অর্জনের সম্ভাবনা নেই।
একসময় ভাবাই যেত না, দাবার মতো এমন একটি চিন্তাসর্বস্ব খেলা যেখানে দেহের অবস্থান পরিবর্তন হয় সর্বনিম্ন, তাও টেলিভিশনের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছে। অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার জন্য গণমাধ্যম একটু এগিয়ে এলেই হবে। যে দেশ পৃথিবীর ভূখণ্ডের এক-সহস্রাংশ ভূমিতে ২৪ সহস্রাংশ মানুষের আহার জোগাচ্ছে, বাসস্থান, চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে, তা-ও আবার উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবেই, সে দেশে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে প্রতিটি ক্ষেত্রে কী মাত্রার উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করা দরকার, তা বলাই বাহুল্য।
একটি পরিসংখ্যান মতে, প্রাথমিক শিক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরে মাথাপিছু বিনিয়োগ করে পাঁচ হাজার ৪০০ ডলার, ভারত ও নেপাল করে ১৩ ডলার, আমরা করি তারও কম। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভৌত অবকাঠামো উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনীয় নয়, না তুলনীয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার পরিমাণ। একমাত্র যে বিষয়ে আমরা সমকক্ষ হতে পারি, তা হলো আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রাণশক্তি। তবে এই প্রাণশক্তিকে কীভাবে উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতির প্রভাবে দেশ গড়ার কাজে ব্যবহার করতে পারি, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আমাদের তরুণ-তরুণীদের শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত হতে হবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানে বলিয়ান হতে হবে। যেকোনো বিষয়ে উৎকর্ষ অর্জনের সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী পদ্ধতি হচ্ছে সুস্থ প্রতিযোগিতা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তথা শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনের জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা হয়তো আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হবে না। শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে সুস্থ প্রতিযোগিতা সূচনা করে, গণমাধ্যমে তার বহুল প্রচার নিশ্চিত করে আমরা তরুণদের অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দক্ষতায় উৎকর্ষ সাধনে উৎসাহিত করতে পারি। ইদানীং বাংলাদেশে গণিত, ইনফরমেটিক্স, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নসহ নানা বিষয়ে অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সাফল্য নির্ভর করছে এই প্রতিযোগিতাগুলোকে আমরা সমাজে কত দ্রুত জনপ্রিয় করতে পারছি তার ওপর।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি।
No comments