চারদিক-‘নেন ভাই, পাতা নেন, দাম কম’ by সালেক খোকন

স্টেশন রোডের দুই পাশটা যেন সবুজ পাতায় সাজানো। ব্যস্ত রাস্তার দুই দিকে স্তূপ করে রাখা হয়েছে পাতা আর পাতা। ছোট ছোট ডালে সবুজ সতেজ পাতা। ডালগুলো থেকে বের হচ্ছে সাদা রঙের কষ। অন্য কোনো পাতা নয়, একেবারে সবুজ সজীব কাঁঠালপাতা। ছোট ছোট ডাল একত্র করে যত্নের সঙ্গে বাঁধা হচ্ছে আঁটি।


লোকসকলের সাইকেল কিংবা মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে পাতার আঁটিগুলো। কেউ কেউ রিকশায় তুলে নিচ্ছে ১০-১২টি আঁটি। কেউ বা আবার দু-একটি আঁটি হাতে নিয়েই ছুটছেন বাড়ির দিকে। এখানকার সবাই যেন সবুজ পাতার ভালোবাসায় মত্ত। এখানে পাতাপ্রেমীদের এ রকম আনাগোনা চলে সারা বছরই। সকাল থেকে রাত অবধি। রোদ কিংবা বৃষ্টিতেও থেমে থাকে না পাতার কেনাবেচা। এ রাস্তায় চলতে গেলেই দুই পাশ থেকে নারীকণ্ঠগুলো ঘিরে ধরে।
চারপাশ থেকে ডাকাডাকি, ‘নেন ভাই, পাতা নেন, দাম কম।’
দিনাজপুর জেলা শহরের মধ্যেই বাহাদুর বাজার। বাজারের ঠিক পাশেই নামকরা এক মিষ্টির দোকান। নামটিও অন্য রকম—পাবনা সুইটস। দিনাজপুর শহরে দোকান অথচ নামটি কেন ‘পাবনা সুইটস?’ চিন্তার জট খুলতে খুলতেই পৌঁছে যাই সেখানে।
পাবনা সুইটসের সামনের রাস্তাটি টিঅ্যান্ডটি অফিসের ঠিক সামনে গিয়ে মিশেছে স্টেশন রোডের সঙ্গে। ভিড় ঠেলে সে পথেই এগোই আমরা। এ জায়গাটা একেবারে অন্য রকম। লোকজনের ভিড় নেই বললেই চলে। রাস্তার দুই পাশে ১০-১৫ জন নারী-পুরুষ দা হাতে বসা। তাঁদের প্রত্যেকের পেছনেই সবুজ সতেজ কাঁঠালপাতার স্তূপ। হ্যাঁ, এভাবেই আমরা আবিষ্কার করি দিনাজপুরের পাতার বাজারটিকে।
কাঁঠালপাতা ছাগলের প্রিয় খাবার। দিনাজপুর শহরে নিজ বাড়িতে যারা ছাগল পোষে, তাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। শহরের মধ্যে পর্যাপ্ত কাঁঠালগাছ না থাকায় সবার নির্ভরতা এই পাতার বাজারের ওপর। সে রকমটিই জানালেন পাতা কিনতে আসা রায়হান নামের একজন সরকারি চাকরিজীবী।
কবে থেকে এ পাতার বাজারের শুরু সে বিষয়ে স্থানীয় লোকজনের সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা নেই। তবে পাতাবিক্রেতা পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী মহসিনা জানালেন নানা তথ্য।
এখানে পাতা বিক্রির সঙ্গে যুক্ত আছেন ১৬ জনের মতো। তাঁরা প্রায় সবাই এ ব্যবসা করছেন ২০ বছর আগে থেকে। তারও আগে নাকি এখানে পাতা বিক্রি হতো স্বল্প পরিসরে।
মহসিনা প্রতি আঁটি পাতা বিক্রি করেন ১০ থেকে ২০ টাকায়। যা লাভ হয় তা দিয়েই চলে সংসার। কেমন লাভ হয়? মহসিনার উত্তর, ‘দাদা, কহনো লাভ কহনো আবার লস, আল্লাহ চালায়া নেয়।’
