ঢাবি সমাবর্তন-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী দান-প্রতিষ্ঠান by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

যেসব শিক্ষার্থী সনদ ও সেরাদের সেরা হওয়ার জন্য পদক নিচ্ছে তাদের অভিবাদন। তাদের হাসিমুখ দেখে পিতামাতার আনন্দের শেষ থাকবে না। অনেক পরিশ্রম করেই কেবল শিক্ষায় এত দূর পর্যন্ত আসা যায়। তবে বৃহত্তম কর্মযজ্ঞ তাদের সামনে। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ থাকবে, অন্যায়ের কাছে তোমরা নিজেদের হারিয়ে ফেল না।


প্রত্যেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও, এটাই কাম্য। ধনে-মানে-জ্ঞানে সবদিক থেকেই এটা হতে হবে। এ নতুন জীবনে যেখানে যা পাবে, তার একটি অংশ ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের, যাদের অর্থে পরিচালিত হয় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিষ্ঠার ৯১ বছর পূর্ণ হবে আগামী ১ জুলাই। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বাংলার তৎকালীন গভর্নর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড লিটন সমাবর্তন ভাষণ দেন। প্রতি বছরই বিদায়ী শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের আয়োজন হওয়ার কথা। কিন্তু আজ ৩১ মার্চ ৪৬তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এ তথ্য থেকেই স্পষ্ট বাংলাদেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় অভিষিক্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি দুই বছরে একটি সমাবর্তনের আয়োজন করতে পেরেছে। মাঝে অনেক বছর অনিয়মিত আয়োজনের জন্যই এ সমাবর্তনজট। এ কারণে সমাবর্তনের সময় আবেগ-আনন্দের পাশাপাশি আমার ব্যক্তিগত আক্ষেপও প্রকাশ পায়। প্রচলিত মানদণ্ডে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েও আমি সমাবর্তন মঞ্চ থেকে পরম সম্মানিত কোনো অতিথির কাছ থেকে শিক্ষা সনদ ও পদক গ্রহণ করতে পারিনি। যারা মাননীয় চ্যান্সেলরের কাছ থেকে সনদ নেবেন, তাদের গর্ব-অহংকার আমি উপলব্ধি করতে পারি।
তবে হাল আমলে নিয়মিতই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং কোনো অজুহাতেই যেন এর ব্যত্যয় না ঘটে। পৃথিবীর সর্বত্র উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সনদ গ্রহণ শিক্ষার্থীদের অধিকার হিসেবে গণ্য হয়। গাউন ও মর্টারবোর্ড বা বিশেষ চৌকা টুপি পরে ছবি তোলা ও আনন্দে ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য প্রকৃতপক্ষে দেশকাল মানে না। ক্যাম্পাসে যারা নতুন আসে, তারা এমন অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
এ বছরে সমাবর্তনকে বলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ_ ১৭ হাজারের বেশি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা এতে অংশ নেবেন। আগামীতে এ সংখ্যা বাড়বে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বেড়ে চলেছে। এ ধরনের বড় আয়োজনে অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। তারপরও আমার একটি অনুরোধ থাকবে কর্তৃপক্ষের প্রতি_ অতীতে যেসব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা সমাবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষা সনদ ও সেরাদের সেরা হওয়ার পদক নিতে পারেনি তাদের দুই-তিনটি ব্যাচকে সমাবর্তনের প্রতিটি আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো। তাদের কেউ কেউ হয়তো বেঁচে নেই। তাদের সন্তানরা তা গ্রহণ করতে পারেন। আমার মতো অনেকেই হয়তো বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একত্রে মঞ্চে উঠে যাব। তাতে বরং আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
গত নয় দশকে আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় অনেক এগিয়েছে। নতুন নতুন বিভাগ ও ইনস্টিটিউট গড়ে উঠছে। বাড়ছে আবাসিক হল। ছাত্রছাত্রী অনুপাত প্রায় কাছাকাছি এবং এ অবস্থার মূলে কোনো কোটা নয়, বরং মেধার লড়াইয়ে যোগ্য বিবেচিত হয়েই তারা স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের কিছু দুর্বলতাও এখন প্রকটভাবে ধরা পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান সৃষ্টি, চর্চা, লালন ও বিতরণ কেন্দ্র। এক সময়ে এ প্রতিষ্ঠান বিশ্বের সেরা ৫০০ উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল। কিন্তু এখন পাঁচ হাজারের সারিতেও নাকি পাওয়া যায় না! আমরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি। আকারে-পরিমাণে বাড়লেও গুণগত উৎকর্ষে দারুণ সমস্যা থেকে যাচ্ছে। সমাবর্তনে যারা সনদ গ্রহণ করবেন এবং এর আয়োজনে যারা যুক্ত তাদের সবাইকে এ বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করার অনুরোধ করব। এখানে শুধু সনদ পাওয়া নয়, নিজেকে কীভাবে আরও ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য যথাযোগ্যরূপে গড়ে তুলতে পারি, তারও আলোচনা হতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বাজেট আসে সরকারি তহবিল থেকে। এর পরিমাণ অপ্রতুল এবং এ কারণে গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ মেলে না। গ্রন্থাগারের অবস্থা শোচনীয়। ভৌত অবকাঠামো দুর্বল। এ পরিবেশে ব্যক্তিগত মেধা ও কঠোর পরিশ্রমে কিছু শিক্ষার্থী বিকাশের পথ খুঁজে পায়। কিন্তু বেশিরভাগ তাদের স্বপ্নের পূর্ণতা দিতে পারে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার অব এক্সসেলেন্স আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত জগৎ সেরাদের আসরে স্থান করে নেওয়ার মতো করে ক'জন সেখান থেকে বের হয়ে আসছেন? এসব সমস্যা সমাধানের জন্য উচ্চশিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এটা দুঃখজনক যে, ভারতের তুলনায় আমাদের এ খাতে সরকারি বরাদ্দ যথেষ্ট কম, এমনকি পাকিস্তানের তুলনাতেও কম।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে শক্তিশালী করা। এখন পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানটির কাজ অনেকটা পোস্ট অফিসের মতো। তাদের কাজের পরিসর যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ দিকনির্দেশনা প্রদানের মতো সক্ষমতাও চাই।
শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াও একটি বড় সমস্যা। রাজনীতি প্রাধান্য পায়, এটা বড় সমস্যা। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে তাদের অনুগতরাই স্থান করে নেয়। শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মী নিয়োগে তাদের পছন্দই হয় চূড়ান্ত। তবে এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শিক্ষক নিয়োগেই দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পায়। কিন্তু এটা যদি শতকরা ১০ ভাগও হয়ে থাকে, তার প্রভাব কিন্তু শ্রেণী কক্ষে পাঠদানে এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নসহ অন্যান্য বিষয়ে পড়বে।
ভর্তি ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও ভাবতে হবে। ভর্তি পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ, এটা এখন কমবেশি সবাই স্বীকার করবেন। এমসিকিউ পদ্ধতিতে মেধার যথাযথ বিচার হয় না। ইংরেজি বিভাগে দেখছি, এখানে পড়ার জন্য অনেকে তৈরি থাকে না। বিষয়বস্তু ধরে উঠতে উঠতে অনেকের দুই বছর চলে যায়। এরপর তাদের ওপর অসম্ভব চাপ পড়তে থাকে। অবকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। ১০০-১৫০ জন শিক্ষার্থী থাকে এক একটি ক্লাসে। সেমিস্টার পদ্ধতির সঙ্গে তা খাপ খায় না। এ জন্য আদর্শ হচ্ছে ২০-২২ জন ছাত্রছাত্রী। পাওয়ার পয়েন্টের সুবিধা রয়েছে সীমিতসংখ্যক রুমে। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু থেকেই এ সুবিধা পায় সব শিক্ষার্থী। শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। পরীক্ষা নেওয়ার পর অনেক সময় চলে যায় ফল প্রকাশে। এ কারণে যারা খারাপ করে কিংবা মানোন্নয়নের পরীক্ষা দিতে চায়, তাদের হাতে সময় থাকে না। টিউটোরিয়ালের বাড়তি বোঝাও বহন করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা সেমিস্টার চালু করেছি, কিন্তু মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রেই রয়ে গেছে সাবেক পদ্ধতিতে। এখনও ৫০ মিনিটের ক্লাস নেওয়া হয়, যা হওয়া উচিত অন্তত দেড় ঘণ্টার। ফলে শিক্ষক হিসেবে অতৃপ্তি নিয়ে বের হই ক্লাস রুম থেকে। কখনও যদি অসুস্থ হই কিংবা অতি জরুরি কাজ পড়ে, তা পুষিয়ে দেওয়ার সুযোগ আর মেলে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগেও অভিন্ন পদ্ধতি চালু করা যায়নি। সাবেক কোর্স পদ্ধতিতেই পড়ানো ও পরীক্ষা চলছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে।
ঢাকা এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুধু শিক্ষার মধ্যেই সীমিত থাকার কথা নয়। এখানে সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্য রয়েছে সেই সূচনাকাল থেকে। হাল আমলে তাতে ভাটা পড়েছে, এমন অভিমত রয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র আর আগের মতো প্রাণচঞ্চল ও জমজমাট নেই।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়েও কেউ ভাবার নেই। এক সময় সমাবর্তন নিয়ে জট লেগেছিল। সে জট ছাড়ানো গেছে। কিন্তু প্রায় দুই যুগের ডাকসুজট কে ছাড়াবে? শঙ্কা রয়েছে, এ নির্বাচন দেওয়া হলে ক্যাম্পাসে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। ছাত্ররাজনীতি আর আগের অবস্থায় নেই। অস্ত্র, অর্থ এবং অল্প পরিশ্রমে অধিক প্রাপ্তির জন্য লালায়িত কিছুসংখ্যক ছাত্র। তারা সংখ্যায় কম, দাপটে বেপরোয়া। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা বিরোধী পক্ষকে ক্যাম্পাসে আসতে দেবে না, সেটা ধরে নেওয়া যায়। যা কিছু ঘটবে তা নিজেদের মধ্যেই। অথচ শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্র চর্চার কার্যকর একটি উপায় ছিল এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
প্রতিবারেই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজন কাউকে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আশা করব, শিক্ষা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্তরাই এ সম্মানে ভূষিত হতে থাকবেন। আমরা তাদের কথা শুনতে চাই, যাদের দৃষ্টি অনেক দূর প্রসারিত, যারা সভ্যতার বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে নিঃস্বার্থ কাজ করে চলেছেন।
যেসব শিক্ষার্থী সনদ ও সেরাদের সেরা হওয়ার জন্য পদক নিচ্ছে তাদের অভিবাদন। তাদের হাসিমুখ দেখে পিতামাতার আনন্দের শেষ থাকবে না। অনেক পরিশ্রম করেই কেবল শিক্ষায় এত দূর পর্যন্ত আসা যায়। তবে বৃহত্তম কর্মযজ্ঞ তাদের সামনে। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ থাকবে, অন্যায়ের কাছে তোমরা নিজেদের হারিয়ে ফেল না। প্রত্যেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও, এটাই কাম্য। ধনে-মানে-জ্ঞানে সবদিক থেকেই এটা হতে হবে। এ নতুন জীবনে যেখানে যা পাবে, তার একটি অংশ ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের, যাদের অর্থে পরিচালিত হয় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের বরাদ্দ আরও অনেক বাড়ানোর পক্ষে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় উদারভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। এ থেকে যারা উপকৃত হবে, তারা জীবনপথে চলতে গিয়ে যা কিছু সাফল্য অর্জন করবে তার একটি অংশ যেন ফিরিয়ে দেয় সমাজ ও রাষ্ট্রকে। অনেক ক্ষেত্রে দানের চেয়ে প্রতিদান আরও বড় হয়ে উঠতে পারে। আমি এটাও আশা করতে পারি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে যারা কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন বা করবেন তাদের অর্থে আগামী এক দশকে অন্তত পাঁচ হাজার বৃত্তি চালু হবে। এর ফলে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তানদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে আর দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, উচ্চতর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এমন আয়োজন করা যেতে পারে।
আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বড় পরিবার। এ প্রতিষ্ঠান কলেবরে কতটা বড় হবে, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। কতটা বড় হওয়া উচিত, সে নিয়েও অভিন্ন মত হয়তো মিলবে না। কিন্তু একক ও সম্মিলিত জ্ঞানে দিন দিন আমরা যেন পুষ্ট হতে থাকি, এ প্রত্যাশায় দ্বিমত নিশ্চয়ই থাকবে না।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.