সব সমস্যা সমাধান করতে পারে জনগণের উদ্যোগ by শিরিন আখতার

কালের কণ্ঠ : রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে আপনার রঙিন পোস্টার। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আপনি দলীয় প্রার্থী হচ্ছেন। সিদ্ধান্তটি এলো কী করে? সিদ্ধান্ত কি দলীয় ফোরামে গৃহীত হয়েছে? শিরিন আখতার : ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়মানুযায়ী দলনিরপেক্ষ। এখানে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই।


সুতরাং প্রথম উদ্যোগটি ব্যক্তিগত। দ্বিতীয়ত, যেহেতু রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি, তাই সবার ইতিবাচক মতামত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে বিষয়ে আমার দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ আলোচনা করছে।
কালের কণ্ঠ : ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করেছে সরকার। এই বিভাজনকে আপনি কিভাবে দেখছেন? এই বিভাজনে কি নাগরিক সেবার মান নিশ্চিত হবে বলে আপনি মনে করেন?
শিরিন আখতার : ঢাকা সিটি করপোরেশন কোটি জনগণের আবাসস্থল। প্রতিদিন কম করে হলেও তিন থেকে চার লাখ নারী-পুরুষ ঢাকায় আসছেন। সুতরাং এই শহরকে পরিপূর্ণভাবে ঢেলে সাজানো এবং নাগরিকের সব অধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। সে কারণে আমরা মনে করি, ঢাকা সিটি করপোরেশন বিষয়ে একটি বিশেষ ব্যবস্থার আলোকে সব কিছু বিবেচনায় আনা দরকার। তা হলে হয়তোবা মানসম্মত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। সেসব দেশে নগর প্রশাসন কিভাবে চলছে তা দেখে একটা ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই মুহূর্তের দুটি ভাগ কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকে জনগণের আরো কাছের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনায় আনতে সাহায্য করবে।
কালের কণ্ঠ : ঢাকা সিটি করপোরেশনের নাগরিক সুবিধা শতভাগ নিশ্চিত করা কি সম্ভব?
শিরিন আখতার : এই মুহূর্তে ঢাকা শহরের নাগরিকদের যে সব সমস্যা রয়েছে তা একটি সিদ্ধান্তেই সমাধান হয়ে যাবে, এমনটি নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন নীতিমালা ও পরিকল্পনা। সব কিছু মিলিয়ে সমস্যা সমাধান করতে হলে প্রয়োজন একটি আশু পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। পরিকল্পনায় অবশ্যই মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে। সব কিছুর আগে প্রয়োজন সদিচ্ছা। শতভাগ সদিচ্ছা অনেক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারে।
কালের কণ্ঠ : ঢাকার নাগরিক সেবা শুধু সিটি করপোরেশনের ওপর নির্ভর করে না। ওয়াসা, ডেসা, ডেসকো, পুলিশ ইত্যাদি অনেক সেবা সংস্থাও এর সঙ্গে জড়িত। এ সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। এটা কী করে নিশ্চিত করা যায়?
শিরিন আখতার : যেকোনো দেশের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক গতিশীল এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি সুস্পষ্ট না থাকলে সমস্যার সমাধান খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। যে দেশে স্থানীয় সরকার যত বেশি শক্তিশালী, সে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের বিষয়টি ততটাই পরিচ্ছন্ন। তাই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার ওপর নির্ভর করছে ওয়াসা, ডেসা, ডেসকো, পুলিশ ইত্যাদি সংস্থার কার্যক্রম। সেই আলোকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেট্রোপলিটন সরকারের বিষয়টি বিবেচনায় আসে। মূল বিষয়টি হচ্ছে, একটি স্থানীয় সরকার হিসেবে নাগরিকদের সেবা দেওয়ার জন্য সেই সংস্থাটিকে সব দিক থেকেই পরিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সম্পন্ন হতে হবে। এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলতে পারে। তার পরও যে কথাটি বলা যায় তা হলো, সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে যিনি থাকবেন তাঁকে কারো ওপর নির্ভর করে বা কারো চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে চলবে না। বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থার কাছ থেকে নাগরিকদের সেবা আদায় করার মতো ধৈর্য, সাহস এবং জনগণকে আস্থায় নেওয়ার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। সব সেবামূলক সংস্থার কাজের সমন্বয় ঘটানোর জন্য মন্ত্রণালয়গুলোর ভেতরে আন্তসম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের কাজের সব তথ্য প্রতিনিয়ত নজরদারি ও খবরদারির মধ্যে রেখে সমন্বয় সাধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : একজন প্রার্থী হিসেবে নয়, এই মহানগরীর একজন বাসিন্দা হিসেবে আপনি কী কী সমস্যা দেখেন?
শিরিন আখতার : নর্দমার দুর্গন্ধ, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা, পানযোগ্য পানির অভাব, এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা, যেখানে-সেখানে আবর্জনার স্তূপ, অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, পরিকল্পাহীন বাড়িঘর-দোকানপাট নির্মাণ, মশা-মাছির অসহনীয় বংশ বিস্তার, যানজট- এসব তো আছেই। রাতে সড়কগুলোতে আলো অপর্যাপ্ত। কাগজ খুললেই দেখবেন, এ মহানগরীতে মাদক সহজলভ্য। ইভ টিজিং, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, রাহাজানি, ছিনতাই, খুন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যাসহ নানা সমস্যা ঢাকা শহরে রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : এই সমস্যা সমাধানে আপনার চেষ্টা কী হবে?
শিরিন আখতার : সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াটা হবে প্রধান কাজ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নগরবাসীর মধ্যে এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ। সঠিক নেতৃত্ব এবং জনগণের সমন্বিত ও সম্মিলিত উদ্যোগই পারে যেকোনো সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে। এখন সিটি করপোরেশনের যে আয় আছে তার অপচয় শতভাগ রোধ করে ও দুর্নীতি রোধ করে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। মহানগরীর উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে শুরু করে সব কাজের ডেটাবেজ তৈরি করা গেলে দুর্নীতি প্রতিরোধ অনেকটা সম্ভব হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে স্বচ্ছতা। সব কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আমি সব কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চাই।
কালের কণ্ঠ : আপনার দল একটি জোটের অংশীদার। সে ক্ষেত্রে জোটের প্রধান শরিক যদি কোনো প্রার্থী দেয় তাহলে আপনি কী করবেন?
শিরিন আখতার : নির্বাচনটি নির্দলীয়। বিভিন্ন প্রার্থী সমমনা হতে পারেন। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি অন্য রকম। ৪২ বছর এই ঢাকা শহরেই সংগ্রাম-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমার বেড়ে ওঠা। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করে যাচ্ছি জনগণের এক উন্নততর জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে। এই শহরের জনতার সিদ্ধান্তই হবে সর্বশেষ।
কালের কণ্ঠ : প্রাক্তন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ একসময় মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্টের ধারণা দিয়েছিলেন। এই মহানগরী নিয়ে আপনি কি এমন কোনো ধারণ পোষণ করেন?
শিরিন আখতার : এ রকম একটি ধারণা স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ একটি মেট্রোপলিটন সরকার গঠনের বিষয়টি আলোচনার মধ্যেই আছে। নাগরিক সেবার মান শতভাগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
কালের কণ্ঠ : যদি সমস্যার দিকে তাকাই, তাহলে দেখব মহানগরীতে গ্যাসসংযোগ নেই। বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি নতুন সংযোগ নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট। নিরাপত্তাও নিশ্চিত নয়। এসব সমস্যা সমাধানের সহজতম পথ কী?
শিরিন আখতার : আমি আগেই বলেছি, এসব সমস্যা সমাধানে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। আর এ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যেই শহরের যেকোনো সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
শিরিন আখতার : আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনার মাধ্যমে কালের কণ্ঠের সব পাঠককে ধন্যবাদ। এ সুযোগে ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের জনগণের প্রতি আমার আহ্বান, ঢাকাকে সচল, আরো বাসযোগ্য ও নিরাপদ নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে নারী-পুরুষ, তরুণ-যুবক- সবাই এগিয়ে আসুন।

No comments

Powered by Blogger.