মহসিনার পাঁচজনের সংসার চলে এই পাতার ব্যবসার ওপর। তাঁর বাড়ি পঞ্চগড়ে। মেয়ের সুখের জন্য বাবা-মা মহসিনাকে বিয়ে দেন স্থানীয় খুরশেদের সঙ্গে। বিয়ের পর পরই বাবা-মায়ের স্বপ্ন রূপ নেয় দুঃস্বপ্নে। জুয়াড়ি স্বামীর অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে মহসিনা চলে আসেন দিনাজপুরে। শুরু করেন পাতার ব্যবসা। সে থেকেই মহসিনার বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু। পেছনের কথা এখন আর মনে করতে চান না মহসিনা। পাতার ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যায় তাঁর জীবনের পাতাটিও।
পাতার বাজারের রাশেদা দুটি আঁটি বেঁধে দিচ্ছেন এক ক্রেতার সাইকেলের সঙ্গে। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। লাভের কথা জানতে চাইলে উত্তরে বলেন, ‘ছাওয়াল-পাওয়াল নিয়ে বাঁচতে পারি।’
প্রতিদিন ভোর হতেই দা হাতে রাশেদা বেরিয়ে পড়েন কাঁঠালপাতা সংগ্রহে। সংগ্রহ করা পাতা সারা দিন বিক্রি করে যা পান তা দিয়েই চলে পাঁচজনের সংসার। এভাবে পাতা বিক্রি করেই বিয়ে দিয়েছেন এক মেয়েকে। কোনো কোনো দিন বিক্রি কম হলে কাঁধে নিয়ে পাতার আঁটি ফেরি করে বেড়ান রাশেদা।
পেছনের কথা বলতে গিয়ে রাশেদা আনমনা হয়ে যান। তাঁর বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দায়। ১০ বছর বয়সেই তাঁর বিয়ে হয়। বাবার মৃত্যুর পর স্বামী সালামের হাত ধরে চলে আসেন দিনাজপুরে। কোনো কাজ না পেয়ে মাত্র ৩০০ টাকা পুঁজিতে শুরু করেন পাতার ব্যবসা। নিজে পাতার ব্যবসা করলেও রাশেদার রিকশাচালক ছেলের পছন্দ নয় এ ব্যবসা। এ নিয়ে রাশেদার দুঃখের শেষ নেই। পাতার ব্যবসায় শরীর নোংরা হয় বেশি। সে কারণেই ছেলের কাছে মায়ের পাতার ব্যবসাটি আজ ‘নোংরা ব্যবসা’।
মহসিনার পাশেই ডাল কেটে আঁটি বাঁধায় ব্যস্ত প্রতিবন্ধী এক বৃদ্ধ। নাম মান্নান। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন, পাস করতে পারেননি। থাকেন বালুবাড়ি রেলব্রিজের পাশে। পাতার ব্যবসা করছেন ২৫ বছর ধরে। প্রতিদিন সকালে পাতার সন্ধানে তিনি বেরিয়ে পড়েন আশপাশের গ্রামগুলোতে। যাদের বাড়িতে কাঁঠালগাছ আছে, তাদের জানান গাছের পাতা ছাঁটার সুফলগুলোর কথা। পাতা বাড়ির চাল নষ্ট করে, উঠান নষ্ট করে আর ডাল ছেঁটে দিলে গাছ আরও বাড়ে। যাদের সম্মতি মেলে, তাদের কাছ থেকে গাছপ্রতি ১৫০-২০০ টাকা হিসেবে পাতা কিনে নেন তিনি। এরপর গাছের চার ভাগের তিন ভাগ পাতা কেটে এনে বিক্রি করেন। পরিশ্রম আর সততাকে পুঁজি করে টিকে আছে পাতার বাজারের সংগ্রামীরা। জীবনযুদ্ধে জয়ী এসব মানুষের পাশে নিজেকে আবিষ্কার করি অন্যভাবে। এঁদের কাছে জীবনের মানে পাতার মতোই জন্মানো আর ঝরে যাওয়া। পাতাই এঁদের জীবন, পাতাই স্বপ্ন। পাতায় পাতায় বদলে যায় এঁদের জীবন।
সালেক খোকন

No comments

Powered by Blogger.