শ্রদ্ধাঞ্জলি-রাউজানে নজরুল by শাম্মী তুলতুল
চট্টগ্রামের রাউজানে এসেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আমার দাদা আবদুল কুদ্দুস মাস্টারের কাছে বহুবার শুনেছি সে ঘটনা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন পত্রিকায়ও দাদা সে কথা বলেছেন। জাতীয় কবির ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সেই কথাগুলোই আরেকবার শোনাতে চাই।
তৎকালীন পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য কবি নজরুল ইসলামকে ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় আনা হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি ছিল তরুণ সম্মেলন (কনফারেন্স) ও শিক্ষা সম্মিলনী। প্রয়াত শিক্ষাবিদ ও লেখক আবদুল কুদ্দুস মাস্টার তখন স্কুলের ছাত্র।
১৯৩২ সালে যে তরুণ সংঘের উদ্যোগে কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাউজানে আসেন, আবদুল কুদ্দুস মাস্টার সে সংঘের নির্বাহী সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন গবেষকের লেখায়ও কবিকে ঘিরে কুদ্দুস মাস্টারের স্মৃতিময়তা ঠাঁই পেয়েছে।
কবি নজরুল ইসলাম দুই রাত ছিলেন রাউজানের ঢেউয়া হাজিপাড়ায়। ১৯৩২ সালের শুরু থেকেই কবিকে সম্মেলনে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ জন্য তৎকালীন ‘রাউজান তরুণ সংঘের’ সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা চৌধুরী চাঁদা সংগ্রহের জন্য রেঙ্গুনে যান। সেখানে তিনি দেড় মাস ছিলেন। এ ছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ী, শিক্ষানুরাগী, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। এভাবে প্রায় তিন হাজার টাকা জোগাড় হয়।
মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক নজির আহমদ চৌধুরীকে নিয়ে নুরুল হুদা চৌধুরী কলকাতার শ্যামবাজারে কবির বাসায় যান। কবিপত্নীর জন্য পাঁচ টাকা দামের একটি শাড়ি নিয়ে যান। নুরুল হুদা চৌধুরী কবিকে শাড়িটি ‘ভাবির জন্য এনেছি’ বলতেই কবি ‘হা হা’ করে হেসে ওঠেন।
কবিকে রাউজান আসার খরচ বাবদ ২০০ টাকা দেওয়া হয়। ফেরার পথে দেওয়া হয় আরও ২০০ টাকা। কবির ‘রাউজান সফর’ ১৯৩২ সালের ৫ ও ৬ মে বলে ইতিপূর্বে বিভিন্ন লেখায় বলা হলেও আবদুল কুদ্দুস মাস্টারের মতে, কবি এসেছিলেন ১৯৩২ সালের ১৯ ও ২০ মে। এই দুই দিনে তরুণ কনফারেন্স ও শিক্ষা সম্মিলনী হয়েছিল রাউজানে।
নুরুল আবছার চৌধুরী ছিলেন সেই আয়োজনের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ। কবি হাজিবাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। সম্মেলনে যাতায়াতের সুবিধার জন্য মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের ইচ্ছাতেই হাজিবাড়িতে রাখা হয় কবিকে। সম্মিলনীতে আসা প্রতিনিধিদের খাবার-দাবার দেওয়া হয় হাজিবাড়ি ও শেখ ওমর বাড়ি থেকে। ১৯২৯-৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তরুণ সংঘটি। রাউজানের শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
সেকালে রাউজানে শিক্ষা-দীক্ষায় অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা মোহাম্মদপুরের অধিবাসীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তরুণ সম্মেলনের (কনফারেন্স) আয়োজন করা হয়। নজরুল আসার পর মোহাম্মদপুরের লোকজনের মধ্যে শিক্ষা-সচেতনতা বেড়ে যায়।
কবি নজরুল ইসলাম প্রথম দিন ‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি আবৃত্তি করে তাঁর কর্মকাণ্ড শুরু করেন। প্রথম দিন ছিল শিক্ষা সম্মিলনী। এ দিন আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে বিকেলে কবি তাঁর নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত একনাগাড়ে তিনি ইসলামিক গান গেয়ে যান। গানের আসর শেষে রাতে ভাত খান হাজিবাড়িতে। দুই দিনই কবিকে গরুর মাংস ও ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ানো হয়। কবিরও বাড়তি কোনো চাহিদা ছিল না। তাঁকে কোরমা, পোলাও, বিরিয়ানি দেওয়া হয়নি। এসবের প্রচলনও ছিল না তখন।
শতরঞ্জি বিছিয়ে বসে কবি ভাত খান। সেখানে বসে চা ও পান খেতে খেতে রাত একটা পর্যন্ত ইসলামিক গান গেয়ে যান। কবি চা বেশি পছন্দ করতেন বলে জানা যায়। বারবার চা খেতে চাইতেন তিনি। কবিকে দেখতে এবং কবির কণ্ঠে গান শুনতে মানুষের ভিড় জমে যায় হাজিবাড়িতে। কবি রাতে ঘুমান বাড়িটির দক্ষিণ কামরায়। দ্বিতীয় দিন কবি ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন এবং সে দিন রাতেও গানে, কবিতায় নিমগ্ন ছিলেন তিনি। পরদিন সকালে বিদায়বেলায় প্রায় ২০০ স্বেচ্ছাসেবক হেঁটে কবিকে চট্টগ্রামের সদরঘাট পর্যন্ত দিয়ে আসেন। কবি যান ট্যাক্সিতে করে। সেই সময়কার ট্যাক্সিতে ১০-১২ জন যাত্রী বসতে পারতেন। কবির সঙ্গে ট্যাক্সিতে ছিলেন আবুল কাশেম উকিল, আহমদ সগীর চৌধুরী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী ও বালক কুদ্দুস মাস্টার। রাউজানের গহিরা স্কুলের সামনে যেতেই আহমদ সগীর চৌধুরী কবিকে নামিয়ে স্কুলটিতে নিয়ে যান। সেখানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে দাঁড়িয়ে ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি গান।
জানা যায়, হাজিবাড়ির দক্ষিণে ২০-২৫টি সুপারিগাছ ছিল। কবি যে কামরায় ছিলেন তা থেকে সেগুলো দেখা যেত। এই গাছগুলো দেখে কবি ‘বাতায়ন পাশে গুবাকতরুর সারি’ কবিতাটি লেখেন বলে জানিয়েছেন কুদ্দুস মাস্টার।
যখন নজরুল রাউজান সফরে আসেন, তাঁর পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি ও সাদা গান্ধী টুপি। পায়ে ছিল পাম্প শু। পাম্প শু তখনকার অভিজাত শ্রেণীর
ব্যবহার্য ছিল। আবদুল কুদ্দুস মাস্টারের ভাষ্যমতে, নজরুল হিন্দু-মুসলমান উভয়ের অপবাদের জবাব দেন তাঁর গান ও কবিতার মধ্য দিয়ে।
রাউজানের ওই শিক্ষা সম্মিলনীতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন দর্শনীর বিনিময়ে কবিকে দেখতে আসেন। দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে কবি তাঁর বক্তব্য, গান ও আবৃত্তিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখেন।
শাম্মী তুলতুল১৯৩২ সালে যে তরুণ সংঘের উদ্যোগে কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাউজানে আসেন, আবদুল কুদ্দুস মাস্টার সে সংঘের নির্বাহী সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন গবেষকের লেখায়ও কবিকে ঘিরে কুদ্দুস মাস্টারের স্মৃতিময়তা ঠাঁই পেয়েছে।
কবি নজরুল ইসলাম দুই রাত ছিলেন রাউজানের ঢেউয়া হাজিপাড়ায়। ১৯৩২ সালের শুরু থেকেই কবিকে সম্মেলনে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ জন্য তৎকালীন ‘রাউজান তরুণ সংঘের’ সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা চৌধুরী চাঁদা সংগ্রহের জন্য রেঙ্গুনে যান। সেখানে তিনি দেড় মাস ছিলেন। এ ছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ী, শিক্ষানুরাগী, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। এভাবে প্রায় তিন হাজার টাকা জোগাড় হয়।
মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক নজির আহমদ চৌধুরীকে নিয়ে নুরুল হুদা চৌধুরী কলকাতার শ্যামবাজারে কবির বাসায় যান। কবিপত্নীর জন্য পাঁচ টাকা দামের একটি শাড়ি নিয়ে যান। নুরুল হুদা চৌধুরী কবিকে শাড়িটি ‘ভাবির জন্য এনেছি’ বলতেই কবি ‘হা হা’ করে হেসে ওঠেন।
কবিকে রাউজান আসার খরচ বাবদ ২০০ টাকা দেওয়া হয়। ফেরার পথে দেওয়া হয় আরও ২০০ টাকা। কবির ‘রাউজান সফর’ ১৯৩২ সালের ৫ ও ৬ মে বলে ইতিপূর্বে বিভিন্ন লেখায় বলা হলেও আবদুল কুদ্দুস মাস্টারের মতে, কবি এসেছিলেন ১৯৩২ সালের ১৯ ও ২০ মে। এই দুই দিনে তরুণ কনফারেন্স ও শিক্ষা সম্মিলনী হয়েছিল রাউজানে।
নুরুল আবছার চৌধুরী ছিলেন সেই আয়োজনের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ। কবি হাজিবাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। সম্মেলনে যাতায়াতের সুবিধার জন্য মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের ইচ্ছাতেই হাজিবাড়িতে রাখা হয় কবিকে। সম্মিলনীতে আসা প্রতিনিধিদের খাবার-দাবার দেওয়া হয় হাজিবাড়ি ও শেখ ওমর বাড়ি থেকে। ১৯২৯-৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তরুণ সংঘটি। রাউজানের শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
সেকালে রাউজানে শিক্ষা-দীক্ষায় অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা মোহাম্মদপুরের অধিবাসীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তরুণ সম্মেলনের (কনফারেন্স) আয়োজন করা হয়। নজরুল আসার পর মোহাম্মদপুরের লোকজনের মধ্যে শিক্ষা-সচেতনতা বেড়ে যায়।
কবি নজরুল ইসলাম প্রথম দিন ‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি আবৃত্তি করে তাঁর কর্মকাণ্ড শুরু করেন। প্রথম দিন ছিল শিক্ষা সম্মিলনী। এ দিন আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে বিকেলে কবি তাঁর নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত একনাগাড়ে তিনি ইসলামিক গান গেয়ে যান। গানের আসর শেষে রাতে ভাত খান হাজিবাড়িতে। দুই দিনই কবিকে গরুর মাংস ও ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ানো হয়। কবিরও বাড়তি কোনো চাহিদা ছিল না। তাঁকে কোরমা, পোলাও, বিরিয়ানি দেওয়া হয়নি। এসবের প্রচলনও ছিল না তখন।
শতরঞ্জি বিছিয়ে বসে কবি ভাত খান। সেখানে বসে চা ও পান খেতে খেতে রাত একটা পর্যন্ত ইসলামিক গান গেয়ে যান। কবি চা বেশি পছন্দ করতেন বলে জানা যায়। বারবার চা খেতে চাইতেন তিনি। কবিকে দেখতে এবং কবির কণ্ঠে গান শুনতে মানুষের ভিড় জমে যায় হাজিবাড়িতে। কবি রাতে ঘুমান বাড়িটির দক্ষিণ কামরায়। দ্বিতীয় দিন কবি ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন এবং সে দিন রাতেও গানে, কবিতায় নিমগ্ন ছিলেন তিনি। পরদিন সকালে বিদায়বেলায় প্রায় ২০০ স্বেচ্ছাসেবক হেঁটে কবিকে চট্টগ্রামের সদরঘাট পর্যন্ত দিয়ে আসেন। কবি যান ট্যাক্সিতে করে। সেই সময়কার ট্যাক্সিতে ১০-১২ জন যাত্রী বসতে পারতেন। কবির সঙ্গে ট্যাক্সিতে ছিলেন আবুল কাশেম উকিল, আহমদ সগীর চৌধুরী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী ও বালক কুদ্দুস মাস্টার। রাউজানের গহিরা স্কুলের সামনে যেতেই আহমদ সগীর চৌধুরী কবিকে নামিয়ে স্কুলটিতে নিয়ে যান। সেখানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে দাঁড়িয়ে ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি গান।
জানা যায়, হাজিবাড়ির দক্ষিণে ২০-২৫টি সুপারিগাছ ছিল। কবি যে কামরায় ছিলেন তা থেকে সেগুলো দেখা যেত। এই গাছগুলো দেখে কবি ‘বাতায়ন পাশে গুবাকতরুর সারি’ কবিতাটি লেখেন বলে জানিয়েছেন কুদ্দুস মাস্টার।
যখন নজরুল রাউজান সফরে আসেন, তাঁর পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি ও সাদা গান্ধী টুপি। পায়ে ছিল পাম্প শু। পাম্প শু তখনকার অভিজাত শ্রেণীর
ব্যবহার্য ছিল। আবদুল কুদ্দুস মাস্টারের ভাষ্যমতে, নজরুল হিন্দু-মুসলমান উভয়ের অপবাদের জবাব দেন তাঁর গান ও কবিতার মধ্য দিয়ে।
রাউজানের ওই শিক্ষা সম্মিলনীতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন দর্শনীর বিনিময়ে কবিকে দেখতে আসেন। দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে কবি তাঁর বক্তব্য, গান ও আবৃত্তিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখেন।
No comments