ইতিহাসের সাক্ষী একটি বাড়ি নিয়ে কিছু কথা by এস এম আব্রাহাম লিংকন
গত সাফ গেমস উদ্বোধনকালে ডিসপ্লেতে দেখানো হয়েছিল তেভাগা আন্দোলনের একটি দৃশ্য। একই সঙ্গে ইলা মিত্রের ওপর একটি দৃশ্যও উপস্থাপিত হয়। তাঁর সংগ্রাম কৃষকের স্বার্থে হলেও বিষয়বস্তু ভিন্ন। আমাদের দেশে ব্রিটিশ শাসনের শেষ থেকে পাকিস্তানের গোড়ার দিক পর্যন্ত যে আন্দোলন গোটা পাকিস্তানের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছিল, তা হচ্ছে
তেভাগা। এ আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশের শেষদিকে। এর বিস্তৃতি ছিল অবিভক্ত বাংলার ১৯টি জেলায়। রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহীর কিছু অংশ এবং ভারতের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় ছিল এর ব্যাপকতা। তবে এ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল রংপুর থেকে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন মাঠে নামার সুযোগ ছিল না পূর্ব পাকিস্তানিদের, তখন তেভাগা আন্দোলনের ভাগচাষিরা পাকিস্তানের বলয়-বৃত্ত ভেঙে রাজপথে নামার সুযোগ করে দিয়েছিল। ওই আন্দোলন পাকিস্তানের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমাদের দেশে এখনো তেভাগা চালু আছে। একদিন এই তেভাগা চালু করতে গিয়েই প্রাণ দিয়েছিলেন প্রতিবাদী কিছু মানুষ। ভাগচাষিদের তেভাগার দাবি জোতদার-জমিদারদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠলেও এর প্রবল ঢেউ পাকিস্তান সরকারকে প্রায় শ্বাসরোধ করে ফেলেছিল। কৃষক এবং কৃষির এ আন্দোলন পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রবাহিত হয়েছিল। এ রকম একটি আন্দোলন দেশের সামগ্রিক সফলতার স্মারক হিসেবে পরিচিত; কিন্তু তেভাগার সে আন্দোলনের কোনো স্মৃতি আমাদের বা প্রজন্মের সামনে নেই।
তেভাগার সংগ্রামকে বাদ দিয়ে রংপুর, দিনাজপুরের ইতিহাস রচনার চেষ্টা হবে ইতিহাস-বিকৃতির শামিল। একেক অঞ্চলের একেক ধরনের গৌরব আছে এবং তা সে অঞ্চলের ইতিহাসের মূল আকর। ইতিহাস শুধু বিশেষ ব্যক্তিকে স্মরণ করার জন্য নয়, বরং দেশ ও প্রজন্মের প্রয়োজনে ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে কিছু অত্যুজ্জ্বল ব্যক্তি এসে যান, তাঁরা সেই ঘটনার নির্মাতারূপে ইতিহাসে অবস্থান করেন। সে ইতিহাস স্মরণ কিন্তু ইতিহাস-স্রষ্টা ব্যক্তিকে পূজা বা ব্যক্তিচর্চা নয়। ইতিহাসচর্চা করতে গেলে এমনিতেই বারবার উচ্চারিত হবে সেই ইতিবাচক পুরুষদের নাম, যাঁদের হাত ধরে ইতিহাস নির্মিত হয়েছে। ইতিহাসের নক্ষত্রদের বাদ দিলে এর আকাশ অন্ধকারে ঢেকে যাবে। আজ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘর এমনকি বঙ্গবন্ধু জাদুঘর বিশেষ অবদান রাখছে। হয়তো ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি জেলায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টা হবে। সরকারের শেরেবাংলার নামে কৃষি জাদুঘর করার সদ্য গৃহীত সিদ্ধান্তটি যুক্তিযুক্ত এবং কালের দাবি মেটানোর যথাযথ উদ্যোগ। এ ধরনের মিউজিয়ামে আমাদের জনপদের কৃষি এবং কৃষকের আন্দোলন, সংগ্রাম, বঞ্চনা, প্রাপ্তি_সবই স্থান পাবে। এ উদ্যোগটি কার্যকর রূপ পেলে দেশ তার ঐতিহ্য ধারণে সক্ষম হবে।
শেরেবাংলা কৃষি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা হওয়ার বেশ আগে থেকেই দেশের উত্তর জনপদ এবং জাতীয়ভাবে রংপুরের কিংবদন্তি রাজনীতিক বিপ্লবী মণিকৃষ্ণ সেনের বসতবাড়ি 'শিবকৃষ্ণ ভবন'কে তেভাগার জাদুঘরে রূপান্তরের দাবি জাতীয় পত্রিকাগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে বিবৃতিদাতারা হলেন রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, টিপু মুন্সী, আসাদুজ্জামান নূরসহ শাসক জোটের সাত সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্যরা ওই বাড়িটি রক্ষার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন বলে বিষয়টি গুরুত্ব ও মর্যাদা পেয়েছে, তা কিন্তু নয়। তবে পদমর্যাদার কারণে সাত সংসদ সদস্যের একত্রে বিবৃতির মূল্য অনেক। সরকার মণিকৃষ্ণ সেনের বাড়িটি রক্ষায় কার্যকর অবদান রাখবে। তাঁদের উদ্যোগ ধ্বংসের হাত থেকে পূর্বপুরুষের গড়ে তোলা এক স্বর্ণমন্দির রক্ষায় সহায়ক হোক। সংসদ সদস্যরা যে বাড়িটি রক্ষা করে সেখানে তেভাগার জাদুঘর তৈরির কথা বলেছেন, সেটি মণিকৃষ্ণ সেনের জনগণের জন্য উৎসর্গীকৃত বাড়ি, যিনি সারা দেশের ব্রিটিশ-পাকিস্তান যুগে আন্দোলনের অগ্রণী পুরুষ এবং উত্তর জনপদের কিংবদন্তিরূপে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পশ্চিম বাংলার খ্যাতিমান শিল্পী সোমনাথ হোড়ের তেভাগার ডায়েরি খুললেই তেভাগা আন্দোলনে আহত মণিকৃষ্ণ সেনের একটি রক্তাক্ত ছবি পাওয়া যায়। যে ছবিটি তেভাগা আন্দোলনে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার অনুগত লাঠিয়ালদের আঘাতে আহত হওয়ার পর শিল্পী এঁকেছিলেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিক রণেশ দাশগুপ্ত বলেছিলেন, তিনি সমগ্র উত্তর বাংলায় তেভাগা আন্দোলনের সামনের সারির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। এই সময়কালে তৎকালীন যুক্তবাংলার কৃষক, শ্রমিক ও অন্য শ্রমজীবীদের উত্থানের সময় মণিকৃষ্ণ সেন ছিলেন উত্তর বাংলার অন্যতম প্রধান জননায়ক। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এক নিবন্ধে বলেছেন, 'আমাদের দেশ ও জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে যাঁরা সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব মণিকৃষ্ণ সেন। তেভাগা আন্দোলনে তিনি নিজ পরিবারের স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। শেষ বয়সে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির একাংশ পার্টির নামে এবং বাকি সম্পত্তি জনগণের কল্যাণে ট্রাস্ট করে দিয়েছেন।' বঙ্গবন্ধু বারবার কারাবাসে যেসব বিপ্লবী মনীষীর সানি্নধ্যে নিজেকে ইস্পাতদৃঢ় করতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মণিকৃষ্ণ সেন। সিকি শতাব্দীর কারাবাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বহুদিন পাশাপাশি থেকেছেন। তাঁরা উভয়েই জন্মসূত্রে ফরিদপুরের মানুষ ছিলেন। আমরা কিছুদিন ধরে দেশে জাতীয় বরেণ্য রাজনীতিকদের বিবৃতি দেখছি মণিকৃষ্ণ সেনের বাস্তুভিটা রক্ষার জন্য, একই সঙ্গে দাবি লক্ষ করছি তাঁর বাড়িটিকে তেভাগার মিউজিয়ামে রূপান্তরের। মণিকৃষ্ণ সেনের বাড়িটি শুধু তেভাগার স্মৃতিধন্য তা নয়, সেটি জাতীয় রাজনীতির বহু বরেণ্য পুরুষের পদধূলিতে ধন্য। বাড়িটি এ অঞ্চলের সংগ্রামীদের তীর্থস্থান। ফলে ওই বাড়িটি যদি একটি মিউজিয়াম হয়, তবে তা হবে উত্তর জনপদের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
বিপ্লবী মণিকৃষ্ণ সেন তাঁর রংপুর শহরের বাড়িটিসহ কয়েক কোটি টাকার ভূসম্পত্তি আটের দশকে সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রমোদা সুন্দরী কল্যাণ ট্রাস্টের অনুকূলে হস্তান্তর করেন। কিন্তু এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নামে-বেনামে বাড়িটি অগ্রণী ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ রাখেন। ঋণসংক্রান্ত জটিলতার সুযোগে বাড়িটি নিলামের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী গ্রাস করার চেষ্টা করছে। অগ্রণী ব্যাংক পাওনা আদায়ের নামে বেআইনি বন্ধকের মাধ্যমে বাড়িটি সেই বিশেষ গোষ্ঠীকে দেওয়ার চেষ্টা করছে_এ অভিযোগও খুব পুষ্ট। বাড়ি দখলের চেষ্টা স্থানীয় রাজনীতিবিদরা এবং রংপুর শহরের মানুষ প্রতিরোধ করেন। ঋণ-জটিলতার মামলা সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চ অগ্রণী ব্যাংকের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন অগ্রাহ্য করে চেম্বার জজের আদেশ বহাল রেখেছেন।
উত্তর জনপদের মানুষের কাছে মণিকৃষ্ণ সেনের বাড়িটি তীর্থস্থান। বাড়িটি রক্ষা করা শুধু স্থানীয় জনগণের জন্য নয়, রাষ্ট্রের আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য ধারণের জন্যও জরুরি। দেশের মানুষ মনে করে, রাষ্ট্র বাড়িটি উদ্ধার করতে দেনা মওকুফ করে দিতে পারে বা অগ্রণী ব্যাংক নিজেই দেশের ইতিহাস সংরক্ষণের মহান উদ্যোগের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের দাবি পরিত্যাগ করে তেভাগার মিউজিয়ামসহ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় নানাবিধ গবেষণার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। মণিকৃষ্ণ সেনরা ছিলেন প্রচারবিমুখ। মণিকৃষ্ণ সেন বলেছেন, 'আমাদের যুগ আত্মপ্রচারের যুগ ছিল না। ছিল আত্মবিলোপের যুগ। আমরা নিজের নাম গোপন রাখতাম, বাপের নাম বলতাম না। ছবি তুলতাম না। বিপ্লবীদের জন্য তখনকার দিনে এটাই নিয়ম, এটাই ছিল প্রয়োজন।' আমরা আশা করব, অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং সরকার যদি বিপ্লবী মণিকৃষ্ণ সেনসহ অন্যান্য বিপ্লবীর স্মৃতি সংরক্ষণে এবং তেভাগার জাদুঘর নির্মাণে এগিয়ে এসে আত্মবিলোপবাদী মহানাগরিক মণিকৃষ্ণ সেনের বাড়িটি রক্ষা করে, তবে তা হবে রাষ্ট্রের জন্য অনেক বড় সম্মানের কাজ।
লেখক : রাকসুর সাবেক নেতা ও আইনজীবী
lincoln_bd@yahoo.com
তেভাগার সংগ্রামকে বাদ দিয়ে রংপুর, দিনাজপুরের ইতিহাস রচনার চেষ্টা হবে ইতিহাস-বিকৃতির শামিল। একেক অঞ্চলের একেক ধরনের গৌরব আছে এবং তা সে অঞ্চলের ইতিহাসের মূল আকর। ইতিহাস শুধু বিশেষ ব্যক্তিকে স্মরণ করার জন্য নয়, বরং দেশ ও প্রজন্মের প্রয়োজনে ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে কিছু অত্যুজ্জ্বল ব্যক্তি এসে যান, তাঁরা সেই ঘটনার নির্মাতারূপে ইতিহাসে অবস্থান করেন। সে ইতিহাস স্মরণ কিন্তু ইতিহাস-স্রষ্টা ব্যক্তিকে পূজা বা ব্যক্তিচর্চা নয়। ইতিহাসচর্চা করতে গেলে এমনিতেই বারবার উচ্চারিত হবে সেই ইতিবাচক পুরুষদের নাম, যাঁদের হাত ধরে ইতিহাস নির্মিত হয়েছে। ইতিহাসের নক্ষত্রদের বাদ দিলে এর আকাশ অন্ধকারে ঢেকে যাবে। আজ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘর এমনকি বঙ্গবন্ধু জাদুঘর বিশেষ অবদান রাখছে। হয়তো ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি জেলায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টা হবে। সরকারের শেরেবাংলার নামে কৃষি জাদুঘর করার সদ্য গৃহীত সিদ্ধান্তটি যুক্তিযুক্ত এবং কালের দাবি মেটানোর যথাযথ উদ্যোগ। এ ধরনের মিউজিয়ামে আমাদের জনপদের কৃষি এবং কৃষকের আন্দোলন, সংগ্রাম, বঞ্চনা, প্রাপ্তি_সবই স্থান পাবে। এ উদ্যোগটি কার্যকর রূপ পেলে দেশ তার ঐতিহ্য ধারণে সক্ষম হবে।
শেরেবাংলা কৃষি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা হওয়ার বেশ আগে থেকেই দেশের উত্তর জনপদ এবং জাতীয়ভাবে রংপুরের কিংবদন্তি রাজনীতিক বিপ্লবী মণিকৃষ্ণ সেনের বসতবাড়ি 'শিবকৃষ্ণ ভবন'কে তেভাগার জাদুঘরে রূপান্তরের দাবি জাতীয় পত্রিকাগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে বিবৃতিদাতারা হলেন রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, টিপু মুন্সী, আসাদুজ্জামান নূরসহ শাসক জোটের সাত সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্যরা ওই বাড়িটি রক্ষার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন বলে বিষয়টি গুরুত্ব ও মর্যাদা পেয়েছে, তা কিন্তু নয়। তবে পদমর্যাদার কারণে সাত সংসদ সদস্যের একত্রে বিবৃতির মূল্য অনেক। সরকার মণিকৃষ্ণ সেনের বাড়িটি রক্ষায় কার্যকর অবদান রাখবে। তাঁদের উদ্যোগ ধ্বংসের হাত থেকে পূর্বপুরুষের গড়ে তোলা এক স্বর্ণমন্দির রক্ষায় সহায়ক হোক। সংসদ সদস্যরা যে বাড়িটি রক্ষা করে সেখানে তেভাগার জাদুঘর তৈরির কথা বলেছেন, সেটি মণিকৃষ্ণ সেনের জনগণের জন্য উৎসর্গীকৃত বাড়ি, যিনি সারা দেশের ব্রিটিশ-পাকিস্তান যুগে আন্দোলনের অগ্রণী পুরুষ এবং উত্তর জনপদের কিংবদন্তিরূপে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পশ্চিম বাংলার খ্যাতিমান শিল্পী সোমনাথ হোড়ের তেভাগার ডায়েরি খুললেই তেভাগা আন্দোলনে আহত মণিকৃষ্ণ সেনের একটি রক্তাক্ত ছবি পাওয়া যায়। যে ছবিটি তেভাগা আন্দোলনে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার অনুগত লাঠিয়ালদের আঘাতে আহত হওয়ার পর শিল্পী এঁকেছিলেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিক রণেশ দাশগুপ্ত বলেছিলেন, তিনি সমগ্র উত্তর বাংলায় তেভাগা আন্দোলনের সামনের সারির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। এই সময়কালে তৎকালীন যুক্তবাংলার কৃষক, শ্রমিক ও অন্য শ্রমজীবীদের উত্থানের সময় মণিকৃষ্ণ সেন ছিলেন উত্তর বাংলার অন্যতম প্রধান জননায়ক। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এক নিবন্ধে বলেছেন, 'আমাদের দেশ ও জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে যাঁরা সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব মণিকৃষ্ণ সেন। তেভাগা আন্দোলনে তিনি নিজ পরিবারের স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। শেষ বয়সে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির একাংশ পার্টির নামে এবং বাকি সম্পত্তি জনগণের কল্যাণে ট্রাস্ট করে দিয়েছেন।' বঙ্গবন্ধু বারবার কারাবাসে যেসব