গণমাধ্যম-সাংবাদিকতায় নৈতিকতার প্রশ্ন by মশিউল আলম
২০১০ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ‘একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা: মতিউর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে গোয়েন্দারা’ এবং ১০ মে কালের কণ্ঠ পত্রিকায় ‘হোতা তাজউদ্দিনকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন মতিউর রহমান’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। বসুন্ধরা গ্রুপের ‘ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড’
-এর মালিকানাধীন এ দুটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকদের বিরুদ্ধে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান গত বছরের ২৪ অক্টোবর প্রেস কাউন্সিলে দুটি পৃথক মামলা করেন। প্রেস কাউন্সিল গত ১২ এপ্রিল কালের কণ্ঠ পত্রিকার বিরুদ্ধে করা মামলাটির রায় ঘোষণা করেছেন। রায়ে বলা হয়েছে, ‘সাংবাদিক টিপুকে [সুলতান] জড়িয়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে ঘিরে দৈনিক কালের কণ্ঠ যে অপসাংবাদিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা সাংবাদিকতার পরিপন্থী বলে এই কাউন্সিল ভবিষ্যতে বিচারাধীন কোনো মামলা বা এমন সাক্ষী-সাবুদ ছাড়া বা কোনো সূত্র ছাড়া কোনো তথ্য পত্রিকায় প্রকাশ থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করে দিচ্ছে।’ ৪ মে প্রেস কাউন্সিল বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটিরও রায় ঘোষণা করেছেন। সে রায়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সম্পর্কে ‘মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও কুৎসাপূর্ণ সংবাদ প্রকাশের’ জন্য বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশককে ভর্ৎসনা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ বিষয়ে সতর্ক করেছেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল।
কালের কণ্ঠ পত্রিকার বিরুদ্ধে রায়টি প্রসঙ্গে পত্রিকাটির সম্পাদক আবেদ খান ২৯ এপ্রিল তাঁর পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘প্রেস কাউন্সিলের রায় এবং আমার বক্তব্য’ শিরোনামে একটি বিশেষ মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। লেখাটিতে তিনি প্রেস কাউন্সিলকে সাধুবাদ জানিয়েছেন; সেই সঙ্গে আরও লিখেছেন, ‘কালের কণ্ঠের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতাকে একটি মাত্র মোকদ্দমার নিক্তিতে বিচার করে হলুদ বা অপসাংবাদিকতার দায় চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত হবে।’ বলা বাহুল্য, প্রেস কাউন্সিল কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত একটিমাত্র প্রতিবেদন প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, যেটি নিয়ে মামলা হয়েছে। পত্রিকাটির সব সাংবাদিক বা সামগ্রিকভাবে পত্রিকাটির সাংবাদিকতা সম্পর্কে মন্তব্য করেননি। কিন্তু কালের কণ্ঠ মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগসহ কুৎসামূলক নানা কথা প্রচার করেছে দিনের পর দিন। মতিউর রহমান, প্রথম আলো, এ পত্রিকার অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম গ্রুপ ও তার স্বত্বাধিকারী লতিফুর রহমান, এমনকি মতিউর রহমানের পুত্র সম্পর্কেও ভিত্তিহীন, মানহানিকর অভিযোগ প্রকাশ করেছে। ২০১০ সালের ১০ মার্চ থেকে ২০১১ সালের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এ ধরনের প্রতিবেদনের সংখ্যা প্রায় ৩৫টি। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায়ও একই ধরনের বিষয়ে প্রায় আরও বেশিসংখ্যক লেখা ছাপা হয়েছে।
সমাজে প্রথম আলো ও মতিউর রহমানের মর্যাদাহানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে ‘জাতীয় সংবাদপত্র পাঠক ফোরাম’ নামে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি সংগঠনের মানববন্ধনের খবর শুধু কালের কণ্ঠ ও তার সহযোগী বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায়ই ছাপা হয়েছে। ওই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মানববন্ধন করে মতিউর রহমানের বিচার ও শাস্তির দাবি করেছেন কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত ভিত্তিহীন প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে। আবার তাদের মানববন্ধনগুলোর খবরও ছাপা হয়েছে ওই দুটি পত্রিকাতেই, এবং একই গ্রুপের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান-এ। দেশের আর কোনো সংবাদপত্রে ওই খবরগুলো ছাপা হয়নি, কারণ সবার কাছেই সুস্পষ্ট ছিল যে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার সঙ্গে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে জড়ানোর চেষ্টা অসৎ উদ্দেশ্যমূলক।
কালের কণ্ঠ পত্রিকার সহযোগী বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাটিও প্রথম আলো এবং বিশেষ করে এর সম্পাদক মতিউর রহমানের সম্মানহানির উদ্দেশ্যে দিনের পর দিন যেসব লেখা প্রকাশ করে চলেছে, সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে সাংবাদিকতার ন্যূনতম নৈতিকতা ও রীতিনীতি ওই সব লেখায় প্রতিফলিত হয়নি। প্রসঙ্গত, একটি তথ্য উল্লেখ করা যায়, গত ৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা ব্যর্থ হলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে লেখা হয় ‘আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে জনমত উসকে দেয় ওয়ান-ইলেভেনের সময় বিতর্কিত ভূমিকা পালনকারী প্রথম আলো। শুধু পত্রিকায় বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বিক্ষোভ সংগঠিত করতে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করারও অভিযোগ রয়েছে।’ প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এই ভিত্তিহীন প্রতিবেদনের প্রতিবাদ পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ, কিন্তু পত্রিকাটি সেই প্রতিবাদ প্রকাশ করেনি, যা করা সাংবাদিকতার সাধারণ রীতিগুলোর অন্যতম।
আবেদ খানের বিশেষ মন্তব্য প্রতিবেদনটির সুবাদে দুঃখের সঙ্গে কিছু কথা বলতে হচ্ছে। তিনি বর্ষীয়ান পেশাজীবী সাংবাদিক, আজীবন সংবাদপত্র জগতের ভেতরের মানুষ। তাঁর দীর্ঘ চার দশকের সাংবাদিকজীবনে তিনি কখনো এমন ঘটনা দেখেছেন কি যে দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের মর্যাদাহানি, এমনকি অতি গুরুতর একটি ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে তাঁকে জড়ানোর চেষ্টায় কোনো আরেকটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র ভিত্তিহীন অভিযোগসংবলিত কুৎসাপূর্ণ প্রচারণা দিনের পর দিন চালিয়েছে? দৈনিক কালের কণ্ঠ সেই কাজ করেছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে; আর সেই কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক স্বয়ং আবেদ খান। এমনকি, ১২ এপ্রিল কালের কণ্ঠ পত্রিকার বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলের রায়টি ঘোষণার পরও ২২ এপ্রিল পত্রিকাটির প্রথম পাতায় মতিউর রহমানের ছবিসহ বিরাট এক লেখা ছাপা হয়েছে ‘মতিউর রহমানের ক্ষমা চাওয়া’ শিরোনামে, যেটি কোনো সাংবাদিকী রচনার বৈশিষ্ট্য বহন করে না (তথ্যসূত্রহীন নানা ভিত্তিহীন অভিযোগ ও নিন্দামূলক কথাবার্তার পুনরাবৃত্তি)।
আবেদ খান তাঁর লেখায় যুক্তরাষ্ট্রের উনিশ শতকের দুটি পত্রিকা জোসেফ পুলিৎজারের দি নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও র্যানডলফ হার্স্টের দ্য জার্নাল-এর মধ্যকার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে মন্তব্য করেছেন, প্রেস কাউন্সিল কালের কণ্ঠ পত্রিকার বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার আগে ‘এই বাস্তবতাটি’ বিবেচনায় নিলে ‘কালের কণ্ঠকে এককভাবে এই নীল বেদনা বহন করতে হতো না।’ আবেদ খান ‘এই বাস্তবতা’ বলতে সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন ওই দুটি মার্কিন পত্রিকার মধ্যেকার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাস্তবতাকে। কিন্তু প্রথম আলোর সঙ্গে কালের কণ্ঠ পত্রিকার কি সেই রকমের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে? কালের কণ্ঠ পত্রিকার অর্থলগ্নিকারী বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গেও প্রথম আলোর অর্থলগ্নিকারী ট্রান্সকম গ্রুপের ব্যবসায়িক কোনো দ্বন্দ্ব নেই; দুই গ্রুপের ব্যবসার ক্ষেত্র ও ধরন আলাদা। কালের কণ্ঠ যদি প্রথম আলোকে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে সাংবাদিকতার গুণমান বাড়িয়ে পাঠকের মন জয় করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো, তবে তা হতো অতিশয় উৎসাহব্যঞ্জক ব্যাপার। কিন্তু পত্রিকাটি মোটেও সে-পথে পা বাড়ায়নি, বরং প্রথম আলোর সম্পাদকের মর্যাদাহানির লক্ষ্যে মিথ্যা ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালিয়েছে সাংবাদিকতার সব নৈতিকতা লঙ্ঘন করে।
সংবাদপত্রকে যদি স্রেফ ব্যবসা বলেও ধরা হয় (পাবলিক সার্ভিসের কথা সরিয়ে রাখলাম), এই ব্যবসারও নীতি-নৈতিকতা আছে। এই ব্যবসার পণ্য হলো তথ্য, সংবাদ। মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট, কুৎসামূলক কোনো কিছুই তথ্য বা সংবাদ নয়। সুতরাং সেগুলো পাঠকের পাতেই দেওয়া চলে না। এসব বিষয় উৎপাদন করার জন্য সংবাদকর্মীর জন্ম হয়নি। সংবাদমাধ্যমের মালিক বেতন-ভাতা দেন বলেই সংবাদকর্মীকে দিয়ে তিনি এমন কিছু করাতে পারেন না, যা সাংবাদিকতা পেশার নৈতিকতার পরিপন্থী। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ সাজিয়ে তাঁর সম্মানহানি ঘটানো কোনো সংবাদকর্মী বা সম্পাদকের কাজের বা চাকরির অংশ হতে পারে না। এ ধরনের কিছু করতে অস্বীকৃতি জানানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার নৈতিক মনোবল সংবাদকর্মীদের, বিশেষত সম্পাদকদের থাকা প্রয়োজন। নইলে সাংবাদিকতা পেশার মানমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে।
আবেদ খান তাঁর বিশেষ মন্তব্য প্রতিবেদনের শেষে লিখেছেন, ‘আমি চাই কালের কণ্ঠে সুস্থ সাংবাদিকতা থাকুক। দেশে সুস্থ প্রতিযোগিতা এবং স্বাস্থ্যকর সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হোক।’ প্রেস কাউন্সিলের রায়ের মাধ্যমে তাঁর মধ্যে এই শুভবোধ সৃষ্টি হয়ে থাকলে তা নিশ্চয়ই স্বস্তি ও আনন্দের বিষয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
কালের কণ্ঠ পত্রিকার বিরুদ্ধে রায়টি প্রসঙ্গে পত্রিকাটির সম্পাদক আবেদ খান ২৯ এপ্রিল তাঁর পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘প্রেস কাউন্সিলের রায় এবং আমার বক্তব্য’ শিরোনামে একটি বিশেষ মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। লেখাটিতে তিনি প্রেস কাউন্সিলকে সাধুবাদ জানিয়েছেন; সেই সঙ্গে আরও লিখেছেন, ‘কালের কণ্ঠের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতাকে একটি মাত্র মোকদ্দমার নিক্তিতে বিচার করে হলুদ বা অপসাংবাদিকতার দায় চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত হবে।’ বলা বাহুল্য, প্রেস কাউন্সিল কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত একটিমাত্র প্রতিবেদন প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, যেটি নিয়ে মামলা হয়েছে। পত্রিকাটির সব সাংবাদিক বা সামগ্রিকভাবে পত্রিকাটির সাংবাদিকতা সম্পর্কে মন্তব্য করেননি। কিন্তু কালের কণ্ঠ মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগসহ কুৎসামূলক নানা কথা প্রচার করেছে দিনের পর দিন। মতিউর রহমান, প্রথম আলো, এ পত্রিকার অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম গ্রুপ ও তার স্বত্বাধিকারী লতিফুর রহমান, এমনকি মতিউর রহমানের পুত্র সম্পর্কেও ভিত্তিহীন, মানহানিকর অভিযোগ প্রকাশ করেছে। ২০১০ সালের ১০ মার্চ থেকে ২০১১ সালের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এ ধরনের প্রতিবেদনের সংখ্যা প্রায় ৩৫টি। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায়ও একই ধরনের বিষয়ে প্রায় আরও বেশিসংখ্যক লেখা ছাপা হয়েছে।
সমাজে প্রথম আলো ও মতিউর রহমানের মর্যাদাহানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে ‘জাতীয় সংবাদপত্র পাঠক ফোরাম’ নামে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি সংগঠনের মানববন্ধনের খবর শুধু কালের কণ্ঠ ও তার সহযোগী বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায়ই ছাপা হয়েছে। ওই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মানববন্ধন করে মতিউর রহমানের বিচার ও শাস্তির দাবি করেছেন কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত ভিত্তিহীন প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে। আবার তাদের মানববন্ধনগুলোর খবরও ছাপা হয়েছে ওই দুটি পত্রিকাতেই, এবং একই গ্রুপের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান-এ। দেশের আর কোনো সংবাদপত্রে ওই খবরগুলো ছাপা হয়নি, কারণ সবার কাছেই সুস্পষ্ট ছিল যে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার সঙ্গে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে জড়ানোর চেষ্টা অসৎ উদ্দেশ্যমূলক।
কালের কণ্ঠ পত্রিকার সহযোগী বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাটিও প্রথম আলো এবং বিশেষ করে এর সম্পাদক মতিউর রহমানের সম্মানহানির উদ্দেশ্যে দিনের পর দিন যেসব লেখা প্রকাশ করে চলেছে, সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে সাংবাদিকতার ন্যূনতম নৈতিকতা ও রীতিনীতি ওই সব লেখায় প্রতিফলিত হয়নি। প্রসঙ্গত, একটি তথ্য উল্লেখ করা যায়, গত ৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা ব্যর্থ হলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে লেখা হয় ‘আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে জনমত উসকে দেয় ওয়ান-ইলেভেনের সময় বিতর্কিত ভূমিকা পালনকারী প্রথম আলো। শুধু পত্রিকায় বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বিক্ষোভ সংগঠিত করতে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করারও অভিযোগ রয়েছে।’ প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এই ভিত্তিহীন প্রতিবেদনের প্রতিবাদ পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ, কিন্তু পত্রিকাটি সেই প্রতিবাদ প্রকাশ করেনি, যা করা সাংবাদিকতার সাধারণ রীতিগুলোর অন্যতম।
আবেদ খানের বিশেষ মন্তব্য প্রতিবেদনটির সুবাদে দুঃখের সঙ্গে কিছু কথা বলতে হচ্ছে। তিনি বর্ষীয়ান পেশাজীবী সাংবাদিক, আজীবন সংবাদপত্র জগতের ভেতরের মানুষ। তাঁর দীর্ঘ চার দশকের সাংবাদিকজীবনে তিনি কখনো এমন ঘটনা দেখেছেন কি যে দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের মর্যাদাহানি, এমনকি অতি গুরুতর একটি ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে তাঁকে জড়ানোর চেষ্টায় কোনো আরেকটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র ভিত্তিহীন অভিযোগসংবলিত কুৎসাপূর্ণ প্রচারণা দিনের পর দিন চালিয়েছে? দৈনিক কালের কণ্ঠ সেই কাজ করেছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে; আর সেই কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক স্বয়ং আবেদ খান। এমনকি, ১২ এপ্রিল কালের কণ্ঠ পত্রিকার বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলের রায়টি ঘোষণার পরও ২২ এপ্রিল পত্রিকাটির প্রথম পাতায় মতিউর রহমানের ছবিসহ বিরাট এক লেখা ছাপা হয়েছে ‘মতিউর রহমানের ক্ষমা চাওয়া’ শিরোনামে, যেটি কোনো সাংবাদিকী রচনার বৈশিষ্ট্য বহন করে না (তথ্যসূত্রহীন নানা ভিত্তিহীন অভিযোগ ও নিন্দামূলক কথাবার্তার পুনরাবৃত্তি)।
আবেদ খান তাঁর লেখায় যুক্তরাষ্ট্রের উনিশ শতকের দুটি পত্রিকা জোসেফ পুলিৎজারের দি নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও র্যানডলফ হার্স্টের দ্য জার্নাল-এর মধ্যকার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে মন্তব্য করেছেন, প্রেস কাউন্সিল কালের কণ্ঠ পত্রিকার বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার আগে ‘এই বাস্তবতাটি’ বিবেচনায় নিলে ‘কালের কণ্ঠকে এককভাবে এই নীল বেদনা বহন করতে হতো না।’ আবেদ খান ‘এই বাস্তবতা’ বলতে সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন ওই দুটি মার্কিন পত্রিকার মধ্যেকার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাস্তবতাকে। কিন্তু প্রথম আলোর সঙ্গে কালের কণ্ঠ পত্রিকার কি সেই রকমের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে? কালের কণ্ঠ পত্রিকার অর্থলগ্নিকারী বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গেও প্রথম আলোর অর্থলগ্নিকারী ট্রান্সকম গ্রুপের ব্যবসায়িক কোনো দ্বন্দ্ব নেই; দুই গ্রুপের ব্যবসার ক্ষেত্র ও ধরন আলাদা। কালের কণ্ঠ যদি প্রথম আলোকে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে সাংবাদিকতার গুণমান বাড়িয়ে পাঠকের মন জয় করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো, তবে তা হতো অতিশয় উৎসাহব্যঞ্জক ব্যাপার। কিন্তু পত্রিকাটি মোটেও সে-পথে পা বাড়ায়নি, বরং প্রথম আলোর সম্পাদকের মর্যাদাহানির লক্ষ্যে মিথ্যা ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালিয়েছে সাংবাদিকতার সব নৈতিকতা লঙ্ঘন করে।
সংবাদপত্রকে যদি স্রেফ ব্যবসা বলেও ধরা হয় (পাবলিক সার্ভিসের কথা সরিয়ে রাখলাম), এই ব্যবসারও নীতি-নৈতিকতা আছে। এই ব্যবসার পণ্য হলো তথ্য, সংবাদ। মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট, কুৎসামূলক কোনো কিছুই তথ্য বা সংবাদ নয়। সুতরাং সেগুলো পাঠকের পাতেই দেওয়া চলে না। এসব বিষয় উৎপাদন করার জন্য সংবাদকর্মীর জন্ম হয়নি। সংবাদমাধ্যমের মালিক বেতন-ভাতা দেন বলেই সংবাদকর্মীকে দিয়ে তিনি এমন কিছু করাতে পারেন না, যা সাংবাদিকতা পেশার নৈতিকতার পরিপন্থী। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ সাজিয়ে তাঁর সম্মানহানি ঘটানো কোনো সংবাদকর্মী বা সম্পাদকের কাজের বা চাকরির অংশ হতে পারে না। এ ধরনের কিছু করতে অস্বীকৃতি জানানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার নৈতিক মনোবল সংবাদকর্মীদের, বিশেষত সম্পাদকদের থাকা প্রয়োজন। নইলে সাংবাদিকতা পেশার মানমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে।
আবেদ খান তাঁর বিশেষ মন্তব্য প্রতিবেদনের শেষে লিখেছেন, ‘আমি চাই কালের কণ্ঠে সুস্থ সাংবাদিকতা থাকুক। দেশে সুস্থ প্রতিযোগিতা এবং স্বাস্থ্যকর সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হোক।’ প্রেস কাউন্সিলের রায়ের মাধ্যমে তাঁর মধ্যে এই শুভবোধ সৃষ্টি হয়ে থাকলে তা নিশ্চয়ই স্বস্তি ও আনন্দের বিষয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments