বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পরনির্ভরশীলতা by তারেক শামসুর রেহমান
বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে এখন দিনের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে না। বিদ্যুতের চাহিদা যেখানে সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার মেগাওয়াট, সেখানে উৎপাদিত হচ্ছে চার হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। তাই ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। বিঘি্নত হচ্ছে শিল্পোৎপাদন ও সেই সঙ্গে সেচ ব্যবস্থাপনা।
সরকার এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে বলে দাবি করলেও এর হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা গত বছরের এপ্রিলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ছিল চার হাজার ১৩৯ মেগাওয়াট। এক বছর পরও যদি উৎপাদন চার হাজার ৪০০ মেগাওয়াট হয়, তাহলে সরকারের দাবি করা নতুন যোগ হওয়া এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গেল কোথায়? এ প্রশ্নের জবাব আমাদেরও নেই। বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবনাটা দিন দিন বাড়ছে। বিদ্যুৎ পাওয়া আমাদের অধিকার। নিত্যকার জীবনে এমন কোনো কাজ নেই, যা বিদ্যুৎ ছাড়া চলে। বিদ্যুৎ প্রাপ্তির বিষয়টি মানবাধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বোরো মৌসুমে সেচ সরবরাহ (সারা দেশে ৪৮ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি) অব্যাহত রাখা দরকার। সে জন্য সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। বলা হয়েছে, সেচের জন্য ২০ হাজারের বেশি সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে, যার জন্য প্রয়োজন হবে এক হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে সেখানেও সমস্যা তৈরি হয়েছে। সমস্যা মোকাবিলায় নতুন নতুন রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তা উৎপাদনে যেতে পারছে না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে, যার মধ্যে অর্ধেক নতুন ভাড়াভিত্তিক রেন্টাল তথা কুইক রেন্টাল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এখন বিদ্যুৎ শীর্ষে থাকা উচিত। গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে এবং নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হচ্ছে না। সুতরাং গ্যাসনির্ভর যে বিদ্যুৎকেন্দ্র তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাপানের ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও কথা উঠেছে। ভরসা এখন কয়লা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন, যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ)। এতে ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সম্ভব। উত্তরাঞ্চলের বড় পুকুরিয়ায় ছয়টি কয়লা স্তর (১১৯ থেকে ৫৬০ মিটার গভীরে) পাওয়া গেছে, যার মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লা খনিটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড় পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে কয়লা পাওয়া গেছে। অথচ সরকার ভারত থেকে কয়লা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতীয় কয়লায় চট্টগ্রাম ও খুলনায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। ব্যয় হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। জামালগঞ্জে সাতটি কয়লা স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা খনি এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার এবং আনুমানিক মজুদের পরিমাণ এক হাজার ৫৩ মিলিয়ন টন। এখানে কয়লা স্তরের গভীরতা বেশি হওয়ায় তা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক হবে কি না, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। ফলে এ মজুদের উন্নয়নের কাজ শুরু হয়নি। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লা খনি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখানে কয়লা মজুদের পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা এশিয়া এনার্জি করপোরেশন (বাংলাদেশ)। খনির মেয়াদকালে মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ফুলবাড়ী কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলার কথা, যা ইতিমধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ খনির বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা হবে ১৫ মিলিয়ন টন। এই কয়লা খনির দৈর্ঘ্য আট কিলোমিটার (উত্তর-দক্ষিণে) এবং প্রস্থ তিন কিলোমিটার (পূর্ব-পশ্চিমে)। এই খনিটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬৫-২৭০ মিটার গভীরে অবস্থিত।