বিপ্লবী মনীষীর সানি্নধ্যে নিজেকে ইস্পাতদৃঢ় করতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মণিকৃষ্ণ সেন। সিকি শতাব্দীর কারাবাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বহুদিন পাশাপাশি থেকেছেন। তাঁরা উভয়েই জন্মসূত্রে ফরিদপুরের মানুষ ছিলেন। আমরা কিছুদিন ধরে দেশে জাতীয় বরেণ্য রাজনীতিকদের বিবৃতি দেখছি মণিকৃষ্ণ সেনের বাস্তুভিটা রক্ষার জন্য, একই সঙ্গে দাবি লক্ষ করছি তাঁর বাড়িটিকে তেভাগার মিউজিয়ামে রূপান্তরের। মণিকৃষ্ণ সেনের বাড়িটি শুধু তেভাগার স্মৃতিধন্য তা নয়, সেটি জাতীয় রাজনীতির বহু বরেণ্য পুরুষের পদধূলিতে ধন্য। বাড়িটি এ অঞ্চলের সংগ্রামীদের তীর্থস্থান। ফলে ওই বাড়িটি যদি একটি মিউজিয়াম হয়, তবে তা হবে উত্তর জনপদের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
বিপ্লবী মণিকৃষ্ণ সেন তাঁর রংপুর শহরের বাড়িটিসহ কয়েক কোটি টাকার ভূসম্পত্তি আটের দশকে সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রমোদা সুন্দরী কল্যাণ ট্রাস্টের অনুকূলে হস্তান্তর করেন। কিন্তু এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নামে-বেনামে বাড়িটি অগ্রণী ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ রাখেন। ঋণসংক্রান্ত জটিলতার সুযোগে বাড়িটি নিলামের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী গ্রাস করার চেষ্টা করছে। অগ্রণী ব্যাংক পাওনা আদায়ের নামে বেআইনি বন্ধকের মাধ্যমে বাড়িটি সেই বিশেষ গোষ্ঠীকে দেওয়ার চেষ্টা করছে_এ অভিযোগও খুব পুষ্ট। বাড়ি দখলের চেষ্টা স্থানীয় রাজনীতিবিদরা এবং রংপুর শহরের মানুষ প্রতিরোধ করেন। ঋণ-জটিলতার মামলা সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চ অগ্রণী ব্যাংকের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন অগ্রাহ্য করে চেম্বার জজের আদেশ বহাল রেখেছেন।
উত্তর জনপদের মানুষের কাছে মণিকৃষ্ণ সেনের বাড়িটি তীর্থস্থান। বাড়িটি রক্ষা করা শুধু স্থানীয় জনগণের জন্য নয়, রাষ্ট্রের আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য ধারণের জন্যও জরুরি। দেশের মানুষ মনে করে, রাষ্ট্র বাড়িটি উদ্ধার করতে দেনা মওকুফ করে দিতে পারে বা অগ্রণী ব্যাংক নিজেই দেশের ইতিহাস সংরক্ষণের মহান উদ্যোগের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের দাবি পরিত্যাগ করে তেভাগার মিউজিয়ামসহ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় নানাবিধ গবেষণার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। মণিকৃষ্ণ সেনরা ছিলেন প্রচারবিমুখ। মণিকৃষ্ণ সেন বলেছেন, 'আমাদের যুগ আত্মপ্রচারের যুগ ছিল না। ছিল আত্মবিলোপের যুগ। আমরা নিজের নাম গোপন রাখতাম, বাপের নাম বলতাম না। ছবি তুলতাম না। বিপ্লবীদের জন্য তখনকার দিনে এটাই নিয়ম, এটাই ছিল প্রয়োজন।' আমরা আশা করব, অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং সরকার যদি বিপ্লবী মণিকৃষ্ণ সেনসহ অন্যান্য বিপ্লবীর স্মৃতি সংরক্ষণে এবং তেভাগার জাদুঘর নির্মাণে এগিয়ে এসে আত্মবিলোপবাদী মহানাগরিক মণিকৃষ্ণ সেনের বাড়িটি রক্ষা করে, তবে তা হবে রাষ্ট্রের জন্য অনেক বড় সম্মানের কাজ।
লেখক : রাকসুর সাবেক নেতা ও আইনজীবী
lincoln_bd@yahoo.com
No comments