সমকালীন প্রসঙ্গ-অটুট থাকুক সমালোচনার অধিকার by আবু সাঈদ খান
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীরা ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন। তারা বিরোধী দলের অভিযোগের বিপরীতে পাল্টা অভিযোগ করছেন। কিন্তু নিজেদের ভুল স্বীকার করছেন না। ভুল স্বীকার করা সাহসী কাজ। আমাদের দেশে অবশ্য ভুল স্বীকারের রেওয়াজ মোটেও গড়ে ওঠেনি।
কিন্তু পার্শ্ববর্তী ভারতের কথাই ভাবা যাক, সে দেশের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার শাসনামলের জরুরি অবস্থার জন্য জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়েছিলেন। জনগণ তার প্রতি সদয় হয়েছিল। তাই পরবর্তী সময়ে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল তার দল
পরমতসহিষ্ণুতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য উপাদান। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে নানা কাজকর্ম ও সিদ্ধান্তের সমালোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ সমালোচনা আসতে পারে বিরোধী দল কিংবা সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যম কিংবা ব্লগ-ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ থেকে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন ফোরাম বা ব্যক্তিও সমালোচনামুখর হতে পারেন। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই এটি। যারা দেশ চালান তাদের কর্তব্য হলো, সমালোচনা সহ্য করা; শুধু সহ্য করা নয়, সমালোচকদের কথা আমলে নিয়ে নিজেদের শোধরানো। কোনো সমালোচনা গায়ে জ্বালা ধরালেও তা সহ্য করতে হয়, শ্রদ্ধার সঙ্গেই দেখতে হয়। সমালোচক সর্বদা প্রতিপক্ষ নন, বন্ধুও। মনে রাখতে হবে, প্রতিপক্ষ হলেও শত্রু নয়, বন্ধু। বিশেষত প্রকাশ্য সমালোচনাকে ভিন্ন চোখে দেখার অবকাশ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে নেই। বরং সজাগ থাকতে হয় গোপন শত্রুদের বিষয়ে_ যারা প্রকাশ্যে সমালোচনা না করে সুযোগ খোঁজে।
সরকার যে ব্যবস্থা বা আবহের মধ্যে কাজ করে, সেখান থেকে ভুলত্রুটি মালুম করা যায় না। সরকার যন্ত্রের বাইরে থেকে কেউ কিংবা বিরোধী পক্ষ ভুলগুলো সহজেই দেখতে পায়, তাই তারা সমালোচনা করলে তা আমলে নেওয়াই গণতান্ত্রিক দেশগুলোর রেওয়াজ। এতে সরকারের মঙ্গলই হয়। আমাদের দেশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা ভুল সমালোচনাও দেদার হয়। সেগুলোর জবাব দেওয়ার অধিকার সমালোচিতের আছে, এ জন্য বিষোদ্গারের প্রয়োজন নেই। সঠিক তথ্যটি জনগণের সামনে তুলে ধরাই উপযুক্ত জবাব।
এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অজানা নয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সমকাল-ব্র্যাক ব্যাংক আয়োজিত যক্ষ্মা বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। এর আগে তার দু'একটি মন্তব্য নিয়ে গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠলেও ওইদিন তিনি গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সাংবাদিকরা আমাদের সমালোচনা করে উপকার করেন। ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেন। এতে আমরা সংশোধিত হওয়ার সুযোগ পাই। এভাবে সমালোচনা করে তারা আগামীতে জেলে যাওয়া থেকে আমাদের রক্ষা করেন। এটি যদি সরকারের উপলব্ধি হয়, তবে তা গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক। কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি?
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীরা ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন। তারা বিরোধী দলের অভিযোগের বিপরীতে পাল্টা অভিযোগ করছেন। কিন্তু নিজেদের ভুল স্বীকার করছেন না। ভুল স্বীকার করা সাহসী কাজ। আমাদের দেশে অবশ্য ভুল স্বীকারের রেওয়াজ মোটেও গড়ে ওঠেনি। কিন্তু পার্শ্ববর্তী ভারতের কথাই ভাবা যাক, সে দেশের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার শাসনামলের জরুরি অবস্থার জন্য জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়েছিলেন। জনগণ তার প্রতি সদয় হয়েছিল। তাই পরবর্তী সময়ে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল তার দল। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ক্ষমতায় থাকাকালে এবং পরাজিত হওয়ার পর কর্মীদের অপকর্মসহ ভুলভ্রান্তির কথা স্বীকার করছেন। এখন দলের অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছে সিপিএম। আমাদের দেশের নেতাকর্মীদের অপকর্মের কোনো সাজা নেই। বরং কিছু ক্ষেত্রে পুরস্কৃতও করার উদাহরণ আছে। অতীত অপকর্ম থাকার পরেও নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো ধরেই নিয়েছে যে, পেশি এবং কালো টাকাই নির্বাচন ও রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, সাধারণের কাছে একজন নেতার ভাবমূর্তি কী, তা নয়। নেতাদের অলিখিত নীতি হলো, নির্বাচনে টাকা খাটিয়েছেন, তা সুদে-আসলে তুলে নেবেন; কর্মীরা কষ্ট করেছেন, তাদেরও কিছু সুযোগ দিতে হবে। তাই যখন লুটপাট-চাঁদাবাজি-দখলবাজি-টেন্ডারবাজি চলে, তার জন্য সমালোচনা করা হলে বলা হয়_ বিএনপির আমলে এর চেয়ে বেশি হয়েছে। অর্থাৎ এখানে কে কত খারাপ, সেই তর্কই বড়। কে কত ভালো সেই প্রতিযোগিতা নেই। এখানে কে কত গণতান্ত্রিক সেটা প্রমাণের চেষ্টা নেই। সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই মনে করে, দাপট দেখাতে হবে। সেটি ক্ষমতার দাপট। এই দাপট দেখাতেই বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিনকে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। বিরোধী দলকে ঠাণ্ডা করতে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। এমন কাজ চারদলীয় জোট সরকারও করেছিল, তাই বলে কি মহাজোট সরকারও করবে? আমাদের প্রশ্ন, এই খেলা কতকাল চলবে? এ ধারা অব্যাহত থাকলে কি দিনবদল হবে?
দেশের প্রচলিত নেতৃত্বের লক্ষ্য হচ্ছে নিছক ক্ষমতা দখল। সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখা বা বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচেষ্টা থাকবে_ সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে পদ্ধতি হতে হবে নিয়মমাফিক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ছলেবলে ক্ষমতা ধরে রাখার সুযোগ নেই। আবার ছলেবলে ক্ষমতাচ্যুত করারও সুযোগ নেই। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে জনকল্যাণে দেশ পরিচালনা করতে হবে। জনগণের আকাঙ্ক্ষায় সরকার পরিবর্তন হবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের নিয়মতান্ত্রিক উপায়_ নির্বাচন। সরকার পরিবর্তনের মাধ্যম কখনও আন্দোলনও হতে পারে। তবে তা হবে জনগণের আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু আমাদের দেশে গণতন্ত্রের স্থলে চলছে ব্যক্তিতন্ত্র, দলতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র। জনকল্যাণের স্থলে প্রধান প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠীর স্বার্থ। ক্ষমতাবাজি ও ভোগবাদ রাজনীতিতে এখন দুই প্রবণতা, একটি অন্যটির পরিপূরক। রাজনীতির এই সুবিধাবাদী ধারা পরিবর্তন করতে হলে চাই সমালোচনা ও আত্মসমালোচনা। এর জন্য দলের ভেতর ও বাইরে সমালোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
যেখানে সমালোচনা করলে বিপদে পড়তে হয়, সেখানে রাজনীতি পরিশুদ্ধ হয় না, লুটপাট-দুর্নীতি বন্ধ হয় না, গণতন্ত্রেরও বিকাশ ঘটে না। রাজনৈতিক দলগুলোতে সেই পরিবেশ দরকার, যাতে সাধারণ সদস্যরা নিদ্বর্িধায় সকল পর্যায়ের নেতৃত্বের সমালোচনা করতে পারবেন। সেটি তখনই সম্ভব হবে, যখন সাধারণ সদস্যদের ভোটে নেতা নির্বাচিত হবেন। আর যেখানে ওপর থেকে নেতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে এমন সুযোগ কখনোই তৈরি হতে পারে না। যেমনটি আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই। এখানে তাকেই মন্ত্রী করা হয় কিংবা এমপি পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়, যে শীর্ষ নেতার অনুগত। আনুগত্য এখানে যোগ্যতার মাপকাঠি। এ কারণে অনেক অযোগ্য অথচ অনুগত ব্যক্তি মন্ত্রিত্বের আসনে বসেছেন। সরকার ও বিরোধী দলগুলোর নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন। এ নিয়ে টুঁ শব্দ করলে তারা দলদ্রোহী, সংস্কারপন্থি। শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের ইচ্ছায় দল চলে, কর্মীরা এখানে আজ্ঞাবহ।
সমালোচনার অধিকার যেমন দলের ভেতরে থাকবে, তেমনি সরকারকে বিরোধী দল এবং বিরোধী দলকেও ক্ষমতাসীন দল সমালোচনা করবে। তবে গণতন্ত্র যাচ্ছেতাই বলার অধিকার দেয় না। সমালোচনা হতে হবে যৌক্তিক। সমালোচনা মানে চরিত্র হনন নয়, কাদা ছোড়াছুড়ি নয়। সমালোচনার সঙ্গে শ্রদ্ধার ব্যাপারটা এসে যায়। সঙ্গত কারণে সরকার বিরোধী দলকে ভয় দেখাবে না, বিরোধী দল তাদের লুলা-ল্যাংড়া করার কথা বলবে না। নীতিনির্ধারকরা হবেন পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বাদ-প্রতিবাদ হবে সংসদের ভেতর ও বাইরে। তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু তা শালীনতাবর্জিত হওয়া উচিত নয়।
রাজনীতি কেবল সরকার ও বিরোধী দলের ব্যাপার নয়, জনগণ হচ্ছে_ রাজনীতির নিয়ামক শক্তি। তাই যুক্তিসঙ্গতভাবে সরকার ও বিরোধী দলের বড় সমালোচক বন্ধু হচ্ছে জনগণ, গণমাধ্যম। কিন্তু গণমাধ্যমের জন্য সেই সুযোগ কতটুকু অবারিত?
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত এক বছরে ১৩৯ জন সংবাদকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, হুমকি এসেছে ৫৩ জনের ওপর। আমরা কি সব লিখতে পারি, বলতে পারি? সরকারের সমালোচনা করলে বিরোধী দলের সমর্থক হয়ে যাই, আর বিরোধী দলের ভুল ধরিয়ে দিলে সরকারের লোক হয়ে যাই। তবে এটি ঠিক যে, গণমাধ্যমকর্মীদের একাংশ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে আছেন। তারা আওয়ামী লীগপন্থি ও বিএনপিপন্থি। তাদের কথা বলছি না। বলছি তাদের কথা_ যাদের চেতনায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিভাজন নেই। দেশ ও দশের কল্যাণই যাদের মূলমন্ত্র।
এ প্রসঙ্গে দুই বড় দলের দুই বন্ধুর উক্তি তুলে ধরতে চাই। আওয়ামী লীগের জন বললেন, আমাদের এত সমালোচনা করে কি আবার হাওয়া ভবনের রাজত্ব কায়েম করতে চান? তার ভাষায়, আওয়ামী লীগ ফেল করলে নিজামী-মুজাহিদের বিচার হবে না, বরং তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়বে। অন্যদিকে বিএনপির বন্ধু বলেছেন, আমাদের সমালোচনা করছেন কি আওয়ামী লীগের লুটপাটের রাজনীতিকে রক্ষা করতে, ভারতকে বিনা মাশুলে ট্রানজিট দিতে? এমনই নানা পাল্টাপাল্টি কথার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় আমাদের।
আসলে আমরা কোনো দলের লুটপাটের রাজনীতি চাই না, যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা দেখতেও চাই না, বরং তাদের ফাঁসি চাই। ভারতকে বিনা মাশুলে ট্রানজিট দিতে চাই না। আমরা চাই ন্যায় ও সমতা। আমাদের সমালোচনার লক্ষ্য হচ্ছে সুস্থধারার রাজনীতি, যে রাজনীতি জনকল্যাণে নিবেদিত হবে, নেতৃত্ব হবে দেশের স্বার্থের পাহারাদার। আমরা চাই, যে কোনো মূল্যে মতপ্রকাশ ও সমালোচনার অধিকার অক্ষুণ্ন থাকুক, যা গণতন্ত্রকেই শক্তিশালী করে তুলবে।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments