দিল্লির চিঠি-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কোন্নয়নের সুবর্ণ সুযোগ by কুলদীপ নায়ার

ভারত ভাগ হওয়ার কয়েক মাস আগে লাহোর থেকে প্রকাশিত উর্দু সাপ্তাহিক চাতান-এ এক সাক্ষাৎকারে কংগ্রেসের বড় নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের বাতাবরণ বদলে দেওয়ার মতো বিপর্যয়কর কিছু না ঘটলে ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠা এবং শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে বসবাস সম্ভব হবে না।’


আমার মন বলছে, পাকিস্তানের ভেতর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা, তা-ও আবার পাকিস্তানকে আগাম অবহিত না করে এবং পাকিস্তানের পক্ষে পাল্টা জবাব দেওয়ার সামর্থ্য না থাকা হয়তো সেই ‘বিপর্যয়কর’ ঘটনা। এ ঘটনায় পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব অবজ্ঞা করা হয়েছে। আর তালেবানের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের লড়াইয়ে পাকিস্তানের সহায়তা দেওয়া অবধারিত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। প্রায় ৩৫ হাজার পাকিস্তানিকে জীবন দিতে হয়েছে মার্কিন-আফগান যুদ্ধে।
কিন্তু পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর ও সেনাবাহিনী অবমাননা উতরানোর জন্য ভারতের বিরুদ্ধে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কৌশলগত আক্রমণ পরিচালনা করার সামর্থ্য ভারত রাখে কি না, এই চাতুরতাপূর্ণ প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় সেনাপ্রধানের অবিবেচক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাল, যেন তারা ভারতকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল।
পাকিস্তানের মার্জিতস্বভাব পররাষ্ট্রসচিবের কি এ কথা বলার কোনো দরকার ছিল, আক্রমণের শিকার হলে কালবিলম্ব না করে মিনিটের মধ্যেই জবাব দেবে পাকিস্তান? ভারতের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখা পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি তো সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন, কীভাবে নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে উষ্মা সঞ্চারিত করা যায়।
তিন বছর তামাদি হওয়ার পর যখন আবার দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হলো, তারই মাঝে এই উষ্মার বিস্ফোরণ ঘটল। আশা করি, দুই দেশের সংলাপ অনেক গভীরে যাবে এবং বিরোধের পুরো জায়গা তাতে ঠাঁই পাবে। আমার বিশ্বাস, যত বিলম্বেই তারা উপলব্ধি করুক না কেন, দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা ভিন্ন অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
পাকিস্তানকে আবার বিশ্বাস করবে যুক্তরাষ্ট্র? সে তো হবে না। ওয়াশিংটন যে একাই ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করল, ঘনিষ্ঠ মিত্রকে গোচরে আনল না—এতেই সব পরিষ্কার। যুক্তরাষ্ট্র কেন কোনো সার্বভৌম দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে, সে ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত দিতে দেখা গেল না তাদের; ক্ষমা চাওয়া তো বহু দূরের বিষয়।
আমার বিশ্বাস, গোয়েন্দা তথ্যাদি আদান-প্রদানের ব্যাপারে ওয়াশিংটন কোনো দিনই ইসলামাবাদকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। যুক্তরাষ্ট্র শুধু আল-কায়েদা ও তালেবানসংক্রান্ত তথ্যাদি আদান-প্রদান করেছে, কিন্তু কখনো ওসামার বিষয়ে নয়। ওসামার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল, আর এ কাজে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কয়েক ডজন পাকিস্তানিকে নিয়োগ দিয়েছিল। সার্বভৌম, স্বাধীন পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়ক নিজস্ব ব্যবস্থা জারি ছিল, আর এখনো তা বহাল আছে।
পাকিস্তানের জনগণ যৌক্তিকভাবেই তাদের সেনাবাহিনী ও সরকারকে অক্ষমতার জন্য অভিযুক্ত করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি বললেন, ওসামার ব্যাপারে তাঁরা জানতেন না। তাঁর এ বক্তব্যে জবাব মেলে না, ওসামা কেমন করে অন্তত পাঁচ বছর ধরে বসবাস করলেন অ্যাবোটাবাদের মতো রক্ষীনগরে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পরাজয়ের পর পাকিস্তান যেমন কমিশন গঠন করেছিল, সে ধরনের একটা কমিশন নিয়োগ করে সেসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে দেখা দরকার। হামুদুর রহমান কমিশন তখন যে ‘ব্যর্থতা’র কথা বলেছিল, এবারকার ‘ব্যর্থতা’ তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কোনো তদন্ত তা সে সরকারি কিংবা সামরিক যা-ই হোক না কেন, সেটা স্বাধীন ও সমন্বিত হবে না, কিংবা তা বিশ্বাসযোগ্যতাও জাগাতে পারবে না।
জাতীয় পরিষদে প্রধানমন্ত্রী গিলানির বক্তৃতায় পাকিস্তান কোনো শিক্ষা নিয়েছে, তেমন কোনো লক্ষণ ফুটে ওঠে না। যুক্তরাষ্ট্রকে তুলোধুনো করার মাধ্যমে আসলে নিজের সরকারের ব্যর্থতারই অজুহাত দাঁড় করানো হচ্ছে, তার বেশি কিছু নয়। কখন পাকিস্তান নিজের ভেতরে তাকাবে, আর তার ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পুনর্বিবেচনা করবে? এবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র আরও বহুবার পাকিস্তানে ঢুকবে হয়তো। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহ, অ্যাবোটাবাদে ওসামার উপস্থিতিই শেষ কথা নয়, আরও ব্যাপার আছে। তাই ইসলামাবাদকে প্রস্তুত থাকা উচিত এ ধরনের ঘটনা দেখার জন্য। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সংশয় পরিষ্কার বোঝা যায় ভারতের মুম্বাইয়ে ২৬/১১ হামলায় পাকিস্তানের হাত থাকার বিষয়ে শিকাগোতে দায়ের করা এক মামলায়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রকাশ্যে বলেছেন, পাকিস্তান সরকারের ভেতরে ও বাইরে কারা ওসামাকে সহায়তা করছিলেন, সেটা তাঁরা তদন্ত করবেন। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যত দূর পর্যন্ত এগোতে পেরেছিল, তত দূর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে পারবে না। কেননা, পাকিস্তানের সমর্থন ছাড়া আল-কায়েদা ও তালেবানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে তীব্রতা ও গভীরতা অর্জন সম্ভব হবে না। তবে লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে তাদের উপস্থিতি কমাবে বলে আমার মনে হয় না।
সুতরাং, ভারতের প্রতি নিজেদের নীতি পুনর্বিবেচনা করতে ইসলামাবাদের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো সুযোগ। পাকিস্তানি শাসককুল আর কত কাল তাদের শিশুদের শেখাবে, ভারত তোমাদের শত্রু! ৬০ বছর ধরে এই প্রচারণা চালিয়ে পাকিস্তানের কোনোভাবে কোনো উপকার হয়নি, পাকিস্তানি জনগণকেও বোঝানো যায়নি—ভারত জুজু ভয়ংকর, এর থেকে দূরে থাকতে হবে। বাস্তবতা হলো, ভারতীয়দের সঙ্গে মোলাকাতে পাকিস্তানিরা তাদের ঘর ও হূদয় অবারিত করে দেয়। গৎবাঁধা অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে ভিন্নতাকে যাচাই করতে ইসলামাবাদ বন্ধুসুলভ হয়ে দেখতে পারে। অসামান্য ফল পাবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.