পাকিস্তান-কার টাকা আইএসআই কাদের দিয়েছিল by মশিউল আলম
আসগর খান বনাম আসলাম বেগ মামলা গত ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে শুরু হয়েছে এক চাঞ্চল্যকর মামলার শুনানি। ‘এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান বনাম জেনারেল (অব.) মির্জা আসলাম বেগ’ নামের মামলাটির ইতিহাস দীর্ঘ ১৬ বছরের।
১৯৯৬ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা বেনজির ভুট্টো যখন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন, সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর পার্লামেন্টে অভিযোগ তোলেন, ১৯৯০ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পিপিপি ও বেনজিরকে পরাজিত করার লক্ষ্যে সামরিক গোয়েন্দা আইএসআইয়ের সহায়তায় বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের মধ্যে ১৪ কোটি (১৪০ মিলিয়ন) পাকিস্তানি রুপি বিতরণ করা হয়। একই বছর অবসরপ্রাপ্ত বিমানবাহিনীর প্রধান ও তেহরিক-ইশতিকলাল নামের একটি ছোট্ট রাজনৈতিক দলের নেতা আসগর খান একই রকম অভিযোগ তুলে আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করেন।
পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল-এ গত ৩ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবরের ১৯৯৬ সালের ভাষ্য অনুযায়ী, রাজনীতিকদের অর্থ দেওয়া সম্পর্কে কিছু নথিপত্র সংগ্রহ করে তিনি সেনা সদরে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াহিদ কাকারের সঙ্গে। তখন বাবরের সঙ্গে ছিলেন মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের ডিজি আলি কুলি খান ও অ্যাডজুডেন্ট জেনারেল লে. জে. মইন হায়দার। বাবর যখন সেনাপ্রধানের কাছে বিষয়টি তোলেন, তখন কুলি খান ও মইন হায়দার বলেন, মামলাটি নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত হবে না। কারণ, এতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনা হবে। সেনাপ্রধান কাকার বলেন, ঘটনাটি প্রাতিষ্ঠানিক নয়, ঘটেছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। তাই এ নিয়ে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে নেতিবাচক প্রচারণা হবে না, মামলাটি এগিয়ে নেওয়া উচিত। নাসিরুল্লাহ বাবর সেনাসদর থেকে বেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সবকিছু বিশদভাবে বলেন। প্রধানমন্ত্রী বেনজির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবরকে সঙ্গে নিয়ে সাক্ষাৎ করেন সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার ও প্রেসিডেন্ট ফারুক খান লেঘারির সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট লেঘারি বলেন, যে মামলায় সেনাবাহিনী জড়িত, সেটা নিয়ে আমরা এগোব কীভাবে? তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে জানান, সেনাবাহিনী এ বিষয়ে ‘ক্লিয়ারেন্স’ দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট লেঘারি তখন সম্মতি দেন এবং একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে ঘটনাটির তদন্ত শুরু হয়। তারপর আদালতে রুদ্ধদ্বার শুনানি হয়েছিল, সাবেক সেনাপ্রধান মির্জা আসলাম বেগ, আইএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আসাদ দুররানি ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবরের জবানবন্দি নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে নির্বাচিত পাকিস্তানের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর কোয়ালিশন সরকার ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে ভেঙে দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান। তারপর দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি হয়, জাতীয় পরিষদের সম্মিলিত বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মুস্তাফা জাতোয়ির নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সে বছরই অক্টোবরে নতুন করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেখা যায়, সে নির্বাচনে সত্যিই ভরাডুবি ঘটে বেনজিরের দল পিপিপির (মাত্র ৪৪টি আসন পেয়েছিল)। আর তার দ্বিগুণেরও অনেক বেশি (১০৬ টি) আসন পেয়ে জয়ী হয়েছিল প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন)। আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা বলেছিলেন, ওই নির্বাচনে কারচুপি হয়েছিল ব্যাপক।
১৩ বছর পর
প্রায় ১৩ বছর পর, বেনজির না থাকলেও তাঁর দল যখন আবার ক্ষমতায় এবং তাঁর স্বামী দেশটির প্রেসিডেন্ট, তখন, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি বেঞ্চে নতুন করে আবার শুরু হয়েছে আসগর খান মামলার শুনানি। ২৯ ফেব্রুয়ারির শুনানিতে মামলার গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলো আদালতে হাজির হয়নি বলে ৮ মার্চ আবার শুনানির দিন ধার্য করে ওই দিন ব্যাংকার ইউনুস হাবিব ও আসাদ দুররানিকে হাজির হতে এবং এ মামলার পুরোনো নথিপত্রগুলো আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয়। ৮ মার্চ আসাদ দুররানি ও ইউনুস হাবিব দুজনই হাজির হন। ৯ মার্চ হাজির হয়ে লিখিত হলফনামা দেন সাবেক সেনাপ্রধান আসলাম বেগ। ৮ ও ৯ মার্চের পর ১৪ মার্চ ও আজ ৩০ মার্চ শুনানির পর আগামী ১৪ এপ্রিল পরবর্তী শুনানি হওয়ার কথা।
কে কী বলেন
৮ মার্চ ইউনুস হাবিব আদালতে বলেন, ১৯৯০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান ও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আসলাম বেগ তাঁকে ‘জাতীয় স্বার্থে’ ৩৪ কোটি পাকিস্তানি রুপির ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিলেন। তিনি বলেন, আইএসআইয়ের নির্দেশে হাবিব ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় মোট ১৪ কোটি ৮০ লাখ রুপি। ১৪ কোটি রুপি দেওয়া হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের, আর ৮০ লাখ রুপি দেওয়া হয় আর্মি ওয়েলফেয়ার স্কিমের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার অ্যাকাউন্টে, অ্যাকাউন্ট নম্বরগুলো তাঁকে দেওয়া হয়েছিল আইএসআই থেকে।
একই দিন আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান আসাদ দুররানি আদালতে লিখিত হলফনামায় বলেন, ‘আমি তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মির্জা আসলাম বেগের কাছ থেকে নির্দেশনা পাই, করাচির ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আগামী নির্বাচনে ইসলামি জামহুরি ইত্তেহাদের (বেনজির-বিরোধী নয়টি রাজনৈতিক দলের একটি মোর্চা) জন্য ১৪ কোটি রুপি সংগ্রহ করেছে, আমি যেন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে গঠিত নির্বাচনী কেন্দ্রের ফর্মুলা মোতাবেক সেই টাকা বিতরণের ব্যবস্থা করি।’ দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় ১৪ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইসলামাবাদের সাংবাদিক হামিদ মীর লিখেছেন, রাজনীতিকদের যে টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা করাচির ব্যবসায়ীদের তোলা চাঁদার টাকা নয়, খাঁটি জনগণের টাকা। টাকাটা নেওয়া হয়েছিল হাবিব ব্যাংক লিমিটেড (এইচবিএল) থেকে; ব্যাংকটি তখন ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, ব্যাংকার ইউনুস হাবিব ১৯৯০ সালে হাবিব ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা পাঠান, ইউনুস হাবিব ‘ভেরি স্পেশাল’ কিছু করছেন, মন্ত্রণালয় যেন তাঁর অনুকূলে যত শিগগির সম্ভব টাকা ছাড় করে। তখন হাবিব ব্যাংক ইউনুস হাবিবের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১৪৮ কোটি (১.৪৮ বিলিয়ন) রুপি ছাড় করে। হামিদ মীর ইউনুস হাবিবের সঙ্গে নিজের একান্ত সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ইউনুস হাবিব তাঁকে বলেছেন, ‘রাজনীতিকদের ঘুষ বাবদ আমি আইএসআইকে ৪০ কোটি রুপি দিয়েছিলাম, কিছু অর্থ দেওয়া হয়েছিল আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে, আর অবশিষ্ট অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছিল বিভিন্ন সম্পত্তিতে।’
লক্ষণীয়, ইউনুস হাবিব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঙ্ক উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে তাঁর সমালোচনা হয়েছে। তিনি বর্তমানে অসুস্থ, আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন হুইলচেয়ারে এবং বলেছেন, তাঁর এখন সবকিছু ঠিকমতো মনে পড়ে না।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মির্জা আসলাম বেগ ৯ মার্চ আদালতে হাজির হয়ে লিখিত হলফনামা দিয়ে বলেন, ইউনুস হাবিবের অভিযোগ ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ (বোল্ট ফ্রম দ্য ব্লু)। আসলাম বেগ তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ইউনুস হাবিব নিজের আর্থিক কেলেঙ্কারি ঢাকার মতলবে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান ও তাঁকে (আসলাম বেগ) কলঙ্কিত করতে এসব অভিযোগ তুলেছেন।
কারা টাকা নিয়েছেন
এ পর্যন্ত সূত্র মূলত তিনটি। এক. আসাদ দুররানির হলফনামা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুটোকে ১৯৯৬ সালে লেখা স্বীকারোক্তিমূলক গোপন পত্র, যেটি তিনি লিখেছিলেন জার্মানিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত থাকাকালে (তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর সেটি সংবাদমাধ্যমের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন)। দুই. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবরের (প্রয়াত) গোপন জবানবন্দি (১৯৯৬ সালে আদালতে রুদ্ধদ্বার শুনানিকালে নথিভুক্ত)। এবং তিন. ব্যাংকার ইউনুস হাবিবের দেওয়া গত ৮ মার্চের হলফনামা। এ ছাড়া পিটিশনকারী আসগর খানের আইনজীবী সালমান আকরাম রাজাও অভিযোগ আকারে কিছু তথ্য আদালতে হাজির করেছেন।
আসাদ দুররানির হলফনামার বরাত দিয়ে দৈনিক ডন ও দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল-এর পৃথক প্রতিবেদনে পাওয়া যায় অর্থ গ্রহণকারী রাজনীতিকদের নাম। তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে প্রয়াত। দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল-এর তথ্য অনুযায়ী মৃতদের মধ্যে আছেন: সাবেক প্রেসিডেন্ট ফারুক খান লেঘারি, খায়বার-পাখতুনখাওয়ার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মীর আফজাল খান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী গোলাম মুস্তাফা জাতোয়ি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মেরাজ খালিদ, সিন্ধুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জাম সাদিক আলী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ খান জুনেজো, পীর সাহেব পাগারো, হুমায়ুন মারী, মুস্তাফা সাদিক, মাওলানা সালাউদ্দিন, সারওয়ার কাকার, ইউসুফ হারুন ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর। আর জীবিতদের মধ্যে আছেন: সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিয়া নওয়াজ শরিফ, লে. জেনারেল (অব) রাফাকাত, সৈয়দা আদিবা হুসেন, সাংবাদিক আলতাফ হোসেন কোরেশি, আইনজীবী আবদুল হাফিজ পীরজাদা, আলতাফ হোসেন, এমকিউএম-এর প্রধান ও সিন্ধু প্রদেশের সাবেক স্পিকার মুজাফফর হোসেন শাহ প্রমুখ।
ব্যাংকার ইউনুস হাবিব বলেছেন, তিনি নিজের হাতে ৩৫ লাখ রুপি দিয়েছেন নওয়াজ শরিফকে আর ২৫ লাখ রুপি দিয়েছেন তাঁর ভাই শাহবাজ শরিফকে। নওয়াজ শরিফসহ জীবিত সবাই টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। নওয়াজ শরিফ বলেছেন, তিনি ইউনুস হাবিবের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল বেনজির ভুট্টোকে লেখা আসাদ দুররানি স্বীকারোক্তিমূলক পত্রের বরাত দিয়ে লিখেছে, অবশিষ্ট আট কোটি রুপি (৮০ মিলিয়ন) রাখা হয়েছিল আইএসআইয়ের ‘কে’ ফান্ডে (‘K’ Fund), অথবা ‘স্পেশাল অপারেশনের’ জন্য দেওয়া হয়েছিল এক্সটারনাল ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টরকে। দৈনিক ডন আসগর খানের আইনজীবী সালমান আকরাম রাজার আদালতে দেওয়া বক্তব্যের বরাত দিয়ে লিখেছে, ছয় কোটি (৬০ মিলিয়ন) রুপি দেওয়া হয়েছে ‘কে’ ফান্ডকে; আর দুই কোটি (২০ মিলিয়ন) রুপি দেওয়া হয়েছে আইএসআইয়ের ডিরেক্টরেট অব এক্সটারনাল অপারেশনসকে।
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে আসগর খান মামলার আজকের শুনানিতে আর কোনো নতুন উল্লেখযোগ্য তথ্য বেরিয়ে আসেনি। পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ১৪ এপ্রিল; তখন কোনো নতুন তথ্য বেরিয়ে আসে কি না, বা আদালত আইএসআইয়ের এক্সটারনাল অপারেশনস-এ অর্থ খরচ, বা ‘কে’ ফান্ড সম্পর্কে কিছু জানতে চান কি না, তাও কৌতূহলের বিষয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল-এ গত ৩ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবরের ১৯৯৬ সালের ভাষ্য অনুযায়ী, রাজনীতিকদের অর্থ দেওয়া সম্পর্কে কিছু নথিপত্র সংগ্রহ করে তিনি সেনা সদরে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াহিদ কাকারের সঙ্গে। তখন বাবরের সঙ্গে ছিলেন মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের ডিজি আলি কুলি খান ও অ্যাডজুডেন্ট জেনারেল লে. জে. মইন হায়দার। বাবর যখন সেনাপ্রধানের কাছে বিষয়টি তোলেন, তখন কুলি খান ও মইন হায়দার বলেন, মামলাটি নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত হবে না। কারণ, এতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনা হবে। সেনাপ্রধান কাকার বলেন, ঘটনাটি প্রাতিষ্ঠানিক নয়, ঘটেছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। তাই এ নিয়ে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে নেতিবাচক প্রচারণা হবে না, মামলাটি এগিয়ে নেওয়া উচিত। নাসিরুল্লাহ বাবর সেনাসদর থেকে বেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সবকিছু বিশদভাবে বলেন। প্রধানমন্ত্রী বেনজির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবরকে সঙ্গে নিয়ে সাক্ষাৎ করেন সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার ও প্রেসিডেন্ট ফারুক খান লেঘারির সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট লেঘারি বলেন, যে মামলায় সেনাবাহিনী জড়িত, সেটা নিয়ে আমরা এগোব কীভাবে? তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে জানান, সেনাবাহিনী এ বিষয়ে ‘ক্লিয়ারেন্স’ দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট লেঘারি তখন সম্মতি দেন এবং একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে ঘটনাটির তদন্ত শুরু হয়। তারপর আদালতে রুদ্ধদ্বার শুনানি হয়েছিল, সাবেক সেনাপ্রধান মির্জা আসলাম বেগ, আইএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আসাদ দুররানি ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবরের জবানবন্দি নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে নির্বাচিত পাকিস্তানের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর কোয়ালিশন সরকার ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে ভেঙে দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান। তারপর দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি হয়, জাতীয় পরিষদের সম্মিলিত বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মুস্তাফা জাতোয়ির নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সে বছরই অক্টোবরে নতুন করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেখা যায়, সে নির্বাচনে সত্যিই ভরাডুবি ঘটে বেনজিরের দল পিপিপির (মাত্র ৪৪টি আসন পেয়েছিল)। আর তার দ্বিগুণেরও অনেক বেশি (১০৬ টি) আসন পেয়ে জয়ী হয়েছিল প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন)। আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা বলেছিলেন, ওই নির্বাচনে কারচুপি হয়েছিল ব্যাপক।
১৩ বছর পর
প্রায় ১৩ বছর পর, বেনজির না থাকলেও তাঁর দল যখন আবার ক্ষমতায় এবং তাঁর স্বামী দেশটির প্রেসিডেন্ট, তখন, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি বেঞ্চে নতুন করে আবার শুরু হয়েছে আসগর খান মামলার শুনানি। ২৯ ফেব্রুয়ারির শুনানিতে মামলার গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলো আদালতে হাজির হয়নি বলে ৮ মার্চ আবার শুনানির দিন ধার্য করে ওই দিন ব্যাংকার ইউনুস হাবিব ও আসাদ দুররানিকে হাজির হতে এবং এ মামলার পুরোনো নথিপত্রগুলো আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয়। ৮ মার্চ আসাদ দুররানি ও ইউনুস হাবিব দুজনই হাজির হন। ৯ মার্চ হাজির হয়ে লিখিত হলফনামা দেন সাবেক সেনাপ্রধান আসলাম বেগ। ৮ ও ৯ মার্চের পর ১৪ মার্চ ও আজ ৩০ মার্চ শুনানির পর আগামী ১৪ এপ্রিল পরবর্তী শুনানি হওয়ার কথা।
কে কী বলেন
৮ মার্চ ইউনুস হাবিব আদালতে বলেন, ১৯৯০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান ও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আসলাম বেগ তাঁকে ‘জাতীয় স্বার্থে’ ৩৪ কোটি পাকিস্তানি রুপির ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিলেন। তিনি বলেন, আইএসআইয়ের নির্দেশে হাবিব ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় মোট ১৪ কোটি ৮০ লাখ রুপি। ১৪ কোটি রুপি দেওয়া হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের, আর ৮০ লাখ রুপি দেওয়া হয় আর্মি ওয়েলফেয়ার স্কিমের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার অ্যাকাউন্টে, অ্যাকাউন্ট নম্বরগুলো তাঁকে দেওয়া হয়েছিল আইএসআই থেকে।
একই দিন আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান আসাদ দুররানি আদালতে লিখিত হলফনামায় বলেন, ‘আমি তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মির্জা আসলাম বেগের কাছ থেকে নির্দেশনা পাই, করাচির ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আগামী নির্বাচনে ইসলামি জামহুরি ইত্তেহাদের (বেনজির-বিরোধী নয়টি রাজনৈতিক দলের একটি মোর্চা) জন্য ১৪ কোটি রুপি সংগ্রহ করেছে, আমি যেন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে গঠিত নির্বাচনী কেন্দ্রের ফর্মুলা মোতাবেক সেই টাকা বিতরণের ব্যবস্থা করি।’ দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় ১৪ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইসলামাবাদের সাংবাদিক হামিদ মীর লিখেছেন, রাজনীতিকদের যে টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা করাচির ব্যবসায়ীদের তোলা চাঁদার টাকা নয়, খাঁটি জনগণের টাকা। টাকাটা নেওয়া হয়েছিল হাবিব ব্যাংক লিমিটেড (এইচবিএল) থেকে; ব্যাংকটি তখন ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, ব্যাংকার ইউনুস হাবিব ১৯৯০ সালে হাবিব ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা পাঠান, ইউনুস হাবিব ‘ভেরি স্পেশাল’ কিছু করছেন, মন্ত্রণালয় যেন তাঁর অনুকূলে যত শিগগির সম্ভব টাকা ছাড় করে। তখন হাবিব ব্যাংক ইউনুস হাবিবের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১৪৮ কোটি (১.৪৮ বিলিয়ন) রুপি ছাড় করে। হামিদ মীর ইউনুস হাবিবের সঙ্গে নিজের একান্ত সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ইউনুস হাবিব তাঁকে বলেছেন, ‘রাজনীতিকদের ঘুষ বাবদ আমি আইএসআইকে ৪০ কোটি রুপি দিয়েছিলাম, কিছু অর্থ দেওয়া হয়েছিল আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে, আর অবশিষ্ট অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছিল বিভিন্ন সম্পত্তিতে।’
লক্ষণীয়, ইউনুস হাবিব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঙ্ক উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে তাঁর সমালোচনা হয়েছে। তিনি বর্তমানে অসুস্থ, আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন হুইলচেয়ারে এবং বলেছেন, তাঁর এখন সবকিছু ঠিকমতো মনে পড়ে না।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মির্জা আসলাম বেগ ৯ মার্চ আদালতে হাজির হয়ে লিখিত হলফনামা দিয়ে বলেন, ইউনুস হাবিবের অভিযোগ ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ (বোল্ট ফ্রম দ্য ব্লু)। আসলাম বেগ তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ইউনুস হাবিব নিজের আর্থিক কেলেঙ্কারি ঢাকার মতলবে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান ও তাঁকে (আসলাম বেগ) কলঙ্কিত করতে এসব অভিযোগ তুলেছেন।
কারা টাকা নিয়েছেন
এ পর্যন্ত সূত্র মূলত তিনটি। এক. আসাদ দুররানির হলফনামা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুটোকে ১৯৯৬ সালে লেখা স্বীকারোক্তিমূলক গোপন পত্র, যেটি তিনি লিখেছিলেন জার্মানিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত থাকাকালে (তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর সেটি সংবাদমাধ্যমের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন)। দুই. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবরের (প্রয়াত) গোপন জবানবন্দি (১৯৯৬ সালে আদালতে রুদ্ধদ্বার শুনানিকালে নথিভুক্ত)। এবং তিন. ব্যাংকার ইউনুস হাবিবের দেওয়া গত ৮ মার্চের হলফনামা। এ ছাড়া পিটিশনকারী আসগর খানের আইনজীবী সালমান আকরাম রাজাও অভিযোগ আকারে কিছু তথ্য আদালতে হাজির করেছেন।
আসাদ দুররানির হলফনামার বরাত দিয়ে দৈনিক ডন ও দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল-এর পৃথক প্রতিবেদনে পাওয়া যায় অর্থ গ্রহণকারী রাজনীতিকদের নাম। তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে প্রয়াত। দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল-এর তথ্য অনুযায়ী মৃতদের মধ্যে আছেন: সাবেক প্রেসিডেন্ট ফারুক খান লেঘারি, খায়বার-পাখতুনখাওয়ার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মীর আফজাল খান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী গোলাম মুস্তাফা জাতোয়ি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মেরাজ খালিদ, সিন্ধুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জাম সাদিক আলী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ খান জুনেজো, পীর সাহেব পাগারো, হুমায়ুন মারী, মুস্তাফা সাদিক, মাওলানা সালাউদ্দিন, সারওয়ার কাকার, ইউসুফ হারুন ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর। আর জীবিতদের মধ্যে আছেন: সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিয়া নওয়াজ শরিফ, লে. জেনারেল (অব) রাফাকাত, সৈয়দা আদিবা হুসেন, সাংবাদিক আলতাফ হোসেন কোরেশি, আইনজীবী আবদুল হাফিজ পীরজাদা, আলতাফ হোসেন, এমকিউএম-এর প্রধান ও সিন্ধু প্রদেশের সাবেক স্পিকার মুজাফফর হোসেন শাহ প্রমুখ।
ব্যাংকার ইউনুস হাবিব বলেছেন, তিনি নিজের হাতে ৩৫ লাখ রুপি দিয়েছেন নওয়াজ শরিফকে আর ২৫ লাখ রুপি দিয়েছেন তাঁর ভাই শাহবাজ শরিফকে। নওয়াজ শরিফসহ জীবিত সবাই টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। নওয়াজ শরিফ বলেছেন, তিনি ইউনুস হাবিবের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল বেনজির ভুট্টোকে লেখা আসাদ দুররানি স্বীকারোক্তিমূলক পত্রের বরাত দিয়ে লিখেছে, অবশিষ্ট আট কোটি রুপি (৮০ মিলিয়ন) রাখা হয়েছিল আইএসআইয়ের ‘কে’ ফান্ডে (‘K’ Fund), অথবা ‘স্পেশাল অপারেশনের’ জন্য দেওয়া হয়েছিল এক্সটারনাল ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টরকে। দৈনিক ডন আসগর খানের আইনজীবী সালমান আকরাম রাজার আদালতে দেওয়া বক্তব্যের বরাত দিয়ে লিখেছে, ছয় কোটি (৬০ মিলিয়ন) রুপি দেওয়া হয়েছে ‘কে’ ফান্ডকে; আর দুই কোটি (২০ মিলিয়ন) রুপি দেওয়া হয়েছে আইএসআইয়ের ডিরেক্টরেট অব এক্সটারনাল অপারেশনসকে।
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে আসগর খান মামলার আজকের শুনানিতে আর কোনো নতুন উল্লেখযোগ্য তথ্য বেরিয়ে আসেনি। পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ১৪ এপ্রিল; তখন কোনো নতুন তথ্য বেরিয়ে আসে কি না, বা আদালত আইএসআইয়ের এক্সটারনাল অপারেশনস-এ অর্থ খরচ, বা ‘কে’ ফান্ড সম্পর্কে কিছু জানতে চান কি না, তাও কৌতূহলের বিষয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments