ভিন্নমত-আগামী বাজেট প্রণয়ন অত সহজ হবে না by আবু আহমেদ
দেশের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না সেই দেড় বছর আগ থেকেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সবাইকে আঘাত করছে। তবে যারা সিমিত আয়ের লোক, তাদের সেই আঘাতটা আরো জোরে করছে। একজন সৎ সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে তাঁর ছোট সংসারেরও বাজেট মেলানো দায়।
অবসরে যাওয়া লোকেরা আরো অসুবিধায় আছেন। অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। শেয়ারবাজারটা বিধ্বস্ত; অন্যখাতে কোনো অর্থকরি নেই যে বিনিয়োগ করা যাবে। সর্বত্রই একটা না থাকার বোধ অনুভূত হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি রোধ করার জন্য যে কৌশল বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রহণ করেছে, তা তো কোন কাজই দিচ্ছে না, বরং অর্থনীতিতে বিনিয়োগ স্থবিরতা এনে দিয়েছে। সুদের হার ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ। এই সুদে বিনিয়োগ চাহিদা যে অনেক কম হবে, সেটা অর্থনীতি যারা পড়েনি তাদেরও জানার কথা। মেয়াদি আমানতের সুদের হার ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। এই বৃদ্ধি ঘটেছে মাত্র গত এক বছরে। সবই ঘটেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনশীল মুদ্রানীতির কারণে। বিনিয়োগ কমে গেলে প্রবৃদ্ধিও কম হবে। অর্থনীতি যদি ৬.৫ শতাংশ করেও বাড়ে তাহলে বিনিয়োগ লাগবে জিডিপির ২৫ থেকে ২৭ শতাংশ। সেই বিনিয়োগ কি অর্থনীতিতে হচ্ছে? এই অবস্থায় প্রবৃদ্ধি আরো কমবে। এর ফল হবে রাজস্ব আয়ও কমে যাবে। অন্যদিকে বিদেশি সাহায্য আর অনুদান ভাটার দিকে। পদ্মা সেতুর জন্য কোনো বিদেশি সাহায্য পাওয়া যাবে না এটা প্রায় নিশ্চিত। যেটা পাওয়া যেতে পারে সেটা হলো বিদেশি প্রাইভেট বিনিয়োগ। কিন্তু সেই বিনিয়োগ দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। বিদেশিরা অন্যান্য সাহায্যও স্থগিত করে দিয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের সামনে দুটো পথ খোলা আছে। এক. লোকবল কমানো ও নতুন নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং দুই. প্রকল্পের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া। কিন্তু সরকার নতুন করে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে অতিউৎসাহী বলে মনে হয়। এতে রাজস্ব উদ্বৃত্ত কমে গিয়ে উন্নয়ন বাজেটের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে মাত্র। রাজস্ব বাজেটের বেশি অংশ চলে যাবে বেতনভাতা এবং সুদ-দায় মেটাতে। একদিকে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম, অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব দায় অনবরত বৃদ্ধি। এই দুয়ের মধ্যে সমন্বয় হবে কিভাবে? বিগত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন খাতে প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০১১-১২ অর্থবছরের সেই উন্নয়ন বাজেট ইতিমধ্যে অর্থাভাবে ছোট করতে হয়েছে। অন্যদিকে রাজস্ব বাজেট প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই। বিগত বাজেটে উন্নয়ন খাতে ৪৭ থেকে ৪৮ শতাংশ ধরা হয়েছিল বিদেশি উৎস থেকে। এর অর্থ হলো, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থা কমপক্ষে বাংলাদেশকে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা দিতে সম্মত ছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি থেকে তারা সরে গেছে। এ বছর বাংলাদেশকে তারা নতুন করে বড় অঙ্কের অর্থ-প্রতিশ্রুতি দেবে না। ফলে বাংলাদেশকে উন্নয়ন বাজেট প্রণয়ন করতে হবে নিজের সম্পদের ওপর নির্ভর করে। তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াতে পারে? ২০১২-২০১৩ সালের সরকারের বাজেট সামনে আনলে যা দাঁড়াতে পারে তাহলো এই, রাজস্ব বাজেট এক লাখ কোটি টাকা, আর উন্নয়ন বাজেট বড় জোর ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা। ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট হবে প্রকৃত আয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের ক্ষুদ্রতম বাজেট। বেসরকারি খাতে মন্দা চলছে। উন্নয়ন বাজেটের জন্য অর্থ নেই। এ অবস্থায় ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হার কত হবে? এটা কি ৬ শতাংশের নিচে নেমে যাবে? বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে এই কারণে। অর্থনীতি মন্দায় প্রবেশ করছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। এই অবস্থায় হতাশা সবাইকে তাড়া করতে থাকবে। কিন্তু হতাশার বড় শিকার হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা। গরিব মানুষরা তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারবে না। অর্থনীতিতে একটা অভাব বোধ দারুণভাবে অনুভূত হবে। যে সব মানুষ ব্যবসা করে, বা দুর্নীতি করে অর্থ জমা করেছে, তারা তাদের আয়কে দেশে না রেখে বিদেশে নিয়ে যেতে পারে। ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ার কোনো কারণ আপাতত নেই। আমদানি কমে টাকা শক্তিশালী হচ্ছে সেটা অর্থনীতির দুর্বলতাকেই প্রকট করে সবার সামনে তুলে ধরে। টাকা যদি অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির কারণে শক্তিশালী হতো, তাহলে সেটা হতো আসল শক্তিশালী। বাংলাদেশ অর্থনীতির সমস্যা সামনে হ্রাস পাওয়ার কোনো চিহ্ন লক্ষ করা যাচ্ছে না। সামনের অবস্থা আরো খারাপ হওয়ার সব লক্ষণ ফুটে উঠছে। এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রী মহোদয় আগামী বাজেট কিভাবে মেলান, সেটা দেখার বিষয়। বিশাল ঘাটতি বাজেটের আশ্রয় নেওয়া হলে সেটা হবে অর্থনীতিকে আরো সংকটের দিকে ঠেলে দেওয়া।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments