দেশজুড়ে প্রতারণার ফাঁদ ডেসটিনির by ফখরুল ইসলাম
অল্প দিনে বড়লোক বানিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দেশজুড়ে গণপ্রতারণার ফাঁদ পেতেছে কথিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড। লোভে পড়ে সেই ফাঁদে ধরা দিয়েছে দেশের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। কেবল বাংলাদেশ নয়, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও এখন ডেসটিনির থাবা।
এই সুযোগে ডেসটিনির কয়েকজন শীর্ষ ব্যক্তি বিনা শ্রমে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। ২০০০ সালে ‘ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড’ নাম নিয়ে যাত্রা শুরুর পর ১১ বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন ৩৭টি। ডেসটিনি ২০০০-এর মুনাফা দিয়েই এই প্রতিষ্ঠানগুলো করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকসংখ্যা এখন ৭০ লাখ বলে তাদের দাবি এবং চলতি বছরের মধ্যে এক কোটি ছাড়িয়ে যাওয়া তাদের লক্ষ্য।
কাগজে-কলমে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা রয়েছে গুটি কয়েক ব্যক্তির নামে। তাঁরা হলেন: ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন, ডেসটিনির সভাপতি হারুন-অর-রশিদ, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ গোফরানুল হক, পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ সাইদ-উর রহমান, পরিচালক (ক্রয়) মেজবাহ উদ্দীন স্বপন, পরিচালক (প্রশাসন) সাকিবুজ্জামান খান প্রমুখ।
প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধান, ডেসটিনির অবৈধ কার্যক্রম বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিনিয়োগ বোর্ড এবং যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তরের কার্যালয়ের (রেজসকো) মধ্যকার চিঠি চালাচালি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
রেজসকো থেকে নিবন্ধন, সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স, এনবিআর থেকে আয়কর প্রত্যয়নপত্র এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সদস্যপদ প্রাপ্তির নমুনাপত্র ছাপিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করছে ডেসটিনি। এ ছাড়া, সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য কোম্পানিটি রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ সাবেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবহার করছে। শুরুর দিকে বিদেশ থেকে সস্তা দামের অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে বাজারজাত করলেও ধীরে ধীরে ব্যবসার ধরন পাল্টিয়েছে ডেসটিনি। বর্তমানে মনোযোগ বৃক্ষরোপণ ও আবাসন খাতে।
ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীন গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানিটির কোনো কিছুই গোপন নয়। ব্যবসা চলছে স্বচ্ছভাবে। কোম্পানি শুরু থেকে এ পর্যন্ত আইনকানুন মেনেই ব্যবসা পরিচালনা করছে। প্রতারণা করার কোনো সুযোগই নেই।
গ্রাহক ধরার ফাঁদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেসটিনি প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্থ সংগ্রহে লিপ্ত। নতুন গ্রাহক সংগ্রহে মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে প্রতি শুক্রবার এবং রাজধানীর কাকরাইল ও পল্টন এলাকার বিভিন্ন ভবনে সপ্তাহের ছয় দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আগে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও বর্তমানে টাকা দিয়ে তা নিতে হয়।
প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে দেখা গেছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষিত ও হতাশ বেকার তরুণ-তরুণী, স্বল্প আয়ের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও গৃহিণীরাই ডেসটিনির প্রধান শিকার। প্রশিক্ষণে তাঁদের বোঝানো হয়, ‘আসুন, বাংলালিংক দেশ-এর মতো আমরা ডেসটিনি দেশ গড়ি। ছয় হাজার টাকা দিয়ে শুরু করুন, পকেটে রাখুন আরও চার হাজার টাকা। ১০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করে মাসে ৫০ হাজার টাকা আয়ের সুযোগ নিন।’
এ ছাড়া ডেসটিনি প্রকাশিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও বইয়ে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রভাবিত হয়ে মানুষ অকাতরে ঢেলে দিচ্ছে তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অর্থের বিনিময়ে পৃষ্ঠপোষক হয়েও মানুষকে আকৃষ্ট করছে ডেসটিনি। আবার সরকারের মুখও তাতে বন্ধ থাকছে।
বহু রোগের মহৌষধ কালিজিরার তৈরি নাইজেলা, বৃক্ষরোপণ, ডেসটিনির এমডির বক্তব্য-সংবলিত সিডি, মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভে বিনিয়োগ ইত্যাদিতে ছয় হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা রাখলে যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে পরিবেশক বানানো হয়। ডেসটিনির ভাষায়, এতে ৫০০ পয়েন্ট ভ্যালু (পিভি) অর্জন করা যায়। আর এভাবে নেটওয়ার্কিং পদ্ধতিতে সপ্তাহে ১২ হাজার ৬০০ টাকা এবং মাসে ৫০ হাজার ৪০০ টাকা আয় করা সম্ভব।
কোম্পানি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘শুরু হওয়ার দুই বছরের মধ্যে বন্ধ না হলে বিশ্বের কোনো এমএলএম কোম্পানিই বন্ধ হয় না। সুতরাং ডেসটিনিও বন্ধ হবে না।’
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কয়েকজন: ডেসটিনি ২০০০-এর কার্যক্রম শুরুর চার বছর পর ২০০৪ সালে নিবন্ধিত হয় ডেসটিনি শপিং সেন্টার। পাঁচ বছর পর বর্তমান সরকারের শুরুর বছর ২০০৯ সালে নিবন্ধিত হয় আরও পাঁচটি। এগুলো হচ্ছে: ডেসটিনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডেসটিনি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, ডেসটিনি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, ডেসটিনি হিটাচি ইলেকট্রিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও ডেসটিনি এনভায়রনমেন্ট সেভিংস।
২০১০ সালে নিবন্ধিত হয় ডেসটিনি বিল্ডার্স লিমিটেড, ডেসটিনি কনজ্যুমার প্রোডাক্টস, ডেসটিনি টি লিমিটেড ও ডেসটিনি সাসকো প্রোপার্টিজ। ২০১১ সালে নিবন্ধিত হয় ডেসটিনি চীনা তিয়ানহং কনস্ট্রাকশন, এয়ার ডেসটিনি লিমিটেড, ডেসটিনি এয়ার সিস্টেমস, ডেসটিনি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশনস ও ডেসটিনি ট্রি প্ল্যানটেশনস লিমিটেড।
এ ছাড়া রয়েছে আলিশা ডেসটিনি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, ডেসটিনি ডায়মন্ড বিল্ডার্স, কনফিগার হাউজিং লিমিটেড, ডেসটিনি সিকিউরিটি ফোর্স, ডেসটিনি এডুকেশন অ্যান্ড হ্যালথ ফাউন্ডেশন, বন্দীশাহী কোল্ড স্টোরেজ, ডেসটিনি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং কনফিগার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, বৈশাখী টেলিভিশন ও দৈনিক ডেসটিনি।
এর মধ্যে বেশির ভাগ কোম্পানিতেই পরিচালকেরা হলেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ওই একই ব্যক্তি। তাঁরা হলেন: মোহাম্মদ রফিকুল আমীন, হারুন-অর-রশিদ, মোহাম্মদ গোফরানুল হক, সাঈদ-উর-রহমান, মোহাম্মদ হোসেন, শেখ তৈয়েবুর রহমান ও মেজবাহউদ্দিন স্বপন। এর বাইরে আরও রয়েছেন: সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, আবু জাফর নিজামী, ইরফান আহমেদ, রফিকুল ইসলাম সরকার, মনিরুল ইসলাম, শেখ আতিয়ার রহমান, পাপিয়া শারমিন, নেপাল চন্দ্র বিশ্বাস, শেখ আতিয়ার রহমান, ফরিদ আক্তার, দিদারুল আলম, ওয়ালিউল হাসনাত, জসিমউদ্দিন রানা, তৌফিক আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, মাহমুদ আহমেদ ও মাহমুদ হাসান খান।
এক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার রয়েছে অন্যটিতে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের মনোনীত পরিচালকেরা হলেন ডেসটিনির এসব শীর্ষ ব্যক্তিই। তিনজন বিদেশি নাগরিকও ডেসটিনির কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পরিচালক রয়েছেন। দুই চীনা নাগরিক চেন জিয়ান চুং, বাই ফু কিয়াং ও মার্কিন নাগরিক লি লিন আইলিন।
আইনি দুর্বলতার সুযোগ: অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডেসটিনি এমএলএমের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে মূলত আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। রেজসকো থেকে নিবন্ধন নিয়ে এখতিয়ারের বাইরে কাজ করছে।
রেজসকোর নিবন্ধক আহমেদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোম্পানি করতে গেলেই রেজসকো থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। কিন্তু কেউ ব্যাংক ব্যবসা করতে চাইলে ব্যাংকিং লাইসেন্স নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। একইভাবে টেলিফোন ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) থেকে এবং বিমা ব্যবসার জন্য বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।’
আহমেদুর রহিম আরও বলেন, রেজসকো থেকে নিবন্ধন নিয়ে কেউ ব্যাংক ব্যবসা করলে নিশ্চিতভাবেই তাঁর দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের। আবার কেউ টেলিফোন ব্যবসা করলে দায় বিটিআরসির, আর বিমা ব্যবসা করলে দায় আইডিআরএর।
ডেসটিনি গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচিতিসহ অন্যান্য প্রকাশনায় বলা রয়েছে যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখলে ছয় মাস বা এক বছর পর জমাকৃত টাকা দ্বিগুণ করে দেওয়া হবে। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার পণ্য বিপণনের সঙ্গে যুক্ত।
অবৈধভাবে আমানত সংগ্রহেও লিপ্ত ডেসটিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, অবৈধ ব্যাংকিংও করছে তারা। লোভনীয় মুনাফার লোভ দেখিয়ে এর আগে বিসিআই, আইটিসিএল, জিজিএন, যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক) এবং সম্প্রতি ইউনিপে টুইউ অসংখ্য মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছিল। একই ধরনের ঘটনা ঘটলেও সরকার এবার নীরব।
জাতীয় সংসদে ডেসটিনি: ডেসটিনিসহ এমএলএম কোম্পানি নিয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদের বলেছেন, কোম্পানিগুলো মানুষের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করছে। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে স্বপ্ন দেখিয়ে নিঃস্ব করছে অনেককে।
এর আগে ২০১১ সালের ২৪ আগস্ট বাগমারার সাংসদ এনামুল হক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের উদ্দেশে ডেসটিনি ২০০০-এর প্রতারণামূলক কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি তুলেছিলেন। ওই দিন এনামুল হক সংসদে বলেন, তাঁর নির্বাচনী আসনের ১০ হাজার সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে ২০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছে ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ডেসটিনি ২০০০-এর প্রতারণামূলক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
ডেসটিনির বক্তব্য: ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীন গতকাল সন্ধ্যায় বৈশাখী টেলিভিশন কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ডেসটিনি ২০০০-এর গ্রাহক ৪৩ লাখ ছয় হাজার। আর ডেসটিনি গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ৩৭টি। এর মধ্যে ভালোভাবে কার্যকর ডেসটিনি ২০০০, ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ডেসটিনি ডেভেলপার্স এবং ডেসটিনি মিডিয়া। তবে মোট চালু রয়েছে ১২ থেকে ১৩টি প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলো কাগজে-কলমে। যেহেতু দুই লাখ টাকা হলেই কোম্পানির নিবন্ধন করা যায়, তাই এতগুলো কোম্পানির নিবন্ধন নিয়ে রেখেছেন তিনি।
রফিকুল আমীন আরও জানান, ডেসটিনি গ্রুপের মালিকানাধীন সব কোম্পানির পরিচালকেরা ডেসটিনি-২০০০, ট্রি প্ল্যানটেশন ও কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে শেয়ার হস্তান্তর করেছেন। তিনি বলেন, ২০০৭ সালের আগে ডেসটিনি ২০০০ মুনাফায় যেতে পারেনি। দেশ-বিদেশে সমপ্রসারিত ব্যবসায়ের কথা স্বীকার করে তিনি জানান, প্রতারণার মাধ্যমে ১১ বছর ধরে মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখা যায় না।
কাগজে-কলমে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা রয়েছে গুটি কয়েক ব্যক্তির নামে। তাঁরা হলেন: ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন, ডেসটিনির সভাপতি হারুন-অর-রশিদ, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ গোফরানুল হক, পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ সাইদ-উর রহমান, পরিচালক (ক্রয়) মেজবাহ উদ্দীন স্বপন, পরিচালক (প্রশাসন) সাকিবুজ্জামান খান প্রমুখ।
প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধান, ডেসটিনির অবৈধ কার্যক্রম বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিনিয়োগ বোর্ড এবং যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তরের কার্যালয়ের (রেজসকো) মধ্যকার চিঠি চালাচালি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
রেজসকো থেকে নিবন্ধন, সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স, এনবিআর থেকে আয়কর প্রত্যয়নপত্র এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সদস্যপদ প্রাপ্তির নমুনাপত্র ছাপিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করছে ডেসটিনি। এ ছাড়া, সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য কোম্পানিটি রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ সাবেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবহার করছে। শুরুর দিকে বিদেশ থেকে সস্তা দামের অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে বাজারজাত করলেও ধীরে ধীরে ব্যবসার ধরন পাল্টিয়েছে ডেসটিনি। বর্তমানে মনোযোগ বৃক্ষরোপণ ও আবাসন খাতে।
ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীন গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানিটির কোনো কিছুই গোপন নয়। ব্যবসা চলছে স্বচ্ছভাবে। কোম্পানি শুরু থেকে এ পর্যন্ত আইনকানুন মেনেই ব্যবসা পরিচালনা করছে। প্রতারণা করার কোনো সুযোগই নেই।
গ্রাহক ধরার ফাঁদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেসটিনি প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্থ সংগ্রহে লিপ্ত। নতুন গ্রাহক সংগ্রহে মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে প্রতি শুক্রবার এবং রাজধানীর কাকরাইল ও পল্টন এলাকার বিভিন্ন ভবনে সপ্তাহের ছয় দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আগে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও বর্তমানে টাকা দিয়ে তা নিতে হয়।
প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে দেখা গেছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষিত ও হতাশ বেকার তরুণ-তরুণী, স্বল্প আয়ের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও গৃহিণীরাই ডেসটিনির প্রধান শিকার। প্রশিক্ষণে তাঁদের বোঝানো হয়, ‘আসুন, বাংলালিংক দেশ-এর মতো আমরা ডেসটিনি দেশ গড়ি। ছয় হাজার টাকা দিয়ে শুরু করুন, পকেটে রাখুন আরও চার হাজার টাকা। ১০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করে মাসে ৫০ হাজার টাকা আয়ের সুযোগ নিন।’
এ ছাড়া ডেসটিনি প্রকাশিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও বইয়ে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রভাবিত হয়ে মানুষ অকাতরে ঢেলে দিচ্ছে তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অর্থের বিনিময়ে পৃষ্ঠপোষক হয়েও মানুষকে আকৃষ্ট করছে ডেসটিনি। আবার সরকারের মুখও তাতে বন্ধ থাকছে।
বহু রোগের মহৌষধ কালিজিরার তৈরি নাইজেলা, বৃক্ষরোপণ, ডেসটিনির এমডির বক্তব্য-সংবলিত সিডি, মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভে বিনিয়োগ ইত্যাদিতে ছয় হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা রাখলে যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে পরিবেশক বানানো হয়। ডেসটিনির ভাষায়, এতে ৫০০ পয়েন্ট ভ্যালু (পিভি) অর্জন করা যায়। আর এভাবে নেটওয়ার্কিং পদ্ধতিতে সপ্তাহে ১২ হাজার ৬০০ টাকা এবং মাসে ৫০ হাজার ৪০০ টাকা আয় করা সম্ভব।
কোম্পানি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘শুরু হওয়ার দুই বছরের মধ্যে বন্ধ না হলে বিশ্বের কোনো এমএলএম কোম্পানিই বন্ধ হয় না। সুতরাং ডেসটিনিও বন্ধ হবে না।’
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কয়েকজন: ডেসটিনি ২০০০-এর কার্যক্রম শুরুর চার বছর পর ২০০৪ সালে নিবন্ধিত হয় ডেসটিনি শপিং সেন্টার। পাঁচ বছর পর বর্তমান সরকারের শুরুর বছর ২০০৯ সালে নিবন্ধিত হয় আরও পাঁচটি। এগুলো হচ্ছে: ডেসটিনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডেসটিনি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, ডেসটিনি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, ডেসটিনি হিটাচি ইলেকট্রিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও ডেসটিনি এনভায়রনমেন্ট সেভিংস।
২০১০ সালে নিবন্ধিত হয় ডেসটিনি বিল্ডার্স লিমিটেড, ডেসটিনি কনজ্যুমার প্রোডাক্টস, ডেসটিনি টি লিমিটেড ও ডেসটিনি সাসকো প্রোপার্টিজ। ২০১১ সালে নিবন্ধিত হয় ডেসটিনি চীনা তিয়ানহং কনস্ট্রাকশন, এয়ার ডেসটিনি লিমিটেড, ডেসটিনি এয়ার সিস্টেমস, ডেসটিনি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশনস ও ডেসটিনি ট্রি প্ল্যানটেশনস লিমিটেড।
এ ছাড়া রয়েছে আলিশা ডেসটিনি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, ডেসটিনি ডায়মন্ড বিল্ডার্স, কনফিগার হাউজিং লিমিটেড, ডেসটিনি সিকিউরিটি ফোর্স, ডেসটিনি এডুকেশন অ্যান্ড হ্যালথ ফাউন্ডেশন, বন্দীশাহী কোল্ড স্টোরেজ, ডেসটিনি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং কনফিগার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, বৈশাখী টেলিভিশন ও দৈনিক ডেসটিনি।
এর মধ্যে বেশির ভাগ কোম্পানিতেই পরিচালকেরা হলেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ওই একই ব্যক্তি। তাঁরা হলেন: মোহাম্মদ রফিকুল আমীন, হারুন-অর-রশিদ, মোহাম্মদ গোফরানুল হক, সাঈদ-উর-রহমান, মোহাম্মদ হোসেন, শেখ তৈয়েবুর রহমান ও মেজবাহউদ্দিন স্বপন। এর বাইরে আরও রয়েছেন: সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, আবু জাফর নিজামী, ইরফান আহমেদ, রফিকুল ইসলাম সরকার, মনিরুল ইসলাম, শেখ আতিয়ার রহমান, পাপিয়া শারমিন, নেপাল চন্দ্র বিশ্বাস, শেখ আতিয়ার রহমান, ফরিদ আক্তার, দিদারুল আলম, ওয়ালিউল হাসনাত, জসিমউদ্দিন রানা, তৌফিক আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, মাহমুদ আহমেদ ও মাহমুদ হাসান খান।
এক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার রয়েছে অন্যটিতে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের মনোনীত পরিচালকেরা হলেন ডেসটিনির এসব শীর্ষ ব্যক্তিই। তিনজন বিদেশি নাগরিকও ডেসটিনির কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পরিচালক রয়েছেন। দুই চীনা নাগরিক চেন জিয়ান চুং, বাই ফু কিয়াং ও মার্কিন নাগরিক লি লিন আইলিন।
আইনি দুর্বলতার সুযোগ: অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডেসটিনি এমএলএমের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে মূলত আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। রেজসকো থেকে নিবন্ধন নিয়ে এখতিয়ারের বাইরে কাজ করছে।
রেজসকোর নিবন্ধক আহমেদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোম্পানি করতে গেলেই রেজসকো থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। কিন্তু কেউ ব্যাংক ব্যবসা করতে চাইলে ব্যাংকিং লাইসেন্স নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। একইভাবে টেলিফোন ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) থেকে এবং বিমা ব্যবসার জন্য বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।’
আহমেদুর রহিম আরও বলেন, রেজসকো থেকে নিবন্ধন নিয়ে কেউ ব্যাংক ব্যবসা করলে নিশ্চিতভাবেই তাঁর দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের। আবার কেউ টেলিফোন ব্যবসা করলে দায় বিটিআরসির, আর বিমা ব্যবসা করলে দায় আইডিআরএর।
ডেসটিনি গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচিতিসহ অন্যান্য প্রকাশনায় বলা রয়েছে যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখলে ছয় মাস বা এক বছর পর জমাকৃত টাকা দ্বিগুণ করে দেওয়া হবে। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার পণ্য বিপণনের সঙ্গে যুক্ত।
অবৈধভাবে আমানত সংগ্রহেও লিপ্ত ডেসটিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, অবৈধ ব্যাংকিংও করছে তারা। লোভনীয় মুনাফার লোভ দেখিয়ে এর আগে বিসিআই, আইটিসিএল, জিজিএন, যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক) এবং সম্প্রতি ইউনিপে টুইউ অসংখ্য মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছিল। একই ধরনের ঘটনা ঘটলেও সরকার এবার নীরব।
জাতীয় সংসদে ডেসটিনি: ডেসটিনিসহ এমএলএম কোম্পানি নিয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদের বলেছেন, কোম্পানিগুলো মানুষের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করছে। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে স্বপ্ন দেখিয়ে নিঃস্ব করছে অনেককে।
এর আগে ২০১১ সালের ২৪ আগস্ট বাগমারার সাংসদ এনামুল হক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের উদ্দেশে ডেসটিনি ২০০০-এর প্রতারণামূলক কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি তুলেছিলেন। ওই দিন এনামুল হক সংসদে বলেন, তাঁর নির্বাচনী আসনের ১০ হাজার সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে ২০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছে ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ডেসটিনি ২০০০-এর প্রতারণামূলক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
ডেসটিনির বক্তব্য: ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীন গতকাল সন্ধ্যায় বৈশাখী টেলিভিশন কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ডেসটিনি ২০০০-এর গ্রাহক ৪৩ লাখ ছয় হাজার। আর ডেসটিনি গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ৩৭টি। এর মধ্যে ভালোভাবে কার্যকর ডেসটিনি ২০০০, ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ডেসটিনি ডেভেলপার্স এবং ডেসটিনি মিডিয়া। তবে মোট চালু রয়েছে ১২ থেকে ১৩টি প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলো কাগজে-কলমে। যেহেতু দুই লাখ টাকা হলেই কোম্পানির নিবন্ধন করা যায়, তাই এতগুলো কোম্পানির নিবন্ধন নিয়ে রেখেছেন তিনি।
রফিকুল আমীন আরও জানান, ডেসটিনি গ্রুপের মালিকানাধীন সব কোম্পানির পরিচালকেরা ডেসটিনি-২০০০, ট্রি প্ল্যানটেশন ও কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে শেয়ার হস্তান্তর করেছেন। তিনি বলেন, ২০০৭ সালের আগে ডেসটিনি ২০০০ মুনাফায় যেতে পারেনি। দেশ-বিদেশে সমপ্রসারিত ব্যবসায়ের কথা স্বীকার করে তিনি জানান, প্রতারণার মাধ্যমে ১১ বছর ধরে মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখা যায় না।
No comments