পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন-মমতা-ঝড়ের আড়ালে বুদ্ধিজীবী মঞ্চ by মিজানুর রহমান খান
জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ‘জগদ্দল পাথরের’ মতো চেপে থাকা প্রচলিত ব্যবস্থা বদলে ফেলা সম্ভব। সে জন্য মাত্র কয়েকটা বছরই হতে পারে যথেষ্ট। গণমাধ্যমের পূর্বাভাস সত্য হলে (অতীতে হয়নি) ১৩ তারিখ লাল দুর্গের পতন দিবস। কিন্তু তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হোক বা না হোক, যেটা দেখার সেটা হলো সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা।
মমতা বারুদের সলতে। বুদ্ধিজীবীরা তাতে আগুন দেন। গরিবের নেত্রী মমতাকে অনেক উঁচুতে তুলেছেন বুদ্ধিজীবীরাই।
কলকাতার ‘বুদ্ধিজীবী মঞ্চ’ মমতার নেতৃত্বাধীন গণজাগরণের ভিত্তি। মঙ্গলবার আমার সঙ্গে আলোচনায় এর অন্যতম পুরোধা মহাশ্বেতা দেবী যদিও এর সঙ্গে সামান্য দ্বিমত করেন। তাঁর মতে, পরিবর্তনের নায়ক সাধারণ মানুষ। কিন্তু মঞ্চসংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেন, নন্দীগ্রাম মডেল প্রমাণ করেছে, বুদ্ধিজীবীরা বিরোধী দলকে বা পরিবর্তনকে পথ দেখাতে পারেন।
২০০৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নন্দীগ্রামে গুলিবর্ষণের ঘটনায় গড়ে উঠেছিল ‘শিল্প সাংস্কৃতিক কর্মী বুদ্ধিজীবী মঞ্চ’। এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের কৃতী মানুষেরা একাত্ম হন। সেই মঞ্চ তিন বছর ধরে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। মার্ক্সবাদী শাসন হটাতে যাঁরা বামবিরোধী বুদ্ধিজীবী মঞ্চের নেতৃত্ব দেন, তাঁদের অনেকেই কিন্তু মার্ক্সবাদী। স্কটিশ চার্চ কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ তরুণ সান্যাল এর সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক হন তিনজন। এর মধ্যে ড. তরুণ কান্তি লস্কর পদ ছেড়ে এসইউসির (সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার) টিকিটে বিধানসভা লড়েন। অন্য দুজন কুমিল্লার কমিউনিস্ট নেতা ক্ষিতিশ চক্রবর্তীর ছেলে দিলীপ চক্রবর্তী ও অধ্যাপক মিরাতুন্নাহার। এর মধ্যে মার্ক্সবাদী তরুণ ও দিলীপ, যিনি নিজেকে বাউল কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন, ১০ মে ভোট অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পরবর্তী পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন। তাঁরা বলেন, মার্ক্সবাদ মূল্য হারায়নি। হারিয়েছে বামফ্রন্ট। মমতা নিজের বিবর্তন এনেছেন। মেনেছেন যে তিনি বাম পন্থার বিরোধিতা করবেন না। মহাকরণের লাল ভবনের রং বদলানো তাঁর কাজ নয়। দিলীপ বলেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষ বোস, বঙ্গবন্ধু, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রোকেয়া বামপন্থী। মমতা বামপন্থী। আর বামফ্রন্ট সরকার মানে বাম পন্থার মোড়কে দক্ষিণ পন্থা। বুদ্ধিজীবী মঞ্চই প্রথম বলেছে, পরিবর্তন চাই। মমতাকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ ভাবতে আপত্তি নেই তাঁর।
বুদ্ধিজীবী মঞ্চ মমতাকে ভোট দিতে বলেনি। তবে তাঁরা সর্বসম্মতভাবে একটি স্লোগান অনুমোদন করেন: বামফ্রন্টকে ‘না’ বলুন। সেটাই ছিল যথেষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতেও তার ছাপ দেখলাম। সরব বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, যারা বামফ্রন্ট শাসনের অবসান চান, তাঁরা মমতার জন্য রবীন্দ্রনাথকেও কাজে লাগান। বছরব্যাপী তাঁরা সারা পশ্চিমবঙ্গে ‘প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ’ উদ্যাপন করেন। দেড় শ সভা করার পরিকল্পনা ছিল। প্রায় ৩৫টি হয়েছে। এই সভার চেতনা বামফ্রন্টবিরোধী, মমতাকে তা সুবিধা দিয়েছে। অন্যদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ প্রমুখ বামফ্রন্টের পক্ষে অবস্থান নিয়েও নীরব থাকেন। তারকা বা সেলিব্রিটিরা শুধু তৃণমূলের প্রার্থী।
বুদ্ধিজীবীদের পাল্লাটা তৃণমূলের দিকে ভারী থাকলেও কিছুটা টানাপোড়েনও দেখা দিয়েছে। মমতা রেলমন্ত্রী। তাই তিনি রেলের হেরিটেজ ও যাত্রী পরিষেবা কমিটিতে যথাক্রমে শাওলি মিত্র ও চিত্রকর শুভা প্রসন্নকে উপদেষ্টা করেছেন। শাওলি (শম্ভু মিত্রের মেয়ে) ৬০ হাজার টাকা মাসোহারা নেন। শুভা নেন না। মঞ্চ নেতৃত্ব এটা সুনজরে দেখেনি।
প্রশ্নের উত্তরে মঞ্চ সভাপতি তরুণ সান্যাল সরাসরি স্বীকার করেন, আজকের মমতা মঞ্চের সৃষ্টি। বললেন, ২০০৪ সালে মমতা লোকসভায় একটি আসন পান। আমাদের দুই বছরের আন্দোলনের পরে ২০০৯ সালে লোকসভা হয়। মমতার দল ১৯ আসন পায়। এ সময় কবির সুমন, শতাব্দী রায় ও তাপস পালকে লোকসভার টিকিট দেওয়া হয়। তৃণমূলের টিকিটে কলাগাছেরও জয়ের পরিবেশ ছিল। বামফ্রন্টের কোটি ক্যাডার, যাদের চাঁদায় দল চলে। অসংগঠিত তৃণমূল তারকাদের দিয়েও শূন্যস্থান পূরণ করে। তবে কবির সুমন ইদানীং ক্ষুণ্ন। ১৫টি বিধানসভা নিয়ে গঠিত একটি লোকসভা আসন। কবির পান দুই কোটি টাকার বরাদ্দ। তৃণমূলের দলীয় তালিকামতে তা বিতরণের চাপ তাঁর ভালো লাগেনি।
মমতার বহু প্রার্থীর মনোনয়নও পছন্দ হয়নি মঞ্চের। তরুণ সান্যাল বলেন, ‘এর প্রতিবাদে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছি।’ তরুণ সান্যাল রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার পান। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর কথায়, ‘সব কমিউনিস্ট বামপন্থী। সব বামপন্থী কমিউনিস্ট নয়। সেই অর্থে মমতা ব্যক্তিগতভাবে বামপন্থী। কিন্তু মার্ক্সবাদী বা কমিউনিস্ট নন। ক্ষমতায় গিয়ে তিনি দলকে ক্রমেই মার্ক্সবাদী না করলে সমূহ বিপদ।’ উল্লেখ্য, নন্দীগ্রামের ঘটনায় বহু লেখক ও শিল্পী রাজ্য সরকারের পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। পুরস্কারের টাকা নন্দীগ্রাম তহবিলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের ছেলেও আছেন। টালিউড হার্টথ্রব প্রসেনজিৎও প্রায় আড়াই লাখ রুপি দেন।
র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারজয়ী মহাশ্বেতা দেবী প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণীই সাধারণত আন্দোলনে অংশ নেয়। পরিবর্তনের জন্য সাধারণ মানুষের জেগে ওঠা জীবনে এই প্রথম দেখলাম। তাই সাধারণ মানুষ যখন প্রতিবাদে উচ্চকিত হলো, তখন আমরা তাকে স্বাগত না জানিয়ে পারিনি। বাংলার আজকের যে গণজাগরণ, সেটা কতিপয় বুদ্ধিজীবীর কাজ বলে মনে করি না।’
মমতার প্রতি মহাশ্বেতার মমতা অকপট: পয়সা-কড়ির ব্যাপারটা তাঁর কাছে অত্যন্ত স্বচ্ছ। তিন-তিনবার মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। যেকোনো সাধারণ মানুষ তাঁর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে পারেন। এটা একটা অসাধারণ ব্যাপার। এটা আর অন্য কারও মধ্যে দেখিনি। প্রশ্নের জবাবে মহাশ্বেতা বলেন, ‘মমতা মহাত্মা গান্ধীর সব গুণ ধারণ করেন তা আমি বলব না, তবে সাধারণ মানুষকে ভগবান ভাবার গুণ তাঁর মধ্যে আছে।’
লোকসভায় তৃণমূলের দুই তারকা-সাংসদ তাপস পাল ও শতাব্দী রায়। দুজনের সঙ্গে কথা হয়। শতাব্দী কলাগাছের মতো পাস করলেও তাপস তা নন। আগে বিধায়ক ছিলেন। তাপস বলেন, মানুষ এত দিন বোকা ছিল। ঘুমিয়ে ছিল। তাদের চোখ খুলেছে। তারা জেগে উঠেছে। পরিবর্তনের হওয়া বইছে। ৩৪ বছরে একঘেয়েমি এসেছে। শতাব্দী দিল্লিতে পার্লামেন্টে ঢুকছিলেন। এ সময় ফোনে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া টালিউডের চিত্রতারকারা কেন তৃণমূলেই? তাঁর উত্তর, ‘পরিবর্তন এতটাই ব্যাপক যে তা আমাদেরও ছুঁয়েছে।’
পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের একদলীয় শাসনে বিরোধী দলের বিকাশ হয়নি। লোকসভায় স্পিকারের প্রতি শাল ছুড়ে মারার মতো অনেক কিছুর জন্য মমতা আলোচিত। মানুষ মার খেতে খেতে প্রতিবাদী হতে শিখেছে। মহাশ্বেতার জোর ঠিক সেখানেই। নন্দীগ্রামে তিনি সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর শুনেছেন। তাই তিনি বুদ্ধিজীবীদের অতটা কৃতিত্ব দিতে চান না। আমরা শুধু ওঁদের ধারণ করেছি, নইলে তো মানুষই থাকি না। দিলীপ চক্রবর্তী, যাঁর স্মৃতিতে বাংলাদেশ উজ্জ্বল। ১৯৪২ সালের ১৪ জুলাই ময়মনসিংহের কমিউনিস্ট কমিউনে (শেওড়া) তাঁর জন্ম। তাঁর কথায়, গণজাগরণের আসল নায়ক নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের কৃষক, যাঁরা কখনো মার্ক্সবাদের বই পড়েনি। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা যা করেন, তা-ই মার্ক্সের দীক্ষা।
নন্দীগ্রাম পশ্চিমবঙ্গে একধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনে। সেই বিপ্লব ‘সাধারণ মেয়ে’ মমতাকে জনপ্লাবনে ভাসিয়েছে।
[কলকাতা, ভারত থেকে]
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
কলকাতার ‘বুদ্ধিজীবী মঞ্চ’ মমতার নেতৃত্বাধীন গণজাগরণের ভিত্তি। মঙ্গলবার আমার সঙ্গে আলোচনায় এর অন্যতম পুরোধা মহাশ্বেতা দেবী যদিও এর সঙ্গে সামান্য দ্বিমত করেন। তাঁর মতে, পরিবর্তনের নায়ক সাধারণ মানুষ। কিন্তু মঞ্চসংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেন, নন্দীগ্রাম মডেল প্রমাণ করেছে, বুদ্ধিজীবীরা বিরোধী দলকে বা পরিবর্তনকে পথ দেখাতে পারেন।
২০০৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নন্দীগ্রামে গুলিবর্ষণের ঘটনায় গড়ে উঠেছিল ‘শিল্প সাংস্কৃতিক কর্মী বুদ্ধিজীবী মঞ্চ’। এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের কৃতী মানুষেরা একাত্ম হন। সেই মঞ্চ তিন বছর ধরে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। মার্ক্সবাদী শাসন হটাতে যাঁরা বামবিরোধী বুদ্ধিজীবী মঞ্চের নেতৃত্ব দেন, তাঁদের অনেকেই কিন্তু মার্ক্সবাদী। স্কটিশ চার্চ কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ তরুণ সান্যাল এর সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক হন তিনজন। এর মধ্যে ড. তরুণ কান্তি লস্কর পদ ছেড়ে এসইউসির (সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার) টিকিটে বিধানসভা লড়েন। অন্য দুজন কুমিল্লার কমিউনিস্ট নেতা ক্ষিতিশ চক্রবর্তীর ছেলে দিলীপ চক্রবর্তী ও অধ্যাপক মিরাতুন্নাহার। এর মধ্যে মার্ক্সবাদী তরুণ ও দিলীপ, যিনি নিজেকে বাউল কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন, ১০ মে ভোট অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পরবর্তী পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন। তাঁরা বলেন, মার্ক্সবাদ মূল্য হারায়নি। হারিয়েছে বামফ্রন্ট। মমতা নিজের বিবর্তন এনেছেন। মেনেছেন যে তিনি বাম পন্থার বিরোধিতা করবেন না। মহাকরণের লাল ভবনের রং বদলানো তাঁর কাজ নয়। দিলীপ বলেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষ বোস, বঙ্গবন্ধু, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রোকেয়া বামপন্থী। মমতা বামপন্থী। আর বামফ্রন্ট সরকার মানে বাম পন্থার মোড়কে দক্ষিণ পন্থা। বুদ্ধিজীবী মঞ্চই প্রথম বলেছে, পরিবর্তন চাই। মমতাকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ ভাবতে আপত্তি নেই তাঁর।
বুদ্ধিজীবী মঞ্চ মমতাকে ভোট দিতে বলেনি। তবে তাঁরা সর্বসম্মতভাবে একটি স্লোগান অনুমোদন করেন: বামফ্রন্টকে ‘না’ বলুন। সেটাই ছিল যথেষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতেও তার ছাপ দেখলাম। সরব বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, যারা বামফ্রন্ট শাসনের অবসান চান, তাঁরা মমতার জন্য রবীন্দ্রনাথকেও কাজে লাগান। বছরব্যাপী তাঁরা সারা পশ্চিমবঙ্গে ‘প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ’ উদ্যাপন করেন। দেড় শ সভা করার পরিকল্পনা ছিল। প্রায় ৩৫টি হয়েছে। এই সভার চেতনা বামফ্রন্টবিরোধী, মমতাকে তা সুবিধা দিয়েছে। অন্যদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ প্রমুখ বামফ্রন্টের পক্ষে অবস্থান নিয়েও নীরব থাকেন। তারকা বা সেলিব্রিটিরা শুধু তৃণমূলের প্রার্থী।
বুদ্ধিজীবীদের পাল্লাটা তৃণমূলের দিকে ভারী থাকলেও কিছুটা টানাপোড়েনও দেখা দিয়েছে। মমতা রেলমন্ত্রী। তাই তিনি রেলের হেরিটেজ ও যাত্রী পরিষেবা কমিটিতে যথাক্রমে শাওলি মিত্র ও চিত্রকর শুভা প্রসন্নকে উপদেষ্টা করেছেন। শাওলি (শম্ভু মিত্রের মেয়ে) ৬০ হাজার টাকা মাসোহারা নেন। শুভা নেন না। মঞ্চ নেতৃত্ব এটা সুনজরে দেখেনি।
প্রশ্নের উত্তরে মঞ্চ সভাপতি তরুণ সান্যাল সরাসরি স্বীকার করেন, আজকের মমতা মঞ্চের সৃষ্টি। বললেন, ২০০৪ সালে মমতা লোকসভায় একটি আসন পান। আমাদের দুই বছরের আন্দোলনের পরে ২০০৯ সালে লোকসভা হয়। মমতার দল ১৯ আসন পায়। এ সময় কবির সুমন, শতাব্দী রায় ও তাপস পালকে লোকসভার টিকিট দেওয়া হয়। তৃণমূলের টিকিটে কলাগাছেরও জয়ের পরিবেশ ছিল। বামফ্রন্টের কোটি ক্যাডার, যাদের চাঁদায় দল চলে। অসংগঠিত তৃণমূল তারকাদের দিয়েও শূন্যস্থান পূরণ করে। তবে কবির সুমন ইদানীং ক্ষুণ্ন। ১৫টি বিধানসভা নিয়ে গঠিত একটি লোকসভা আসন। কবির পান দুই কোটি টাকার বরাদ্দ। তৃণমূলের দলীয় তালিকামতে তা বিতরণের চাপ তাঁর ভালো লাগেনি।
মমতার বহু প্রার্থীর মনোনয়নও পছন্দ হয়নি মঞ্চের। তরুণ সান্যাল বলেন, ‘এর প্রতিবাদে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছি।’ তরুণ সান্যাল রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার পান। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর কথায়, ‘সব কমিউনিস্ট বামপন্থী। সব বামপন্থী কমিউনিস্ট নয়। সেই অর্থে মমতা ব্যক্তিগতভাবে বামপন্থী। কিন্তু মার্ক্সবাদী বা কমিউনিস্ট নন। ক্ষমতায় গিয়ে তিনি দলকে ক্রমেই মার্ক্সবাদী না করলে সমূহ বিপদ।’ উল্লেখ্য, নন্দীগ্রামের ঘটনায় বহু লেখক ও শিল্পী রাজ্য সরকারের পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। পুরস্কারের টাকা নন্দীগ্রাম তহবিলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের ছেলেও আছেন। টালিউড হার্টথ্রব প্রসেনজিৎও প্রায় আড়াই লাখ রুপি দেন।
র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারজয়ী মহাশ্বেতা দেবী প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণীই সাধারণত আন্দোলনে অংশ নেয়। পরিবর্তনের জন্য সাধারণ মানুষের জেগে ওঠা জীবনে এই প্রথম দেখলাম। তাই সাধারণ মানুষ যখন প্রতিবাদে উচ্চকিত হলো, তখন আমরা তাকে স্বাগত না জানিয়ে পারিনি। বাংলার আজকের যে গণজাগরণ, সেটা কতিপয় বুদ্ধিজীবীর কাজ বলে মনে করি না।’
মমতার প্রতি মহাশ্বেতার মমতা অকপট: পয়সা-কড়ির ব্যাপারটা তাঁর কাছে অত্যন্ত স্বচ্ছ। তিন-তিনবার মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। যেকোনো সাধারণ মানুষ তাঁর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে পারেন। এটা একটা অসাধারণ ব্যাপার। এটা আর অন্য কারও মধ্যে দেখিনি। প্রশ্নের জবাবে মহাশ্বেতা বলেন, ‘মমতা মহাত্মা গান্ধীর সব গুণ ধারণ করেন তা আমি বলব না, তবে সাধারণ মানুষকে ভগবান ভাবার গুণ তাঁর মধ্যে আছে।’
লোকসভায় তৃণমূলের দুই তারকা-সাংসদ তাপস পাল ও শতাব্দী রায়। দুজনের সঙ্গে কথা হয়। শতাব্দী কলাগাছের মতো পাস করলেও তাপস তা নন। আগে বিধায়ক ছিলেন। তাপস বলেন, মানুষ এত দিন বোকা ছিল। ঘুমিয়ে ছিল। তাদের চোখ খুলেছে। তারা জেগে উঠেছে। পরিবর্তনের হওয়া বইছে। ৩৪ বছরে একঘেয়েমি এসেছে। শতাব্দী দিল্লিতে পার্লামেন্টে ঢুকছিলেন। এ সময় ফোনে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া টালিউডের চিত্রতারকারা কেন তৃণমূলেই? তাঁর উত্তর, ‘পরিবর্তন এতটাই ব্যাপক যে তা আমাদেরও ছুঁয়েছে।’
পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের একদলীয় শাসনে বিরোধী দলের বিকাশ হয়নি। লোকসভায় স্পিকারের প্রতি শাল ছুড়ে মারার মতো অনেক কিছুর জন্য মমতা আলোচিত। মানুষ মার খেতে খেতে প্রতিবাদী হতে শিখেছে। মহাশ্বেতার জোর ঠিক সেখানেই। নন্দীগ্রামে তিনি সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর শুনেছেন। তাই তিনি বুদ্ধিজীবীদের অতটা কৃতিত্ব দিতে চান না। আমরা শুধু ওঁদের ধারণ করেছি, নইলে তো মানুষই থাকি না। দিলীপ চক্রবর্তী, যাঁর স্মৃতিতে বাংলাদেশ উজ্জ্বল। ১৯৪২ সালের ১৪ জুলাই ময়মনসিংহের কমিউনিস্ট কমিউনে (শেওড়া) তাঁর জন্ম। তাঁর কথায়, গণজাগরণের আসল নায়ক নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের কৃষক, যাঁরা কখনো মার্ক্সবাদের বই পড়েনি। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা যা করেন, তা-ই মার্ক্সের দীক্ষা।
নন্দীগ্রাম পশ্চিমবঙ্গে একধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনে। সেই বিপ্লব ‘সাধারণ মেয়ে’ মমতাকে জনপ্লাবনে ভাসিয়েছে।
[কলকাতা, ভারত থেকে]
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments