চলতি পথে-মথুরাপুর দেউলের ইতিবৃত্ত by দীপংকর চন্দ

দৌতলদিয়া ফেরিঘাটের পর থেকে সত্যিই কি পাল্টে গেল প্রকৃতির চরিত্র? পাটুরিয়ার তীব্র রোদ কি নদী পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বৈশিষ্ট্যে বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে তীব্রতাহীন, নম্রস্বভাবী হয়ে উঠল? ওপারের রোগাক্রান্ত, পান্ডুর বাতাসও কি হয়ে উঠল প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ, আত্মবিশ্বাসী? হ্যাঁ, ঠিক তা-ই মনে হলো আমাদের কাছে।


তীব্র গতিসম্পন্ন বাসের জানালার বাইরের গ্রামগুলোকে মনে হলো স্বর্গভূমি। আমরা সেই স্বর্গভূমি স্পর্শ করতেই ছুটলাম দিগ্বিদিকহীন। কিন্তু স্বর্গসম সেই ভূমি যেন মরীচিকার মতো! যতই ছুটি আমরা, দূরে সরে যায়! ধরা দেওয়ার ভান করেই দৌড়ে পালায়! এভাবেই অতিক্রান্ত হলো ঘণ্টা দেড়েক। সুপারভাইজার জানালেন, আমাদের গন্তব্যস্থান নিকটবর্তীপ্রায়। সামনেই মধুখালী বাজার।
বাস থেকে নামতেই বিচিত্র মানুষের কোলাহলমুখর সমাবেশ গ্রাস করে নিল আমাদের। বেশ বড় বাজার এই মধুখালী। শত-সহস্র পণ্যের হাতবদল হচ্ছে বাজারের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে। মুনাফা নামের বহু নিন্দিত কিংবা বহু নন্দিত অর্থনৈতিক প্রপঞ্চটিকে যতদূর সম্ভব বাড়িয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত সবাই। হাঁটতে হাঁটতে থানা রোডের কাছে এসে দাঁড়ালাম। মুনাফাকাঙ্ক্ষী মানুষের ভিড় এড়িয়ে প্রকৃতির কাছে ছুটে যাওয়ার আশায় রিকশা নিলাম। গাড়াখোলা জামে মসজিদ, মধুখালী থানা, ফরিদপুর চিনিকল উচ্চবিদ্যালয় পেছনে ফেলে সামনে এগোতে না-এগোতেই ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা একটি গ্রাম আবির্ভূত হলো আমাদের দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে। গ্রামের নাম মথুরাপুর। শান্ত সবুজ সেই গ্রামের অপ্রশস্ত পথের পাশেই ধারণাতীত সৌন্দর্যশোভিত একটি স্থাপনার উপস্থিতি প্রতিভাসিত হলো হঠাৎ। অসাধারণ এ স্থাপনাটি সাধারণ্যে মথুরাপুর দেউল নামে পরিচিত।
অনিবার্য এক আচ্ছন্নতা, অপার্থিব এক আবিষ্টতা নিয়ে ভূতগ্রস্তের মতো রিকশা থেকে নেমে এলাম আমরা। অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী এক স্থাপত্যরীতির ধারণা সংযোজন করতেই অগ্রসর হলাম মথুরাপুর দেউলের দিকে।
ফরিদপুর শহর থেকে প্রায় ২২ মাইল পশ্চিমে এবং মধুখালী বাজার থেকে মাইল দেড়েক উত্তরে অবস্থিত অপরূপ এ দেউলটি চতুর্দিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি বর্গাকার ভূমির কেন্দ্রস্থলে নির্মিত। বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা ১২ কোণবিশিষ্ট এ স্থাপনাটি মাটি থেকে আনুমানিক ২০ ফুট পর্যন্ত সমানভাবে ওপরে ওঠার পর একটু চাপা ভঙ্গিতে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে আবার। এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মো. মাইনুদ্দিন মোল্লা জানালেন, মথুরাপুর দেউলের বেশ কিছু অংশ মাটিতে দেবে গেলেও ভূমিসমতল থেকে দেউলের শীর্ষদেশের উচ্চতা এখনো ৬০ ফুটের কম নয়। মাইনুদ্দিন মোল্লার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেউলের একেবারে কাছে গেলাম। মথুরাপুর দেউলের অভ্যন্তরে একটি ছোট্ট প্রকোষ্ঠ বিদ্যমান। সেই প্রকোষ্ঠে প্রবেশের জন্য দুটি প্রবেশপথ থাকলেও কেবল দক্ষিণ দেয়ালের অর্ধগোলাকৃতি, অপেক্ষাকৃত নিচু পথটিই ভেতরে প্রবেশের জন্য ব্যবহূত হয়। প্রবেশপথটি বর্তমানে তালাবদ্ধ। তালার চাবি রক্ষিত থাকে গাড়াখোলার অতুল কুন্ডুর কাছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত এ স্থাপনাটি দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত অতুল কুন্ডুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেউলের অভ্যন্তরের ছোট্ট প্রকোষ্ঠটির ভেতর উঁকি দিই আমরা। না, প্রকোষ্ঠটিতে কোনো ধরনের বিগ্রহ নেই, কোনো ধরনের পূজা-অর্চনার জন্য এ স্থানটি কখনো ব্যবহূত হতো বলেও জানা যায় না। কিন্তু কে এই দেউলের নির্মাতা? কী উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি নির্মাণ করেছিলেন এ স্থাপনাটি? এ প্রসঙ্গে একটি লোকভাষ্য প্রচলিত এই এলাকায়, জানালেন মো. মাইনুদ্দিন মোল্লা। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, রাজা প্রতাপাদিত্যকে যুদ্ধে পরাজিত করে মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ নির্মাণ করেছিলেন এ স্থাপনাটি। নান্দনিক এ স্থাপনাটি আসলে একটি বিজয়স্তম্ভ। কিন্তু মাইনুদ্দিন মোল্লার এ বক্তব্য কি ইতিহাস-সমর্থিত? পূর্ববঙ্গে প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে সত্যিই কি কোনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন রাজা মানসিংহ? প্রতাপাদিত্য যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়ার বহু আগেই কি মানসিংহ বাংলা ত্যাগ করেননি? ইতিহাসের জটিল প্রশ্নগুলো নিয়ে খুব বেশিক্ষণ ভাবার অবকাশ হলো না আমাদের। কারণ, মথুরাপুর দেউলের রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত অতুল কুন্ডু এসে দাঁড়ালেন সামনে। দেউলের প্রবেশপথের তালা খুলতে খুলতে তিনি জানালেন, সপ্তদশ শতাব্দীতে সংগ্রাম সিংহ নামের একজন ফৌজদার ছিলেন ভূষণায়। কোনো এক বিশেষ কার্যসিদ্ধি উপলক্ষে সংগ্রাম সিংহই এই দেউল নির্মাণ করেন মথুরাপুরে। নির্মাণের পর কালের প্রতিকূল প্রবাহে স্থাপনাটি লোকসাধারণের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু থেকে বিচ্যুত হয়। জঙ্গলে আকীর্ণ হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক শতাব্দী। দেশভাগের কয়েক বছর আগে মথুরাপুর দেউলকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। কিছু সংস্কার সাধিত হয় স্থাপনাটির। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সংস্কারের সেই ক্ষীণ ধারা অব্যাহত থাকলেও তা প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট কি না, সে প্রশ্ন তুলতেই নিস্তব্ধতা এসে ঘিরে ধরল অতুল কুন্ডুকে। অতুল কুন্ডুর এই নিস্তব্ধতাকে লেখ্যভাষায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলাম আমরা। কিন্তু ব্যর্থতার অমার্জনীয় আচরণে নিষ্ফলাই থেকে গেল আমাদের চেষ্টার আবাদভূমি।
দীপংকর চন্দ

No comments

Powered by Blogger.