সপ্তাহের হালচাল-‘হস্তক্ষেপমুক্ত জীবন, অবারিত সুযোগ’ by আব্দুল কাইয়ুম

ইউনিভার্সিটি হাইটস এলাকাটি অপেক্ষাকৃত শান্ত, নিরিবিলি। স্যান ডিয়েগো নগরের কেন্দ্র থেকে সামান্য দূরে। পার্ক বুলেভার্ড রোডে টুইগস কফি শপে বসে আমার ল্যাপটপে লিখছি। চমৎকার পরিবেশ। হালকা সুর ভেসে আসছে। ছোট ছোট টেবিল পাতা, একজন বা দুজন বসতে পারে। ল্যাপটপে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা ঘরজুড়েই আছে।


এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের প্রায় সবাই কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার বা ছোটগল্পের লেখক। কিছু ছাত্রও আসে। এ মুহূর্তে অপরিসর ঘরে প্রায় ১৫ জন যাঁর যাঁর ল্যাপটপে লিখছেন। বাইরে প্রশস্ত ফুটপাতের পাশ ঘেঁষে টেবিল পাতা আছে। সেখানেও লেখালেখি চলছে। একজন লেখার ফাঁকে ফাঁকে পাশে রাখা গিটারটা তুলে নিচ্ছেন। টুংটাং ধ্বনি বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। পরক্ষণেই লেখায় মগ্ন হয়ে পড়ছেন। কফি খাচ্ছেন। চিন্তা করছেন। আবার লিখছেন।
সৈয়দ শামসুল হক তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ঢাকার রায়সাবাজারে মুকুল সিনেমা হলের (এখন আজাদ) পাশে মিরান্ডা রেস্টুরেন্টে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে কবি-সাহিত্যিকেরা যেতেন, অনেক সাড়া জাগানো গল্প-উপন্যাস তাঁরা ওখানেই লিখেছেন। ষাটের দশকে আমিও সেখানে যেতাম—মাঝেমধ্যে, স্কুল পালিয়ে। নওয়াবপুর রেলগেটের কাছে ছোট রেস্টুরেন্ট ক্যাপিটালে সন্ধ্যায় মোগলাই পরোটা খাওয়ার আসর বসত। গুলিস্তানে রেক্সে যেতাম কাবাব-পরোটা খেতে। চায়নিজ খেতে যেতাম চু চিন চাওয়ে। সেসব জায়গায় অনেক গুণীজনের সঙ্গে দেখা হতো। আজ স্যান ডিয়েগোতেও ও রকম একটা রেস্টুরেন্টে বসেছি।
ভাবলাম, এখানেও হয়তো কোনো বিখ্যাত ঔপন্যাসিক রচনা করছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কোনো উপন্যাস। কাউন্টারে কাজে মগ্ন এক তরুণী, নাম কোর্টনি। জিজ্ঞেস করলাম, কারা আসে এখানে? একটু হেসে বলল, সবাই লেখক। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানির লেখকেরাও আসেন। বিদেশি প্রখ্যাতদের জন্য সপ্তাহে দুদিন বাঁধা। সে আরও উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘শনিবার সন্ধ্যায় এসো, দারুণ মজা পাবে।’ কী রকম? সে বলল, প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় এখানে কৌতুকের আসর বসে। পাঁচজন রম্যলেখক তাঁদের রচিত কৌতুক পড়ে বা অভিনয় করে পরিবেশন করেন। আমি কোনো কৌতুক শোনাতে পারব কি না, জিজ্ঞেস করলাম। সে জানাল, শ্রোতাদের সারি থেকে কিছু সুযোগ আমিও পেতে পারি!
কোর্টনিকে জিজ্ঞেস করলাম, আমেরিকান জীবন কেমন, এককথায় বলতে পারো? সে একটুও না ভেবে বলল, বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ নেই, অবারিত সুযোগ! বললাম, দুশ্চিন্তা নেই? সে বলল, ‘ও হো, আছে তো বটেই।’ কিন্তু তার পরও জীবন আবেগময়, উত্তেজনাপূর্ণ।’ বললাম, আর কিছু বলার আছে? একমুহূর্ত ভেবে বলল, ‘আমার মনে হয় এখানে স্বর্গ। আমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে সপ্তাহান্তে বেরিয়ে পড়ি, সৌন্দর্য উপভোগ করি।’
সেদিন সন্ধ্যায় ব্রডওয়ে থিয়েটার দেখে বের হয়েছি। একসঙ্গে সবাই ভিড় করেছে লিফটের জন্য। বহুতল ভবনের পার্কিংয়ে গাড়ি রাখা হয়েছে। এ জন্য যেতে হবে নবম তলায়। লিফট আসছে না। তৃতীয় তলায় আটকে আছে। সম্ভবত বেশি লোক চাপাচাপি করে ওঠায় এ অবস্থা। লিফটকর্মী নেই। অন্য তিনটা লিফটেও প্রায় একই অবস্থা। অপেক্ষমাণ লোকদের মধ্যে একটা গুঞ্জন। একটা লিফট মাঝপথে কিছুক্ষণ থেমে থেকে ফিরে এল। দরজা খুলতেই সবাই হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ল। তাঁদের মধ্যে দু-একজন স্বগতোক্তি করলেন, লিফট বোধহয় নষ্ট। অনেকে ইতিমধ্যে সিঁড়িতে উঠতে শুরু করেছেন। কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করলেন না। উঁচু গলায় কারও কোনো অভিযোগ শোনা গেল না। কেউ কাউকে দায়ী করলেন না। তাঁরা এসব স্বাভাবিকভাবে নিতেই অভ্যস্ত। মনে হয়, তাঁরা যুক্তি দিয়ে আশ্বস্ত হয়েছেন যে বেশি লোক উঠলে তো এ রকম হবেই, লিফটের কী দোষ! আর এ জন্য কাউকে দায়ী করে সময় নষ্ট না করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়াই ভালো।
ব্রডওয়ে শো নিউইয়র্কেও দেখেছি কয়েক বছর আগে। সেদিন বিখ্যাত মঞ্চনাটক শিকাগো দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। এখানে দেখলাম মেরি পপিনস। অসাধারণ! আধুনিক প্রযুক্তি যে মঞ্চনাটককে এত প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। নিউইয়র্কে শিকাগো নাটকেও দেখেছি একই ব্যাপার। আর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, নাটকের একটি দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে যাওয়ার সময় কোনো ছেদ পড়ে না। বাচ্চাদের শোবার ঘরে নাটকের এক দৃশ্য থেকে নিমেষে চলে যাচ্ছে গাছপালায় ঘেরা পার্কে; কখনো কারখানায়—শ্রমিকদের কর্মমুখর দৃশ্যে। নাটকের পটপরিবর্তন নিখুঁতভাবে চলেছে। আমরা বুঝতেই পারছি না, কীভাবে কী হয়ে যাচ্ছে। সবই আধুনিক প্রযুক্তির অবদান।
আনন্দের উপকরণ থাকাই যথেষ্ট নয়, তা উপভোগ করার মনও গড়ে তুলতে হয়। লিফটের জন্য যে মানুষ অধৈর্য হয়ে উঠল না অথবা দর্শকের ভিড়ের কারণে মাসের পর মাস যে নাটকের টিকিট পাওয়া যায় না, এর পেছনে মার্কিন সমাজের একটা সচেতন চেষ্টা আছে। ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের গড়ে তোলা হয়। মেরি পপিনস নাটকটি বাচ্চাদের জন্য, আবার বড়দের জন্যও। এটি একটি রূপকথা। এক পরিবারের বাচ্চাদের নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ শিক্ষার জন্য যে গভর্নেস (গৃহশিক্ষিকা) রাখা হয়েছে, তিনি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন। কাউকে তা জানতে দেননি। মানুষকে সম্মান করা, গরিবদের ভালোবাসা, পরিবারের বিভিন্ন সমস্যা ধৈর্য নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা প্রভৃতি খুব সহজভাবে শেখালেন। পপিনস যখন নিশ্চিত হলেন যে এবার বাচ্চারা নিজেরাই ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে পারবে, তখন একদিন আবার আকাশে উড়ে গেলেন। মা-বাবা তাঁদের বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন এই নাটক দেখতে। ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত্তি শক্ত করে গড়ে তোলার প্রতি মা-বাবারা মনোযোগী হন।
বাচ্চাদের মানুষ করার চমৎকার পদ্ধতি রয়েছে এদের। ওরা কখনো শিশুদের কোনো কাজে বাধা দেয় না। পার্কে নিয়ে ছেড়ে দেয়, বাচ্চারা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। মা-বাবারা শুধু কাছে থেকে চোখ রাখেন। কোনো বাচ্চাকে মা-বাবার কাছে ধমক খেতে হয় না। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে বাচ্চাকে একটা উঁচু চেয়ারে বসিয়ে আলাদা পাত্রে তাদের জন্য খাবার দেন। তারপর শিশু তার ইচ্ছেমতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেতে থাকে। সমুদ্রসৈকতে বাচ্চারা ঠান্ডা পানিতে ইচ্ছেমতো হেঁটে বেড়ায়। মা তাকে ধমকে উঠিয়ে নেন না। অবশ্য নিরাপত্তার ব্যাপারটা প্রথমেই নিশ্চিত হয়ে নেন।
পার্কে দেখেছি, মা-বাবা বসে বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করছেন আর তাঁদের দুই বছরের শিশু মাঠের ঘাস তুলে খাচ্ছে। কারও খেয়াল নেই। যখন নজরে পড়ল, বাচ্চাকে আস্তে করে তুলে এনে মুখ থেকে ঘাসগুলো বের করে আবার ছেড়ে দিলেন। সেই ঘাস একেবারে মধুর, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। মাঠে সবার কুকুর ঘুরে বেড়ায় এবং যথারীতি বিষ্ঠা ত্যাগ করে। কুকুরের মালিক তা পরিষ্কার করেন বটে, কিন্তু ময়লা তো কিছু থেকেই যায়। বাচ্চারা মা-বাবার চোখের সামনে নির্ভয়ে সেই ঘাস চিবোয়। এ জন্য বকুনি খেতে হয় না। মা-বাবার কাজ হলো শুধু চোখ রাখা, যেন বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে।
ছোটবেলা থেকে নিজেদের অভিজ্ঞতায় ভালো-মন্দ বুঝতে শেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব সময় যদি শুধু ‘না’, ‘না’ শুনতে হয় আর নীতিবাক্য মুখস্থ করতে হয়, তাহলে শিশুর মন তা আত্মস্থ করতে চায় না। আমাদের দেশে শিশুশিক্ষার এই দিকগুলো তেমন গুরুত্ব পায় না।
হয়তো কেউ বলবেন, উন্নত আধুনিক দেশে এসব চলে, আমাদের মতো গরিব দেশে ওসব অচল। এটা নিশ্চয়ই সত্য। বাস্তবতার একটি দিক। কিন্তু তার পরও আমাদের মতো করে একটা পথ তো বের করতে হবে। শিশুদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। আমাদের রয়েছে প্রাচ্যদেশীয় মায়া-মমতায় ঘেরা পারিবারিক শিক্ষার এক বিশাল ঐতিহ্য। আর অন্যদিকে রয়েছে আধুনিক বিশ্বের অভিজ্ঞতা। দুইয়ের সুনিপুণ সম্মিলন প্রয়োজন।
সমাজে শৃঙ্খলা আপনাআপনি আসে না। সচেতন উদ্যোগ নিতে হয়। আমেরিকায় শ দুয়েক বছর আগে সরকারি উদ্যোগে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষকে গ্রামে গ্রামে পাঠানো হতো। তাঁরা সমাজে মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য কাজ করে গেছেন। দুদিন আগে ঢাকার গাবতলীতে বাসচালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ ঘেরাও হয়ে পড়েছিল। পরিবহনশ্রমিকদের দাবি, দু-চার বছর ‘ডেরাইভারি’ করলেই তো ড্রাইভার, তাদের লাইসেন্স না দেওয়া হলে সেটা কর্তৃপক্ষের দোষ, ‘ড্রাইভারদের’ নয়। নকল লাইসেন্সের জন্য তাদের জেল দেওয়া যাবে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ওদের হাতে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীররা মারা যাবেন, কিন্তু কিছু বলা যাবে না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না! আর আমাদের মন্ত্রীরা এসব সস্তা চিন্তাভাবনাকে উসকে দিচ্ছেন।
দুদিন আগে প্রবাসী বাঙালিদের ইফতার পার্টিতে গিয়েছিলাম। কথা হচ্ছিল কামাল সাহেবের সঙ্গে। মেয়েদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, পরদিনই ঢাকায় ফিরে যাবেন। তিনি বললেন, আমাদের দেশের মন্ত্রীরা যদি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কষ্ট দূর করতে মনোযোগী হতেন!
সেদিক থেকে ভাবলে কোর্টনির কথাগুলো আমাদের দেশের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়। কবে হাসিমুখে বলতে পারব যে আমাদেরও রয়েছে হস্তক্ষেপমুক্ত জীবন, অবারিত সুযোগ। আমাদের হয়তো আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে সেই দিনের জন্য।
স্যান ডিয়েগো থেকে, ২২ আগস্ট ২০১১
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.