বীর মুক্তিযোদ্ধাঃ তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না- ৩৩১

স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. তৈয়ব আলী, বীর প্রতীক। এক দুর্ধর্ষ গণযোদ্ধার কথা
মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের ঢাকার গেরিলা দলের সদস্য ছিলেন মো. তৈয়ব আলী। ঢাকা মহানগরের মাদারটেক ও আশপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা অপারেশন করে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

এর মধ্যে একটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গানবোটে আক্রমণ। ১৯৯৫ সালে তিনি মারা গেছেন। আমাদের সংগ্রাম চলবেই (ঢাকা ১৯৮৯, অপরাজেয় সংঘ) বইয়ে মো. তৈয়ব আলীর একটি অসম্পূর্ণ বয়ান আছে। তাতে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আমি মাছ ধরতাম। ঢাকা শহরে আম, কমলা, লিচু, ফল ফেরি করে বিক্রি করতাম। এককথায় ফেরিওয়ালা।
‘পুরো এপ্রিল মাস মাদারটেকে ছিলাম। মাঝেমধ্যে কলা বিক্রি করতে ঢাকা শহরে যেতাম। মে মাসের শেষে মাদারটেক থেকে হেঁটে ডেমরা গেলাম। সেখান থেকে বাসে নরসিংদী। মরিচা বাজার গেলাম লঞ্চে। তারপর একটানা হেঁটে ভারত। হাতীমারা ক্যাম্পে সন্ধ্যাবেলা পৌঁছালাম। দুই দিন পর আমাদের লাইন করে দাঁড় করানো হলো। সুবেদার বললেন, ঢাকা টাউন বা ঢাকার আশপাশ থেকে কেউ এসেছেন কি না, হাত তোলেন। আমরা দেড় শ জনের মতো ছিলাম। তিনজনই মাত্র হাত তুললাম।
‘মতিনগরে সাত দিন ট্রেনিং নিলাম। গ্রেনেড, এলএমজি, এমজি। আলম সাহেব আমাদের ট্রেনিং দিতেন। গ্রেনেডের পিন কীভাবে খুলতে-লাগাতে হয়। কী পজিশনে থ্রো করলে কত মিনিট পর বার্স্ট হয়।’
মো. তৈয়ব আলীর এরপরের বয়ান ওই বইয়ে ছাপা হয়নি। তবে মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা (ঢাকা ১৯৯৯, দিব্যপ্রকাশ) বইয়ে তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য আছে। তিনি লিখেছেন,
‘ছেলেটির নাম তৈয়ব আলী। লেখাপড়া নেই, থাকলে খুবই সামান্য। শক্ত গঠন এবং কিঞ্চিৎ স্থূল গড়নের বেঁটেখাটো। এ ছেলেটি ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছে ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় তাকে একটি এলএমজি দেওয়ার জন্য রীতিমতো অনুনয় করতে লাগল। পাশে আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে। এলএমজি তখন একটি দুষ্প্রাপ্য অস্ত্র। সাধারণত গেরিলা দলকে এ অস্ত্র দেওয়া হয় না। তৈয়ব আলী এমন সরলভাবে ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছে আকুতি-মিনতি করতে লাগল, যেন তিনি ইচ্ছে করলেই তাকে সেটি দিতে পারেন।
‘হায়দার মুচকি মুচকি হাসছেন। বললেন, “যুদ্ধ আগে কিছু করো। এলএমজি পাবে।” কিছুদিন পর তৈয়ব আলী গামছায় বেঁধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশের এক ক্যাপ্টেনকে হত্যা করে তার ব্যাজেজ অব র‌্যাংক, সাদা বেল্ট, লাল টুপি, বুট, পাউচসহ পিস্তল এনে ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছে উপস্থাপন করল। তারপর বলল, “স্যার, যুদ্ধ কইরা আইছি, এইবার এলএমজি দ্যান।”
‘তারও বেশ কিছুদিন পরের কথা। হায়দার তৈয়ব আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, “বল তো ২ ইঞ্চি মর্টারের গোলা কত দূর যায়?” তৈয়ব আলী সামনের পাহাড়ের নিচে ছোট একটি গাছ দেখিয়ে বলল, “স্যার, ওদ্দুর যাইব।” চার শ-সাড়ে চার শ গজ। হায়দার বললেন, “যদি বলতে পারো কীভাবে মারলে অত দূর গোলা যাবে, তবে তোমাকে মর্টার দিব।” তৈয়ব আলী বাম হাত আড়াআড়ি করে রেখে ডান হাত তার ওপর বাঁকা করে বলল, “এই রকম স্যার। মাঝামাঝি।”
‘অপূর্ব! ঠিক ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল। এরপর থিয়োরি অব স্মল আর্মস ফায়ার, হাই ট্রাজেকটরি উইপন ট্রেনিং, ক্যালকুলাস পড়ার কোনো প্রয়োজনই রইল না।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. তৈয়ব আলীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৩৬।
মো. তৈয়ব আলীর পৈতৃক বাড়ি ছিল ঢাকার ২৮ মধ্য মাদারটেকে। স্বাধীনতার পর পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে ৭৫ মধ্য মাদারটেকে ভাড়াবাড়িতে তিনি বসবাস করতেন। তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা এই ঠিকানায়ই বাস করেন। তাঁর বাবার নাম সোনা মিয়া, মা জোহরা বিবি। স্ত্রী হাজেরা বেগম। তাঁদের তিন ছেলে, তিন মেয়ে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com