এসব কয়লা খনি নিয়ে আমাদের দেশে একটি বড় বিতর্ক চলছে_আর তা হলো, কয়লা আমরা তুলব কিভাবে : ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে? উন্মুক্ত পদ্ধতির ব্যাখ্যা পয়েন্ট হলো_এ পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড বা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ। এতে ঝুঁকিও বেশি। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। অল্প জমিতে প্রচুর মানুষ বাস করে। তাই সমস্যা হচ্ছে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তুলতে হলে অনেকে জমি হারাবে। ফুলবাড়ী কয়লা খনি প্রকল্পের জন্য প্রায় পাঁচ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে, এর প্রায় ৮০ শতাংশই কৃষিজমি। প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে প্রকল্পকালে প্রায় দুই হাজার ৩০০ আদিবাসীসহ প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ও পুনর্বাসন করতে হবে। এ কাজটি ১০ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এখানে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা। বলা হয়ে থাকে, ফুলবাড়ী কয়লা খনি প্রকল্প চালু হলে প্রতিবছর জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ সংযোজন হতে পারে। প্রকল্পের মেয়াদকালে জিডিপিতে অবদান রাখবে প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ফুলবাড়ীর জনগণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিরোধিতা করে আসছে প্রথম থেকেই। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী কয়লা খনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ছয়জন। এশিয়া এনার্জির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, তারও বিরোধিতা করছে একটি জাতীয় কমিটি। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলন নিয়ে যে জটিলতা, সেই জটিলতা এখনো দূর হয়নি। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির বৈঠকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। তারা কয়লানীতি দ্রুত চূড়ান্ত করারও সুপারিশ করেছে। এই যখন পরিস্থিতি এবং যেখানে দেশে প্রচুর কয়লা সম্পদ রয়েছে, সেখানে বিদেশ (ভারত) থেকে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত_এ প্রশ্ন করাই যায়। এতে ভারতের ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। ভবিষ্যতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যদি অবনতি ঘটে, তাহলে এই কয়লা আমদানির ওপর তা কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, আমরা জানি না। বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা দেশ দুটি সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এ ক্ষেত্রে ভারত যা ব্যয় করবে, তা তুলে নেবে কিভাবে? এই চুক্তি বহাল থাকবে কত বছরের জন্য? এসব বিষয় বিস্তারিত জানা দরকার। দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে কি না? তৃতীয়ত, ভারতীয় ঋণ শোধ করার প্রক্রিয়াটি কী? চতুর্থত, যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে কোনো তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি রয়েছে কি না?
ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ আমাদের জন্য একটি আশার আলো। কিন্তু যেহেতু দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে, সেহেতু এই চুক্তি যেন আমাদের 'গলার কাঁটা' হয়ে না দাঁড়ায়! একই সঙ্গে সংসদীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার যে সুপারিশ করেছে, আমি তাকে স্বাগত জানাই। তবে ফুলবাড়ীর মানুষের কথা মনে রাখতে হবে। কয়লা সম্পদের ভাগীদার তারাও। পুনর্বাসনই শুধু নয়, চাকরিবাকরির ক্ষেত্রেও তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফুলবাড়ীর কয়লা সম্পদের 'হক' তাদের আছে। এই হক থেকে তাদের আমরা বঞ্চিত করতে পারি না। রাষ্ট্র এ অঞ্চলের সম্পদ জাতীয় উন্নয়নে ব্যয় করবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা। দেশে ইতিমধ্যে একটি 'জাতীয় কমিটি' গঠিত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই দেশের জ্বালানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশের কয়লা ব্যবহার না করে কেন ভারতীয় কয়লা আমদানি করব_এর একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। কেননা আমরা জানি, ভারতীয় কয়লায় পরিবেশ দূষণ হয় সবচেয়ে বেশি। সে তুলনায় আমাদের কয়লার মান অনেক ভালো। মনে রাখতে হবে, যেখানে সারা বিশ্বে বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৭৯, চীনে ৭৮, জার্মানিতে ৪৯ কিংবা ভারতে ৬৯ শতাংশ; সেখানে আমাদের কয়লা সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারছি না। বাংলাদেশে ২০১২ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ হাজার মেগাওয়াট; আর ২০২০ সালে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট। তখন কয়লা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। সে ক্ষেত্রেও কয়লা সম্পদ আমাদের জন্য একটি ভরসা। কিন্তু এই কয়লা সম্পদকে ব্যবহার না করে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কয়লা আমদানি করলে বিতর্ক তো বাড়বেই। সব ব্যাপারেই পরনির্ভরশীলতা কেন?
বিদ্যুৎ সংকট রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াবে। বছরের শুরুতেই হরতাল দিয়ে 'রাজনীতির যাত্রা' শুরু হয়েছে। বিরোধী দল ইস্যু খুঁজছে। আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ বন্ধ হয়েছে। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। লোডশেডিং এখন নিত্যদিনের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। 'লোড ম্যানেজমেন্ট'-এর বিষয়টি বেশ জরুরি। যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তার সদ্ব্যবহার যেন আমরা করতে পারি। অপচয় বন্ধ হওয়া দরকার জাতীয় স্বার্থেই। প্রয়োজনে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ব্যাপারে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবেই। এটা মেনে নিয়েই গ্রীষ্মে একটি সুষ্ঠু 'লোড ম্যানেজমেন্ট' ব্যবস্থা দরকার।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এখন বিদ্যুৎ শীর্ষে থাকা উচিত। গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে এবং নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হচ্ছে না। সুতরাং গ্যাসনির্ভর যে বিদ্যুৎকেন্দ্র তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাপানের ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও কথা উঠেছে। ভরসা এখন কয়লা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন, যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ)। এতে ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সম্ভব। উত্তরাঞ্চলের বড় পুকুরিয়ায় ছয়টি কয়লা স্তর (১১৯ থেকে ৫৬০ মিটার গভীরে) পাওয়া গেছে, যার মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লা খনিটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড় পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে কয়লা পাওয়া গেছে। অথচ সরকার ভারত থেকে কয়লা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতীয় কয়লায় চট্টগ্রাম ও খুলনায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। ব্যয় হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। জামালগঞ্জে সাতটি কয়লা স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা খনি এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার এবং আনুমানিক মজুদের পরিমাণ এক হাজার ৫৩ মিলিয়ন টন। এখানে কয়লা স্তরের গভীরতা বেশি হওয়ায় তা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক হবে কি না, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। ফলে এ মজুদের উন্নয়নের কাজ শুরু হয়নি। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লা খনি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখানে কয়লা মজুদের পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা এশিয়া এনার্জি করপোরেশন (বাংলাদেশ)। খনির মেয়াদকালে মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ফুলবাড়ী কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলার কথা, যা ইতিমধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ খনির বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা হবে ১৫ মিলিয়ন টন। এই কয়লা খনির দৈর্ঘ্য আট কিলোমিটার (উত্তর-দক্ষিণে) এবং প্রস্থ তিন কিলোমিটার (পূর্ব-পশ্চিমে)। এই খনিটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬৫-২৭০ মিটার গভীরে অবস্থিত।
এসব কয়লা খনি নিয়ে আমাদের দেশে একটি বড় বিতর্ক চলছে_আর তা হলো, কয়লা আমরা তুলব কিভাবে : ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে? উন্মুক্ত পদ্ধতির ব্যাখ্যা পয়েন্ট হলো_এ পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড বা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ। এতে ঝুঁকিও বেশি। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। অল্প জমিতে প্রচুর মানুষ বাস করে। তাই সমস্যা হচ্ছে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তুলতে হলে অনেকে জমি হারাবে। ফুলবাড়ী কয়লা খনি প্রকল্পের জন্য প্রায় পাঁচ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে, এর প্রায় ৮০ শতাংশই কৃষিজমি। প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে প্রকল্পকালে প্রায় দুই হাজার ৩০০ আদিবাসীসহ প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ও পুনর্বাসন করতে হবে। এ কাজটি ১০ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এখানে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা। বলা হয়ে থাকে, ফুলবাড়ী কয়লা খনি প্রকল্প চালু হলে প্রতিবছর জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ সংযোজন হতে পারে। প্রকল্পের মেয়াদকালে জিডিপিতে অবদান রাখবে প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ফুলবাড়ীর জনগণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিরোধিতা করে আসছে প্রথম থেকেই। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী কয়লা খনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ছয়জন। এশিয়া এনার্জির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, তারও বিরোধিতা করছে একটি জাতীয় কমিটি। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলন নিয়ে যে জটিলতা, সেই জটিলতা এখনো দূর হয়নি। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির বৈঠকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। তারা কয়লানীতি দ্রুত চূড়ান্ত করারও সুপারিশ করেছে। এই যখন পরিস্থিতি এবং যেখানে দেশে প্রচুর কয়লা সম্পদ রয়েছে, সেখানে বিদেশ (ভারত) থেকে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত_এ প্রশ্ন করাই যায়। এতে ভারতের ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। ভবিষ্যতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যদি অবনতি ঘটে, তাহলে এই কয়লা আমদানির ওপর তা কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, আমরা জানি না। বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা দেশ দুটি সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এ ক্ষেত্রে ভারত যা ব্যয় করবে, তা তুলে নেবে কিভাবে? এই চুক্তি বহাল থাকবে কত বছরের জন্য? এসব বিষয় বিস্তারিত জানা দরকার। দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে কি না? তৃতীয়ত, ভারতীয় ঋণ শোধ করার প্রক্রিয়াটি কী? চতুর্থত, যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে কোনো তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি রয়েছে কি না?
ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ আমাদের জন্য একটি আশার আলো। কিন্তু যেহেতু দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে, সেহেতু এই চুক্তি যেন আমাদের 'গলার কাঁটা' হয়ে না দাঁড়ায়! একই সঙ্গে সংসদীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার যে সুপারিশ করেছে, আমি তাকে স্বাগত জানাই। তবে ফুলবাড়ীর মানুষের কথা মনে রাখতে হবে। কয়লা সম্পদের ভাগীদার তারাও। পুনর্বাসনই শুধু নয়, চাকরিবাকরির ক্ষেত্রেও তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফুলবাড়ীর কয়লা সম্পদের 'হক' তাদের আছে। এই হক থেকে তাদের আমরা বঞ্চিত করতে পারি না। রাষ্ট্র এ অঞ্চলের সম্পদ জাতীয় উন্নয়নে ব্যয় করবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা। দেশে ইতিমধ্যে একটি 'জাতীয় কমিটি' গঠিত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই দেশের জ্বালানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশের কয়লা ব্যবহার না করে কেন ভারতীয় কয়লা আমদানি করব_এর একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। কেননা আমরা জানি, ভারতীয় কয়লায় পরিবেশ দূষণ হয় সবচেয়ে বেশি। সে তুলনায় আমাদের কয়লার মান অনেক ভালো। মনে রাখতে হবে, যেখানে সারা বিশ্বে বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৭৯, চীনে ৭৮, জার্মানিতে ৪৯ কিংবা ভারতে ৬৯ শতাংশ; সেখানে আমাদের কয়লা সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারছি না। বাংলাদেশে ২০১২ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ হাজার মেগাওয়াট; আর ২০২০ সালে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট। তখন কয়লা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। সে ক্ষেত্রেও কয়লা সম্পদ আমাদের জন্য একটি ভরসা। কিন্তু এই কয়লা সম্পদকে ব্যবহার না করে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কয়লা আমদানি করলে বিতর্ক তো বাড়বেই। সব ব্যাপারেই পরনির্ভরশীলতা কেন?
বিদ্যুৎ সংকট রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াবে। বছরের শুরুতেই হরতাল দিয়ে 'রাজনীতির যাত্রা' শুরু হয়েছে। বিরোধী দল ইস্যু খুঁজছে। আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ বন্ধ হয়েছে। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। লোডশেডিং এখন নিত্যদিনের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। 'লোড ম্যানেজমেন্ট'-এর বিষয়টি বেশ জরুরি। যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তার সদ্ব্যবহার যেন আমরা করতে পারি। অপচয় বন্ধ হওয়া দরকার জাতীয় স্বার্থেই। প্রয়োজনে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ব্যাপারে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবেই। এটা মেনে নিয়েই গ্রীষ্মে একটি সুষ্ঠু 'লোড ম্যানেজমেন্ট' ব্যবস্থা দরকার।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments