গতকাল সমকাল-আরব গণজাগরণ ও রবীন্দ্রনাথের ভাবনা by ফারুক চৌধুরী
২০১১ সালের শুরু থেকে আরব বিশ্বে গণজাগরণের যে জোয়ার এসেছে, তার চূড়ান্ত পরিণাম আমরা কেউই এখন জানি না। আরব বিশ্বের এই সংগ্রাম মূলত সেই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচার ও স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম।
তবে সেই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক রাজনীতির রূঢ় বাস্তবতার সর্পিল ফেনা বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে ফুঁসে উঠছে। সেই বাস্তবতায় গণতন্ত্র নয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের স্বার্থ রক্ষাই বড় কথা। এই গণজাগরণকে তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—
‘ওরি মাঝে পথ চিরে চিরে
নতুন সমুদ্র তীরে
তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি...’
আমরা তো স্পষ্টই দেখছি যে মিসরে যা সম্ভব হয়েছে, লিবিয়ায় তা হচ্ছে না; তিউনিসিয়ার অবস্থার সঙ্গে সিরিয়ার নেই মিল; বাহরাইন আর ইয়েমেন কাছাকাছি অবস্থানে থেকেও এ মেরু-ও মেরু। তবে প্রত্যাশা তো রয়েছেই (কারও কারও কাছে যা ভীতি) যে, গণতান্ত্রিক আরব বিশ্ব স্বৈরাচারাধীন আরব বিশ্ব থেকে অধিকতর শক্তিধর ও একতাবদ্ধ হবে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, আরব বিশ্বের বেলায় আসে ইসরায়েল আর ফিলিস্তিন। সেটাই মূলত এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু।
মিসরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থাপন করার উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। তবে উদ্যোগটি এখনো মূলত সামরিক বাহিনীরই হাতে রয়েছে। অতএব সাধু সাবধান! তবে পর্বত আরোহণকারী স্যার এডমন্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিং জানতেন, যেমন জানেন আমাদের মুসা ইব্রাহীম যে পর্বতশীর্ষের পথে দুই পা আরোহণেও কিছুটা পদস্খলন হতেই পারে। গণতন্ত্রের যাত্রাপথ ও যে পিচ্ছিল, মিসরে হালের মুসলমান-খ্রিষ্টান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তারই প্রমাণ। দাঙ্গাটি যে কোনো কোনো মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না, তা বলা যাবে না। সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মিসর আরব বিশ্বে যে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রাখে, তা কারও কারও বিচারে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। যা-ই হোক, ভয়াবহ এই দাঙ্গাটি সরকার ও জাগ্রত মিসরীয় জনগণের সময়োচিত হস্তক্ষেপ, অন্তত আপাতত ব্যাপকতর হয়নি। আশার কথা এই যে, শুধু মিসরে নয়, আরব বিশ্বের অন্যত্রও এই গণজাগরণ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক। আমেরিকান বিশেষজ্ঞরা (বিশেষ অজ্ঞ!) বোঝেন কি না, জানা নেই যে এই গণজাগরণ ওসামাবিহীন আল-কায়েদার সন্ত্রাসী ও ধর্মান্ধতার ধারকে অনেকটাই ভোঁতা করবে এবং তা হবে বিশ্ব সন্ত্রাস-পরিস্থিতি দমনে সহায়ক। অতএব এই অবস্থাটিকে অদূরদর্শী সংকীর্ণ পাশ্চাত্য স্বার্থের ওপরে স্থান দিতেই হবে। আরব গণ-অধিকারের ‘বন্দরে বন্ধনকাল’ শেষ হয়ে গেছে। সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধিতে তার অবমুক্তির বিলম্ব ঘটানো যেতে পারে, তবে রোধ করতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। অচিরেই পাশ্চাত্য শক্তিবর্গকে একটি গণতান্ত্রিক, শক্তিধর ও জ্বালানিসমৃদ্ধ আরব বিশ্বের মোকাবিলা করতেই হবে। আরব বিশ্বকে পদানত করার প্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকারের ৯/১১-এর আশঙ্কাকে বাস্তবই করতে পারে। ৯/১১-এর কারণ হচ্ছে সন্ত্রাস ও ধর্মান্ধতা। কিন্তু এই দুইয়ের কারণটি কী, সে জিজ্ঞাসার সময় এখনই। যাক, সে অন্য কথা।
পাশ্চাত্যের তাঁবেদার হোসনি মোবারক-বিহীন মিসরের পররাষ্ট্রনীতি যে গতিশীল হতে পারে, সেই দেশের পররাষ্ট্রনীতির সঞ্চালকেরা তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই রেখেছেন। কায়রো থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, আরব ফিলিস্তিনিদের সতত বিবদমান দুটি গোষ্ঠী, আল ফাতাহ আর হামাস আপাতত তাদের বিভেদ ভুলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ‘একতার সরকার’ গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আগামী এক বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবে। এই দুরূহ কাজটি গোপন আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন মিসর সরকারের উদ্যোগেই সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ মিসর এখন যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েল-বিহীন অম্বরে ডানা মেলতে পারছে।
বর্তমানে যথাক্রমে পশ্চিম তীরে আল ফাতাহ আর গাজাতে হামাসের প্রাধান্য রয়েছে। এই দুয়ের সমঝোতা ফিলিস্তিনি আরবদের অবস্থানকে দৃঢ়তর করবে। তবে সমস্যা এই যে হামাস ইসরায়েলের (তথা যুক্তরাষ্ট্রের) চক্ষুঃশূল। তার কারণ, হামাস প্রকাশ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অবলুপ্তি কামনা করে। তাই ইসরায়েলের (এবং যুক্তরাষ্ট্রের) প্রতিক্রিয়া হলো, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে শান্তি স্থাপনে ইসরায়েল আর হামাসের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। শক্ত কথা! তবে হামাসের ঘোষিত অবস্থানের নিরিখে বোধগম্য বটে। কিন্তু সদিচ্ছাচালিত কূটনীতি অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। সদিচ্ছা-প্রভাবিত কূটনীতিতে শক্ত কথার মধ্যেও সযত্নে লুক্কায়িত থাকে সমঝোতার বীজ। অতএব, চ্যালেঞ্জটি হলো পারস্পরিক বিশ্বাস আর সদ্ভাব সৃষ্টির। কথার চেয়ে কাজ এখানে বহু গুণে কঠিন—পরিকল্পনার চেয়ে বহু গুণে কঠিন সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া। ফিলিস্তিন-আরব সমঝোতা এখনো আকাশকুসুম কল্পনাই রয়ে গেছে। আরব গণজাগরণ সম্পর্কে সন্দিহান ইসরায়েল এবং তা সর্বত্র ঘটুক, তা তারা চায় না। ইসরায়েলের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হলো আরব জাগরণের এই ঢেউকে প্রতিহত করা। যুক্তরাষ্ট্র তা অবশ্যই অবজ্ঞা করতে পারে না। তাই সম্মুখের পারাবার দুস্তরই রয়ে গেছে; রয়ে গেছে বিশ্ব রাজনীতির সদাবিদ্যমান নেতিবাচক বাস্তবতা।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর এই দিনগুলো এই বহুমুখী প্রতিভার ফিলিস্তিন ভাবনার কথা স্মরণ করায়। এই ভাবনা তিনি ১৯৩০ সালে জুইশ স্ট্যান্ডার্ড নামক পত্রিকার সাংবাদিকের কাছে ব্যক্ত করেছিলেন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায়। ইংরেজিতে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারটির প্রধান প্রতিপাদ্য সংক্ষেপে তুলে ধরছি। এ জন্য আমি করুণাময় গোস্বামীর রবীন্দ্রনাথের প্যালেস্টাইন ভাবনা ও অন্যান্য বইটির সাবলীল বাংলা অনুবাদের ওপর কৃতজ্ঞচিত্তে নির্ভরশীল রইলাম।
এখানে মনে রাখার প্রয়োজন রয়েছে যে রবীন্দ্রনাথ এই সাক্ষাৎকারটি দেন ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের রক্তাক্ত অভ্যুদয়ের ১৮ বছর আগে। ইসরায়েল জন্ম নিল রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সাত বছর পর। ৮০ বছর আগের এই সাক্ষাৎকারটির সময়ে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য অথবা অন্য যেকোনো দেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের বর্তমানের কোনো নায়কই জন্মাননি।
রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হলো:
ক. ইহুদি ও আরবদের আধ্যাত্মিক সত্তা মজবুত এবং হারিয়ে যাওয়ার মতো নয়,
খ. যদি যন্ত্রসংস্কৃতির দেশ আমেরিকায় ইহুদিরা একই সঙ্গে ইহুদি ও আমেরিকান হিসেবে বসবাস করতে পারে, তা হলে তারা ইহুদি ও ফিলিস্তিনি কেন হতে পারবে না,
গ. একটি ফিলিস্তিন কমনওয়েলথ স্থাপন করা সম্ভব, যেখানে আরবরা তাদের ধর্ম পালন করবে, ইহুদিরা তাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে নবরূপ দেবে; কিন্তু আরব ও ইহুদি মিলে হবে এক ঐক্যবদ্ধ আর্থরাজনৈতিক সত্তা,
ঘ. ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান লন্ডনে বসে হবে না, তা ফিলিস্তিনেই অর্জন করতে হবে,
ঙ. আরব-ইহুদি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছাড়া ইহুদিদের আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনে এই উদ্যোগের সাফল্য আসতে পারে শুধু আরব ও ইহুদিদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে। ইহুদি অধিকারবাদী নেতারা যদি ফিলিস্তিনে ইহুদিদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে আরবদের স্বার্থ থেকে পৃথক দেখতে চান, তা হলে ‘পবিত্রভূমিতে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে’।
ভাবনা জাগে মনে, আত্মঘাতী বিস্ফোরণসমেত আধুনিক বিস্ফোরকের প্রকারভেদ সম্পর্কে বিজ্ঞানমনা রবীন্দ্রনাথের কোনো ধারণা ছিল কি? তবে বেঁচে থাকলে তিনি তাঁর ভাষায় নিশ্চয়ই বলতেন, আরব বসন্তের এই দিনগুলোই আরব-ইহুদি সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ স্থায়ী সমাধানের প্রকৃষ্ট সময়। তবে সেই সমাধান লন্ডন অথবা ওয়াশিংটনে বসে আদৌ সম্ভব নয়।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
‘ওরি মাঝে পথ চিরে চিরে
নতুন সমুদ্র তীরে
তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি...’
আমরা তো স্পষ্টই দেখছি যে মিসরে যা সম্ভব হয়েছে, লিবিয়ায় তা হচ্ছে না; তিউনিসিয়ার অবস্থার সঙ্গে সিরিয়ার নেই মিল; বাহরাইন আর ইয়েমেন কাছাকাছি অবস্থানে থেকেও এ মেরু-ও মেরু। তবে প্রত্যাশা তো রয়েছেই (কারও কারও কাছে যা ভীতি) যে, গণতান্ত্রিক আরব বিশ্ব স্বৈরাচারাধীন আরব বিশ্ব থেকে অধিকতর শক্তিধর ও একতাবদ্ধ হবে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, আরব বিশ্বের বেলায় আসে ইসরায়েল আর ফিলিস্তিন। সেটাই মূলত এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু।
মিসরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থাপন করার উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। তবে উদ্যোগটি এখনো মূলত সামরিক বাহিনীরই হাতে রয়েছে। অতএব সাধু সাবধান! তবে পর্বত আরোহণকারী স্যার এডমন্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিং জানতেন, যেমন জানেন আমাদের মুসা ইব্রাহীম যে পর্বতশীর্ষের পথে দুই পা আরোহণেও কিছুটা পদস্খলন হতেই পারে। গণতন্ত্রের যাত্রাপথ ও যে পিচ্ছিল, মিসরে হালের মুসলমান-খ্রিষ্টান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তারই প্রমাণ। দাঙ্গাটি যে কোনো কোনো মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না, তা বলা যাবে না। সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মিসর আরব বিশ্বে যে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রাখে, তা কারও কারও বিচারে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। যা-ই হোক, ভয়াবহ এই দাঙ্গাটি সরকার ও জাগ্রত মিসরীয় জনগণের সময়োচিত হস্তক্ষেপ, অন্তত আপাতত ব্যাপকতর হয়নি। আশার কথা এই যে, শুধু মিসরে নয়, আরব বিশ্বের অন্যত্রও এই গণজাগরণ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক। আমেরিকান বিশেষজ্ঞরা (বিশেষ অজ্ঞ!) বোঝেন কি না, জানা নেই যে এই গণজাগরণ ওসামাবিহীন আল-কায়েদার সন্ত্রাসী ও ধর্মান্ধতার ধারকে অনেকটাই ভোঁতা করবে এবং তা হবে বিশ্ব সন্ত্রাস-পরিস্থিতি দমনে সহায়ক। অতএব এই অবস্থাটিকে অদূরদর্শী সংকীর্ণ পাশ্চাত্য স্বার্থের ওপরে স্থান দিতেই হবে। আরব গণ-অধিকারের ‘বন্দরে বন্ধনকাল’ শেষ হয়ে গেছে। সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধিতে তার অবমুক্তির বিলম্ব ঘটানো যেতে পারে, তবে রোধ করতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। অচিরেই পাশ্চাত্য শক্তিবর্গকে একটি গণতান্ত্রিক, শক্তিধর ও জ্বালানিসমৃদ্ধ আরব বিশ্বের মোকাবিলা করতেই হবে। আরব বিশ্বকে পদানত করার প্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকারের ৯/১১-এর আশঙ্কাকে বাস্তবই করতে পারে। ৯/১১-এর কারণ হচ্ছে সন্ত্রাস ও ধর্মান্ধতা। কিন্তু এই দুইয়ের কারণটি কী, সে জিজ্ঞাসার সময় এখনই। যাক, সে অন্য কথা।
পাশ্চাত্যের তাঁবেদার হোসনি মোবারক-বিহীন মিসরের পররাষ্ট্রনীতি যে গতিশীল হতে পারে, সেই দেশের পররাষ্ট্রনীতির সঞ্চালকেরা তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই রেখেছেন। কায়রো থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, আরব ফিলিস্তিনিদের সতত বিবদমান দুটি গোষ্ঠী, আল ফাতাহ আর হামাস আপাতত তাদের বিভেদ ভুলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ‘একতার সরকার’ গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আগামী এক বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবে। এই দুরূহ কাজটি গোপন আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন মিসর সরকারের উদ্যোগেই সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ মিসর এখন যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েল-বিহীন অম্বরে ডানা মেলতে পারছে।
বর্তমানে যথাক্রমে পশ্চিম তীরে আল ফাতাহ আর গাজাতে হামাসের প্রাধান্য রয়েছে। এই দুয়ের সমঝোতা ফিলিস্তিনি আরবদের অবস্থানকে দৃঢ়তর করবে। তবে সমস্যা এই যে হামাস ইসরায়েলের (তথা যুক্তরাষ্ট্রের) চক্ষুঃশূল। তার কারণ, হামাস প্রকাশ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অবলুপ্তি কামনা করে। তাই ইসরায়েলের (এবং যুক্তরাষ্ট্রের) প্রতিক্রিয়া হলো, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে শান্তি স্থাপনে ইসরায়েল আর হামাসের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। শক্ত কথা! তবে হামাসের ঘোষিত অবস্থানের নিরিখে বোধগম্য বটে। কিন্তু সদিচ্ছাচালিত কূটনীতি অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। সদিচ্ছা-প্রভাবিত কূটনীতিতে শক্ত কথার মধ্যেও সযত্নে লুক্কায়িত থাকে সমঝোতার বীজ। অতএব, চ্যালেঞ্জটি হলো পারস্পরিক বিশ্বাস আর সদ্ভাব সৃষ্টির। কথার চেয়ে কাজ এখানে বহু গুণে কঠিন—পরিকল্পনার চেয়ে বহু গুণে কঠিন সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া। ফিলিস্তিন-আরব সমঝোতা এখনো আকাশকুসুম কল্পনাই রয়ে গেছে। আরব গণজাগরণ সম্পর্কে সন্দিহান ইসরায়েল এবং তা সর্বত্র ঘটুক, তা তারা চায় না। ইসরায়েলের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হলো আরব জাগরণের এই ঢেউকে প্রতিহত করা। যুক্তরাষ্ট্র তা অবশ্যই অবজ্ঞা করতে পারে না। তাই সম্মুখের পারাবার দুস্তরই রয়ে গেছে; রয়ে গেছে বিশ্ব রাজনীতির সদাবিদ্যমান নেতিবাচক বাস্তবতা।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর এই দিনগুলো এই বহুমুখী প্রতিভার ফিলিস্তিন ভাবনার কথা স্মরণ করায়। এই ভাবনা তিনি ১৯৩০ সালে জুইশ স্ট্যান্ডার্ড নামক পত্রিকার সাংবাদিকের কাছে ব্যক্ত করেছিলেন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায়। ইংরেজিতে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারটির প্রধান প্রতিপাদ্য সংক্ষেপে তুলে ধরছি। এ জন্য আমি করুণাময় গোস্বামীর রবীন্দ্রনাথের প্যালেস্টাইন ভাবনা ও অন্যান্য বইটির সাবলীল বাংলা অনুবাদের ওপর কৃতজ্ঞচিত্তে নির্ভরশীল রইলাম।
এখানে মনে রাখার প্রয়োজন রয়েছে যে রবীন্দ্রনাথ এই সাক্ষাৎকারটি দেন ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের রক্তাক্ত অভ্যুদয়ের ১৮ বছর আগে। ইসরায়েল জন্ম নিল রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সাত বছর পর। ৮০ বছর আগের এই সাক্ষাৎকারটির সময়ে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য অথবা অন্য যেকোনো দেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের বর্তমানের কোনো নায়কই জন্মাননি।
রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হলো:
ক. ইহুদি ও আরবদের আধ্যাত্মিক সত্তা মজবুত এবং হারিয়ে যাওয়ার মতো নয়,
খ. যদি যন্ত্রসংস্কৃতির দেশ আমেরিকায় ইহুদিরা একই সঙ্গে ইহুদি ও আমেরিকান হিসেবে বসবাস করতে পারে, তা হলে তারা ইহুদি ও ফিলিস্তিনি কেন হতে পারবে না,
গ. একটি ফিলিস্তিন কমনওয়েলথ স্থাপন করা সম্ভব, যেখানে আরবরা তাদের ধর্ম পালন করবে, ইহুদিরা তাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে নবরূপ দেবে; কিন্তু আরব ও ইহুদি মিলে হবে এক ঐক্যবদ্ধ আর্থরাজনৈতিক সত্তা,
ঘ. ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান লন্ডনে বসে হবে না, তা ফিলিস্তিনেই অর্জন করতে হবে,
ঙ. আরব-ইহুদি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছাড়া ইহুদিদের আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনে এই উদ্যোগের সাফল্য আসতে পারে শুধু আরব ও ইহুদিদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে। ইহুদি অধিকারবাদী নেতারা যদি ফিলিস্তিনে ইহুদিদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে আরবদের স্বার্থ থেকে পৃথক দেখতে চান, তা হলে ‘পবিত্রভূমিতে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে’।
ভাবনা জাগে মনে, আত্মঘাতী বিস্ফোরণসমেত আধুনিক বিস্ফোরকের প্রকারভেদ সম্পর্কে বিজ্ঞানমনা রবীন্দ্রনাথের কোনো ধারণা ছিল কি? তবে বেঁচে থাকলে তিনি তাঁর ভাষায় নিশ্চয়ই বলতেন, আরব বসন্তের এই দিনগুলোই আরব-ইহুদি সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ স্থায়ী সমাধানের প্রকৃষ্ট সময়। তবে সেই সমাধান লন্ডন অথবা ওয়াশিংটনে বসে আদৌ সম্ভব নয়।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
No comments