বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস ২০১১-পাখিরা থাকবে কোথায়! by সৌরভ মাহমুদ
পাখি প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাখি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যবর্ধকই নয়, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আজ এ কথা উপলব্ধি করতে পেরেছে। ফসলে ভাগ বসিয়ে পাখিরা মানুষের যেটুকু ক্ষতি করে, উপকার করে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। যেমন যে পরিবেশে পরিযায়ী পাখি থাকে, সে পরিবেশ ভালো থাকে অর্থাৎ পাখির উপস্থিতি প্রমাণ করে,
পরিবেশের ভারসাম্য বজায় আছে। পাখির বিষ্ঠা কৃষিজমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, মাছের ও জলজ অন্যান্য প্রাণীর খাবার হিসেবে ব্যবহূত হয়। পাখি ক্ষতিকর জলজ উদ্ভিদ ও বীজ খেয়ে কৃষকের উপকার করে ও কীটপতঙ্গ খেয়ে কৃষি ফসলের উৎপাদন বাড়ায়।
অঞ্চল বা পরিবেশ ভেদে বিভিন্ন ধরনের পাখি দেখা যায়। এদের মধ্যে কিছু পাখি আবার পরিযায়ী। আমাদের দেশে এসব পাখি বাইরে থেকে আসে বলে আমরা এদের অতিথি বলে থাকি। আসলে এরা অতিথি নয়, আমাদের পরিবারেরই একটি অংশ। শুধু মাঝে মাঝে দেশের বাইরে অবস্থান করে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শীতপ্রধান দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আসে, আবার শীত শেষে একইভাবে দেশান্তরি হয়। খাদ্যের অভাব ও পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে পাখিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তরি হয়।
বাংলাদেশের ৬৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে, তার মধ্যে ৩০০ প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। এই পরিযায়ীদের মধ্যে আট প্রজাতির পাখি গ্রীষ্মে এ দেশে থাকে, শীতে চলে যায়। বাকি ২৯২ প্রজাতির পাখি শীতে এ দেশে থাকে অথবা তার আগে-পরে স্বল্প সময়ের জন্য আসে। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ এবং আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরিযায়ী পাখি আসতে শুরু করে। তবে শীত মৌসুমে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বেশির ভাগ পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে। এসব পরিযায়ী পাখির মধ্যে বেশির ভাগই বিভিন্ন রকমের হাঁস ও অন্যান্য জলচর প্রজাতি। যেমন—রাজশরালি, ধলাকপাল রাজাহাঁস, চখাচখি, পাতি তিলাহাঁস, টিকি হাঁস, কালাটুপি মাছরাঙ্গা ইত্যাদি।
পরিযায়ী পাখিদের জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। এসব পাখি দেশান্তরি হওয়ার আগে প্রচুর পরিমাণে আহার করে শরীরে চর্বি জমায়। কিন্তু এ সঞ্চয় দিয়ে তারা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না, তাই পথে বিভিন্ন স্থানে যাত্রাবিরতি করে খাবার খেতে হয়। কিন্তু প্রতিবছরই দেখা যায়, পূর্বেকার বছরের বহু স্থান বসবাস বা খাবার সংগ্রহের উপযোগী থাকে না। ইতিমধ্যে একটানা পথ পাড়ি দিয়ে গিয়ে ওই পাখিরা দুর্বল হয়ে পড়ে। এভাবে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে বহু পাখি মারা যায়।
১৪ ও ১৫ মে, ২০১১ বিশ্ব পরিযায়ী পাখির দিন বা দিবস পালন করবে বিশ্ববাসী। ২০০৬ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ল্যান্ড ইউজ চেঞ্জেস ফ্রম এ বার্ডস আই ভিউ। পাখির বাসভূমি বা যেখানে বাস করে, তা মানুষের কারণে কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষের নানাবিধ কারণে উজাড় হচ্ছে বন, ভরাট হচ্ছে জলাভূমি। পাখিরা থাকবে কোথায়? এ বছরের প্রতিপাদ্যে ছয়টি বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যা পরিযায়ী পাখিদের বাসভূমির জন্য হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সেগুলো হলো বন উজাড়, নগরায়ণ, বায়োফুয়েল উৎপাদন, কৃষিজমির প্রসারীকরণ, মানুষের মাধ্যমে ভূমি দখল বা উদ্ধার (যেমন—নদীতে বাঁধ দিয়ে চর জাগানো, প্রাকৃতিকভাবে নয় এমন) ও খনিজ সম্পদ উত্তোলন। এ রকম প্রতিটি বিষয়ের কারণে পরিযায়ী পাখির আবাসভূমি ধ্বংস হচ্ছে। যেমন—বায়োফুয়েলের কাঁচামাল জন্মানোর জন্য জলাভূমি ও প্রাকৃতিক বন কাটা হচ্ছে; কৃষি জমি বাড়ানো হচ্ছে ঠিক একইভাবে। ভালো ফলনের জন্য জমিতে দেওয়া হচ্ছে রাসায়নিক সার, পেস্টিসাইড, হার্বিসাইড, যা খাবারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এবং সর্বোপরি খাদ্যশৃঙ্খলে ভারসাম্য নষ্ট করছে। প্রতিবছর পৃথিবীতে ৫০০ কোটি পাউন্ড কীটনাশক ছিটানো হয়। শুধু উত্তর আমেরিকাতেই প্রতিবছর সাত-আট কোটি পাখি কীটনাশক খেয়ে মারা যায়। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য সাগর, মহাসাগর, নদী, পাহাড়, বিশাল সমতলভূমি দখল হচ্ছে, নানা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হছে, যার ফলে পরিযায়ী পাখিরা বসতি হারাচ্ছে ও রাসায়নিক দূষণে মারা পড়ছে।
ওপরের ছয়টি বিষয় বাংলাদেশেও বিদ্যমান। পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশেও এখন নিরাপদ নয়। মানুষের অজ্ঞতা ও অসচেতনতার ফলে এ দেশের পরিযায়ী পাখিরা আজ বিপদসংকুল। প্রতিবছর একশ্রেণীর মানুষের ভোগের জন্য চোরা শিকারিরা বিপুল পরিমাণে এসব পাখি শিকার করে, ফলে দিন দিন বাংলাদেশে পাখির আগমন কমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুক থেকে পাখি যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য সব দেশেই পাখি সংরক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মানুষের প্রকৃতির উপাদানের সঙ্গে পারস্পরিক ভারসাম্য ও বন্ধুত্ব বজায় রাখা দরকার। আর এ জন্য দরকার সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন। আমাদেরও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং বন্য প্রাণী আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে।
সৌরভ মাহমুদ: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
nature.sourav@gmail.com
অঞ্চল বা পরিবেশ ভেদে বিভিন্ন ধরনের পাখি দেখা যায়। এদের মধ্যে কিছু পাখি আবার পরিযায়ী। আমাদের দেশে এসব পাখি বাইরে থেকে আসে বলে আমরা এদের অতিথি বলে থাকি। আসলে এরা অতিথি নয়, আমাদের পরিবারেরই একটি অংশ। শুধু মাঝে মাঝে দেশের বাইরে অবস্থান করে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শীতপ্রধান দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আসে, আবার শীত শেষে একইভাবে দেশান্তরি হয়। খাদ্যের অভাব ও পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে পাখিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তরি হয়।
বাংলাদেশের ৬৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে, তার মধ্যে ৩০০ প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। এই পরিযায়ীদের মধ্যে আট প্রজাতির পাখি গ্রীষ্মে এ দেশে থাকে, শীতে চলে যায়। বাকি ২৯২ প্রজাতির পাখি শীতে এ দেশে থাকে অথবা তার আগে-পরে স্বল্প সময়ের জন্য আসে। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ এবং আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরিযায়ী পাখি আসতে শুরু করে। তবে শীত মৌসুমে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বেশির ভাগ পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে। এসব পরিযায়ী পাখির মধ্যে বেশির ভাগই বিভিন্ন রকমের হাঁস ও অন্যান্য জলচর প্রজাতি। যেমন—রাজশরালি, ধলাকপাল রাজাহাঁস, চখাচখি, পাতি তিলাহাঁস, টিকি হাঁস, কালাটুপি মাছরাঙ্গা ইত্যাদি।
পরিযায়ী পাখিদের জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। এসব পাখি দেশান্তরি হওয়ার আগে প্রচুর পরিমাণে আহার করে শরীরে চর্বি জমায়। কিন্তু এ সঞ্চয় দিয়ে তারা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না, তাই পথে বিভিন্ন স্থানে যাত্রাবিরতি করে খাবার খেতে হয়। কিন্তু প্রতিবছরই দেখা যায়, পূর্বেকার বছরের বহু স্থান বসবাস বা খাবার সংগ্রহের উপযোগী থাকে না। ইতিমধ্যে একটানা পথ পাড়ি দিয়ে গিয়ে ওই পাখিরা দুর্বল হয়ে পড়ে। এভাবে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে বহু পাখি মারা যায়।
১৪ ও ১৫ মে, ২০১১ বিশ্ব পরিযায়ী পাখির দিন বা দিবস পালন করবে বিশ্ববাসী। ২০০৬ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ল্যান্ড ইউজ চেঞ্জেস ফ্রম এ বার্ডস আই ভিউ। পাখির বাসভূমি বা যেখানে বাস করে, তা মানুষের কারণে কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষের নানাবিধ কারণে উজাড় হচ্ছে বন, ভরাট হচ্ছে জলাভূমি। পাখিরা থাকবে কোথায়? এ বছরের প্রতিপাদ্যে ছয়টি বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যা পরিযায়ী পাখিদের বাসভূমির জন্য হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সেগুলো হলো বন উজাড়, নগরায়ণ, বায়োফুয়েল উৎপাদন, কৃষিজমির প্রসারীকরণ, মানুষের মাধ্যমে ভূমি দখল বা উদ্ধার (যেমন—নদীতে বাঁধ দিয়ে চর জাগানো, প্রাকৃতিকভাবে নয় এমন) ও খনিজ সম্পদ উত্তোলন। এ রকম প্রতিটি বিষয়ের কারণে পরিযায়ী পাখির আবাসভূমি ধ্বংস হচ্ছে। যেমন—বায়োফুয়েলের কাঁচামাল জন্মানোর জন্য জলাভূমি ও প্রাকৃতিক বন কাটা হচ্ছে; কৃষি জমি বাড়ানো হচ্ছে ঠিক একইভাবে। ভালো ফলনের জন্য জমিতে দেওয়া হচ্ছে রাসায়নিক সার, পেস্টিসাইড, হার্বিসাইড, যা খাবারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এবং সর্বোপরি খাদ্যশৃঙ্খলে ভারসাম্য নষ্ট করছে। প্রতিবছর পৃথিবীতে ৫০০ কোটি পাউন্ড কীটনাশক ছিটানো হয়। শুধু উত্তর আমেরিকাতেই প্রতিবছর সাত-আট কোটি পাখি কীটনাশক খেয়ে মারা যায়। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য সাগর, মহাসাগর, নদী, পাহাড়, বিশাল সমতলভূমি দখল হচ্ছে, নানা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হছে, যার ফলে পরিযায়ী পাখিরা বসতি হারাচ্ছে ও রাসায়নিক দূষণে মারা পড়ছে।
ওপরের ছয়টি বিষয় বাংলাদেশেও বিদ্যমান। পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশেও এখন নিরাপদ নয়। মানুষের অজ্ঞতা ও অসচেতনতার ফলে এ দেশের পরিযায়ী পাখিরা আজ বিপদসংকুল। প্রতিবছর একশ্রেণীর মানুষের ভোগের জন্য চোরা শিকারিরা বিপুল পরিমাণে এসব পাখি শিকার করে, ফলে দিন দিন বাংলাদেশে পাখির আগমন কমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুক থেকে পাখি যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য সব দেশেই পাখি সংরক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মানুষের প্রকৃতির উপাদানের সঙ্গে পারস্পরিক ভারসাম্য ও বন্ধুত্ব বজায় রাখা দরকার। আর এ জন্য দরকার সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন। আমাদেরও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং বন্য প্রাণী আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে।
সৌরভ মাহমুদ: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
nature.sourav@gmail.com
No comments