সদরে অন্দরে-'তোমাদের আমরা এই শিক্ষা দিয়েছি?' by মোস্তফা হোসেইন
সন্তানকে শাসন করেন বাবা। চূড়ান্ত পর্যায়ের কিছু হলেই বলতে পারেন, তোমাকে কি এটাই শিখিয়েছি আমি? বাবার এহেন উচ্চারণ স্পষ্ট বলে দেয় সন্তানের অপরাধের মাত্রা। যাদের কানে যাবে এমন শব্দ, তাদেরও ভাবতে হয়- হায় রে, না জানি কী করে ফেলেছে ছেলেটা? বাবার এই উচ্চারণ কখনো কখনো অভিমানের বহিঃপ্রকাশও হতে পারে।
কিন্তু একজন শিক্ষক যখন এমন উচ্চারণ করেন, তখন বুঝতে হবে, এই শিক্ষার্থীর অপরাধ নিশ্চিতভাবে অমার্জনীয়। কারণ একজন শিক্ষক এমন শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন শিক্ষার্থীর কৃতকর্ম সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলেই; যখন শাসনেরও সুযোগ হারিয়ে যায় তখন। আর শিক্ষার্থী যদি হয় প্রাপ্তবয়স্ক- বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া কেউ, তখন এহেন বাক্যমালা যিনিই শুনবেন, তাঁরই মনে কাঁপন ধরার কথা। লজ্জা, দুঃখ ও ক্ষোভের সঞ্চারও হতে পারে সংগত কারণেই। বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে ঘটে যাওয়া লজ্জাজনক ঘটনার বিষয়ে। গত বুধবার ঢাকায় ঘটে যাওয়া এ ঘটনার পর মনে হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের ওপর দৃশ্যমান একটি কলঙ্কতিলক লেপ্টে দেওয়া হলো। সমাবর্তনে অংশগ্রহণেচ্ছু শিক্ষার্থীদের রেওয়াজ অনুযায়ী সমাবর্তন-গাউন, ক্যাপ ও উপহারসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছিল। বুধবার দুপুর নাগাদ লাইন ধরে শিক্ষার্থীরা তাদের গাউন, ক্যাপ এবং উপহারসামগ্রী গ্রহণ করছিল। কিন্তু একপর্যায়ে তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। হুড়মুড় করে তারা টিএসসির ভেতরে যেখানে এসব সামগ্রী রাখা হয়েছিল, সেখানে ঢুকে পড়ে এবং গাউন ও অন্য উপহারসামগ্রীর বেশ কিছু লুট করে নিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী ব্যক্তিদের এহেন আচরণ গোটা জাতিকে হতবাক করে দিয়েছে। এমন কোনো মহামূল্যবান সম্পদও নয় লুণ্ঠিত মালামাল। কত টাকা হবে এগুলোর মূল্য? ১০-১৫ হাজার টাকা কিংবা লাখ টাকারই সামগ্রী? সামান্য এই টাকার সামগ্রী অবৈধভাবে প্রাপ্তির লোভ করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষার্থী? সংগত কারণেই প্রশ্ন এসে যায়, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পাওয়া ব্যক্তিটি কিভাবে এহেন অনৈতিক কাজটি করেছে। হাতেনাতে ধৃত এক শিক্ষার্থী বলেছেন, অন্যদের করতে দেখে তিনিও করেছেন। তাঁর হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একাধিক প্যাকেট উদ্ধার করেছে। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে? দেশের উচ্চশিক্ষিত একজন ব্যক্তি কি দেখাদেখি অপরাধ করতে পারেন? পরিবেশকে জয় করেই তো একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করেন। তিনি সনদ লাভ করেন। তেমনি পর্যায়ে যাওয়ার পরও তাঁর মধ্যে ন্যায়নীতির বোধ কি একেবারেই জন্ম নেয়নি? এসব শিক্ষার্থীর কর্মকাণ্ড দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে তাই বলতে শোনা যায়, 'তোমাদের আমরা এই শিখিয়েছি, এই শিক্ষা দিয়েছি?' উপাচার্যের এই উচ্চারণ সাময়িক কষ্টের প্রতিফলন হিসেবে গণ্য হতে পারে না। এই উচ্চারণ আমাদের ভবিষ্যৎকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। নিকট ভবিষ্যতে এসব শিক্ষার্থী দেশের হাল ধরবে। যেসব মানুষ সামান্য কয়েক টাকার দ্রব্যের লোভ সামলাতে পারে না তারা জাতিকে কী দেবে? এই দেশটা তো তাদের মতো যুবকদের হাতেই পরিচালিত হবে। তখন কী অবস্থা হবে দেশের?
উপাচার্য এসব শিক্ষার্থীকে তিন-চার বছর পেয়েছেন। এই সময়ই কি ওরা এই শিক্ষা অর্জন করেছে? আসলে মানুষের নৈতিকতা শিক্ষার শ্রেষ্ঠতম জায়গা হচ্ছে তার পরিবার। তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণকারী ওইসব শিক্ষার্থীর শৈশব থেকে পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সময়ের পরিবেশ-প্রতিবেশ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, তারা কী শিক্ষা পেয়েছে। আমাদের সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিকতাবোধের অভাব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছে। এই তরুণদের এ মানসিকতা তৈরি হয়েছে সামগ্রিক পরিবেশের কারণেই। সুতরাং তাদের এই অধঃপতিত মানসিকতার জন্য অভিভাবক হিসেবে আমরা যেমন দায় এড়াতে পারি না, তেমনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও দায়ী। শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে আমাদের বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই যে সম্পর্কিত নয়, তার সঙ্গে যে পরিবেশগত বিশাল সম্পর্ক বিদ্যমান তা আমরা ভুলে যেতে চাই। যে কারণে প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য নীতিগত কিছু পরিবর্তন আনা হলেও আমরা তৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করি। শিক্ষায় নৈতিকতাবোধকে প্রাধান্য না দেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীর মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ সঠিকভাবে তৈরি হয় না। অথচ আমরা যদি ইতিহাসের দিকে নজর দিই, তাহলে দেখতে পাব, দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো কিংবা অ্যারিস্টটল আমাদের যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন, তার অপরিহার্য অবস্থান এক চুলও কমেনি। বরং আমরা সেই দিকটি উপেক্ষা করে আমাদের তরুণদের নৈতিকতা শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে আনছি। সক্রেটিস মানসিক শিক্ষার ওপর যেভাবে জোর দিয়েছেন, ভালো ও মন্দকে চেনার জন্য যেভাবে তিনি পথ দেখিয়েছেন, সেই আলোকে যুগের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলে আমাদের যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হতো না। সে ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তাও আমাদের দেখতে হতো না। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্বখ্যাত অনেক ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। অনেক বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক বেরিয়ে গেছেন এখান থেকে। সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার এমন অভাব থাকবে তা মেনে নেওয়া সহজ নয়।
১৬ হাজারের অধিক স্নাতক ডিগ্রিধারীর সমাবেশে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি থাকতেই পারে। এত বড় জমায়েতে কাঙ্ক্ষিত সুন্দর দৃশ্য হয়তো আমরা দেখতে নাও পারি। সেই ত্রুটি কিংবা না দেখার মাত্রাটা হয়তো বেশিও হতে পারে। কিন্তু নৈতিকতাবিরোধী সামান্যতম উদাহরণও তৈরি হোক, তা কল্পনাও করা যায় না। আমরা চাই না, কোনো শিক্ষক কিংবা কোনো মা-বাবার মুখ থেকে আর কখনো উচ্চারিত হোক- 'তোমাদের আমরা এই শিক্ষা দিয়েছি?'
mhussain_71@yahoo.com
উপাচার্য এসব শিক্ষার্থীকে তিন-চার বছর পেয়েছেন। এই সময়ই কি ওরা এই শিক্ষা অর্জন করেছে? আসলে মানুষের নৈতিকতা শিক্ষার শ্রেষ্ঠতম জায়গা হচ্ছে তার পরিবার। তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণকারী ওইসব শিক্ষার্থীর শৈশব থেকে পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সময়ের পরিবেশ-প্রতিবেশ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, তারা কী শিক্ষা পেয়েছে। আমাদের সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিকতাবোধের অভাব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছে। এই তরুণদের এ মানসিকতা তৈরি হয়েছে সামগ্রিক পরিবেশের কারণেই। সুতরাং তাদের এই অধঃপতিত মানসিকতার জন্য অভিভাবক হিসেবে আমরা যেমন দায় এড়াতে পারি না, তেমনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও দায়ী। শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে আমাদের বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই যে সম্পর্কিত নয়, তার সঙ্গে যে পরিবেশগত বিশাল সম্পর্ক বিদ্যমান তা আমরা ভুলে যেতে চাই। যে কারণে প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য নীতিগত কিছু পরিবর্তন আনা হলেও আমরা তৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করি। শিক্ষায় নৈতিকতাবোধকে প্রাধান্য না দেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীর মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ সঠিকভাবে তৈরি হয় না। অথচ আমরা যদি ইতিহাসের দিকে নজর দিই, তাহলে দেখতে পাব, দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো কিংবা অ্যারিস্টটল আমাদের যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন, তার অপরিহার্য অবস্থান এক চুলও কমেনি। বরং আমরা সেই দিকটি উপেক্ষা করে আমাদের তরুণদের নৈতিকতা শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে আনছি। সক্রেটিস মানসিক শিক্ষার ওপর যেভাবে জোর দিয়েছেন, ভালো ও মন্দকে চেনার জন্য যেভাবে তিনি পথ দেখিয়েছেন, সেই আলোকে যুগের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলে আমাদের যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হতো না। সে ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তাও আমাদের দেখতে হতো না। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্বখ্যাত অনেক ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। অনেক বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক বেরিয়ে গেছেন এখান থেকে। সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার এমন অভাব থাকবে তা মেনে নেওয়া সহজ নয়।
১৬ হাজারের অধিক স্নাতক ডিগ্রিধারীর সমাবেশে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি থাকতেই পারে। এত বড় জমায়েতে কাঙ্ক্ষিত সুন্দর দৃশ্য হয়তো আমরা দেখতে নাও পারি। সেই ত্রুটি কিংবা না দেখার মাত্রাটা হয়তো বেশিও হতে পারে। কিন্তু নৈতিকতাবিরোধী সামান্যতম উদাহরণও তৈরি হোক, তা কল্পনাও করা যায় না। আমরা চাই না, কোনো শিক্ষক কিংবা কোনো মা-বাবার মুখ থেকে আর কখনো উচ্চারিত হোক- 'তোমাদের আমরা এই শিক্ষা দিয়েছি?'
mhussain_71@yahoo.com
No comments