শেষ দেখা হলো না by জিয়াউল হক মুক্তা

ঘুমাতে যাওয়ার অনেক আগে, কাজ শেষের আগে আগে ব্ল্যাকবেরিতে চোখে পড়ল সাগর সরওয়ারের সর্বশেষ ফেসবুক স্টেটাস। কিছুক্ষণ আগেই নিজের একটি বই সম্পর্কে তিনি লিখেছেন খুব সাধারণ কয়েকটি বাক্য_ 'নীল পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এঁকে ফেলেছিলাম বইটি। পরে লিখে ফেললাম। গত বইমেলার শেষ দিকে বের করল ভাষাচিত্র।


বইটি এ মেলাতেও আছে। ওদের স্টল নম্বর ২০০। শান্তি বাহিনী আর ইউপিডিএফ, পাহাড়ের রাজনীতি, সেই সময় এবং এই সময়, এমএন লারমা (মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা) ও পাহাড়ের মানুষ এ বইয়ের চরিত্র।' চকিতে মনে পড়ে গেল জার্মানির বন শহরে রাইন নদীর ধারে এক পার্কের রেস্টুরেন্টে আমাদের দু'জনের আড্ডায় বলছিলেন ওটাতে তিনি কী লিখছিলেন। তার স্টেটাসে মন্তব্য করলাম, 'গল্পটা বলেছিলেন... কালেক্ট করব।' সময় তখন রাত সোয়া ১১টার একটু বেশি।
শারীরিক ব্যথায় ঘুমে-অঘুমে কাটল সারারাত। কিছুটা দেরিতে ওঠে সকালে ব্যাগ গোছাচ্ছি_ পিআইএর ফ্লাইট ধরব। স্ত্রী বাইরে গেছেন। এ সময় রেজোয়ান নবীন ফোন করে ফোঁপাতে লাগলেন_ সাগর ভাই আর রুনি আপা খুন হয়েছেন। কোন সাগর? কোন রুনি? 'খুন' শব্দটির প্রেক্ষাপটে মনে হলো, আমার যে বন্ধুটি একটি বিভাগীয় শহরে একা থাকেন কর্মসূত্রে সে নয়তো? কিন্তু সেখানে তো 'রুনি' নামে কেউ নেই? কয়েক ঘণ্টা আগেই যার সঙ্গে যোগাযোগ হলো, যে ঢাকাতেই থাকে, একটি টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক যে, সে সাগর খুন হতে পারেন_ আমার 'ফ্রেম অব রেফারেন্স' তা 'অ্যাকনলেজ' করতে পারল না মোটেই। কী কথা হলো নবীনের সঙ্গে তা মনে নেই আর_ জলমগ্ন ঝাপসা চোখে দেখা যায় না কিছু। মনের কোণে ভেসে ওঠে সাগর সরওয়ারের চোখের ঝিলিক। তার চোখের ঝিলিক আমার খুব প্রিয়। সাগর সরওয়ারের আর সব ছবি হারিয়ে গেল বিস্মৃতির গহ্বরে হঠাৎ তার জীবনপ্রদীপের মতো। তৈরি হতে হতে মনের গভীর থেকে ধীরে ধীরে উঁকি দিতে লাগল তার সব ছবি। বন শহরের পরে, রাইন নদীর একদম সমান্তরালে, একসার বাড়ি পেরিয়ে, সড়কের অন্য পাড়ে, কনিগসউইন্টারে, সাগর-রুনির বাড়িতে নৈশভোজ-উত্তর আড্ডা! তাদের সন্তান মেঘের সঙ্গে গল্প! দু'একবার এমনও হয়েছে_ রাত যতই হোক, যেতেই হয়েছে, তারা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করেছে। আড্ডা শেষে ফিরতে হয়েছে রাত ১টা-২টায়। মনে পড়ে বনের আরেকদিকে, পার্কের রেস্টুরেন্টে বিয়ার-চিপসের ফাঁকে, তার দেশে ফেরার পরিকল্পনার কথা। দৈনিক পত্রিকা থেকে যিনি রেডিওতে গিয়েছেন, দেশে ফিরে কাজ করবেন টেলিভিশনে। জ্বালানি ও শক্তি বিষয়ে ওয়েবসাইটভিত্তিক কর্মপরিকল্পনার কথাও বললেন। সেই বিকেলের তির্যক আলোয় তার চোখের ঝিলিক গেঁথে গেল আমার হৃদয়ে।
ডয়েচে ভেলের স্টুডিওতে তাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছি জলবায়ু আলোচনা নিয়ে। সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন পরবর্তী কাভারেজের জন্য। প্রতিবেদনের জন্য তাকে আপডেট করতে হয়েছে টেলিফোনে বহুবার। কাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব বিষয়ে অনুষ্ঠান করবেন জানতে চেয়েছেন সবসময়। বন থেকে বনে, বন থেকে ঢাকায়, ঢাকা থেকে ঢাকায়, এমনকি জার্মানির বাইরে অন্যসব দেশেও যখন চলছিল জলবায়ু আলোচনা, ফেসবুক থেকে নম্বর জোগাড় করে ঠিক কল করে বসেছেন_ কী খবর?
স্ত্রী ফিরেছেন। হতবাক তিনি! তারও প্রশ্ন, কোন সাগর? তিনিই বললেন, ওই যে জার্মান কালচারাল সেন্টারে ডয়েচে ভেলের অনুষ্ঠানে আমাদের নিয়ে গেলেন, তিনি। মনে পড়ে গেল, অনেক দিন পর কোথাও থেকে ফিরেছি, ক্লান্ত এবং স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে থাকা উচিত। কিন্তু সাগর সরওয়ারের শ্রোতামণ্ডলীর জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে যেতেই হবে। খুব সহজ করে কথা বলতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে। অগত্যা তাদের নিয়ে হাজির হলাম সেখানে। স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে 'মাছরাঙা'তেও ডেকেছেন। গিয়েছি। তার চোখের ঝিলিক আমাকে নিয়ে গিয়েছে তার কাছে, বারবার।
সাগর সরওয়ার আর আমাকে ডাকবেন না কোথাও। ফোন করবেন না, এসএমএস করবেন না, ফেসবুক স্টেটাসে কমেন্ট করবেন না। আমাকে ধাওয়া করবেন না, জিজ্ঞেস করবেন না নোয়াখালীতে কার সঙ্গে কথা বলবেন বা খুলনা থেকে কার সাক্ষাৎকার নেবেন। সাংবাদিকতার প্রতি তার নিষ্ঠা, আমার কাজের প্রতি আমার আস্থা কাছাকাছি এনেছিল আমাদের দু'জনকে। তার পরিমণ্ডলে তিনি আমার মর্যাদার বিষয়ে ছিলেন সচেতন। হয়তো কাছের ভাবতেন। তাই পরামর্শও দিতেন। পেশাগত দায়বদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে বন্ধুত্বের মতো কিছু একটা হয়তো তৈরি হয়েছিল ব্যক্তিগত সময়ক্ষেপণে_ বাসা, রেস্টুরেন্ট, পার্ক, নদীর ধার, বিদেশ-দেশ, দিন ও রাতে।
হ্যাঁ, সাগর ভাই খুন হয়েছেন সস্ত্রীক। তিনি জার্মানিতে থাকলে তার স্ত্রী রুনির ক্যারিয়ারের কী হবে তা ভাবতেন গভীরভাবে। সাগর-রুনি দেশে ফিরে এলেন। দু'জনই খুন হলেন দেশের মাটিতে। সস্ত্রীক রওনা দিলাম তাদের শেষবার দেখতে। ভিড় ঠেলে তার বাসার দরজার সামনে দাঁড়ালাম। জুলফিকার আলী মানিক আমার হাতে চাপ দিয়ে শুধু নাম ধরে আমাকে সম্বোধন করলেন একবার। বুঝলাম লোকারণ্যে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। তবু দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর পুলিশ এলো ব্যাগ নিয়ে, সাগর-রুনিকে নিয়ে যাবে। শেষ দেখা হলো না! আমি ছুটলাম এয়ারপোর্টে।

জিয়াউল হক মুক্তা :আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অক্সফামের এশিয়া অঞ্চলের পলিসি কোঅর্ডিনেটর
zmukta@oxfam.org.uk

No comments

Powered by Blogger.