বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি-জনদুর্ভোগে নতুন মাত্রা
মহাজোট সরকারের তৃতীয় বছর পূর্তি উপলক্ষে যেসব জনমত জরিপ পরিচালনা করা হয়, তার প্রতিটিতেই প্রধান সাফল্যের তালিকায় ছিল বিদ্যুৎ। তিন বছরে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করার স্বীকৃতি মিলেছে মুক্তকণ্ঠে। কয়েকটি নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণাধীন এবং সেগুলো চালু হলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কথা।
এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম কিছুটা বাড়ানো হলে ভোক্তারা অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই তা গ্রহণ করত। কিন্তু মার্চ মাসের দাবদাহের মধ্যে বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা হচ্ছে সব মহল থেকে। সরকার এবং বিদ্যুৎ বিভাগের যুক্তি আগের মতোই_ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে এবং এর কারণ প্রধানত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। জ্বালানি খাতে বিপুল ভর্তুকি সরকারের বাজেটে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। এ যুক্তি বিদ্যুতের গ্রাহক শিল্প-বাণিজ্য-কৃষি খাতের উদ্যোক্তা এবং বাসগৃহের অধিবাসীদের মেনে নিতে আপত্তি থাকত না, যদি মোটামুটি নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত হতো। কিন্তু বাস্তবে গরমের সময়ে বিদ্যুতের দামের সঙ্গে সমানতালে বেড়ে চলেছে লোডশেডিং। ভোক্তা এবং সংশ্লিষ্ট মহলের আরও অভিমত, বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা প্রচুর এবং তার দায়ও চাপানো হয় গ্রাহকদের ওপর। সিস্টেম লসের নামে বিদ্যুৎ চুরি চলছে বছরের পর বছর এবং তার খেসারতও দেয় ভোক্তারাই। বিদ্যুৎ বিভাগ এসব সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট আন্তরিক, সেটা জনসাধারণের কাছে প্রতীয়মান হয় না। জ্বালানি তেল আমদানির প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং কমিশন ভোগসহ বিভিন্ন অনিয়ম বন্ধ করতে পারলেও বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো। গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে সচেষ্ট হওয়া এবং এ ক্ষেত্রে 'নাইকো কেলেঙ্কারি'র পুনরাবৃত্তি রোধ করাও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ ও সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীদের জীবন-জীবিকার স্বার্থ নিশ্চিত করে কয়লার উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণও প্রত্যাশিত। সৌরবিদ্যুৎ ও বায়োগ্যাসের মতো বিকল্প জ্বালানির জোগান বাড়াতে উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহায়তা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি জ্বালানি তেল ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া এবং এ ক্ষেত্রে সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর 'সরকারকা মাল দরিয়া মে দাল' মনোভাবে অবশ্যই পরিবর্তন আনা চাই। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রতিক্রিয়া অর্থনীতি ও জনজীবনে দ্রুতই পড়তে শুরু করবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অস্থিরতা রয়েছে তাতেও যোগ হতে পারে নতুন মাত্রা। সরকারের জন্য এ ইস্যুটি শাঁখের করাতের মতো। কিন্তু সরকারি বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলো দ্রুত চালু এবং নতুন ও পুরনো সব প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হলে জনগণের মূল্যবৃদ্ধিজনিত ক্ষোভ-রোষের মাত্রাও কিছুটা সীমিত হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, লোডশেডিংয়ের মাত্রা যতটা সম্ভব সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ। বোরো মৌসুমে সেচকাজের অপরিহার্য চাহিদা মেটাতে শহরে লোডশেডিং বেড়েছে_ এ বক্তব্য তখনই জনগণ মেনে নেবে যখন দেখা যাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের বসবাস যে গ্রামে সেখানে সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবতা তো একেবারেই ভিন্ন_ শহর ও গ্রাম সর্বত্র গ্রীষ্ম শুরু হতে না হতেই বিদ্যুৎ সরবরাহে চরম বিঘ্ন ঘটছে।
No comments