অর্থনীতি-তারল্য, মুদ্রাস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির সংকট by ফারুক মঈনউদ্দীন

চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান সমস্যা হয়ে ওঠে তারল্য-সংকট। প্রায় সব কটি প্রধান ব্যাংকের ফেঁপে ওঠা ঋণ কাঙ্ক্ষিত ঋণ-আমানত অনুপাতের নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্কসংকেত পাঠায়। এই সতর্কসংকেতের মূল বক্তব্য ছিল দুটি: ঋণ-আমানত অনুপাত কাঙ্ক্ষিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনা এবং


অপ্রয়োজনীয় খাতে ঋণ সম্প্রসারণ বন্ধ করা। কারণ, দুই বছর ধরে ব্যাংক ঋণের প্রবাহ উদ্দাম গতিতে বাড়ছিল, তার সঙ্গে বেড়ে চলছিল রিয়েল এস্টেট খাতে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি। এই প্রবণতাকে রোধ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভূসম্পদ ক্রয়ের জন্য ব্যাংকের ঋণদান বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তাতে করে জমির দাম বৃদ্ধি রোধ করা যায়নি। ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত ৮৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ সম্প্রসারণ কার্যক্রম থেমে গিয়ে ঋণ সংকোচনে পর্যবসিত হয়। ফলে নতুন ঋণ অনুমোদন না করে ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ের দিকে অধিক নজর দিতে হচ্ছে।
এ কথা সবার নিশ্চয়ই জানা আছে যে ঋণ সহজলভ্য হলে দেশের অর্থনীতিতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে যায়, ফলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। এই মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে মুদ্রানৈতিক যে অস্ত্র থাকে, তা হচ্ছে সুদের হার বৃদ্ধি করা এবং ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগযোগ্য তহবিল সংকুচিত করা। শেষোক্তটি প্রয়োগ করা হয় দুভাবে—নগদ জমা (ক্যাশ রিজার্ভ রিকয়ারমেন্ট, সংক্ষেপে সিআরআর) এবং সংবিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের (স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রিকয়ারমেন্ট, সংক্ষেপে এসএলআর) হার বৃদ্ধি করে। এই তারল্য সংরক্ষণের হারের ওপর নির্ভর করে ব্যাংকের ঋণ সম্প্রসারণ কার্যক্রম, যা হিসাব করা হয় গুণক (মাল্টিপ্লায়ার) দিয়ে। ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ বিভিন্ন ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা হয়, সেই আমানতের ঋণযোগ্য অংশ আবার ঋণ হিসেবে বাজারে গিয়ে অন্য ব্যাংকের আমানতে পরিণত হয়। সেই আমানত থেকে সিআরআর এবং এসএলআর বাদ দিয়ে আবার ঋণ বিতরণ করা হয়। এভাবে দেখা যায়, ১০০ টাকা আদি আমানত (উদাহরণ হিসাবে ২০ শতাংশ তারল্য সংরক্ষণের পর) বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ হিসেবে ঘুরতে ঘুরতে মোট ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় (১০০x.২০) ৫০০ টাকায়। এই তারল্য সংরক্ষণের হার যদি ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়, তাহলে আদি ১০০ টাকা দাঁড়ায় (১০০x.১৫) ৬৬৬ টাকায়। এই তাত্ত্বিক বিবেচনায় মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা সামনে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১০ সালেই দুই দফায় ব্যাংকগুলোর সিআরআর বাড়িয়ে পরিস্থিতির হাল ধরতে চেয়েছিল। মে ২০১০ সালে এই হার এক দফা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, দ্বিতীয় দফায় আবারও একবার বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়। অথচ ১৯৯৭ সালের পর থেকে আমাদের সিআরআর কখনোই ৫ শতাংশের ওপর যায়নি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর থেকেই ঋণপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করে মুদ্রাস্ফীতির রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করেছিল মুদ্রানীতির মাধ্যমে।
কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ সম্প্রসারণের মাত্রা এমন একপর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে তার লাগাম হঠাৎ করে টেনে ধরা কঠিন হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক বর্তমান অর্থবছরের (২০১০-১১) প্রথম পাঁচ মাসে (২০১০ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর) অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ, আর একই সময়ে বেসরকারি খাতে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ পুরো অর্থবছরের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যেখানে আগের অর্থবছরে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল মাত্র ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণযোগ্য তহবিলকে মোট আমানতের ৮৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ সম্প্রসারণের ফলে মূল্যস্ফীতি ঘটার মূল কারণ বাজারে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি, যার কারণে চাহিদা বেড়ে যায়। আর চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত মূল্যস্তর। তবে ঋণ সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবেই, সেটা স্বতঃসিদ্ধ নয়। মূলত অর্থনীতিতে সবকিছুই অনেক ধরনের উপাদান ও ব্যতিক্রমের ওপর নির্ভরশীল। ঋণ ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির সঙ্গে যদি উৎপাদনশীলতা বাড়তে থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি ঘটে না। আবার অর্থের গতি যদি কম হয়, সে ক্ষেত্রেও ঋণপ্রবাহ বাড়ার সমানুপাতে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে না। অর্থের গতি বলতে আমরা বুঝি, একটি অর্থনীতিতে কতবার অর্থ হাতবদল হয়। কোনো একটা অর্থনীতিতে এক কৃষক আর এক জেলের কাছে যদি ১০০ টাকা থাকে, কৃষক ১০০ টাকা দিয়ে জেলের কাছ থেকে মাছ কেনে। জেলে এই টাকা থেকে ৬০ টাকা দিয়ে কৃষকের কাছ থেকে চাল কেনে, আর বাকি ৪০ টাকা দিয়ে ডাল, মসলা ইত্যাদি কেনে। তাহলে কৃষকের খরচ করা ১০০ টাকা এবং জেলের খরচ করা মোট ১০০ টাকা মিলে মোট খরচ হয় ২০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে অর্থের গতি হচ্ছে দুই। এই গতি যদি আরও বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল আছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময়ে মানুষ অর্থ ধরে রাখে না, বিভিন্ন কারণে খরচ করে ফেলে, তাই অর্থের গতিশীলতা বাড়ে। অন্যদিকে মুদ্রা সংকোচনের সময় অর্থের গতি কমে যায়, কারণ মানুষ তখন খরচ না করে বরং সঞ্চয় করে।
সনাতনী ধারণামতে, অতিরিক্ত পরিমাণ অর্থ যদি স্বল্প পরিমাণ পণ্যের পেছনে ধাবিত হয়, তখন মূল্যস্তর বেড়ে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। কেইনস অবশ্য মুদ্রাস্ফীতিকে মুদ্রানৈতিক ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখেননি। তাঁর সংজ্ঞামতে, দ্রব্য এবং সেবার কার্যকর মোট চাহিদা যখন তার সরবরাহের চেয়ে বেড়ে যায়, তখন মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। অর্থনীতিতে মোট চাহিদা বলতে বোঝায়, পণ্য ও সেবার ওপর ভোক্তাদের মোট ব্যয়, মোট বিনিয়োগ ব্যয়, মোট সরকারি ব্যয় এবং নিট রপ্তানি আয় (আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে)—এ সবকিছুর সমষ্টি। অতএব এই মতানুসারে একটি অর্থনীতিতে উপরিউক্ত বিভিন্ন কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পেলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এ সময় অতিরিক্ত চাহিদার কারণে দ্রব্য ও সেবার সরবরাহের মূল্য যখন বেড়ে যায়, অর্থনীতির ভাষায় তাকে বলা হয় চাহিদাজাত মুদ্রাস্ফীতি (ডিমান্ড পুল ইনফ্লেশন)। আবার উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি কিংবা সংগ্রহমূল্য বৃদ্ধির কারণে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে, তাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি (কস্ট পুশ ইনফ্লেশন)।
শাস্ত্রীয়ভাবে বলতে গেলে মুদ্রানীতির মূল কর্মপরিধি হচ্ছে চাহিদা ব্যবস্থাপনা। এটা দিয়ে অর্থনীতির মোট চাহিদাকে প্রভাবিত করে তার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে চাহিদাজাত মুদ্রাস্ফীতিকে বাগে আনার চেষ্টা করা যায়। এটা সুস্পষ্ট যে নগদ জমা কিংবা সংবিধিবদ্ধ তারল্য বাড়িয়ে দিলে বাজারে তারল্য ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে মুদ্রাবাজারে স্বল্প মেয়াদে সুদ বেড়ে যায় এবং বাড়তি তহবিল সংগ্রহের তাগিদের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে আমানতের ওপর সুদ এবং এর ফলে ঋণের ওপর সুদ বেড়ে যায়। এতে করে বিনিয়োগ কমে যায়, আর তার কারণে অর্থনীতিতে মোট চাহিদা হ্রাস পায়। হ্রাসকৃত বিনিয়োগের জন্য মানুষের ভোগ কমে যায়, যা আবার প্রভাব ফেলে মোট চাহিদার ওপর। ফলে দেখা যায়, ঋণ সংকোচন করে বিনিয়োগ, মানুষের আয় এবং ক্রয়ক্ষমতা কমানো যায়, যে প্রক্রিয়ায় একসময় অর্থনীতিতে দেখা দেয় মন্দাবস্থা, যা মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত।
বাংলাদেশে যে ধরনের মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা দেখা যায়, সেটা সীমিত কিছু ক্ষেত্রে চাহিদাজাত হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধিজনিত। দেশের রিয়েল এস্টেট খাতে গত কয়েক বছরে যে অবিশ্বাস্য মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে, সেটা পুরোপুরি চাহিদাজাত। এমনকি ভূসম্পদের এই মূল্যস্ফীতি বিদেশি বিনিয়োগের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তবে আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়, তা মূলত খাদ্য এবং অন্যান্য কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ভোক্তা মূল্যসূচকের ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়। এই মূল্যসূচকের মধ্যে খাদ্যমূল্য একটা প্রধান উপাদান। ভূসম্পদ খাতের মূল্যস্ফীতি যদি হিসাবের মধ্যে ধরা হতো, তাহলে মুদ্রাস্ফীতির হার আরও বহুগুণ বেশি দেখা যেত। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য কিংবা জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার সঙ্গে আমাদের দেশের মূল্যস্তরের যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তার কারণে এমনকি দেশে খাদ্যের বাম্পার ফলন হলেও বাজারব্যবস্থা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে খাদ্যমূল্য কাঙ্ক্ষিত হারে কমে না। ফলে ব্যয় বৃদ্ধিজনিত এই মুদ্রাস্ফীতির একটা ক্রমপ্রবাহ আমাদের সাধারণ মানুষকে যেমন কাতর করে রাখে, তেমনি সরকারকেও ফেলে রাখে বিপাকে।
অর্থ সরবরাহ হ্রাস করে মুদ্রাস্ফীতির রাশকে কিছু মাত্রায় হলেও টেনে রাখা যায়, তবে এতে করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও হোঁচট খায়। মুদ্রাস্ফীতি রোধের এই কঠিন ভারসাম্য রক্ষাকারী কাজটি সব সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই পালন করতে হয়। সেটা করতে গিয়ে কোনো কোনো অতিরিক্ত ঋণপ্রসারী ব্যাংক কিংবা সমগ্র ব্যাংকিং খাতের তারল্যের ওপর চাপ পড়তে পারে, হ্রাস পেতে পারে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান। অতিসম্প্রতি ভারতেও ব্যাংক রেট বাড়িয়ে দিয়ে রিজার্ভ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি রোধ করার কৌশল গ্রহণ করেছে। কারণ, তাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে মুদ্রাস্ফীতি রোধ করার জন্য প্রয়োজনে স্বল্পমেয়াদি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যকে উপেক্ষা করা যায়। সে কারণে গত ১৫ মাসে ভারতে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে নয়বার। অতএব মূল্যস্ফীতি রোধ করা যদি সরকারের অগ্রাধিকার হয়, তাহলে সেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অনেকের কাছে অপ্রিয় হলেও মুদ্রা সংকোচন নীতিটি দৃঢ়ভাবে প্রতিপালন করা হবে, সেই মানসিক প্রস্তুতি আমাদের থাকতে হবে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.