প্রাকৃতিক সম্পদ-স্থলভাগের গ্যাস ব্লক বিদেশি কোম্পানিকে নয় by বদরূল ইমাম
দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে বিদেশি তেল কোম্পানিকে নিয়োগ করা নিয়ে বিতর্কের কারণ হলো, এর ফলে গ্যাসের বড় একটি অংশ তেল কোম্পানি পেয়ে থাকে এবং বাংলাদেশ তার সম্পদের শতভাগ পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই দেশের জাতীয় তেল কোম্পানি কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও উন্নয়ন করলে তাই সর্বোত্তম—এ বিষয়ে কোনো
বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু বিষয়টি আরও একটু ব্যাপক পরিসরে আলোচনা করার প্রয়োজন হয় এ কারণে যে অনুসন্ধান কূপ খনন করার আগেই কোনো একটি এলাকার গ্যাস-সম্ভাবনা নির্ধারণ করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও ব্যবহূত। তাই প্রশ্ন হলো, সে রকম বিশ্লেষণে যেসব এলাকা গ্যাস-সম্ভাবনাময় বলে বিবেচিত হয়, আর যেসব এলাকায় গ্যাস-সম্ভাবনা খুবই কম বা নেহাতই অনিশ্চিত বলে বিবেচিত হয়, তার সবগুলোর ক্ষেত্রেই কি অনুসন্ধান পরিকল্পনা বা ব্যবস্থাপনা (জাতীয় কোম্পানি বনাম বিদেশি কোম্পানি) একই হওয়া উচিত? প্রশ্নটি এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম বিশেষ করে অনুসন্ধান কূপ খনন অতি ব্যয়বহুল কাজ। তাই যেখানে গ্যাস-সম্ভাবনা কম বা খুব কম এবং ঝুঁকি অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়, সেখানে জাতীয় অর্থ লগ্নি করা কতটুকু যৌক্তিক কিংবা করলেও তা কতটা মাত্রা পর্যন্ত করা সংগত, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার যেখানে সম্ভাবনা ভালো বা খুব ভালো, অর্থাৎ ঝুঁকি কম বা অনেক কম, সেখানে বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগ করা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশের গ্যাস কার্যক্রমে এই আদর্শ পন্থা অবলম্বন করা হয়নি। এ কারণে জাতীয় স্বার্থ কীভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, তা নিচের দুটি উদাহরণে লক্ষণীয়।
১. ঝুঁকিশূন্য গ্যাসক্ষেত্র জালালাবাদ: ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রটি উৎপাদনের জন্য অক্সিডেন্টাল কোম্পানিকে ইজারা দেয়। যে উৎপাদনে অংশীদারিত্ব চুক্তির (পিএসসি) অধীন গ্যাসক্ষেত্রটি বিদেশি কোম্পানিকে (বর্তমানে শেভরনের অধীন) দেওয়া হয়, তা এখনো বলবৎ আছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশ জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত গ্যাসের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পেয়ে থাকে এবং বাকি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পায় শেভরন কোম্পানি। প্রতি মাসে বাংলাদেশ শেভরন কোম্পানির গ্যাসের অংশটি নির্ধারিত মূল্যে কিনে নেয়। পেট্রোবাংলার এমআইএস রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ তার গ্যাসের অংশটি কেনা বাবদ শেভরনকে ৩২৭ কোটি টাকা পরিশোধ করে। অথচ বাংলাদেশের জাতীয় কোম্পানি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে ৪৮টি গ্যাসকূপ খননের মাধ্যমে ১২টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন করে থাকে, যার শতভাগ গ্যাস বাংলাদেশ পায়। তাহলে জাতীয় কোম্পানি জালালাবাদে উৎপাদন কূপ খনন না করে বিদেশিদের প্রতি বছর ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা কেন দেয়, তার কোনো সদুত্তর কেউ দিতে পারে না। ভূখণ্ডে আবিষ্কৃত ক্ষেত্র বিদেশিদের দিয়ে দেওয়ার আরও উদাহরণ রয়েছে যেমন: আবিষ্কৃত হরিপুর তেলক্ষেত্র সিমিটার কোম্পানিকে দেওয়া বা আবিষ্কৃৃত ছাতক (টেংরাটিলা) গ্যাসক্ষেত্র নাইকো রিসোর্স কোম্পানিকে দেওয়া। পরে সিমিটার ও নাইকো কোম্পানি দুটি জালিয়াতির দায়ে দণ্ডিত হয়। দেশের নিজস্ব হাতে থাকা অমূল্য গ্যাসসম্পদ বিদেশিদের এভাবে দেওয়া দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার শামিল।
২. ন্যূনতম ঝুঁকিবাহী ব্লকগুলো: সিলেট অঞ্চলে ১৪ নম্বর ব্লকে মৌলভীবাজার নামক ভূতাত্ত্বিক কাঠামোটি খুব সম্ভাবনাময় গ্যাস কাঠামো হিসেবে আগে থেকেই পেট্রোবাংলা শনাক্ত করে। সে হিসেবে পেট্রোবাংলা সেখানে একটি অনুসন্ধান কূপ খননের পরিকল্পনা করে এবং পেট্রোবাংলার ভূ-তত্ত্ববিদেরা সেখানে গ্যাস পাওয়ার ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত থাকেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লক পিএসসির অধীন অক্সিডেন্টালকে দিয়ে দেওয়া হয়। খুব কম সময়েই অক্সিডেন্টাল মৌলভীবাজার কাঠামোতে অনুসন্ধান কূপ খনন করে মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত ওই পিএসসি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানি (বর্তমানে শেভরনের অধীন) যে গ্যাস উত্তোলন করে, তার একটি অংশ পায়, যা কিনা আবার বাংলাদেশ নির্ধারিত মূল্যে কিনে নেয়। পেট্রোবাংলার গত এপ্রিল মাসের এমআইএস রিপোর্ট অনুযায়ী, মৌলভীবাজারে উৎপাদিত গ্যাস ভাগাভাগি হয় এ রকম—বাংলাদেশ ৩৪ শতাংশ, শেভরন ৬৬ শতাংশ। মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রটি নিজে আবিষ্কার করে শতভাগ গ্যাস পাওয়ার নিশ্চিত সুযোগ না নিয়ে তা বিদেশিদের হাতে দিয়ে কেবল ৬৬ শতাংশ গ্যাস পাওয়ার ব্যবস্থাপনার কী অর্থ হতে পারে, তার সদুত্তরও কেউ দিতে পারে না।
কেবল ১৪ নম্বর ব্লকই নয়, ভূ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ১২, ১৩ ও ১৪—এই তিনটি ব্লকই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাময় ব্লক হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর মধ্যে ১২ নম্বর ব্লকে শেভরন একটি বিরাট গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা আবিষ্কার করে এবং সেখানেও বাংলাদেশ ও শেভরনের মধ্যে গ্যাস ভাগাভাগি হয়। সিলেট অঞ্চল ছাড়াও কুমিল্লা অঞ্চলে ৯ নম্বর গ্যাস ব্লকটি অতি সম্ভাবনাময় বলে আগে থেকেই বিবেচিত। ২০০১ সালে সরকার ৯ নম্বর ব্লকটি বিদেশি কোম্পানি তাল্লোকে ইজারা দেয়। তাল্লো সহজেই অল্প সময়ের মধ্যে বাংগোরা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। বর্তমানে এ থেকে উৎপাদিত গ্যাস বাংলাদেশ ৩৫ শতাংশ, তাল্লো ৬৫ শতাংশ অনুপাতে ভাগাভাগি হয় (সূত্র: পেট্রোবাংলা এমআইএস রিপোর্ট এপ্রিল ২০১১)।
এখন দেখা যাক, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের গ্যাস-সম্ভাবনা ও কার্যক্রম কী রকম। একটি এলাকার গ্যাস-সম্ভাবনা নির্ধারণে ভূ-তত্ত্ববিদেরা যে সূত্রটি ব্যবহার করেন, তাতে মোট পাঁচটি উপাদান রয়েছে যথা: উৎস শিলা, মজুদ শিলা, ফাঁদ, আচ্ছাদন শিলা ও মাইগ্রেশন পথ। তেল-গ্যাসবিজ্ঞানে এই পাঁচটি উপাদানের প্রতিটির উপস্থিতির সম্ভাবনা নির্ধারণ করার পর সব কটির গুণন ফল দ্বারা একটি এলাকার গ্যাস বা তেল-সম্ভাবনার পরিমাপ করার যে সূত্রটি বিদ্যমান, তা সব স্থানেই ব্যবহূত হয়। উপরিউক্ত বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশকে মূলত দুটি অংশে ভাগ করা যায়—পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল। পূর্বাঞ্চল বলতে যমুনা-পদ্মা নদীর পূর্বাংশকে ধরা যায়। এ অঞ্চলে উপরিউক্ত পাঁচটি উপাদানই ভূগর্ভে সহ-অবস্থান করে। বিশেষ করে এখানে শিলাস্তরে সুবিন্যস্ত ঊর্ধ্বভাঁজগুলো গ্যাস মজুদের ফাঁদ হিসেবে সহজে চিহ্নিত করা যায় বিধায় অনুসন্ধানকাজে ঝুঁকি কম বা খুব কম। এই ব্লকগুলোর মধ্যে ১১, ১২, ১৩, ১৪, ৯, ১০ ও ১৫ অন্তর্ভুক্ত। কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের ২২ নম্বর ব্লকটি ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ এখানে ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামো তীব্র ভূ-অন্দোলনের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ায় তা ভাঙন ও জটিল প্রকৃতি ধারণ করেছে এবং গ্যাসের মজুদ সৃষ্টির সহজাত ধারা বিঘ্নিত হয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোর ভূ-তাত্ত্বিক প্রকৃতি পূর্বাঞ্চলের মতো গ্যাস মজুদ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট অনুকূল নয়। এখানে গ্যাস ধারণ করার ফাঁদ সহজে চিহ্নিত হয় না, আবার যদিও কোনো ক্ষেত্রে চিহ্নিত হয়, তা সাধারণত পূর্বাঞ্চলের মতো সহজ ঊর্ধ্বভাঁজ প্রকৃতির নয় বরং তা মূলত জটিল স্ট্র্যাটিগ্রাফিক প্রকৃতির, যাতে অনুসন্ধান ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। অধিকন্তু স্ট্র্যাটিগ্রাফিক প্রকৃতির ফাঁদে গ্যাস পেলেও এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে সীমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
উল্লেখ্য, এ কারণে অতীতে পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোর প্রতি বিদেশি কোম্পানির তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোর মধ্যে উত্তর থেকে দক্ষিণে ২৩, ১, ২, ৮, ৩, ৪, ৬, ৫ ও ৭ অন্তর্ভুক্ত। আজ অবধি এই অঞ্চলে কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি এবং সম্প্রতি শেভরন বরিশাল অঞ্চলে ৭ নম্বর ব্লকে কাজল নামে যে অনুসন্ধান কূপ খনন করে, তা-ও গ্যাসশূন্য প্রমাণিত হয়। উল্লেখ্য, আরও পশ্চিম দিকে একই ভূ-তাত্ত্বিক প্রকৃতির পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) অঞ্চলে আজ অবধি ৪৫টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হলেও একটি গ্যাসক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হয়নি।
মূল কথা: উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সম্ভাবনাময় ও খুব সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর সবকটিই দেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে অনুসন্ধান ঝুঁকি কম বা খুব কম। এই ব্লকগুলোর সবই বিদেশি তেল কোম্পানির হাতে দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোয় গ্যাস-সম্ভাবনা কম বা খুব কম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় শূন্য। এখানে বিদেশি কোম্পানির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোয় অনুসন্ধান ঝুঁকি বেশি বা খুব বেশি বিধায় সেখানে জাতীয় কোম্পানির পক্ষে অর্থ বিনিয়োগ করা যুক্তিযুক্ত নয়। বাংলাদেশের উচিত পূর্বাঞ্চলের সব গ্যাস ব্লককে জাতীয় তেল-গ্যাস প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্পণ করা এবং পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোয় বিদেশি কোম্পানিদের নিয়োগ দেওয়া।
কোনো কোনো ব্যক্তি দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ ব্লকে বিদেশি কোম্পানি নিয়োগের বিপক্ষে মত দেন। কিন্তু একদিকে পূর্বাঞ্চলে দেশের সম্ভাবনাময় গ্যাস ব্লকে বিদেশিদের প্রায় ঝুঁকিহীন বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে, অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষীণ সম্ভাবনাময় ও ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস ব্লকে জাতীয় কোম্পানিকে অনুসন্ধান বিনিয়োগ করতে দেওয়া দেশের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের শামিল হবে। একজন দেশীয় ভূ-বিজ্ঞানীর ভাষায়, এর অর্থ হবে ফলের শাঁসালো মিষ্টি অংশটুকু বিদেশিদের হাতে দিয়ে ফলের খোসাটি দেশের জন্য উপহার দেওয়া। এহেন গ্যাস-ব্যবস্থাপনা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১. ঝুঁকিশূন্য গ্যাসক্ষেত্র জালালাবাদ: ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রটি উৎপাদনের জন্য অক্সিডেন্টাল কোম্পানিকে ইজারা দেয়। যে উৎপাদনে অংশীদারিত্ব চুক্তির (পিএসসি) অধীন গ্যাসক্ষেত্রটি বিদেশি কোম্পানিকে (বর্তমানে শেভরনের অধীন) দেওয়া হয়, তা এখনো বলবৎ আছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশ জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত গ্যাসের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পেয়ে থাকে এবং বাকি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পায় শেভরন কোম্পানি। প্রতি মাসে বাংলাদেশ শেভরন কোম্পানির গ্যাসের অংশটি নির্ধারিত মূল্যে কিনে নেয়। পেট্রোবাংলার এমআইএস রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ তার গ্যাসের অংশটি কেনা বাবদ শেভরনকে ৩২৭ কোটি টাকা পরিশোধ করে। অথচ বাংলাদেশের জাতীয় কোম্পানি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে ৪৮টি গ্যাসকূপ খননের মাধ্যমে ১২টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন করে থাকে, যার শতভাগ গ্যাস বাংলাদেশ পায়। তাহলে জাতীয় কোম্পানি জালালাবাদে উৎপাদন কূপ খনন না করে বিদেশিদের প্রতি বছর ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা কেন দেয়, তার কোনো সদুত্তর কেউ দিতে পারে না। ভূখণ্ডে আবিষ্কৃত ক্ষেত্র বিদেশিদের দিয়ে দেওয়ার আরও উদাহরণ রয়েছে যেমন: আবিষ্কৃত হরিপুর তেলক্ষেত্র সিমিটার কোম্পানিকে দেওয়া বা আবিষ্কৃৃত ছাতক (টেংরাটিলা) গ্যাসক্ষেত্র নাইকো রিসোর্স কোম্পানিকে দেওয়া। পরে সিমিটার ও নাইকো কোম্পানি দুটি জালিয়াতির দায়ে দণ্ডিত হয়। দেশের নিজস্ব হাতে থাকা অমূল্য গ্যাসসম্পদ বিদেশিদের এভাবে দেওয়া দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার শামিল।
২. ন্যূনতম ঝুঁকিবাহী ব্লকগুলো: সিলেট অঞ্চলে ১৪ নম্বর ব্লকে মৌলভীবাজার নামক ভূতাত্ত্বিক কাঠামোটি খুব সম্ভাবনাময় গ্যাস কাঠামো হিসেবে আগে থেকেই পেট্রোবাংলা শনাক্ত করে। সে হিসেবে পেট্রোবাংলা সেখানে একটি অনুসন্ধান কূপ খননের পরিকল্পনা করে এবং পেট্রোবাংলার ভূ-তত্ত্ববিদেরা সেখানে গ্যাস পাওয়ার ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত থাকেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লক পিএসসির অধীন অক্সিডেন্টালকে দিয়ে দেওয়া হয়। খুব কম সময়েই অক্সিডেন্টাল মৌলভীবাজার কাঠামোতে অনুসন্ধান কূপ খনন করে মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত ওই পিএসসি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানি (বর্তমানে শেভরনের অধীন) যে গ্যাস উত্তোলন করে, তার একটি অংশ পায়, যা কিনা আবার বাংলাদেশ নির্ধারিত মূল্যে কিনে নেয়। পেট্রোবাংলার গত এপ্রিল মাসের এমআইএস রিপোর্ট অনুযায়ী, মৌলভীবাজারে উৎপাদিত গ্যাস ভাগাভাগি হয় এ রকম—বাংলাদেশ ৩৪ শতাংশ, শেভরন ৬৬ শতাংশ। মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রটি নিজে আবিষ্কার করে শতভাগ গ্যাস পাওয়ার নিশ্চিত সুযোগ না নিয়ে তা বিদেশিদের হাতে দিয়ে কেবল ৬৬ শতাংশ গ্যাস পাওয়ার ব্যবস্থাপনার কী অর্থ হতে পারে, তার সদুত্তরও কেউ দিতে পারে না।
কেবল ১৪ নম্বর ব্লকই নয়, ভূ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ১২, ১৩ ও ১৪—এই তিনটি ব্লকই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাময় ব্লক হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর মধ্যে ১২ নম্বর ব্লকে শেভরন একটি বিরাট গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা আবিষ্কার করে এবং সেখানেও বাংলাদেশ ও শেভরনের মধ্যে গ্যাস ভাগাভাগি হয়। সিলেট অঞ্চল ছাড়াও কুমিল্লা অঞ্চলে ৯ নম্বর গ্যাস ব্লকটি অতি সম্ভাবনাময় বলে আগে থেকেই বিবেচিত। ২০০১ সালে সরকার ৯ নম্বর ব্লকটি বিদেশি কোম্পানি তাল্লোকে ইজারা দেয়। তাল্লো সহজেই অল্প সময়ের মধ্যে বাংগোরা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। বর্তমানে এ থেকে উৎপাদিত গ্যাস বাংলাদেশ ৩৫ শতাংশ, তাল্লো ৬৫ শতাংশ অনুপাতে ভাগাভাগি হয় (সূত্র: পেট্রোবাংলা এমআইএস রিপোর্ট এপ্রিল ২০১১)।
এখন দেখা যাক, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের গ্যাস-সম্ভাবনা ও কার্যক্রম কী রকম। একটি এলাকার গ্যাস-সম্ভাবনা নির্ধারণে ভূ-তত্ত্ববিদেরা যে সূত্রটি ব্যবহার করেন, তাতে মোট পাঁচটি উপাদান রয়েছে যথা: উৎস শিলা, মজুদ শিলা, ফাঁদ, আচ্ছাদন শিলা ও মাইগ্রেশন পথ। তেল-গ্যাসবিজ্ঞানে এই পাঁচটি উপাদানের প্রতিটির উপস্থিতির সম্ভাবনা নির্ধারণ করার পর সব কটির গুণন ফল দ্বারা একটি এলাকার গ্যাস বা তেল-সম্ভাবনার পরিমাপ করার যে সূত্রটি বিদ্যমান, তা সব স্থানেই ব্যবহূত হয়। উপরিউক্ত বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশকে মূলত দুটি অংশে ভাগ করা যায়—পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল। পূর্বাঞ্চল বলতে যমুনা-পদ্মা নদীর পূর্বাংশকে ধরা যায়। এ অঞ্চলে উপরিউক্ত পাঁচটি উপাদানই ভূগর্ভে সহ-অবস্থান করে। বিশেষ করে এখানে শিলাস্তরে সুবিন্যস্ত ঊর্ধ্বভাঁজগুলো গ্যাস মজুদের ফাঁদ হিসেবে সহজে চিহ্নিত করা যায় বিধায় অনুসন্ধানকাজে ঝুঁকি কম বা খুব কম। এই ব্লকগুলোর মধ্যে ১১, ১২, ১৩, ১৪, ৯, ১০ ও ১৫ অন্তর্ভুক্ত। কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের ২২ নম্বর ব্লকটি ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ এখানে ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামো তীব্র ভূ-অন্দোলনের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ায় তা ভাঙন ও জটিল প্রকৃতি ধারণ করেছে এবং গ্যাসের মজুদ সৃষ্টির সহজাত ধারা বিঘ্নিত হয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোর ভূ-তাত্ত্বিক প্রকৃতি পূর্বাঞ্চলের মতো গ্যাস মজুদ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট অনুকূল নয়। এখানে গ্যাস ধারণ করার ফাঁদ সহজে চিহ্নিত হয় না, আবার যদিও কোনো ক্ষেত্রে চিহ্নিত হয়, তা সাধারণত পূর্বাঞ্চলের মতো সহজ ঊর্ধ্বভাঁজ প্রকৃতির নয় বরং তা মূলত জটিল স্ট্র্যাটিগ্রাফিক প্রকৃতির, যাতে অনুসন্ধান ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। অধিকন্তু স্ট্র্যাটিগ্রাফিক প্রকৃতির ফাঁদে গ্যাস পেলেও এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে সীমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
উল্লেখ্য, এ কারণে অতীতে পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোর প্রতি বিদেশি কোম্পানির তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোর মধ্যে উত্তর থেকে দক্ষিণে ২৩, ১, ২, ৮, ৩, ৪, ৬, ৫ ও ৭ অন্তর্ভুক্ত। আজ অবধি এই অঞ্চলে কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি এবং সম্প্রতি শেভরন বরিশাল অঞ্চলে ৭ নম্বর ব্লকে কাজল নামে যে অনুসন্ধান কূপ খনন করে, তা-ও গ্যাসশূন্য প্রমাণিত হয়। উল্লেখ্য, আরও পশ্চিম দিকে একই ভূ-তাত্ত্বিক প্রকৃতির পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) অঞ্চলে আজ অবধি ৪৫টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হলেও একটি গ্যাসক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হয়নি।
মূল কথা: উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সম্ভাবনাময় ও খুব সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর সবকটিই দেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে অনুসন্ধান ঝুঁকি কম বা খুব কম। এই ব্লকগুলোর সবই বিদেশি তেল কোম্পানির হাতে দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোয় গ্যাস-সম্ভাবনা কম বা খুব কম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় শূন্য। এখানে বিদেশি কোম্পানির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোয় অনুসন্ধান ঝুঁকি বেশি বা খুব বেশি বিধায় সেখানে জাতীয় কোম্পানির পক্ষে অর্থ বিনিয়োগ করা যুক্তিযুক্ত নয়। বাংলাদেশের উচিত পূর্বাঞ্চলের সব গ্যাস ব্লককে জাতীয় তেল-গ্যাস প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্পণ করা এবং পশ্চিমাঞ্চলের ব্লকগুলোয় বিদেশি কোম্পানিদের নিয়োগ দেওয়া।
কোনো কোনো ব্যক্তি দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ ব্লকে বিদেশি কোম্পানি নিয়োগের বিপক্ষে মত দেন। কিন্তু একদিকে পূর্বাঞ্চলে দেশের সম্ভাবনাময় গ্যাস ব্লকে বিদেশিদের প্রায় ঝুঁকিহীন বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে, অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষীণ সম্ভাবনাময় ও ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস ব্লকে জাতীয় কোম্পানিকে অনুসন্ধান বিনিয়োগ করতে দেওয়া দেশের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের শামিল হবে। একজন দেশীয় ভূ-বিজ্ঞানীর ভাষায়, এর অর্থ হবে ফলের শাঁসালো মিষ্টি অংশটুকু বিদেশিদের হাতে দিয়ে ফলের খোসাটি দেশের জন্য উপহার দেওয়া। এহেন গ্যাস-ব্যবস্থাপনা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments