কোনো ইতিহাসই তাৎক্ষণিক নয় by মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
লিখছি- আজ ২৬শে মার্চ, সন ২০১২। আমাদের স্বাধীনতা দিবসে। মনে করি, বাক্যটির তারিখাংশ যে গতানুগতিক কালধারাবাহিকতারই আরেক চিহ্নবিশেষ, তা তেমন করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তবে অপরাংশ অবশ্যই জাতীয় ইতিহাসের পটে এবং গভীরের ব্যঞ্জনায় বহন করে অনেক কিছু।
কথা তাই নিয়ে এবং এ ক্ষেত্রে জড়বুদ্ধির মানুষদেরকে বিবেচনায় আনব না এবং সেইসঙ্গে সতর্ক থাকব তাদের থেকে, যারা ধূর্ত, মতলববাজ। আর আপন বর্তমানের তাগিদেই যুগপৎ দেশবাসী সবার জন্য কল্যাণ-ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বার্থে দিবসটিকে সমগ্রতায় বুঝে নিতে চাই। ইতিপূর্বে বলা গেছে যে, এই দিন গতানুগতিক আরেক মাত্র নয়; গভীরে বহন করে অনেক কিছু। আদপে সেইখানে বাংলাদেশ বাঙালির সত্তার ঠিকানা।
প্রসঙ্গত, খেয়ালে আনব, সুদীর্ঘ অতীতাবধি আমাদের কেবলি কায়ক্লেশে দিনযাপনের পালা এবং ভুলি নাই, কেমন ভয়ংকরতম গেছে ১৯৪৭-উত্তর দুই যুগ; সেই সময়টায় পাকিস্তানিত্বের শোষণ-শাসনের শেকলে বাঁধা এতদাঞ্চলের বাসিন্দা সাধারণের দাসের জীবন। তবে মানুষ কিন্তু মুক্তিতীর্থযাত্রী। আমাদের ইতিহাসে এসেছিল সেই '৭১; এবং '৭১-এর ২৬ মার্চ দিবসটি, বাংলার কোটি মানুষকে মুক্তির স্বাধীনতার নিশানায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছিল। কার না জানা, তাই থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ! তাই থেকে বাঙালি মানুষের হাজার বছরের মহত্তম অর্জন। এই বিবেচনা-প্রেক্ষিতে স্বভাবত আত্মজিজ্ঞাসা যে, ক্যালেন্ডার নির্দেশিত এক বিশেষ তারিখে শুধু অনুষ্ঠানিকতাতেই আটকে যাওয়া কেন? এ কি স্থূল আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল নয়? অতএব প্রস্তাব- অবকাশ এসেছে নিজেকে আবিষ্কার করো, আপন অর্জনকে চিহ্নিত করো এবং প্রাণিত হয়ে ওঠো। দুর্গ্রহ গ্রাসিত বর্তমানকে চ্যালেঞ্জের হাতিয়ার করার বিকল্প তেমন আর নাই। কেমন করে, কোন সড়কে ২৬শে মার্চ? জবাবটা পেয়ে যাই; যখন মাহেন্দ্র-যোগাযোগের সেই লগ্নে ইতিহাস-প্রতিভূর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল : 'আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা-কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।'
লক্ষ করব বিশেষ এই দুটি কথা : ক. বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানি দখলদারিত্বের উৎখাত, এবং খ. আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। অতঃপর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে রক্ষক্ষয়ী আত্মোৎসর্গের নয় মাস এবং আমার বাংলার জন্য শাশ্বত হয়ে গেল ২৬ মার্চ। তবে অকস্মাৎই তো নয় ওই প্রতীকী ২৬ মার্চ। অতএব কার্যকারণ হেতুতেই গোড়াকার আর ধারাবাহিকতার সন্ধান। এই জনপদবাসী সচেতন সৎ বাঙালি মাত্রেরই জানা রয়েছে যখন একাত্তর ছাব্বিশে মার্চ, তখন আমরা শেষ সীমান্তের অবধারিত ঠিকানায় পৌঁছে গেছি। তখন সম্বল মৃত্যুঞ্জয়ী প্রত্যয় �do or die�। বলা বাহুল্য যে, অনেক পতন বন্ধুর অভ্যুদয়ের ভেতর দিয়ে ওই জানাটা অর্জন করা গিয়েছিল। এশিয়া থেকেই বিগত শতকের উদাহরণ- যেমন কি না গণচীন, ইন্দোনেশিয়া, সমকালে ভিয়েতনাম। এখন কথা আমাদের ছাব্বিশকে নিয়ে। বলা গেছে বুঝে নিতে চাই, অবলোকন করতে চাই। কোনো ইতিহাস কখনই তো তাৎক্ষণিক নয়। সেই হেতুতে আমরা ইতিহাসের ধারা অনুসরণের প্রয়াস পাব। ওই কথাটারই জের ধরে আগে বলে নেওয়া যাক- তত দিনে আমরা ঠিকানায় পৌঁছে গেছি। এক বাক্যে কেমন সরাসরি উক্তি! গায়ে-গায়েই অতঃপর স্বতঃজিজ্ঞাসাটি আসবে- তবে যাত্রা শুরুর কালে? সড়ক যাত্রার কালে? না, তেমন স্পষ্ট করে তখন অবশ্য জানা ছিল না। ক্রমে অর্জিত হয়েছে ধ্রুব বিশালাকার ওই চেহারা। তখনো আমরা উদ্ভট পাকিস্তানিত্বের জজবায় জিগিরে সম্পূর্ণতই মোহাচ্ছন্ন।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বলা গেছে 'উদ্ভট পাকিস্তানিত্ব'। ফায়সালার দলিলে স্বাক্ষরের মারফত অর্জিত সে রাষ্ট্রসত্তা এবং শেকড়বিস্তারী তাবৎ ফারাকের ভিতের ওপরে নির্মিত পাকিস্তান নামের সেই মহল। পশ্চিমের ওরা আর পুবের আমরা। করাচি-লাহোরের প্রভুরা মোটে নির্বোধ ছিলেন না। গোড়া থেকেই সতর্ক ছিলেন তাঁরা ফাটলে চিড় ধরবার আশঙ্কা কোথা থেকে। অতএব শাসন-রাজনীতির নামে ফরমানের, ইসলামী উম্মাহর নামে ফতোয়ার বান ডাকানো হয়েছিল। আমাদের জ্ঞান দেওয়া হতো এই বলে- হঠাৎই নয়, সুদীর্ঘ �Five thousand Years of Pakistan�, এবং অবশ্য �Pakistan has come to stay; আর সবার ওপর কায়েদ-সত্য তিনি 'কায়েদে আজম,' তাঁর বাণীই চরম। বাঙাল মুলুকের মানুষদের জন্য এক বাঙালি উজির শেষাবধি দাওয়াই বাতলে দিলেন আরবি হরফে বাংলা। এমনিতর নানামুখী হামলা এসেছিল। পূর্বাঞ্চলের বাঙালি জনমানুষের ওপরে, মাতৃভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় হাজার বছর ধরে লালিত বাঙালি সংস্কৃতি চেতনায়, উত্তরাধিকার চেতনায়। আসলে নেপথ্যের গভীরে ছিল এই বাংলাকে স্থায়ী কলোনি বানাবার মতলব। এখানকার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ এবং ওদের স্বার্থে আর্থ-শোষণের মাটি নির্ঝঞ্ঝাট মজবুত করা। এইখানে প্রাসঙ্গিক খতিয়ানটা উপস্থাপিত করব। ১৯৪৯-৫০ থেকে ১৯৬৯-৭০ এই কুড়ি বছরে কী ঘটেছে, ঘটানো হয়েছে? দুই পাকিস্তানের চেহারাটা এ রকমের : গোড়ার দিকে মাথাপিছু গড় আয়ের ফারাক ছিল ওদের বেলায় যখন ৯ শতাংশ বেশি, দুই দশকান্তে সেইটে গিয়ে পৌঁছল ৬০ শতাংশে। পরিসংখ্যানের তত্ত্ব উদ্ধৃত করবেন অর্থনীতিবিদ বিশেষজ্ঞরা। সাধারণ আমরা শোষণের ছবিটা অবলোকন করতে চাইছি। স্পষ্টত এবং কার্যত বাংলাদেশ ছিল ওদের জন্য কাঁচামালের জোগানদার, এই দেশকে ওরা বানিয়েছিল ওদের পণ্য বিক্রির বাজার। তদুপরি আরো যে বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা ঋণ বিনিয়োগ সব কিছুই টেনে নেওয়া হয়েছিল তখনকার ওই পাকিস্তানে। আপন দাবি বুঝে নেওয়ার কথা বলব, তারও উপায় ছিল না। এসব অত্যদ্ভুত এক দেশ সেখানে সংবিধান নেই, সাধারণ নির্বাচন নেই, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পরিষদ নেই। তবে চলছিল কেমন করে? প্রভুত্বের দণ্ড হাতে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল লীগ-পাণ্ডাচক্র, তর্জনী হেলাচ্ছিল আমলাগোষ্ঠী, পৃষ্ঠপোষকতায় পাঞ্জাবি সেনা শিবির এবং গোটাটা জায়েজ করে গেছে অশুভ এক জোট। রাজনৈতিক ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই এইসব বিস্তারে অবগত।
বাংলাদেশ বাঙালির সাম্প্রতিকতম ইতিহাসেরও যাত্রা শুরু ওইখান থেকেই। অর্থাৎ অক্টোপাস-পাকিস্তানিত্বের পয়দাশের প্রায় পরপর থেকেই। স্পষ্ট ছবিগুলো দেখছি- সেই '৪৭-৪৮ থেকেই। প্রত্যক্ষত পাকিস্তানি হামলা এসেছিল মাতৃভাষা দলনের হাতিয়ার উঁচিয়ে; আমাদেরও উদ্বোধন 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দীক্ষামন্ত্রের উচ্চারণে। আঙুলে গোনা কতিপয় ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিক-কর্মচারী এই তো সেদিনকার প্রতিবাদী মিছিলের পয়লা কাতার। তবে বিলম্ব হয়নি। ওদের বাঁধন যতই শক্ত হচ্ছিল, কী দ্রুত আমাদের মোহভঙ্গ ঘটেছিল। মাতৃভাষা নিয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে গেল দেশময় এবং মাতৃভাষা নিয়ে আন্দোলন কখন উত্তোলিত হয়ে গেল বাঙালিত্বের অভিযানে- সেইখানে বাংলাদেশ, বাঙালি, বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার; স্বাদেশিকতার চেতনা আর বাঙালির আপন identification স্পষ্ট চিহ্নিত করে দেওয়া।
ইতিহাস কথা কয় কারুর কণ্ঠে। গোটা দেশ কথা কয় কারুর কণ্ঠে। তিনি/তাঁরা তখন মহৎ প্রতীক-পুরুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একদা ছিলেন যেমন জেফারসন-ওয়াশিংটন-লিংকন, ফরাসি দেশে জোয়ান অফ আর্ক, কি এই এশিয়াতে চীনের সুন ইয়েৎ-সেন-মাও সেতুং, আর ভারতের গান্ধীজি; আমাদের এ দেশে তেমনি এক শেখ মুজিব, প্রতীক-স্বরূপে তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক। শ্রবণ করি তাঁর কণ্ঠে সাত কোটি বাঙালির স্বদেশ-আবিষ্কার, দেশপরিচিতি আর মুক্তিযুদ্ধের ডাক, স্বাধীনতার ঘোষণা; ১৯৫৫, ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে- �The workd Bengal has history, has a tradition of its own. ১৯৬৯, ৫ ডিসেম্বরে- জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি- আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র 'বাংলাদেশ'। ১৯৭১, ১৫ ফেব্রুয়ারি- আমাদের 'জয় বাংলা' স্লোগানের মধ্যেই এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিহিত রয়েছে। এবং ৭ মার্চে আপসহীন সেই শেষ শপথ- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনার সংগ্রাম।' সেই সময় সাক্ষ্য অতঃপর তিনি বাংলাদেশ বাঙালির ইতিহাস হয়ে গেলেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ
প্রসঙ্গত, খেয়ালে আনব, সুদীর্ঘ অতীতাবধি আমাদের কেবলি কায়ক্লেশে দিনযাপনের পালা এবং ভুলি নাই, কেমন ভয়ংকরতম গেছে ১৯৪৭-উত্তর দুই যুগ; সেই সময়টায় পাকিস্তানিত্বের শোষণ-শাসনের শেকলে বাঁধা এতদাঞ্চলের বাসিন্দা সাধারণের দাসের জীবন। তবে মানুষ কিন্তু মুক্তিতীর্থযাত্রী। আমাদের ইতিহাসে এসেছিল সেই '৭১; এবং '৭১-এর ২৬ মার্চ দিবসটি, বাংলার কোটি মানুষকে মুক্তির স্বাধীনতার নিশানায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছিল। কার না জানা, তাই থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ! তাই থেকে বাঙালি মানুষের হাজার বছরের মহত্তম অর্জন। এই বিবেচনা-প্রেক্ষিতে স্বভাবত আত্মজিজ্ঞাসা যে, ক্যালেন্ডার নির্দেশিত এক বিশেষ তারিখে শুধু অনুষ্ঠানিকতাতেই আটকে যাওয়া কেন? এ কি স্থূল আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল নয়? অতএব প্রস্তাব- অবকাশ এসেছে নিজেকে আবিষ্কার করো, আপন অর্জনকে চিহ্নিত করো এবং প্রাণিত হয়ে ওঠো। দুর্গ্রহ গ্রাসিত বর্তমানকে চ্যালেঞ্জের হাতিয়ার করার বিকল্প তেমন আর নাই। কেমন করে, কোন সড়কে ২৬শে মার্চ? জবাবটা পেয়ে যাই; যখন মাহেন্দ্র-যোগাযোগের সেই লগ্নে ইতিহাস-প্রতিভূর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল : 'আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা-কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।'
লক্ষ করব বিশেষ এই দুটি কথা : ক. বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানি দখলদারিত্বের উৎখাত, এবং খ. আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। অতঃপর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে রক্ষক্ষয়ী আত্মোৎসর্গের নয় মাস এবং আমার বাংলার জন্য শাশ্বত হয়ে গেল ২৬ মার্চ। তবে অকস্মাৎই তো নয় ওই প্রতীকী ২৬ মার্চ। অতএব কার্যকারণ হেতুতেই গোড়াকার আর ধারাবাহিকতার সন্ধান। এই জনপদবাসী সচেতন সৎ বাঙালি মাত্রেরই জানা রয়েছে যখন একাত্তর ছাব্বিশে মার্চ, তখন আমরা শেষ সীমান্তের অবধারিত ঠিকানায় পৌঁছে গেছি। তখন সম্বল মৃত্যুঞ্জয়ী প্রত্যয় �do or die�। বলা বাহুল্য যে, অনেক পতন বন্ধুর অভ্যুদয়ের ভেতর দিয়ে ওই জানাটা অর্জন করা গিয়েছিল। এশিয়া থেকেই বিগত শতকের উদাহরণ- যেমন কি না গণচীন, ইন্দোনেশিয়া, সমকালে ভিয়েতনাম। এখন কথা আমাদের ছাব্বিশকে নিয়ে। বলা গেছে বুঝে নিতে চাই, অবলোকন করতে চাই। কোনো ইতিহাস কখনই তো তাৎক্ষণিক নয়। সেই হেতুতে আমরা ইতিহাসের ধারা অনুসরণের প্রয়াস পাব। ওই কথাটারই জের ধরে আগে বলে নেওয়া যাক- তত দিনে আমরা ঠিকানায় পৌঁছে গেছি। এক বাক্যে কেমন সরাসরি উক্তি! গায়ে-গায়েই অতঃপর স্বতঃজিজ্ঞাসাটি আসবে- তবে যাত্রা শুরুর কালে? সড়ক যাত্রার কালে? না, তেমন স্পষ্ট করে তখন অবশ্য জানা ছিল না। ক্রমে অর্জিত হয়েছে ধ্রুব বিশালাকার ওই চেহারা। তখনো আমরা উদ্ভট পাকিস্তানিত্বের জজবায় জিগিরে সম্পূর্ণতই মোহাচ্ছন্ন।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বলা গেছে 'উদ্ভট পাকিস্তানিত্ব'। ফায়সালার দলিলে স্বাক্ষরের মারফত অর্জিত সে রাষ্ট্রসত্তা এবং শেকড়বিস্তারী তাবৎ ফারাকের ভিতের ওপরে নির্মিত পাকিস্তান নামের সেই মহল। পশ্চিমের ওরা আর পুবের আমরা। করাচি-লাহোরের প্রভুরা মোটে নির্বোধ ছিলেন না। গোড়া থেকেই সতর্ক ছিলেন তাঁরা ফাটলে চিড় ধরবার আশঙ্কা কোথা থেকে। অতএব শাসন-রাজনীতির নামে ফরমানের, ইসলামী উম্মাহর নামে ফতোয়ার বান ডাকানো হয়েছিল। আমাদের জ্ঞান দেওয়া হতো এই বলে- হঠাৎই নয়, সুদীর্ঘ �Five thousand Years of Pakistan�, এবং অবশ্য �Pakistan has come to stay; আর সবার ওপর কায়েদ-সত্য তিনি 'কায়েদে আজম,' তাঁর বাণীই চরম। বাঙাল মুলুকের মানুষদের জন্য এক বাঙালি উজির শেষাবধি দাওয়াই বাতলে দিলেন আরবি হরফে বাংলা। এমনিতর নানামুখী হামলা এসেছিল। পূর্বাঞ্চলের বাঙালি জনমানুষের ওপরে, মাতৃভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় হাজার বছর ধরে লালিত বাঙালি সংস্কৃতি চেতনায়, উত্তরাধিকার চেতনায়। আসলে নেপথ্যের গভীরে ছিল এই বাংলাকে স্থায়ী কলোনি বানাবার মতলব। এখানকার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ এবং ওদের স্বার্থে আর্থ-শোষণের মাটি নির্ঝঞ্ঝাট মজবুত করা। এইখানে প্রাসঙ্গিক খতিয়ানটা উপস্থাপিত করব। ১৯৪৯-৫০ থেকে ১৯৬৯-৭০ এই কুড়ি বছরে কী ঘটেছে, ঘটানো হয়েছে? দুই পাকিস্তানের চেহারাটা এ রকমের : গোড়ার দিকে মাথাপিছু গড় আয়ের ফারাক ছিল ওদের বেলায় যখন ৯ শতাংশ বেশি, দুই দশকান্তে সেইটে গিয়ে পৌঁছল ৬০ শতাংশে। পরিসংখ্যানের তত্ত্ব উদ্ধৃত করবেন অর্থনীতিবিদ বিশেষজ্ঞরা। সাধারণ আমরা শোষণের ছবিটা অবলোকন করতে চাইছি। স্পষ্টত এবং কার্যত বাংলাদেশ ছিল ওদের জন্য কাঁচামালের জোগানদার, এই দেশকে ওরা বানিয়েছিল ওদের পণ্য বিক্রির বাজার। তদুপরি আরো যে বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা ঋণ বিনিয়োগ সব কিছুই টেনে নেওয়া হয়েছিল তখনকার ওই পাকিস্তানে। আপন দাবি বুঝে নেওয়ার কথা বলব, তারও উপায় ছিল না। এসব অত্যদ্ভুত এক দেশ সেখানে সংবিধান নেই, সাধারণ নির্বাচন নেই, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পরিষদ নেই। তবে চলছিল কেমন করে? প্রভুত্বের দণ্ড হাতে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল লীগ-পাণ্ডাচক্র, তর্জনী হেলাচ্ছিল আমলাগোষ্ঠী, পৃষ্ঠপোষকতায় পাঞ্জাবি সেনা শিবির এবং গোটাটা জায়েজ করে গেছে অশুভ এক জোট। রাজনৈতিক ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই এইসব বিস্তারে অবগত।
বাংলাদেশ বাঙালির সাম্প্রতিকতম ইতিহাসেরও যাত্রা শুরু ওইখান থেকেই। অর্থাৎ অক্টোপাস-পাকিস্তানিত্বের পয়দাশের প্রায় পরপর থেকেই। স্পষ্ট ছবিগুলো দেখছি- সেই '৪৭-৪৮ থেকেই। প্রত্যক্ষত পাকিস্তানি হামলা এসেছিল মাতৃভাষা দলনের হাতিয়ার উঁচিয়ে; আমাদেরও উদ্বোধন 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দীক্ষামন্ত্রের উচ্চারণে। আঙুলে গোনা কতিপয় ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিক-কর্মচারী এই তো সেদিনকার প্রতিবাদী মিছিলের পয়লা কাতার। তবে বিলম্ব হয়নি। ওদের বাঁধন যতই শক্ত হচ্ছিল, কী দ্রুত আমাদের মোহভঙ্গ ঘটেছিল। মাতৃভাষা নিয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে গেল দেশময় এবং মাতৃভাষা নিয়ে আন্দোলন কখন উত্তোলিত হয়ে গেল বাঙালিত্বের অভিযানে- সেইখানে বাংলাদেশ, বাঙালি, বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার; স্বাদেশিকতার চেতনা আর বাঙালির আপন identification স্পষ্ট চিহ্নিত করে দেওয়া।
ইতিহাস কথা কয় কারুর কণ্ঠে। গোটা দেশ কথা কয় কারুর কণ্ঠে। তিনি/তাঁরা তখন মহৎ প্রতীক-পুরুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একদা ছিলেন যেমন জেফারসন-ওয়াশিংটন-লিংকন, ফরাসি দেশে জোয়ান অফ আর্ক, কি এই এশিয়াতে চীনের সুন ইয়েৎ-সেন-মাও সেতুং, আর ভারতের গান্ধীজি; আমাদের এ দেশে তেমনি এক শেখ মুজিব, প্রতীক-স্বরূপে তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক। শ্রবণ করি তাঁর কণ্ঠে সাত কোটি বাঙালির স্বদেশ-আবিষ্কার, দেশপরিচিতি আর মুক্তিযুদ্ধের ডাক, স্বাধীনতার ঘোষণা; ১৯৫৫, ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে- �The workd Bengal has history, has a tradition of its own. ১৯৬৯, ৫ ডিসেম্বরে- জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি- আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র 'বাংলাদেশ'। ১৯৭১, ১৫ ফেব্রুয়ারি- আমাদের 'জয় বাংলা' স্লোগানের মধ্যেই এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিহিত রয়েছে। এবং ৭ মার্চে আপসহীন সেই শেষ শপথ- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনার সংগ্রাম।' সেই সময় সাক্ষ্য অতঃপর তিনি বাংলাদেশ বাঙালির ইতিহাস হয়ে গেলেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments