আরব কিসিঞ্জার by এম আবদুল হাফিজ

দোহা রাউন্ড বলে অভিহিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক কাতারের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে উপসাগরীয় রাজনীতিতে ক্ষুদ্র উপসাগরীয় উপদ্বীপ কাতার তার স্থান করে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক রাজনীতিতে দেশটির আমির হাম্মাদ বিন খলিফা আল থানির নাম একজন সক্রিয় কূটনীতিক আলোচকরূপে


ওপরে উঠে আসে। আল থানি ইতিমধ্যেই বিবদমান ফিলিস্তিনি উপদল হামাস এবং ফাতাহকে একত্রীভূত করতে পেরেছেন। তালেবানদের সঙ্গে মার্কিনিদের দর কষাকষিরও এক অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছেন তিনি। লিবিয়ার পুনর্জাগরণে গাদ্দাফির পতনে তিনিই ছিলেন প্রণোদনার উৎস। পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে এর কোনোটাই আশ্চর্য নয় এবং তাকে আরব বিশ্বের অনেকেই 'আরব কিসিঞ্জার' বলে অভিহিত করে। ষাট বছর বয়স্ক এ নরপতির উক্তিতে তিনি সবার সঙ্গেই বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়তে চান এবং বন্ধুত্বের এই দাবিতে প্রধান সাহায্যকারী তার স্ফীত ওয়ালেট বা থলে। যদিও তার প্রজ্ঞা তার মিত্রদের অনেককেই অনেক সময় অসন্তুষ্ট করে। বিষয়টিকে প্রাঞ্জল করেছেন একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান তার মূল্যায়নে_ ধরুন যে এই আমির সোমবারেই প্রচণ্ড এক মিত্র; কিন্তু মঙ্গলবার অর্থাৎ পরের দিনই তিনি অর্থ সাহায্য করলেন এক উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে। পালা করে পদাধিকারপ্রাপ্তির ব্যবস্থায় কাতার এখন আরব লীগের প্রেসিডেন্ট। সেখানে আমির চলমান 'আরব বসন্তের' প্রতি আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়ায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় অবস্থান নিয়েছেন। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে তিনি প্রথম আরব শাসক, যিনি তার দেশের দূতাবাস বন্ধ করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট আসাদকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। বিতর্কিত হলেও তিনিই সিরিয়ায় প্রয়োজনে সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন।
আমির আল থানি ব্রিটেনের স্যান্ডহাস্ট মিলিটারি একাডেমীর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১৯৯৫ সালে এবং তার পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। লিবিয়ার বিদ্রোহীদের জন্য তিনিই অস্ত্রের জোগান দিয়েছিলেন। তিনি দোহার সর্বাঙ্গীণ রূপান্তরে সংকল্পবদ্ধ এবং কাতারের রাজধানীতেই তার আনুকূল্যে প্রথম তালেবান লিয়াজোঁ অফিস ২০২২ সালের ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত হতে চলেছে। এ শ্রীহীন মরু উপদ্বীপ কাতারের বিপুল গ্যাসসম্পদই দুই শতাব্দী যাবৎ কাতারের শাসক বংশ আল থানির গোলগাল আমিরকে এনে দিয়েছে এত গুরুত্ব। এক সময়ে হেনরি কিসিঞ্জারের একটি উক্তি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য খুব প্রচলিত ছিল। তিনি বলতেন, মিসর ছাড়া আরবরা যুদ্ধ করতে অক্ষম। আবার সিরিয়াকে ছাড়া আরব বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। হামাদ বিন খলিফা আল থানি এখনও কোনো উক্তি না করলেও, তিনি আরব বিশ্বে যে কূটনীতির চর্চা করছেন তা তাকে ইতিমধ্যেই 'আরব কিসিঞ্জার' অভিধা এনে দিয়েছে। অথচ কাতার আরব বিশ্বের কোনো আহামরি দেশও নয়। আবার এক বন্ধু আশির দশকে কাতারে রাষ্ট্রদূত থাকার সুবাদে বেশ ক'বারই আমার দোহায় যাওয়া হয়েছে। এখানকার স্মরণীয় প্রাণীগুলোর আমার এখনও বৃহদাকার মরু ইঁদুরগুলোর কথা মনে আছে। এখানে প্রতিবেশী আমিরাত বা বাহরাইনের মতো এমন কোনো ল্যান্ডমার্ক নেই, যা বেকায়দায় পড়া কোনো পর্যটককে ছাড়া কাউকে আকর্ষণ করতে পারে। সেই কাতারেরই আজ রমরমা অবস্থা। শুধু 'ফ্লাইং কার্পেট' ডিপ্লোম্যাসির জন্যই নয়।
এখনকার শাসক যেভাবেই হোক বিশ্বের, বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলের নাড়ির স্পন্দন ধরতে পেরেছে। নিজেদের ওপরে টেনে তুলতে কাতারিদের কোনোকিছুতে অনীহা নেই_ তা পাশ্চাত্যের গোলামিই হোক বা ইসরায়েলের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক পাতানোই হোক। বিশ্বের মানচিত্রে যথাযথ স্থান করে নিতে বিশাল আয়তনের দরকার হয় না, জীবন সম্ভোগের উপকরণ সম্পন্ন দুবাইয়েরও দরকার নেই, ঐতিহ্য উত্তরাধিকারেরও দরকার নেই। এগুলোর কোনোটাই ইসরায়েলের নেই। তবুও এগিয়ে চলেছে। অবাক হওয়ার ঘটনাই বটে!

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.