চারদিক-কইয়্যা বৈড়াল by নেয়ামতউল্যা
ভোলা সদর উপজেলা আর মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা একসঙ্গে, কিন্তু বরিশাল থেকে বিচ্ছিন্ন। দুটি দুই জেলায়। এ জন্য মেহেন্দীগঞ্জের অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে ভোলার মানুষের সখ্য বেশি। ভোলাইয়্যারাও মেহেন্দীগঞ্জের মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা পাতায়। যারা না চেনে, তারা ভোলা ভেবে ভুল করে চলে যায় মেহেন্দীগঞ্জে, টেরও পায় না।
হাঁটছিলাম পথে। একজন মানুষের দিকে আটকে গেল চোখ। হাতে বড়শি। সঙ্গে কালো কলসি। একটু পরপর কোনো ডোবার সামনে দাঁড়াচ্ছিলেন। মাছ ধরছিলেন। কথা বলার ইচ্ছে হলো তাঁর সঙ্গে।
আবদুল জলিল চৌকিদারের বয়স ৩৫। বাড়ি মেহেন্দীগঞ্জের পাতারহাট। কিন্তু পেশার কারণে তিনি বছরের বেশির ভাগ সময় ভোলায় থাকেন। চরাঞ্চল চষে বেড়ান। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ইলিশা-আলিমাবাদ সড়কের ভোলা অংশের দক্ষিণ রাজাপুরে। ভোলার এ অংশে সড়কের দুই পাশে বিস্তীর্ণ বিল, ডোবা-নালা, ফসলি খেত, পুকুর-খাল-নদী—সবই আছে। বর্ষাকাল। পানিতে টইটম্বুর। দেশি মাছের পোনা কিলবিল করে। এসব জলাশয়ে মাছের তালাশে প্রকৃতির কাছে ঘুরে ঘুরে বড়শি দিয়ে কই মাছ ধরাই তাঁর পেশা। স্থানীয় ভাষায় তাঁকে ‘কইয়্যা বৈড়াল’ ডাকা হয়।
জলিলের এক হাতে মাটির একটি কালো কলসি। কলসির মুখে নারকেলের আচায় (মালা) মাছের টোপ (লাশার ডিম)। অন্য হাতে বড়শির ছিপ। ছিপের মাথায় হাত দুই সুতা, সুতার মাথায় ছোট বড়শি। জলিল সড়কের ঢালে, বিলের আলে, পুকুরের পাড়ে হাঁটেন, ঝোপে-জঙ্গলে-কচুরিপানার মধ্যে বড়শি পাতেন। প্রতি খোঁটে একটি মাছ ধরবেই। সময় ২০-৩০ সেকেন্ড। আশ্চর্য! এমন কখনো দেখিনি, খোঁটে খোঁটে মাছ! তাঁর সঙ্গে থেকে কিছুক্ষণ হেঁটেই দেখেছি। জলিলের সঙ্গে হাঁটায় তিনি বিরক্ত হচ্ছিলেন। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিলেন।
‘কী মাছ ধরেন?’ আমার প্রশ্ন।
‘কই মাছ,’ বিরক্তির সঙ্গে উত্তর।
‘একটু দেখাবেন?’
‘মাছ পাই নাই।’
‘যে কটা পাইছেন, একটু দেখান।’
‘না।’
এই ‘না’ বলাটা যথেষ্ট দৃঢ় কণ্ঠে। একজন মানুষ মাছ ধরছে, অথচ মাছ দেখাবে না, এটা কেমন কথা! কী এমন ঘটনা আছে এর পেছনে! তিনি কি অভিমান করছেন, নাকি মাছ দেখালে কোনো সমস্যায় পড়ে যাবেন?
নানা ছলছুতোয়, একরকম জোর করে দেখতে হলো মাছ। বোঝা গেল না ঠিক কত মাছ। পানি ভরা কালো কলসি, মাছও কালো।
‘বিক্রি করবেন?’
‘না।’
‘কেন, বাজারদরে দাম দেব।’
‘এই মাছ কইত্থে ধরছি, হোনলে কেনবেন না।’
জলিলের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একসময় কথা হলো কয়েকজন এলাকাবাসীর সঙ্গে। তারাই জানাল, কৈয়্যা বৈড়ালরা পথেঘাটে মাছ বিক্রি করে না। কেন বিক্রি করে না? দুটি কারণ: একটি, এত মাছ দেখলে লোকের মুখ লাগতে পারে, মুখ লাগলে মাছ বড়শিতে ধরা দেবে না। দ্বিতীয় কারণ, বড়শি দিয়ে এত মাছ ধরছে দেখলে কেউ হয়তো মাছ ধরতে বাধা দিতে পারে, তখন পেটে লাথি।
যখন বললাম, ‘ভাই, আমি আপনার মাছ কিনব না। শুধু আপনার সঙ্গে একটু থাকি’, তখন বিরক্ত ভাবটা চলে গেল। মাছ ধরা অবস্থায় ছবিও তুলতে দিল। কথায় কথায় জানলাম, জলিল প্রতিদিন দু-তিন শ কই মাছ ধরেন, তবে সব দিন একই রকম মাছ পান না। কলসি ভরে গেলে নির্ধারিত বাড়ির মাইঠের (বড় মাটির পাত্র) মধ্যে রেখে আসেন। দু-তিন দিন পর মেহেন্দীগঞ্জের আড়তে গিয়ে বিক্রি করেন। জলিল জানান, এ পেশায় তিনি আছেন ২০ বছর ধরে। তাঁর বাবাও এভাবে মাছ ধরতেন। তাঁর বাড়িতে আছে বাবা-মা, স্ত্রী ও ছোট্ট মেয়ে জুঁই। মেয়েটি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। কই মাছ ধরার আয়ে সংসার ভালোই চলছে।
জলিলের সঙ্গে কথা বলার সময় জানতে ইচ্ছে করছিল, বাড়িতে কী রান্না হয়, ছোট্ট মেয়ে জুঁই কি বাবার আদর পায়, কই মাছ ধরে কাটানো ২০ বছরের মধ্যে একবারও কি পেশা বদল করতে ইচ্ছে হয়নি? কিন্তু প্রশ্নগুলো মনের মধ্যেই আড়াল থেকে যায়। আসলে প্রত্যেক মানুষের জীবনেই তো গল্প আছে। প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা গল্প। কিন্তু জলিলের মতো মানুষের জীবনের গল্প প্রায় একই রকম। জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে যাওয়ার অনন্ত পথই যেন তাদের ললাটলিখন।
শুধু জলিল নন, জলিলের মতো বাছেত খাঁ, সিরাজ দেওয়ানসহ অনেক জেলে কই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। গ্রামে ঘুরে তাঁর মাছ ধরতে ভালোই লাগে, তবে সারা বছর মাছ ধরা যায় না। সব সময় কি মাছ থাকে? এ জন্য বছরের ছয় মাস দিনমজুরের কাজ করেন। আর ছয় মাস বড়শি দিয়ে কই মাছ ধরেন।
নেয়ামতউল্যা
আবদুল জলিল চৌকিদারের বয়স ৩৫। বাড়ি মেহেন্দীগঞ্জের পাতারহাট। কিন্তু পেশার কারণে তিনি বছরের বেশির ভাগ সময় ভোলায় থাকেন। চরাঞ্চল চষে বেড়ান। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ইলিশা-আলিমাবাদ সড়কের ভোলা অংশের দক্ষিণ রাজাপুরে। ভোলার এ অংশে সড়কের দুই পাশে বিস্তীর্ণ বিল, ডোবা-নালা, ফসলি খেত, পুকুর-খাল-নদী—সবই আছে। বর্ষাকাল। পানিতে টইটম্বুর। দেশি মাছের পোনা কিলবিল করে। এসব জলাশয়ে মাছের তালাশে প্রকৃতির কাছে ঘুরে ঘুরে বড়শি দিয়ে কই মাছ ধরাই তাঁর পেশা। স্থানীয় ভাষায় তাঁকে ‘কইয়্যা বৈড়াল’ ডাকা হয়।
জলিলের এক হাতে মাটির একটি কালো কলসি। কলসির মুখে নারকেলের আচায় (মালা) মাছের টোপ (লাশার ডিম)। অন্য হাতে বড়শির ছিপ। ছিপের মাথায় হাত দুই সুতা, সুতার মাথায় ছোট বড়শি। জলিল সড়কের ঢালে, বিলের আলে, পুকুরের পাড়ে হাঁটেন, ঝোপে-জঙ্গলে-কচুরিপানার মধ্যে বড়শি পাতেন। প্রতি খোঁটে একটি মাছ ধরবেই। সময় ২০-৩০ সেকেন্ড। আশ্চর্য! এমন কখনো দেখিনি, খোঁটে খোঁটে মাছ! তাঁর সঙ্গে থেকে কিছুক্ষণ হেঁটেই দেখেছি। জলিলের সঙ্গে হাঁটায় তিনি বিরক্ত হচ্ছিলেন। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিলেন।
‘কী মাছ ধরেন?’ আমার প্রশ্ন।
‘কই মাছ,’ বিরক্তির সঙ্গে উত্তর।
‘একটু দেখাবেন?’
‘মাছ পাই নাই।’
‘যে কটা পাইছেন, একটু দেখান।’
‘না।’
এই ‘না’ বলাটা যথেষ্ট দৃঢ় কণ্ঠে। একজন মানুষ মাছ ধরছে, অথচ মাছ দেখাবে না, এটা কেমন কথা! কী এমন ঘটনা আছে এর পেছনে! তিনি কি অভিমান করছেন, নাকি মাছ দেখালে কোনো সমস্যায় পড়ে যাবেন?
নানা ছলছুতোয়, একরকম জোর করে দেখতে হলো মাছ। বোঝা গেল না ঠিক কত মাছ। পানি ভরা কালো কলসি, মাছও কালো।
‘বিক্রি করবেন?’
‘না।’
‘কেন, বাজারদরে দাম দেব।’
‘এই মাছ কইত্থে ধরছি, হোনলে কেনবেন না।’
জলিলের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একসময় কথা হলো কয়েকজন এলাকাবাসীর সঙ্গে। তারাই জানাল, কৈয়্যা বৈড়ালরা পথেঘাটে মাছ বিক্রি করে না। কেন বিক্রি করে না? দুটি কারণ: একটি, এত মাছ দেখলে লোকের মুখ লাগতে পারে, মুখ লাগলে মাছ বড়শিতে ধরা দেবে না। দ্বিতীয় কারণ, বড়শি দিয়ে এত মাছ ধরছে দেখলে কেউ হয়তো মাছ ধরতে বাধা দিতে পারে, তখন পেটে লাথি।
যখন বললাম, ‘ভাই, আমি আপনার মাছ কিনব না। শুধু আপনার সঙ্গে একটু থাকি’, তখন বিরক্ত ভাবটা চলে গেল। মাছ ধরা অবস্থায় ছবিও তুলতে দিল। কথায় কথায় জানলাম, জলিল প্রতিদিন দু-তিন শ কই মাছ ধরেন, তবে সব দিন একই রকম মাছ পান না। কলসি ভরে গেলে নির্ধারিত বাড়ির মাইঠের (বড় মাটির পাত্র) মধ্যে রেখে আসেন। দু-তিন দিন পর মেহেন্দীগঞ্জের আড়তে গিয়ে বিক্রি করেন। জলিল জানান, এ পেশায় তিনি আছেন ২০ বছর ধরে। তাঁর বাবাও এভাবে মাছ ধরতেন। তাঁর বাড়িতে আছে বাবা-মা, স্ত্রী ও ছোট্ট মেয়ে জুঁই। মেয়েটি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। কই মাছ ধরার আয়ে সংসার ভালোই চলছে।
জলিলের সঙ্গে কথা বলার সময় জানতে ইচ্ছে করছিল, বাড়িতে কী রান্না হয়, ছোট্ট মেয়ে জুঁই কি বাবার আদর পায়, কই মাছ ধরে কাটানো ২০ বছরের মধ্যে একবারও কি পেশা বদল করতে ইচ্ছে হয়নি? কিন্তু প্রশ্নগুলো মনের মধ্যেই আড়াল থেকে যায়। আসলে প্রত্যেক মানুষের জীবনেই তো গল্প আছে। প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা গল্প। কিন্তু জলিলের মতো মানুষের জীবনের গল্প প্রায় একই রকম। জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে যাওয়ার অনন্ত পথই যেন তাদের ললাটলিখন।
শুধু জলিল নন, জলিলের মতো বাছেত খাঁ, সিরাজ দেওয়ানসহ অনেক জেলে কই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। গ্রামে ঘুরে তাঁর মাছ ধরতে ভালোই লাগে, তবে সারা বছর মাছ ধরা যায় না। সব সময় কি মাছ থাকে? এ জন্য বছরের ছয় মাস দিনমজুরের কাজ করেন। আর ছয় মাস বড়শি দিয়ে কই মাছ ধরেন।
নেয়ামতউল্যা
No comments