স্থানীয়সরকার-সংবিধান না মানাও সংবিধানের প্রতি অবমাননা by বদিউল আলম মজুমদার
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাসের পর বেগম খালেদা জিয়া সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এটি রাজনৈতিক বক্তব্য হলেও নিন্দনীয়। এর মাধ্যমে সংবিধানকে, যা দেশের সর্বোচ্চ আইন, অবমাননা করা হয়েছে। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন।
তবে স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকেই সংবিধান নিয়ে আরও একটি বড় ধরনের গর্হিত কাজ চলে আসছে, যা সংবিধানের প্রতি আরও বেশি অবমাননাকর। সেটি হলো ইচ্ছাকৃতভাবে সংবিধান এবং সংবিধানের ব্যাখ্যাসংবলিত উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করা। এর মাধ্যমে সাংবিধানিক তথা আইনের শাসন ব্যাহত করা হয়। পক্ষান্তরে, সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার হুমকি একটি ফাঁকা বুলি। আর ফাঁকা বুলি উচ্চারণ যদি দেশদ্রোহ হয়, তাহলে স্বজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় সংবিধান ও আদালতের রায় না মানা, তথা সংবিধানের অবমাননা দেশদ্রোহ হবে না কেন? এ ক্ষেত্রে পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত ৭ক অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকেই দেশে সংবিধান ও আদালতের নির্দেশ অমান্য করার মহোৎসব চলছে। এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হলো সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অমান্য করা। বাহাত্তরের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর স্থানীয় সরকারসম্পর্কিত ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের (১) উপ-অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সব প্রশাসনিক একাংশ বা স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ, সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশকে ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে জেলায় নির্বাচিত জেলা পরিষদ, উপজেলায় নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ, মহানগরে নির্বাচিত সিটি করপোরেশন এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক ‘স্থানীয় শাসন’ পরিচালনা করাই আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশনা।
স্থানীয় শাসন বলতে বোঝায়, সংবিধানের ৫৯(২) অনুযায়ী, প্রশাসন ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্য পরিচালনা করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং পাবলিক সার্ভিস বা জনকল্যাণমূলক সব সরকারি সেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নসম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। অন্যভাবে বলতে গেলে, কেন্দ্রীয় সরকার যেমন পরিচালিত হয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা, তেমনিভাবে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোও পরিচালিত হওয়ার কথা নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে।
সংবিধানের এ বিধান উপেক্ষা করা মানে সংবিধানকে অবমাননা করা। এটি করা হয় দুভাবে। প্রথমত, নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (যেমন জেলা পরিষদ) গঠন না করে; দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংবিধানের ৫৯(২) অনুচ্ছেদে নির্ধারিত দায়দায়িত্ব না দিয়ে বা সেগুলোকে (যেমন উপজেলা পরিষদ) কার্যকর হতে বাধা প্রদান করে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এবং ১৯৯২ থেকে এখন পর্যন্ত সব সরকার—যে সময়কালে সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ বলবৎ ছিল বা আছে—সংবিধানকে লঙ্ঘন করে আসছে।
সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে ১৫২ অনুচ্ছেদের সম্পৃক্ততা রয়েছে—১৫২ অনুচ্ছেদে প্রশাসনিক একাংশ বা স্তরের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘‘‘প্রশাসনিক একাংশ” (স্তর) অর্থ জেলা কিংবা এই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য-সাধনকল্পে আইনের দ্বারা অভিহিত অন্য কোন এলাকা।’ অর্থাৎ সাংবিধানে জেলাকে প্রশাসনিক একাংশ ঘোষণা করায় জেলা পরিষদ নির্বাচন করা সাংবিধানিকভাবে বাধ্যতামূলক। প্রসঙ্গত, সংসদে প্রণীত আইনের দ্বারা উপজেলা, ইউনিয়ন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ঘোষিত।
শুধু সংবিধান লঙ্ঘনই নয়, ১৯৯২ সালের পরবর্তী সরকারগুলো স্থানীয় সরকারের নির্বাচনসম্পর্কিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ‘কুদরত-ই-ইলাহী বনাম বাংলাদেশ’ রায়কেও অমান্য করে আসছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯১ সালে উপজেলা পরিষদ বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক সর্বসম্মত রায়ে ছয় মাসের মধ্যে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিয়েছিলেন; সুপ্রিম কোর্টের রায় আইনের সমতুল্য হওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি জেলা পরিষদের নির্বাচন করা হয়নি এবং বর্তমানে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দলীয় রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করার আরও একটি দৃষ্টান্ত বর্তমান সরকার সৃষ্টি করেছে। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘জেলা মন্ত্রী’র পদ সৃষ্টি করা হয়। ‘আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ [১৬বিএলটি (এএইচসিডি) (২০০৮)]’ মামলার রায়ে ২০০৬ সালে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ প্রজ্ঞাপনটিকে—অর্থাৎ জেলা মন্ত্রী পদকে —অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। একই সঙ্গে সাংসদদের জেলা ও উপজেলা তথা তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় উন্নয়ন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে জড়িত হওয়া অবৈধ ঘোষণা করেন। সংবিধান ও আদালতের এ নির্দেশ অমান্য করে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের ওপর সাংসদদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদ সংবিধান ও সাংবিধানিক বিধানসম্পর্কিত আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারে না। এ ছাড়া সরকার বিরোধী দলের আসনগুলোতে উন্নয়ন তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের।
সংবিধান লঙ্ঘনের আরেকটি ঘটনা হলো ক্ষমতাপ্রাপ্তদের শপথ লঙ্ঘন। সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ পালনকল্পে সাংসদসহ রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের শপথ গ্রহণ করতে হয়। সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে অন্তর্ভুক্ত বিধান অনুযায়ী, শপথের ছক হলো: ‘আমি, ...সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন-অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি-পদের কর্তব্য/ সরকারের প্রধানমন্ত্রী (কিংবা ক্ষেত্রমত মন্ত্রী, প্রতি-মন্ত্রী বা উপ-মন্ত্রী)-পদের কর্তব্য/ সংসদের স্পীকারের কর্তব্য (এবং কখনও আহুত হইলে রাষ্ট্রপতির কর্তব্য)/ সংসদের ডেপুটি স্পীকারের কর্তব্য (এবং কখনও আহুত হইলে স্পীকারের কর্তব্য) বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; ... আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’ প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি, প্রধান ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকসহ সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যদেরও একই ধরনের শপথ গ্রহণ করতে হয়। তবে সাংসদদের একটু ভিন্ন ধরনের শপথ গ্রহণ করতে হয়। তাঁদের ঘোষণা করতে হয়, ‘সংসদ-সদস্যরূপে আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না।’
দুর্ভাগ্যবশত, প্রায় প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীনদের অনেকেই শপথ ভঙ্গ করেন। যার মধ্যে রয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে দলীয় বিবেচনায় অবৈধ সুবিধা প্রদান ও পক্ষপাতিত্ব, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দলীয়করণ ‘অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী’ হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। দলতন্ত্র ও জেলাতন্ত্রের অসংখ্য ঘটনা দৃশ্যমান নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে। ফলে অনেক যোগ্য ব্যক্তি চাকরির সুযোগ এবং পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
পক্ষপাতিত্বের আরেকটি উদাহরণ— রাজনৈতিক বিবেচনায় যে সাত সহস্রাধিক মামলা বর্তমান সরকার প্রত্যাহার করেছে, যাতে খুনের মামলাও রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মাত্র দুটি মামলা। বলা বাহুল্য, একই ধরনের কাজ করেছিল চারদলীয় জোট সরকারও। এ ধরনের মামলা প্রত্যাহার আইনের শাসনের পরিপন্থী।
এ কথা সবারই জানা, আমাদের মাননীয় সাংসদদের অনেকেই সাংসদের পদ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন এবং শপথ ভঙ্গ করে ‘ব্যক্তিগত স্বার্থ’ সিদ্ধি করছেন। সাংসদদের আবার কেউ কেউ আইন ভঙ্গ করে সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছেন—সরকারের সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিরা সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণেরই অযোগ্য। আবার ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতি লঙ্ঘন করে কিছু কিছু সাংসদকে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিতে দেখা যায়, যা সাংবিধানিক কাঠামোর পরিপন্থী।
এটি সুস্পষ্ট যে সংবিধান ও সংবিধানের ব্যাখ্যাসম্পর্কিত আদালতের রায় অমান্য করে বিভিন্ন সময়ে আমাদের সরকারগুলো সংবিধান তথা আইনের শাসনের প্রতি মানুষের অনাস্থা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করে আসছে। দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর মনে আজ সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব ও এর অলঙ্ঘনীয়তা নিয়ে—বিশেষত, এ ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা সম্পর্কে—সংশয় দেখা দিয়েছে। সংবিধান ও আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। এমনকি, মহাজোটের শরিক এরশাদও সম্প্রতি বর্তমান সরকার সম্পর্কে দাবি করেছেন, ‘আইন, সরকার ও পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা নেই’ (যায়যায়দিন, ১ আগস্ট ২০১১)।
আর সম্প্রতি পাস করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, অসাংবিধানিকভাবে সংবিধানের প্রতি মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ। সংশোধনীর ৭ক অনুচ্চ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়—...(খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’
তাই, সংবিধান অবমাননার জন্য ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও ৭ক প্রয়োগ করা যায় বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকেই দেশে সংবিধান ও আদালতের নির্দেশ অমান্য করার মহোৎসব চলছে। এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হলো সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অমান্য করা। বাহাত্তরের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর স্থানীয় সরকারসম্পর্কিত ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের (১) উপ-অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সব প্রশাসনিক একাংশ বা স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ, সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশকে ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে জেলায় নির্বাচিত জেলা পরিষদ, উপজেলায় নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ, মহানগরে নির্বাচিত সিটি করপোরেশন এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক ‘স্থানীয় শাসন’ পরিচালনা করাই আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশনা।
স্থানীয় শাসন বলতে বোঝায়, সংবিধানের ৫৯(২) অনুযায়ী, প্রশাসন ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্য পরিচালনা করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং পাবলিক সার্ভিস বা জনকল্যাণমূলক সব সরকারি সেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নসম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। অন্যভাবে বলতে গেলে, কেন্দ্রীয় সরকার যেমন পরিচালিত হয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা, তেমনিভাবে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোও পরিচালিত হওয়ার কথা নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে।
সংবিধানের এ বিধান উপেক্ষা করা মানে সংবিধানকে অবমাননা করা। এটি করা হয় দুভাবে। প্রথমত, নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (যেমন জেলা পরিষদ) গঠন না করে; দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংবিধানের ৫৯(২) অনুচ্ছেদে নির্ধারিত দায়দায়িত্ব না দিয়ে বা সেগুলোকে (যেমন উপজেলা পরিষদ) কার্যকর হতে বাধা প্রদান করে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এবং ১৯৯২ থেকে এখন পর্যন্ত সব সরকার—যে সময়কালে সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ বলবৎ ছিল বা আছে—সংবিধানকে লঙ্ঘন করে আসছে।
সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে ১৫২ অনুচ্ছেদের সম্পৃক্ততা রয়েছে—১৫২ অনুচ্ছেদে প্রশাসনিক একাংশ বা স্তরের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘‘‘প্রশাসনিক একাংশ” (স্তর) অর্থ জেলা কিংবা এই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য-সাধনকল্পে আইনের দ্বারা অভিহিত অন্য কোন এলাকা।’ অর্থাৎ সাংবিধানে জেলাকে প্রশাসনিক একাংশ ঘোষণা করায় জেলা পরিষদ নির্বাচন করা সাংবিধানিকভাবে বাধ্যতামূলক। প্রসঙ্গত, সংসদে প্রণীত আইনের দ্বারা উপজেলা, ইউনিয়ন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ঘোষিত।
শুধু সংবিধান লঙ্ঘনই নয়, ১৯৯২ সালের পরবর্তী সরকারগুলো স্থানীয় সরকারের নির্বাচনসম্পর্কিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ‘কুদরত-ই-ইলাহী বনাম বাংলাদেশ’ রায়কেও অমান্য করে আসছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯১ সালে উপজেলা পরিষদ বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক সর্বসম্মত রায়ে ছয় মাসের মধ্যে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিয়েছিলেন; সুপ্রিম কোর্টের রায় আইনের সমতুল্য হওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি জেলা পরিষদের নির্বাচন করা হয়নি এবং বর্তমানে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দলীয় রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করার আরও একটি দৃষ্টান্ত বর্তমান সরকার সৃষ্টি করেছে। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘জেলা মন্ত্রী’র পদ সৃষ্টি করা হয়। ‘আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ [১৬বিএলটি (এএইচসিডি) (২০০৮)]’ মামলার রায়ে ২০০৬ সালে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ প্রজ্ঞাপনটিকে—অর্থাৎ জেলা মন্ত্রী পদকে —অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। একই সঙ্গে সাংসদদের জেলা ও উপজেলা তথা তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় উন্নয়ন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে জড়িত হওয়া অবৈধ ঘোষণা করেন। সংবিধান ও আদালতের এ নির্দেশ অমান্য করে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের ওপর সাংসদদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদ সংবিধান ও সাংবিধানিক বিধানসম্পর্কিত আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারে না। এ ছাড়া সরকার বিরোধী দলের আসনগুলোতে উন্নয়ন তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের।
সংবিধান লঙ্ঘনের আরেকটি ঘটনা হলো ক্ষমতাপ্রাপ্তদের শপথ লঙ্ঘন। সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ পালনকল্পে সাংসদসহ রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের শপথ গ্রহণ করতে হয়। সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে অন্তর্ভুক্ত বিধান অনুযায়ী, শপথের ছক হলো: ‘আমি, ...সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন-অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি-পদের কর্তব্য/ সরকারের প্রধানমন্ত্রী (কিংবা ক্ষেত্রমত মন্ত্রী, প্রতি-মন্ত্রী বা উপ-মন্ত্রী)-পদের কর্তব্য/ সংসদের স্পীকারের কর্তব্য (এবং কখনও আহুত হইলে রাষ্ট্রপতির কর্তব্য)/ সংসদের ডেপুটি স্পীকারের কর্তব্য (এবং কখনও আহুত হইলে স্পীকারের কর্তব্য) বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; ... আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’ প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি, প্রধান ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকসহ সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যদেরও একই ধরনের শপথ গ্রহণ করতে হয়। তবে সাংসদদের একটু ভিন্ন ধরনের শপথ গ্রহণ করতে হয়। তাঁদের ঘোষণা করতে হয়, ‘সংসদ-সদস্যরূপে আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না।’
দুর্ভাগ্যবশত, প্রায় প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীনদের অনেকেই শপথ ভঙ্গ করেন। যার মধ্যে রয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে দলীয় বিবেচনায় অবৈধ সুবিধা প্রদান ও পক্ষপাতিত্ব, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দলীয়করণ ‘অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী’ হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। দলতন্ত্র ও জেলাতন্ত্রের অসংখ্য ঘটনা দৃশ্যমান নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে। ফলে অনেক যোগ্য ব্যক্তি চাকরির সুযোগ এবং পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
পক্ষপাতিত্বের আরেকটি উদাহরণ— রাজনৈতিক বিবেচনায় যে সাত সহস্রাধিক মামলা বর্তমান সরকার প্রত্যাহার করেছে, যাতে খুনের মামলাও রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মাত্র দুটি মামলা। বলা বাহুল্য, একই ধরনের কাজ করেছিল চারদলীয় জোট সরকারও। এ ধরনের মামলা প্রত্যাহার আইনের শাসনের পরিপন্থী।
এ কথা সবারই জানা, আমাদের মাননীয় সাংসদদের অনেকেই সাংসদের পদ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন এবং শপথ ভঙ্গ করে ‘ব্যক্তিগত স্বার্থ’ সিদ্ধি করছেন। সাংসদদের আবার কেউ কেউ আইন ভঙ্গ করে সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছেন—সরকারের সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিরা সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণেরই অযোগ্য। আবার ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতি লঙ্ঘন করে কিছু কিছু সাংসদকে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিতে দেখা যায়, যা সাংবিধানিক কাঠামোর পরিপন্থী।
এটি সুস্পষ্ট যে সংবিধান ও সংবিধানের ব্যাখ্যাসম্পর্কিত আদালতের রায় অমান্য করে বিভিন্ন সময়ে আমাদের সরকারগুলো সংবিধান তথা আইনের শাসনের প্রতি মানুষের অনাস্থা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করে আসছে। দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর মনে আজ সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব ও এর অলঙ্ঘনীয়তা নিয়ে—বিশেষত, এ ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা সম্পর্কে—সংশয় দেখা দিয়েছে। সংবিধান ও আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। এমনকি, মহাজোটের শরিক এরশাদও সম্প্রতি বর্তমান সরকার সম্পর্কে দাবি করেছেন, ‘আইন, সরকার ও পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা নেই’ (যায়যায়দিন, ১ আগস্ট ২০১১)।
আর সম্প্রতি পাস করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, অসাংবিধানিকভাবে সংবিধানের প্রতি মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ। সংশোধনীর ৭ক অনুচ্চ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়—...(খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’
তাই, সংবিধান অবমাননার জন্য ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও ৭ক প্রয়োগ করা যায় বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments