পরিবহন-কার টাকায় কাকে ভর্তুকি by আলতাফ পারভেজ

বাংলাদেশের নাগরিক সভ্যতার প্রধান প্রকাশ এখন প্রাইভেট গাড়িতে। কিন্তু এসব গাড়ির চালক ও মালিকরা কতটা সভ্য? আবাসিক এলাকা, স্কুল, হাসপাতাল নির্বিশেষে হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে চলেছেন তারা। বৃষ্টির মাঝে রাস্তার ময়লা পানি পথচারীদের গায়ে ছিটিয়ে চলে যাচ্ছেন। কখনওবা গাড়িটি পার্ক করছেন পুরো রাস্তা ও ফুটপাতজুড়ে।


কেউ কিনে, কেউবা অফিসের গাড়িতে চড়ছেন। গাড়ি ক্রয়ে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো উদার; ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি নিয়েও বসে আছে সরকার। এভাবে গাড়ি বিপ্লবের পটভূমি প্রস্তুতই ছিল। কিন্তু সেই বিপ্লবের অপব্যবহারে নগর জীবন ক্লান্ত, বিপন্ন। আসাদ গেটে বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা জানালেন, তাদের অনেক শিক্ষার্থী একই পরিবার থেকে এলেও পৃথক পৃথক গাড়িতে আসে!
বলাবাহুল্য, যেসব পরিবারে প্রত্যেক সদস্যের জন্য পৃথক পৃথক গাড়ি রয়েছে তাদের সুবিধা অনেক। কেউ আইসক্রিম খেতে গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছেন, কেউবা ক্লাবে যাচ্ছেন গাড়ি নিয়ে, কেউবা বের হচ্ছেন ইয়াবার খোঁজে।
প্রতিদিন কেবল ঢাকাতে ১৫০-২০০টি নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে। স্বভাবতই এত গাড়ি ধারণ করার মতো ঠাঁই নেই রাস্তায়। অথচ সর্বত্র যানজটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে রিকশাকে। গণমাধ্যমে যানজটের ছবি মানেই একগুচ্ছ রিকশা। কারণ অবোধগম্য নয়। রিকশা ও বাসে প্রাইভেট গাড়ির চালকরা বিরক্ত।
আমাদের গণমাধ্যম রিকশাকে যানজটের কারণ হিসেবে প্রতিনিয়ত শনাক্ত করলেও বিশ্বজুড়ে গবেষণা-স্বীকৃত, প্রাইভেট গাড়ির 'ইউজলেস ট্রিপ'ই যানজটের কারণ। ঢাকায়ও গড়ে অর্ধেক প্রাইভেট কার চলন্ত অবস্থায় যাত্রীহীন দেখতে পাওয়া যায়। যেসব পরিবারে এখনও একটি গাড়ি তাদের সেই বাহনটি বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আবার বাসায় যাচ্ছে কর্তাকে অফিসে নিতে; তারপর আবার ফিরবে গিনি্নর ব্যবহারের জন্য। এভাবে একটি প্রাইভেট কার যখন দিনে ছয়বার প্রধান সড়ক দিয়ে চলছে তখন তিনবারই যাচ্ছে অপ্রয়োজনীয়ভাবে। যে ট্রিপগুলো তার দরকারি সেখানেও গড়ে যাত্রী পরিবহন হয় তিন-চারজন মাত্র।
গবেষণা সংস্থা 'ডবিল্গউবিবি ট্রাস্ট'-এর জরিপে দেখা গেছে, প্রাইভেট কারের ৪০ ভাগ মুভমেন্টই 'ইউজলেস ট্রিপ'। রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি মূল্যের জ্বালানিতে এ ধরনের 'ইউজলেস ট্রিপ' বড় এক জাতীয় অপচয়। জ্বালানি তেল খাতে সরকারের ভর্তুকি এ বছর ২৬ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে। এ হিসাবের বাইরে রয়েছে সিএনজির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গ্যাস সম্পদের অপচয়। এসব ভর্তুকি ও অপচয় প্রধানত প্রাইভেট গাড়ির মালিকদের ভোগে লাগছে।
কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা গ্যাস সম্পদ রফতানির বিরুদ্ধে সম্প্রতি আন্দোলন গড়ে তুলেছে। রফতানির হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখে দেওয়া গেলেও এ গ্যাস গাড়ি মালিকদের একচেটিয়া ভোগেই শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে। এ মুহূর্তে বসতবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া বন্ধ। গ্যাস লাইন সম্প্রসারণও বন্ধ। কিন্তু প্রাইভেট গাড়ির সিলিন্ডার কোনো অবস্থাতেই শূন্য থাকছে না। অথচ এ গ্যাসের মালিক সারা দেশের মানুষ। বহু জেলার মানুষ কখনোই গ্যাস সম্পদের সুবিধা ভোগ করেনি এবং হয়তো করবেও না। কিন্তু দুর্নীতির মাধ্যমে একটি গাড়ি কিনে যে কেউ সেই সুবিধা প্রতিদিনই ভোগ করতে পারেন।
ঢাকায় এ মুহূর্তে রিকশার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ। তবে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেওয়া অব্যাহত আছে। দেশজুড়ে ২০০৩ সালে বাস ছিল ৩০ হাজার ৬শ' এবং ছয় বছর পর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৮ হাজার ৪শ'। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ২৫ শতাংশ। একই সময়ে প্রাইভেট কার বেড়েছে ৭৮ শতাংশ (১১৬১৯৬ থেকে ২০৭৫০৩)। এ ক্ষুদ্র তথ্যটিতেও স্পষ্ট, আমাদের নীতিনির্ধারকরা কীভাবে নগরীগুলোকে প্রাইভেট গাড়ির মালিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন।
ঢাকায় নগর কর্তৃপক্ষ বহু সড়কে রিকশা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে ওই সব সড়কের কাছে যাদের বাসস্থান এবং তাদের মধ্যে যারা প্রাইভেট গাড়ির মালিক নন তাদের যন্ত্রণা অবর্ণনীয়। সন্তানসম্ভবা নারীকে নিয়ে, অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নিয়েও ওই সব সড়কে রিকশা প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। অথচ প্রাইভেট কার অবলীলায় সেখানে চলাচল করছে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এরূপ নির্মম বৈষম্যের বিরুদ্ধে কোনো জনপ্রতিনিধিকে কখনও আপত্তি করতে দেখা যায়নি।
অনেকেরই অনুমান, ঋণ ব্যবসায়ী ব্যাংক, গাড়ি ব্যবসায়ী এবং গাড়ি ব্যবহারকারীদের মিলিত সিন্ডিকেটের কাছে আত্মসমর্পণকারী সরকারি নীতিনির্ধারকরা সমাজে প্রাইভেট গাড়ির প্রচলন বাড়াতে রিকশাবিরোধী নানা ধরনের নীতিমালা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। যে কারণে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও সময়মতো কাজকর্ম সমাধা করার জন্য গাড়ি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় এবং এর ফলে যানজট কেবল আরও তীব্র হয়।
বিশ্বের অধিকাংশ সভ্য দেশে যানজট নিরসনে প্রাইভেট বাহন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যে কেউ এরূপ গাড়ি ক্রয় করতে পারেন, যখন-তখন এবং যত্রতত্র ব্যবহার করতে পারেন। জীবনে কখনও রাষ্ট্রকে সামান্যতম কর দেননি এমন ব্যক্তিও এখানে প্রাইভেট কারের মালিক। অথচ মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতনও এখানে আয়করযোগ্য। করের আওতাবহির্ভূত এ গাড়ির মালিকদের আয়ের উৎস বোঝা দুঃসাধ্য। হয়তো অনৈতিক ও অসভ্য কোনো পথে সৃষ্ট আয়ের মাধ্যমেই আজকের গাড়ি বিপল্গব সংঘটিত হয়েছে নগরগুলোতে।
ঢাকার গাড়ি ব্যবহারকারীদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ফুটে ওঠে গাড়ির সাজ-সজ্জাতেও। অধিকাংশ প্রাইভেট গাড়িতেই ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বাম্পার লাগানো হয়। এ বাম্পার লাগানো হয় রিকশাসহ দুর্বল যানকে শক্তভাবে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। প্রতিদিন সর্বত্র এ বাম্পারে লেগে রিকশা যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাম্পারে আটকিয়ে আহত যাত্রীসহ রিকশাকে বহু দূরে টেনে নিয়ে যাওয়ার ছবি গণমাধ্যমেও একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গাড়ি থেকে বাম্পার খোলানো যায়নি।
গাড়ি ব্যাপকভাবে পরিবেশ দূষণ করলেও এ দেশে গাড়ি ব্যবহারকারীদের কোনো ধরনের পরিবেশ কর দিতে হয় না। এমনকি ঢাকায় প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য কোনো ফি দিতে হয় না। যেসব স্থানে ফি দিতে হয় সেখানেও ১০-১৫ টাকা দিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়।
বিশ্বের বিখ্যাত শহরগুলোতে রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করা যায় না। পার্কিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। এখানে গাড়ি মালিকদের বিরল সৌভাগ্য, অধিকাংশ শপিংমলের সামনে ইচ্ছামতো গাড়ি পার্কিং করে শপিং করতে পারেন তারা। অথচ বাস বা রিকশা কখনও এভাবে পার্কিংয়ের নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তা দখল করে বসে থাকে না। পার্কিংয়ের জায়গা বিবেচনা করলে প্রাইভেট গাড়ি একজন মালিককে যে সুবিধা দেয় একই জায়গা ব্যবহার করে রিকশা আরও কম সময়ে বহু মানুষকে সেই সুবিধা দেয়। শহরের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সড়কে প্রাইভেট গাড়ির অবাধ পার্কিং সুবিধা থাকলেও রিকশাকে নূ্যনতম সময়ের জন্যও দাঁড়াতে দেওয়া হয় না। অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট সিকিউরিটি পার্সোনাল নিয়োগ করে রেখেছে রিকশা তাড়িয়ে প্রাইভেট গাড়ির জন্য পার্কিং নির্বিঘ্ন রাখার জন্য।
কেবল একটি প্রাইভেট কার তার পার্কিংয়ের জন্য প্রায় ১৫০ বর্গফুট জায়গা ব্যবহার করে। মতিঝিলে এ পরিমাণ জায়গার দাম ২০-২৫ লাখ টাকা। অথচ প্রাইভেট কার মালিকরা বিনামূল্যে এরূপ পাবলিক প্রপার্টি ব্যবহার করে চলেছেন নির্বিঘ্নে দিনের পর দিন। এরূপ স্থানে রিকশাকে সামান্যতম সময়ের জন্যও দাঁড়াতে দেওয়া হয় না। অথচ একটি রিকশা একজন যাত্রী নামিয়ে ৫-৬ মিনিট দাঁড়িয়েই আরেকজন যাত্রীকে সার্ভিস দিয়ে থাকে।
প্রাইভেট গাড়ির মালিকরা নগরীর দুই শতাংশ অধিবাসী হলেও আমাদের পুরো নগর পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে তাদের গাড়ির নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্নতার ভাবনা। ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে সবই প্রাইভেট গাড়ির চলাচল নির্বিঘ্ন করতে। অথচ প্রাইভেট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে এসব মেগা প্রকল্পের অর্থ দিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সুবিধা বাড়ানো যায় ব্যাপক আকারে। প্রাইভেট গাড়ির মালিক ও নীতিনির্ধারকরা একই শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করছেন বলেই পরিকল্পনাগুলো এভাবে প্রকৃত গতিমুখ হারিয়ে ফেলছে।

আলতাফ পারভেজ : লেখক, গবেষক
altafparvez@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.